রানা প্লাজা- শ্রমিকের কান্না এখনো থামেনি by জলি তালুকদার
গত বছরের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজায়
ঘটে গেল একটি বর্বর হত্যাকাণ্ড। সবাই দেখল, যাঁরা বাংলাদেশের অর্থনীতির
চাকা ঘোরান, তাঁদের জীবনের চাকাকে কীভাবে থামিয়ে দেওয়া হলো। মুনাফালোভী
মালিকদের উদগ্র বাসনার নিচে চাপা পড়ে পিষ্ট হয়ে গেল এক হাজার ১৩৫টি তাজা
প্রাণ। অসংখ্য মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হলো।
স্বজন হারানোর বেদনা, পঙ্গুত্বের আহাজারি, স্বজনের লাশ চিহ্নিত করতে না পারার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে রানা প্লাজার অসহায় শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারগুলো। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে এখনো হাড়-খুলি পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের ২৪ এপ্রিল সকাল পর্যন্ত এই মানুষগুলো মেশিন চালাচ্ছিলেন, উৎপাদন করছিলেন। তাঁদেরও বেঁচে থাকার স্বপ্ন ছিল।
রানা প্লাজা ধসের চার মাস আগে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীনের হত্যাকাণ্ডটি ঘটল। বিল্ডিং কোড না মানা থেকে শুরু করে অনেক আইন ভঙ্গ করে তাজরীনের ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তদুপরি, আগুন লাগার পর সুতা-কাপড় চুরি হতে পারে বলে কারখানা থেকে বের হওয়ার একমাত্র গেটটি তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যা পরে দমকল বাহিনীর লোকজন এসে ভেঙে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। অসহায়ভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১২৪ জনকে জীবন দিতে হলো। অনেকে পঙ্গু হয়ে গেলেন।
তাজরীন, রানা প্লাজাসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের সময় তা আমরা দেখেছি। মালিকদের কাছে মৃতের সংখ্যা কম মানে তো ক্ষতিপূরণ কম। আবার সংখ্যা কম দেখিয়ে তাঁদের নৃশংসতা কিছুটা কম হয়েছে বলে স্বস্তির নিঃশ্বাসও ফেলেন তাঁরা।
তবে এসব ঘটনার পর অনেক শ্রমিকেরই সন্ধান পাওয়া যায়নি। আন্তরিক ও যথাযথভাবে পুনরুদ্ধারের কাজ শেষ করে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবার-পরিজনের কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন। তা ছাড়া, এত দিনেও রানা প্লাজার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন যথাযথভাবে করা হয়নি। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা, ক্রেতা, সরকারের বিভিন্ন অনুদান ও সাহায্য-সহযোগিতা রানা প্লাজার শ্রমিকদের দেওয়া হলেও অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ছিল। ফলে কে, কোথায়, কীভাবে সহযোগিতা করছে, তা ওয়েবসাইট বা গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশের দাবিও জানিয়েছিলেন শ্রমিকেরা। বর্তমান ক্ষতিপূরণ আইনটিরও সময়োপযোগী সংশোধন প্রয়োজন।
রানা প্লাজার হত্যাকাণ্ডের পর দেখলাম, দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সংস্থা ব্যাপক তৎপর হলো। গ্যাপ, ওয়ালমাট, প্রিমার্কসহ বিভিন্ন বায়িং হাউসের সামনে সেই দেশের পোশাকের ক্রেতা ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো বিক্ষোভ করে। একই সময়ে শ্রমিকের সস্তা শ্রম, মজুরি ও ট্রেড ইউনিয়নের বিষয়টিও সামনে আনা হয়। তখন সবাই জীবনধারণ উপযোগী মজুরি ও ট্রেড ইউনিয়নের ব্যাপারে একমত ছিল। বায়াররাও তখন মজুরি বৃদ্ধির দিকে ব্যাপক মনোযোগ দেয়।
তারপর কী ঘটল। নামমাত্র মজুরি বৃদ্ধি করা হলো, যা বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী খুবই অপ্রতুল। সেখানে মালিক ও সরকার মজুরির ঘোষণা এবং ঘোষণা-পরবর্তী বিভিন্ন ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নিল। ১ ডিসেম্বর মজুরি বৃদ্ধি কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও ৬০ শতাংশ কারখানায় এখন পর্যন্ত তা কার্যকর করা হয়নি। গ্রেড নিয়ে কারচুপি, হঠাৎ কার্ড পরিবর্তন, আইডি নম্বর পরিবর্তন, কাজে যোগদানের তারিখ পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ধরনের কারসাজি করা হয়েছে। এই অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আন্দোলন যেন না হয়, সে কারণে ছাঁটাই-নির্যাতন-মামলা-হামলার ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে।
অন্যদিকে, মালিকদের পক্ষ থেকে রানা প্লাজা ধসের পর আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর কথা বারবার বলা হলেও বিজিএমইএর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত বছরের তুলনায় রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর বড় বড় বায়িং হাউস তাদের নিজ নিজ দেশের ভোক্তা ও ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলনের চাপে অনেক শর্ত ও দাবিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললেও পরবর্তী সময়ে তারা তাদের কথা রাখেনি।
ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা যেমন আমেরিকান বায়ারদের অ্যালায়েন্স ও ইউরোপীয় বায়ারদের অ্যাকর্ড কারখানায় নিরাপত্তার ব্যাপারে বাংলাদেশে কাজ শুরু করেছে।
নিরাপত্তার নামে কারখানার মালিকেরা অযাচিত হস্তক্ষেপ বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে, তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য বাজারে প্রচার করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি-সুবিধার বিষয়টি সামনে এনে আমাদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করে। যদিও পোশাকশিল্পে জিএসপি-সুবিধা ছিল না বললেই চলে। তবু বিভ্রান্তি তৈরি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রানা প্লাজা ধসের পর ১৭ জুন ১৬টি শর্ত দিয়ে তা স্থগিত করে ওবামা প্রশাসন।
তাদের শর্তের মধ্যে আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের বিচার, কল্পনা আক্তার ও বাবুল আক্তারের মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি রয়েছে। তাঁদের মামলা প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ঢাকা জেলা প্রশাসনকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতারাসহ অসংখ্য শ্রমিকনেতা মিথ্যা মামলার হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই।
বিশেষ বিশেষ সংগঠন ও ব্যক্তিদের ব্যাপারে আমেরিকাসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের বিষয়টিকে দৃশ্যমান করে তোলে। বহুমুখী দেশি-বিদেশি তৎপরতা-অপতৎপরতার নিচে রানা প্লাজার শ্রমিকদের মূল দাবিগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। এখনো শ্রমিকের রক্তের দাগ, লাশের গন্ধ, পঙ্গুত্বের যন্ত্রণা, স্বজনের আহাজারি-আর্তনাদে ভারী হয়ে আছে সাভার-আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল। সামনে ২৪ এপ্রিল। রানা প্লাজার শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হবে।
আমাদের দাবি, সরকার রানা প্লাজাসহ সোহেল রানার যেসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের দেওয়া হোক। রানা প্লাজার হত্যাকাণ্ডের
জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। একই সঙ্গে ২৪ এপ্রিল পোশাকশিল্পে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হোক।
জলি তালুকদার: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।
joly_talukdeৎ@yahoo.com
No comments