ত্রিশ বছরের বইমেলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে by শামসুজ্জামান খান
বাংলা একাডেমীর অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবার ত্রিশ বছরে (১৯৮৪-২০১৩) পা রাখল। জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীর এই বইমেলা এখন বাঙালির প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের বাংলাভাষীদের আগ্রহের কেন্দ্রেও বাংলা একাডেমীর এই বইমেলা স্থান করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লেখক-পাঠক, তরুণ কবিতাকর্মী, লিটলম্যাগ সম্পাদক যেমন এ মেলার দিকে সোৎসাহে তাকিয়ে থাকেন, তেমনি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের বাঙালিরা নানা মাধ্যমে খোঁজখবর রাখেন। অনেকেই সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে উড়ে আসেন বইমেলা উপলক্ষে। এমনটা বিশ্বের আর কোনো দেশে হয় বলে আমাদের মনে হয় না। বাংলাদেশের বাঙালির এ বইমেলা সম্পর্কে এমন গভীর ঔৎসুক্যের কারণটিও অবশ্য আমাদের বোধের বাইরে নয়। বাংলাদেশের বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটেছে পৃথিবীর এক অদ্ভুত রাষ্ট্র পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের কবল থেকে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে আত্মবলিদানের মাধ্যমে। সেই জাগরণ রাজনৈতিক সংগ্রামের অংশ হলেও ভাষার প্রশ্ন সেখানে যুক্ত ছিল বলে তার মর্মমূলে ছিল মাতৃভাষাপ্রীতি। অতএব মাতৃভাষার আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক স্বাধিকার ও মুক্তির অঙ্গীকার নিয়ে ধীরে ধীরে অনেক সংগ্রামের স্তর অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই রাষ্ট্রের মানুষ ভাষাপ্রীতি থেকে গ্রন্থপ্রীতিতে এবং গ্রন্থপ্রীতি থেকে গ্রন্থমেলার আয়োজনের মধ্য দিয়ে নানা মাত্রিক সাংস্কৃতিক বাঙ্ময়ের প্রকাশ ঘটাবে- সেটাই তো স্বাভাবিক। এই ঐতিহাসিক কারণেই বাংলা একাডেমীর অমর একুশে গ্রন্থমেলাটি বাঙালির প্রাণের মেলা। আত্মবিশ্লেষণের এবং আত্ম-আবিষ্কারের মেলাও বটে। এই মেলা বাঙালির ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির সঙ্গে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের প্রবণতাকে সমন্বিত করে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীকে পরিণত হতে চলেছে। সেখানেই এবং সেই লক্ষ্যেই প্রতিবছর মেলার ঋদ্ধি ঘটলে এই মেলার সাফল্য।
আমরা মেলার এই মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে লক্ষ রেখেই ত্রিশ বছরে এসে একটি পরিপক্ব, পরিণত এবং উন্নতমানের মেলায় উত্তরণে প্রয়াসী হয়েছি। অন্যান্য বছরের মতো এবারের মেলাটি বাংলা একাডেমীর বাইরে সম্প্রসারণ করে আমরা একটি বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চাইনি। মেলার বাইরের অংশে ফেরিওয়ালার চিৎকার, ভ্যানগাড়ির ঠেলাঠেলি, পাইরেটেড বই প্রচারকদের লোক টানার কৌশলী আহ্বানকে দুই হাতে পরিষ্কার করে মেলা পরিচালনা করা সম্ভব নয় বলেই বিবেচনা করেছি। সে জন্যই এ বছরের মেলাকে বাংলা একাডেমীর সীমানার ভেতরে সুশৃঙ্খলভাবে শুধু প্রকাশকদের মেলায় পরিণত করা হয়েছে। এতে মেলার বারোয়ারি রূপটি পরিহার করা যাবে, চিৎকার, হৈচৈ, হৈ-হুল্লোড়ের পরিবর্তে মনোযোগী পাঠক ও গ্রন্থরসিককে বই বাছাইয়ে নিবিষ্ট হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যাবে এবং একটি ছিমছাম-পরিচ্ছন্ন মেলায় আসার আনন্দে গ্রন্থপ্রেমীদের পরিতৃপ্ত করা যাবে বলেও আমাদের বিশ্বাস। মেলায় যাঁরা আসবেন তাঁরা বই দেখবেন, কেউ কেউ নতুন বইয়ের গন্ধ শুকবেন, কেউ বা বিচার-বিবেচনা করে এদিকে-ওদিকে দু-একটা পাতা পড়ে দেখে তারপর নিজের পছন্দের বইটি কিনতে পারবেন। প্রকৃত পাঠক ও গ্রন্থপ্রেমী এ রকম মেলারই প্রত্যাশা করেন। আমরা এই লক্ষ্যেই এ বছরের মেলাকে বিন্যস্ত করার প্রয়াস চালিয়েছি। তবু যে আমাদের প্রয়াসে কিছু ভুলভ্রান্তি হবে না এমন নয়। কিন্তু তবুও অন্যান্য বছরের মতো অতটা হাটুরে মেলার রূপ নিশ্চয়ই পাবে না এবারের বইমেলা। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা অঙ্গীকারদীপ্ত চেতনায় সব মহলের অনুরোধ-উপরোধ-তদবিরকে বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়ে একটি ভিন্নধর্মী ও ব্যতিক্রমী বইমেলার লক্ষ্যে কাজ করে গিয়েছি।
আমরা জানি, যেসব প্রকাশক এবারের বইমেলায় অংশগ্রহণ করছেন, তাঁদের মধ্যে কিছুটা নিম্নমানের বই নিয়েও হয়তো কেউ কেউ স্টল সাজাবেন। তাঁদের জন্য এ বছরটা একটা পরীক্ষার বছর বটে। কারণ আমরা বইয়ের গুণগতমানের প্রতি নজর রাখব এবং যাঁদের স্টলে উন্নতমানের বইয়ের পরিবর্তে নিম্নমানের বইয়ের সংখ্যা বেশি, তাঁদের আগামী বছর রেলিগেশনে পড়তে হবে। তাঁদের জায়গায় অন্য যে প্রকাশকরা অপেক্ষাকৃত ভালো মানের বই প্রকাশ করবেন এবং প্রকাশনার সামগ্রিক দৃষ্টিতে উন্নতি সাধন করবেন, তাঁদেরই আগামী বছর তুলে এনে নিম্নমানের পুস্তক প্রকাশকদের বাদ দেওয়া হবে। আশা করি, এই প্রতিযোগিতার কথাটি প্রকাশকরা বিশেষভাবে মনে রাখবেন এবং যত্নের সঙ্গে তাঁদের বইপত্র মেলায় তুলবেন।
আমাদের প্রকাশনাশিল্প এখনো কিন্তু প্রকৃত উন্নত পর্যায়ে উঠে আসতে পারেনি। কারণ ৯৯ শতাংশ প্রকাশকের নিজস্ব কোনো পাণ্ডুলিপি সম্পাদক নেই, ভালো প্রুফ রিডার নেই, বিষয়-বিশেষজ্ঞ (Subject Specialist) নেই এবং মুদ্রণ-অলংকরণ-বাঁধাই প্রভৃতি ক্ষেত্রেও উৎকর্ষের দিকে লক্ষ রাখার প্রবণতা নেই। তাঁদের তো আর পেশাগত মানে উন্নত প্রকাশক বলা যায় না। এ ব্যাপারে প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা মুক্তধারা প্রতিষ্ঠানে সম্পাদক, বিষয়-বিশেষজ্ঞ রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পুস্তক প্রকাশের যে উদ্যোগটি গ্রহণ করেছিলেন, তা এখন ইউপিএল বা আর দু-একটি প্রকাশনা ছাড়া অন্য প্রকাশকের মধ্যে দেখা যায় না। বাংলাদেশের প্রকাশনাকে উন্নত মানে উত্তীর্ণ করতে হলে এই দিকটায় জরুরি ভিত্তিতে অচিরেই মনোযোগ দিতে হবে। বাংলা একাডেমীর বইমেলা যেহেতু আমাদের প্রকাশনাশিল্পকে নবজীবন দান করেছে এবং এর ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক সুযোগকে অবারিত করেছে, তাই প্রকাশকদেরও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাঁদের পেশাগত শক্তি প্রতিনিয়ত উন্নত করতে হবে। তাহলেই আমাদের প্রকাশনার মান যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বইমেলারও আসল যে উদ্দেশ্য সেটি সফল হবে।
আমরা এবার নানা দিক থেকে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই বইমেলাকে একটি পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয় মেলায় পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি এবং কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করিনি। সে জন্য লেখক-পাঠক-গ্রন্থপ্রেমী-সংস্কৃতিকর্মী-সুশীল সমাজ-ছাত্রসমাজ-মিডিয়াসহ সব মহলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। সবার আন্তরিক সহযোগিতা পেলে একটি সুন্দর মেলা আমরা জাতিকে উপহার দিতে চেষ্টা করব।
লেখক : মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী
আমরা মেলার এই মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে লক্ষ রেখেই ত্রিশ বছরে এসে একটি পরিপক্ব, পরিণত এবং উন্নতমানের মেলায় উত্তরণে প্রয়াসী হয়েছি। অন্যান্য বছরের মতো এবারের মেলাটি বাংলা একাডেমীর বাইরে সম্প্রসারণ করে আমরা একটি বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চাইনি। মেলার বাইরের অংশে ফেরিওয়ালার চিৎকার, ভ্যানগাড়ির ঠেলাঠেলি, পাইরেটেড বই প্রচারকদের লোক টানার কৌশলী আহ্বানকে দুই হাতে পরিষ্কার করে মেলা পরিচালনা করা সম্ভব নয় বলেই বিবেচনা করেছি। সে জন্যই এ বছরের মেলাকে বাংলা একাডেমীর সীমানার ভেতরে সুশৃঙ্খলভাবে শুধু প্রকাশকদের মেলায় পরিণত করা হয়েছে। এতে মেলার বারোয়ারি রূপটি পরিহার করা যাবে, চিৎকার, হৈচৈ, হৈ-হুল্লোড়ের পরিবর্তে মনোযোগী পাঠক ও গ্রন্থরসিককে বই বাছাইয়ে নিবিষ্ট হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যাবে এবং একটি ছিমছাম-পরিচ্ছন্ন মেলায় আসার আনন্দে গ্রন্থপ্রেমীদের পরিতৃপ্ত করা যাবে বলেও আমাদের বিশ্বাস। মেলায় যাঁরা আসবেন তাঁরা বই দেখবেন, কেউ কেউ নতুন বইয়ের গন্ধ শুকবেন, কেউ বা বিচার-বিবেচনা করে এদিকে-ওদিকে দু-একটা পাতা পড়ে দেখে তারপর নিজের পছন্দের বইটি কিনতে পারবেন। প্রকৃত পাঠক ও গ্রন্থপ্রেমী এ রকম মেলারই প্রত্যাশা করেন। আমরা এই লক্ষ্যেই এ বছরের মেলাকে বিন্যস্ত করার প্রয়াস চালিয়েছি। তবু যে আমাদের প্রয়াসে কিছু ভুলভ্রান্তি হবে না এমন নয়। কিন্তু তবুও অন্যান্য বছরের মতো অতটা হাটুরে মেলার রূপ নিশ্চয়ই পাবে না এবারের বইমেলা। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা অঙ্গীকারদীপ্ত চেতনায় সব মহলের অনুরোধ-উপরোধ-তদবিরকে বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়ে একটি ভিন্নধর্মী ও ব্যতিক্রমী বইমেলার লক্ষ্যে কাজ করে গিয়েছি।
আমরা জানি, যেসব প্রকাশক এবারের বইমেলায় অংশগ্রহণ করছেন, তাঁদের মধ্যে কিছুটা নিম্নমানের বই নিয়েও হয়তো কেউ কেউ স্টল সাজাবেন। তাঁদের জন্য এ বছরটা একটা পরীক্ষার বছর বটে। কারণ আমরা বইয়ের গুণগতমানের প্রতি নজর রাখব এবং যাঁদের স্টলে উন্নতমানের বইয়ের পরিবর্তে নিম্নমানের বইয়ের সংখ্যা বেশি, তাঁদের আগামী বছর রেলিগেশনে পড়তে হবে। তাঁদের জায়গায় অন্য যে প্রকাশকরা অপেক্ষাকৃত ভালো মানের বই প্রকাশ করবেন এবং প্রকাশনার সামগ্রিক দৃষ্টিতে উন্নতি সাধন করবেন, তাঁদেরই আগামী বছর তুলে এনে নিম্নমানের পুস্তক প্রকাশকদের বাদ দেওয়া হবে। আশা করি, এই প্রতিযোগিতার কথাটি প্রকাশকরা বিশেষভাবে মনে রাখবেন এবং যত্নের সঙ্গে তাঁদের বইপত্র মেলায় তুলবেন।
আমাদের প্রকাশনাশিল্প এখনো কিন্তু প্রকৃত উন্নত পর্যায়ে উঠে আসতে পারেনি। কারণ ৯৯ শতাংশ প্রকাশকের নিজস্ব কোনো পাণ্ডুলিপি সম্পাদক নেই, ভালো প্রুফ রিডার নেই, বিষয়-বিশেষজ্ঞ (Subject Specialist) নেই এবং মুদ্রণ-অলংকরণ-বাঁধাই প্রভৃতি ক্ষেত্রেও উৎকর্ষের দিকে লক্ষ রাখার প্রবণতা নেই। তাঁদের তো আর পেশাগত মানে উন্নত প্রকাশক বলা যায় না। এ ব্যাপারে প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা মুক্তধারা প্রতিষ্ঠানে সম্পাদক, বিষয়-বিশেষজ্ঞ রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পুস্তক প্রকাশের যে উদ্যোগটি গ্রহণ করেছিলেন, তা এখন ইউপিএল বা আর দু-একটি প্রকাশনা ছাড়া অন্য প্রকাশকের মধ্যে দেখা যায় না। বাংলাদেশের প্রকাশনাকে উন্নত মানে উত্তীর্ণ করতে হলে এই দিকটায় জরুরি ভিত্তিতে অচিরেই মনোযোগ দিতে হবে। বাংলা একাডেমীর বইমেলা যেহেতু আমাদের প্রকাশনাশিল্পকে নবজীবন দান করেছে এবং এর ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক সুযোগকে অবারিত করেছে, তাই প্রকাশকদেরও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাঁদের পেশাগত শক্তি প্রতিনিয়ত উন্নত করতে হবে। তাহলেই আমাদের প্রকাশনার মান যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বইমেলারও আসল যে উদ্দেশ্য সেটি সফল হবে।
আমরা এবার নানা দিক থেকে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই বইমেলাকে একটি পরিচ্ছন্ন ও আকর্ষণীয় মেলায় পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি এবং কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করিনি। সে জন্য লেখক-পাঠক-গ্রন্থপ্রেমী-সংস্কৃতিকর্মী-সুশীল সমাজ-ছাত্রসমাজ-মিডিয়াসহ সব মহলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি। সবার আন্তরিক সহযোগিতা পেলে একটি সুন্দর মেলা আমরা জাতিকে উপহার দিতে চেষ্টা করব।
লেখক : মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী
No comments