শহীদ দিবস থেকে মাতৃভাষা দিবস by মুর ইসলাম
৬০ এর দশকের প্রথম দিকে শহীদ দিবস পালনের
লৰ্যে অনেক আগে থেকে ছাত্র সমাজের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। সব শহরের স্কুল,
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিশেষ করে ছাত্রদের
মধ্যে মহান শহীদ দিবস খুব গুরুত্ব ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালনের উজ্জ্বল
স্বাৰর বহন করত।
এ অনুষ্ঠানাদিতে অংশ নিত না এমন
ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আগেভাগে ছাত্ররা শহীদ মিনারগুলো নিজেরা
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সুন্দরভাবে আল্পনা সাজাত। এছাড়া দিবসটি উপলৰে
স্মরণিকা প্রকাশ, কবিতা আবৃত্তি, প্রবন্ধ পাঠ, স্মৃতিচারণ ও আলোচনাসভার
প্রস্তুতি সুষ্ঠুভাবে চলতে থাকে। আগের রাতে শেষ কর্তব্য হিসেবে শহরে
বিভিন্ন বাড়ির বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ করে, ফুলের মালা, তোড়া ও ফুলের সত্মবক
তৈরির কাজ চলত। আজকাল যেমন শহরে ফুলের দোকান থেকে ফুল কেনা যায় তখন এ
সুযোগ ছিল না।
শহরে ছাত্রদের প্রভাব থাকলেও গ্রাম-গঞ্জের চিত্র ছিল অনেকটা ভিন্ন। এলাকায় মুসলিম লীগপন্থীরা স্কুল-কলেজে শহীদ মিনার তৈরিতে কোথাও গোপনে, প্রকাশ্যে ও কৌশলে বাধা দিত। তারা সে আমলে এ বলে বিরোধিতা করত যে, এটা হিন্দুয়ানা কালচার বা সংস্কৃতি। তবে শিৰিত ও মুক্তবুদ্ধির লোকেরা ঠিকই বুঝত যে, শহীদ ও শহীদ মিনার দুটি পুরোপুরি ইসলামী শব্দ ও সে ধ্যান-ধারণা থেকে উৎপত্তি। মানুষের এ বিষয়ও বুঝতে বাকি ছিল না তাদের স্বার্থের বিরম্নদ্ধে হলেই ধর্মের নামে এসব কথা বলতেন। যাই হোক, এমন অনেক কিছু বলে তারা দিবসটি পালনে নিরম্নৎসাহিত করত। বসনত্মের প্রথম দিকে এ সময়ে শীত ও বসনত্মের হরেক রকম ফুল শহর ও গ্রামে দেখা যেত। আর শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে ফুল সংগ্রহের জন্য যে কোন ফুল বাগানে ফুল তুলতে গেলে সাধারণত কেউ মুখ কালো বা অসন্তুষ্ট হতো না বলে দেখা যেত। প্রধানত ফালগুন মাসের এ দিনে তথা ৮ই ফালগুন তারিখে (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২টার সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, সমিতির পৰ থেকে, ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ লোকেরা শহীদ মিনারের পাদদেশে ফুল দিতে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে লাইন ধরে থাকত। ঘড়ির কাঁটা ১২টা অতিক্রম করলেই সারিবদ্ধ হয়ে একে একে শ্রদ্ধা ও ধৈর্যের সঙ্গে ফুলের সত্মবক দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে স্থান ত্যাগ করতেন। রাত ১২টার পর ইংরেজী তারিখ শুরম্ন হওয়ায় তা বিদেশী বা অবাঙালী নিয়ম বা প্রথা থাকায় অনেকে বাংলার তারিখ শুরম্নর নিয়ম ও রীতিনীতি অনুযায়ী সূর্যোদয়ের সঙ্গে দিনের সূচনা হয় তাই সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুলের সত্মবক বা ফুল দিতে আসত। শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে ফুল দিয়ে শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা বা সম্মান দেখাতেন। এরপর প্রভাতফেরি বের করা হতো। প্রভাতফেরির সম্মুখভাগে শোভা পেত লম্বা কালো কাপড়ের ব্যানারে সাদা অৰরে লেখা 'শহীদ দিবস অমর হোক' 'শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না' তার নিচে প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি থাকত। এছাড়া পস্নাকার্ড বহন করে তাতে অনেক সেস্নাগান লিখা থাকত। প্রভাতফেরিতে কেউ জুতা পরত না, মানে নগ্ন পায়ে চলতে হতো। পোশাক থাকত প্রধানত পায়জামা-পাঞ্জাবি, গায়ে চাদর বা সোয়েটার। প্রভাতফেরি চলাকালে গাড়ি, রিকশা বা যানবাহন অতিক্রমের সময় লোকদের নেমে জুতা খুলে যেতে হতো। নগ্ন পায়ে চলার রীতি কখনও কেউ না মানিলে প্রথমে অনুরোধ করা হতো, তার পরেও অবজ্ঞা করলে তা কার্যকর করা হতো। সে দিনে সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য কাজ থাকত, চলার সময়ে পথে ইংরেজী বা অন্য কোন ভাষায় নামফলক বা সাইনবোর্ড লেখা থাকলে তা আলকাতরা মাখিয়ে ডেকে দেয়া হতো। এ জন্য ছাত্রদের একটা গ্রম্নপ প্রস্তুত থাকত। অর্থাৎ বোঝানো হতো বাংলার মাটিতে বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষার প্রাধান্য মানি না বা মানব না। এছাড়াও সবাই এক হয়ে মুখে এক সুরে আওয়াজ তোলা হতো মহান শহীদ দিবস অমর হোক অমর হোক। 'সর্বসত্মরে বাংলা ভাষা চালু কর চালু কর।'
প্রচ্ছন্ন চিন্তুার অধিকারী তৎকালীন ছাত্রসমাজ ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা তা সমর্থন না করে বরং প্রতিবাদী হয়েছিলেন। তারা পাকিসত্মানের অর্ধেকের বেশি লোক বাংলাভাষাী হওয়া তারা আশা করেছিল এবং বিভিন্নভাবে মত প্রকাশ করেছিল যে বাংলা ভাষাই পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা হবে। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সে কথা বলে। এ সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রতিবাদের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টানত্ম দেখা যায়, ১৯৪৮ সালে যখন পাকিসত্মানের নিয়ন্ত্রণে প্রথম মানিওয়ার্ডার ফরম, পোস্টকার্ড ও ইনভিলাফ বার করা হয় তাতে শুধু উদর্ু ভাষায় ছাপা হয়। বাংলাকে বাদ দিয়ে উদর্ুকে প্রাধান্য দেয়ায় বাংলা অঞ্চলের ডাক বিভাগের বাঙালী কর্মচারী ও সাধারণ লোকেরা দারম্নণভাবে প্রতিবাদ করে। বিষয়টি পত্রপত্রিকায় স্থান পায়।
বর্তমান যা দেখা যায়, মহান শদীদ দিবস অমর হোক। একথা আজ তেমন একটা বলা হয় না বা লিখা হয় না। তবে সেই সময়ের যারা এখনও জীবিত আছেন বা যারা সঠিকভাবে দিনটিতে দেখেন ও ভাবেন তারা শহীদ দিবস অমর হোক একথা বলে থাকেন। আজকাল শহীদ দিবস কথাটি না বলে অমর একুশে খুব গুরম্নত্ব দিয়ে বলা হচ্ছে। এতে যে কথা ইতোমধ্যে তুলে দেয়া হয়েছে। যাদের রাজনৈতিক স্বার্থের বিরম্নদ্ধে হওয়ার সবসময়ে শহীদ দিবস বলেনি তারাই প্রকারানত্মে এর পেছনে কৌশলে কাজ করে চলেছে। পাকিসত্মান আমল থেকে, এমনকি স্বাধীনতার পর প্রায় সব সময়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা ৰমতায় থাকায় এ রকম হয়েছে বলে দেশের বরেণ্য ও নিরপেৰ বুদ্ধিজীবীরা মত প্রকাশ করে থাকেন।
অপকৌশলের আর একটা দিকও এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। তারা শহীদ দিবসকে অবমূল্যায়ন করে শহীদ দিবস না বলে ভাষা দিবস হিসেবে চালানোর চেষ্টা চলছে। একবার শহীদ দিবস পালন উপলৰে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আলোচনা সভায় এ দিনটিতে 'ভাষা দিবস' বলে বড় করে ব্যানারে লেখা হয়। কোথাও কোথাও আলোচকরা তার সমালোচনা করেন এবং কার নির্দেশে ভাষা দিবস ব্যানারে উলেস্নখ করেছেন তার জবাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানান, তাদের কর্তৃপৰের নির্দেশেই লেখা হয়েছে, সারাদেশে। এতে বুঝতে বাকি থাকে না, তারা শহীদ দিবস বলতে তারা নারাজ। এ ভাবে বহু ঘটনার অবতারণা করে এর শেষ করা যাবে না।
বর্তমান প্রজন্মের মুক্তচিনত্মার অধিকারী ও মাতৃভাষা প্রেমিকরা অনেকে বলে থাকেন, উদর্ু ভাষার বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলা প্রতিষ্ঠার যেখানে প্রধান লৰ্য সেখানে ইংরেজী ভাষা প্রাধান্য পায় বা কিভাবে দেশবাসীর প্রশ্ন? এটা মাতৃভাষার প্রতি কোন ধরনের প্রীতি বা শ্রদ্ধা তা বলা তারাই জানেন। কারণ বাসত্মবে দেখা যাচ্ছে, এক বিদেশী ভাষা বাদ দিয়ে আর এক বিদেশী ভাষা তথা ইংরেজী ভাষাকে তুলে ধরা কোন ধরনের মাতৃভাষা প্রেমের নমুনা তা সবার জানা। যুক্তিও অকাট্য এ সবের কোন সদুত্তর দেয়ার কিছু তাদের নেই। তবে এর পেছনে শুরম্ন থেকে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন চক্রের কর্মকা- চলছে বলে ধরে নেয়া যায়।
প্রখ্যাত কলামিস্ট ও মুক্তচিনত্মার অধিকারী হিসেবে দেশে পরিচিত আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর শহীদ দিবসের গানটি 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ শে ফেব্রম্নয়ারি আমিকি ভুলিতে পারি।' অনেকে মনত্মব্য করে থাকেন, গাফ্ফার চৌধুরীর এ গান ও তার প্রতি দেশবাসীর ভাললাগার পুরস্কার হিসেবে তিনি ইংরেজদের দেশে বহালতবিয়াতে আছেন। আর এ বিষয়টি বাসত্মবে দেখা যায়, ইংরেজী ভাবধারা ও ইংরেজী কালচারে এখনও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে। তাই শহর, গ্রামগঞ্জ থেকে আসা মেধাবী বাঙালী ছাত্ররা এখানে এসে মাতৃভাষার দিন ও তারিখ ভুলে জান বলেও অনেক ৰেত্রে দেখা গেছে। এসব ধারা থেকে পরিত্রাণের পথ হলো মাতৃভাষা ও দেশপ্রেমের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। এর জন্য জাতীয়ভাবে পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক।
যে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মদানের জন্য বিশ্বব্যাপী 'আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালন করা হচ্ছে। সে ৰেত্রেও প্রতিক্রিয়াশীলরা তাদের কাজ ভিন্নভাবে করে চলছে। তাদের অনেকে বলে থাকেন, ২১ ফেব্রম্নয়ারি ইংরেজী মাস বলা হতো সে জন্যই আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে। একথা একেবারেই অবাসত্মব ও মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। 'আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব সংগ্রাম ও প্রাণ উৎসর্গের বিরল ইতিহাস ও তার গুরম্নত্বের দিকগুলো বিবেচনা করে।
এছাড়া, একুশ বলতে একটি সংখ্যা বোঝায় তা আবার অন্য ভাষার। একটি সংখ্যা কীভাবে অমর বা মহান হয় তা বোঝা যায় না। কোন সংখ্যা এরূপ অমর বা মহান আছে এমন কোন নজির কোথাও আছে বলে দেখা যায় না। আর শহীদ দিবস বলতে দুটি শব্দের মধ্যে গুরম্নত্ব ও কোন দিনটিকে বোঝান হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
লেখক : কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী
শহরে ছাত্রদের প্রভাব থাকলেও গ্রাম-গঞ্জের চিত্র ছিল অনেকটা ভিন্ন। এলাকায় মুসলিম লীগপন্থীরা স্কুল-কলেজে শহীদ মিনার তৈরিতে কোথাও গোপনে, প্রকাশ্যে ও কৌশলে বাধা দিত। তারা সে আমলে এ বলে বিরোধিতা করত যে, এটা হিন্দুয়ানা কালচার বা সংস্কৃতি। তবে শিৰিত ও মুক্তবুদ্ধির লোকেরা ঠিকই বুঝত যে, শহীদ ও শহীদ মিনার দুটি পুরোপুরি ইসলামী শব্দ ও সে ধ্যান-ধারণা থেকে উৎপত্তি। মানুষের এ বিষয়ও বুঝতে বাকি ছিল না তাদের স্বার্থের বিরম্নদ্ধে হলেই ধর্মের নামে এসব কথা বলতেন। যাই হোক, এমন অনেক কিছু বলে তারা দিবসটি পালনে নিরম্নৎসাহিত করত। বসনত্মের প্রথম দিকে এ সময়ে শীত ও বসনত্মের হরেক রকম ফুল শহর ও গ্রামে দেখা যেত। আর শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে ফুল সংগ্রহের জন্য যে কোন ফুল বাগানে ফুল তুলতে গেলে সাধারণত কেউ মুখ কালো বা অসন্তুষ্ট হতো না বলে দেখা যেত। প্রধানত ফালগুন মাসের এ দিনে তথা ৮ই ফালগুন তারিখে (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২টার সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, সমিতির পৰ থেকে, ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ লোকেরা শহীদ মিনারের পাদদেশে ফুল দিতে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে লাইন ধরে থাকত। ঘড়ির কাঁটা ১২টা অতিক্রম করলেই সারিবদ্ধ হয়ে একে একে শ্রদ্ধা ও ধৈর্যের সঙ্গে ফুলের সত্মবক দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে স্থান ত্যাগ করতেন। রাত ১২টার পর ইংরেজী তারিখ শুরম্ন হওয়ায় তা বিদেশী বা অবাঙালী নিয়ম বা প্রথা থাকায় অনেকে বাংলার তারিখ শুরম্নর নিয়ম ও রীতিনীতি অনুযায়ী সূর্যোদয়ের সঙ্গে দিনের সূচনা হয় তাই সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুলের সত্মবক বা ফুল দিতে আসত। শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে ফুল দিয়ে শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা বা সম্মান দেখাতেন। এরপর প্রভাতফেরি বের করা হতো। প্রভাতফেরির সম্মুখভাগে শোভা পেত লম্বা কালো কাপড়ের ব্যানারে সাদা অৰরে লেখা 'শহীদ দিবস অমর হোক' 'শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না' তার নিচে প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি থাকত। এছাড়া পস্নাকার্ড বহন করে তাতে অনেক সেস্নাগান লিখা থাকত। প্রভাতফেরিতে কেউ জুতা পরত না, মানে নগ্ন পায়ে চলতে হতো। পোশাক থাকত প্রধানত পায়জামা-পাঞ্জাবি, গায়ে চাদর বা সোয়েটার। প্রভাতফেরি চলাকালে গাড়ি, রিকশা বা যানবাহন অতিক্রমের সময় লোকদের নেমে জুতা খুলে যেতে হতো। নগ্ন পায়ে চলার রীতি কখনও কেউ না মানিলে প্রথমে অনুরোধ করা হতো, তার পরেও অবজ্ঞা করলে তা কার্যকর করা হতো। সে দিনে সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য কাজ থাকত, চলার সময়ে পথে ইংরেজী বা অন্য কোন ভাষায় নামফলক বা সাইনবোর্ড লেখা থাকলে তা আলকাতরা মাখিয়ে ডেকে দেয়া হতো। এ জন্য ছাত্রদের একটা গ্রম্নপ প্রস্তুত থাকত। অর্থাৎ বোঝানো হতো বাংলার মাটিতে বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষার প্রাধান্য মানি না বা মানব না। এছাড়াও সবাই এক হয়ে মুখে এক সুরে আওয়াজ তোলা হতো মহান শহীদ দিবস অমর হোক অমর হোক। 'সর্বসত্মরে বাংলা ভাষা চালু কর চালু কর।'
প্রচ্ছন্ন চিন্তুার অধিকারী তৎকালীন ছাত্রসমাজ ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা তা সমর্থন না করে বরং প্রতিবাদী হয়েছিলেন। তারা পাকিসত্মানের অর্ধেকের বেশি লোক বাংলাভাষাী হওয়া তারা আশা করেছিল এবং বিভিন্নভাবে মত প্রকাশ করেছিল যে বাংলা ভাষাই পাকিসত্মানের রাষ্ট্রভাষা হবে। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সে কথা বলে। এ সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রতিবাদের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টানত্ম দেখা যায়, ১৯৪৮ সালে যখন পাকিসত্মানের নিয়ন্ত্রণে প্রথম মানিওয়ার্ডার ফরম, পোস্টকার্ড ও ইনভিলাফ বার করা হয় তাতে শুধু উদর্ু ভাষায় ছাপা হয়। বাংলাকে বাদ দিয়ে উদর্ুকে প্রাধান্য দেয়ায় বাংলা অঞ্চলের ডাক বিভাগের বাঙালী কর্মচারী ও সাধারণ লোকেরা দারম্নণভাবে প্রতিবাদ করে। বিষয়টি পত্রপত্রিকায় স্থান পায়।
বর্তমান যা দেখা যায়, মহান শদীদ দিবস অমর হোক। একথা আজ তেমন একটা বলা হয় না বা লিখা হয় না। তবে সেই সময়ের যারা এখনও জীবিত আছেন বা যারা সঠিকভাবে দিনটিতে দেখেন ও ভাবেন তারা শহীদ দিবস অমর হোক একথা বলে থাকেন। আজকাল শহীদ দিবস কথাটি না বলে অমর একুশে খুব গুরম্নত্ব দিয়ে বলা হচ্ছে। এতে যে কথা ইতোমধ্যে তুলে দেয়া হয়েছে। যাদের রাজনৈতিক স্বার্থের বিরম্নদ্ধে হওয়ার সবসময়ে শহীদ দিবস বলেনি তারাই প্রকারানত্মে এর পেছনে কৌশলে কাজ করে চলেছে। পাকিসত্মান আমল থেকে, এমনকি স্বাধীনতার পর প্রায় সব সময়ে স্বাধীনতাবিরোধীরা ৰমতায় থাকায় এ রকম হয়েছে বলে দেশের বরেণ্য ও নিরপেৰ বুদ্ধিজীবীরা মত প্রকাশ করে থাকেন।
অপকৌশলের আর একটা দিকও এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। তারা শহীদ দিবসকে অবমূল্যায়ন করে শহীদ দিবস না বলে ভাষা দিবস হিসেবে চালানোর চেষ্টা চলছে। একবার শহীদ দিবস পালন উপলৰে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আলোচনা সভায় এ দিনটিতে 'ভাষা দিবস' বলে বড় করে ব্যানারে লেখা হয়। কোথাও কোথাও আলোচকরা তার সমালোচনা করেন এবং কার নির্দেশে ভাষা দিবস ব্যানারে উলেস্নখ করেছেন তার জবাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানান, তাদের কর্তৃপৰের নির্দেশেই লেখা হয়েছে, সারাদেশে। এতে বুঝতে বাকি থাকে না, তারা শহীদ দিবস বলতে তারা নারাজ। এ ভাবে বহু ঘটনার অবতারণা করে এর শেষ করা যাবে না।
বর্তমান প্রজন্মের মুক্তচিনত্মার অধিকারী ও মাতৃভাষা প্রেমিকরা অনেকে বলে থাকেন, উদর্ু ভাষার বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলা প্রতিষ্ঠার যেখানে প্রধান লৰ্য সেখানে ইংরেজী ভাষা প্রাধান্য পায় বা কিভাবে দেশবাসীর প্রশ্ন? এটা মাতৃভাষার প্রতি কোন ধরনের প্রীতি বা শ্রদ্ধা তা বলা তারাই জানেন। কারণ বাসত্মবে দেখা যাচ্ছে, এক বিদেশী ভাষা বাদ দিয়ে আর এক বিদেশী ভাষা তথা ইংরেজী ভাষাকে তুলে ধরা কোন ধরনের মাতৃভাষা প্রেমের নমুনা তা সবার জানা। যুক্তিও অকাট্য এ সবের কোন সদুত্তর দেয়ার কিছু তাদের নেই। তবে এর পেছনে শুরম্ন থেকে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন চক্রের কর্মকা- চলছে বলে ধরে নেয়া যায়।
প্রখ্যাত কলামিস্ট ও মুক্তচিনত্মার অধিকারী হিসেবে দেশে পরিচিত আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর শহীদ দিবসের গানটি 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১ শে ফেব্রম্নয়ারি আমিকি ভুলিতে পারি।' অনেকে মনত্মব্য করে থাকেন, গাফ্ফার চৌধুরীর এ গান ও তার প্রতি দেশবাসীর ভাললাগার পুরস্কার হিসেবে তিনি ইংরেজদের দেশে বহালতবিয়াতে আছেন। আর এ বিষয়টি বাসত্মবে দেখা যায়, ইংরেজী ভাবধারা ও ইংরেজী কালচারে এখনও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে। তাই শহর, গ্রামগঞ্জ থেকে আসা মেধাবী বাঙালী ছাত্ররা এখানে এসে মাতৃভাষার দিন ও তারিখ ভুলে জান বলেও অনেক ৰেত্রে দেখা গেছে। এসব ধারা থেকে পরিত্রাণের পথ হলো মাতৃভাষা ও দেশপ্রেমের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। এর জন্য জাতীয়ভাবে পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক।
যে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মদানের জন্য বিশ্বব্যাপী 'আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালন করা হচ্ছে। সে ৰেত্রেও প্রতিক্রিয়াশীলরা তাদের কাজ ভিন্নভাবে করে চলছে। তাদের অনেকে বলে থাকেন, ২১ ফেব্রম্নয়ারি ইংরেজী মাস বলা হতো সে জন্যই আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে। একথা একেবারেই অবাসত্মব ও মনগড়া কথা ছাড়া আর কিছুই নয়। 'আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব সংগ্রাম ও প্রাণ উৎসর্গের বিরল ইতিহাস ও তার গুরম্নত্বের দিকগুলো বিবেচনা করে।
এছাড়া, একুশ বলতে একটি সংখ্যা বোঝায় তা আবার অন্য ভাষার। একটি সংখ্যা কীভাবে অমর বা মহান হয় তা বোঝা যায় না। কোন সংখ্যা এরূপ অমর বা মহান আছে এমন কোন নজির কোথাও আছে বলে দেখা যায় না। আর শহীদ দিবস বলতে দুটি শব্দের মধ্যে গুরম্নত্ব ও কোন দিনটিকে বোঝান হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
লেখক : কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী
No comments