নারী দিবসের শতবর্ষ- সমানাধিকারের পক্ষে by শাহীন রহমান
একজন মানুষ হিসেবে নারীর পূর্ণ অধিকারের
দাবি হলো নারীবাদ (ঋবসরহরংস)। আধুনিক সংজ্ঞায় নারীবাদ হচ্ছে পরিবার,
কর্মত্রে ও সমাজে নারীর হীনমর্যাদা সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন এবং এই অবস্থা
পরিবর্তনে নারী ও পুরুষের সচেতন সক্রিয় উদ্যোগ।
বিশ্বজুড়ে
যে বিদ্যমান শ্রম বিভাগ পুরম্নষের ওপর রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এসব
সামাজিক পরিমণ্ডলের দায়িত্ব অর্পণ করে এবং নারীকে গোটা সংসারের বোঝা
বহনকারী বিনা মজুরির দাসীগিরির দিকে ঠেলে দেয় তাকে চ্যালেঞ্জ করে নারীবাদ।
নারীবাদ বিরাজমান মতা কাঠামো, আইন-কানুন, রীতি-নীতি যা নারীকে বশ্য,
অধীনস্থ ও হীন করে রাখে_ তার বিরম্নদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। নারীবাদ হলো
একটি সামাজিক আন্দোলন যা নারীর গৎবাঁধা ভূমিকা ও ভাবমূর্তির পরিবর্তন,
জেন্ডার বৈষম্য বিলোপ এবং পুরম্নষের মতো নারীর সমান অধিকার অর্জনের
প্রয়াসী। অনেকে ভ্রানত্ম ধারণার বশে নারীবাদকে পশ্চিমা এজেন্ডা বা
পুরম্নষের বিরম্নদ্ধে নারীর প্রাধান্য স্থাপন বলে মনে করে। পিতৃতন্ত্রের
ঠিক বিপরীত কোন কিছু বলে বিবেচনা করে নারীবাদকে। কিন্তু নারীবাদ অর্থ কখনই
নারীর প্রাধান্য বিসত্মার নয়। নারীবাদ তাই নারীদের আন্দোলন নয়, বরং নারীদের
জন্য আন্দোলন, নারী ও পুরম্নষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সে জন্য
তা নারীদের পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা প্রত্যাশী পুরম্নষদেরও
আন্দোলন। ফরাসী শব্দ ফেমিনিজম বা বাংলায় নারীবাদ শব্দটি প্রথম প্রচলন ও
ব্যবহার করেন কাল্পনিক বা ইউটোপিও (টঃড়ঢ়রড়) সমাজতন্ত্রী চার্লস ফু্যয়েরার।
১৮৯৪ সালে ইংরেজী শব্দটি গৃহীত হলেও ১৯৩৩ সালে অক্সফোর্ড অভিধানের
পরিশিষ্টতে এর প্রথম উলেস্নখ পাওয়া যায়; আভিধানিক অর্থে নারীবাদ হলো একটি
আন্দোলন যা, 'পুরম্নষের মতো নারীদের সমান অধিকারের দাবি করে।' সমসাময়িক
প্রোপটে তাই নারীবাদ হলো পরিবার, কর্মত্রে ও সমাজে নারীর ওপর শোষণ-নিপীড়ন
সম্বন্ধে সচেতনতা এবং এই অবস্থা বদলের ল্যে নারীর (সেই সঙ্গে পুরম্নষের)
সচেতন প্রয়াস। নারীবাদ তাই কেবল সমতা ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম নয়, যা নারীর
বিরম্নদ্ধে বিদ্যমান বৈষম্য অবসানের ল্যে সমান অধিকার ও আইনী সংস্কার
সাধনের জন্য তাড়িত করবে। বরং তা পরিবারে নারীর অধসত্মনতার মূল বিষয়গুলোকে
মোকাবিলা করে এবং বিরাজমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ
জানায়।
নারীবাদ : আনত্মর্জাতিক প্রোপট
অতীতের ইতিহাসে এমন অনেক নারীর উদাহরণ পাওয়া যায় যারা ছিলেন প্রচণ্ড মতা, সাহস আর প্রতিভার অধিকারী। এসব নারীরা বিখ্যাত সম্রাজ্ঞী বা রানী, সাহসী নারীযোদ্ধা, সন্ন্যাসিনী, ডাইনী (তথাকথিত), বিজ্ঞানী, কবি, শিল্পী ইত্যাদি পরিচয়ে আমাদের কাছে পরিচিত। তাঁরা হলেন নারীর ইতিহাসের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, একক ব্যতিক্রমরূপে যাদের উত্থান ঘটেছে। কিন্তু এঁরা কেউই অধিকাংশ সাধারণ নির্যাতিতা নারীর স্বাধীনতা বৃদ্ধিতে কোন অবদান রাখতে সম হননি। এটা তাঁদের ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, যুগের সীমাবদ্ধতা। তাই নারীর অধসত্মন অবস্থা পরিবর্তনের প্রচেষ্টার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নারীবাদ সম্পর্কিত। কখন নারীবাদের উন্মেষ ঘটেছে এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, যখনই নারীরা তাদের পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট বৃহৎ পরিসরে এবং যথেষ্ট কার্যকরভাবে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে শুরম্ন করেছে, তখন থেকেই নারীবাদের যাত্রা শুরম্ন।
১৬৬২ সালে ওলন্দাজ নারী মার্গারেট লুকাস রচিত নারী ভাষণ (ঋবসধষব ঙৎধঃরড়হং) বিশ্বের জ্ঞাত ইতিহাসে প্রথম নারীবাদী সাহিত্য যেখানে নারীর পরাধীনতা ও অসম অধিকারের বিষয়টি বিধৃত হয়েছে। নারীবাদের ইতিহাসে প্রথম নারীবাদী যার নাম পাওয়া যায় তিনি হলেন সতেরো শতকের ফরাসী নারী পলেইন ডি লা ব্যারে। সেই সময়েই তিনি লিখেন, পুরম্নষ কতর্ৃক নারী সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়েছে তার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে হবে। কারণ এেেত্র পুরম্নষ একই সঙ্গে অভিযুক্ত এবং বিচারকের আসনে আসীন। উলেস্নখ্য যে, ১৭৮৯ সালের মহান ফরাসী বিপস্নবের সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বাণী সারা বিশ্বের নারীবাদীদের কাছে অভূতপূর্ব অনুপ্রেরণার উৎস রূপে কাজ করে। সেই সময় 'মানুষের অধিকার'-এর ঘোষণাপত্রের সময় নারীবাদী ওল্যাম্প দু্য গুৎজ প্রশ্ন উত্থাপন করেন, নারীদের যদি ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে, তবে পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন? ফরাসী সরকার পরে এই মহান নারীবাদীকে সত্যি সত্যিই ফাঁসি দেয়। নারীবাদকে প্রথম সংগঠিত আকারে উপস্থিত করেন ইংল্যান্ডের মেরি ওলস্টোনক্রাফট তাঁর বিখ্যাত সাড়া জাগানো বই 'নারীর অধিকারের ন্যায্যতা'য় (ঠরহফরপধঃরড়হ ড়ভ জরমযঃং ড়ভ ডড়সবহ) ১৭৯২ সালে। এই বইয়ের মূল বক্তব্য হলো নারীরা কোন ভোগের সামগ্রী বা যৌন জীব নয়, তারাও বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ- তাই তাদের স্বাধিকার দিতে হবে। সমসাময়িককালে আমেরিকার জুডিথ সারজেন্ট মুরে লিঙ্গ বৈষম্য প্রসঙ্গে (ঙহ ঃযব রহবয়ঁধষরঃরবং ড়ভ ঃযব ংবী) শিরোনামে কতগুলো নিবন্ধ রচনা করে দেখান যে নারীরা কখনই জন্মগত কারণে পুরম্নষের চাইতে কম দ নয়। ১৮৩৭ সালে আমেরিকায় প্রথম দাসপ্রথাবিরোধী নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যার মাধ্যমে মার্কিন নারীরা রাজনীতি করার অধিকার ও সুযোগ পায়। ১৮৪০ সাল থেকে আমেরিকার দাসপ্রথা ও মদ্যপান বিলোপ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীবাদী চেতনা আরও বিকশিত হয়। এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন, লুক্রেশিয়া মটো, সুশান বি এ্যান্থনী, লুসি স্টোন, এ্যাঞ্জেলিকা এম গ্রিমকে, সারা এম গ্রিমকে প্রমুখ নারীবাদী বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এদের মধ্যে এ্যাঞ্জেলিকা এম গ্রিমকে এবং সারা এম গ্রিমকে- প্রথম যুগের মার্কিন নারীবাদী এই দুই নিগ্রো বোন নারী ও পুরম্নষের সাম্যের প েপ্রচারণা চালান। ১৮৯১ সালে এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন আরও ২৩ জন নারীসহ মিলিতভাবে রচনা করেন নারীর বাইবেল (ডড়সবহং ইরনষব)। তাঁরা এই গ্রন্থে খ্রিস্টধর্মে বর্ণিত নারীর অধীনসত্মতাকে চ্যালেঞ্জ করেন। এছাড়াও কেডি স্ট্যান্টন ও সুশান বি এ্যান্থনি মিলে ১৮৬৮ সালে নর-নারীর অভিন্ন অধিকার প্রচারের ল্যে নারীবাদী সাময়িকী দি রেভোলিউশন প্রকাশ করেন। ১৮৪৮ সালের ১৯-২০ জুলাই নারীবাদীদের উদ্যোগ নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস এ বিশ্বের প্রথম নারীর অধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমেরিকার ঘোষণাপত্রের অনুরূপ 'ডিকারেশন অব সেন্টিমেন্ট' ঘোষণা করা হয়। এখানে উলেস্নখ্য যে, আমেরিকার শ্রমজীবী নারীদের লড়াই-সংগ্রাম নারীবাদী চেতনার বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। ১৮৫৭ সাল থেকে নিউইয়র্কের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা ভোটাধিকার, উন্নত কর্ম পরিবেশ, শ্রম সময়-হ্রাস ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের দাবিতে এক রক্তয়ী সংগ্রামের সূচনা করে। এর ফলে ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরের কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের ল্যে নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার নারী-শ্রমিকদের এই আত্মত্যাগী মহৎ সংগ্রামের কথা স্মরণ করে ১৯১০ সালে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী কারা জেটকিন কতর্ৃক আনত্মর্জাতিক শ্রমজীবী নারী সম্মেলনে উত্থাপিত প্রসত্মাব অনুযায়ী ১৯১৪ সালে প্রতি বছর ৮ মার্চ আনত্মর্জাতিক নারী দিবস পালনের সিদ্ধানত্ম গৃহীত হয়। অবশ্য এরপর থেকে ৭০ বছর যাবত দিবসটি বিশ্বব্যাপী কেবল কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী নারীরাই পালন করতো। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আনত্মর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় বর্তমানে এ দিবসটি সার্বজনীনভাবে জাতীয় ও আনত্মর্জাতিক পরিসরে পালিত হচ্ছে।
ইউরোপে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কমিউনিস্ট-সমাজতান্ত্রিক আদর্শে শ্রমজীবী নারীদের নানা আন্দোলন নারীবাদের বিকাশকে আরও প্রভাবিত করে। এর মধ্যে নারীদের ট্রেড ইউনিয়ন ও ভোটাধিকার আন্দোলন অন্যতম। ফ্রান্সে নারীবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৮৩০-এর দশকে। এ সময় বিবাহ েেত্র সমঅধিকার ও ভোটাধিকারসহ নানা সম রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের দাবিতে বিভিন্ন নারী সংগঠন জন্ম লাভ করে। বিভিন্ন নারীবাদী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো ১৮৪৮ সালে নিবয়েটের সম্পাদনায় প্রকাশিত নারীদের কণ্ঠস্বর (ডড়সবহ ঠড়রপব) পত্রিকা। ১৮৭১ সালে ফ্রান্সে শ্রমজীবী জনগণের প্রথম কমিউনিস্ট সমাজ নির্মাণের মহৎ প্রচেষ্টা 'প্যারি কমিউন'- এ হাজার হাজার শ্রমজীবী নারীর অংশগ্রহণ নারীবাদকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করে এবং শ্রমজীবী জনগণের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে নারীবাদের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। জার্মানিতে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী ও আনত্মর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চের রূপকার কারা জেটকিন মার্কসবাদ তথা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে নারীবাদের সেতুবন্ধন ঘটান। বস্তুত দেখা যায় যে বিশ্বজুড়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরম্ন থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যনত্ম নারীবাদী আন্দোলন ও শ্রমজীবী নারী আন্দোলন হাত ধরাধরি করে চলেছে। নারীদের সম স্বার্থ ও সম অধিকারের দাবি একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে। ভোটাধিকার, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ অধিকার, নারীর উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির দাবিকে সমর্থন করেছে সব শ্রমজীবী নারী সংগঠনগুলো। পানত্মরে নারী শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও সুরা, উন্নত কর্মপরিবেশ, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ইত্যাদি দাবিকেও সমর্থন যুগিয়েছে নারীবাদী সংগঠনগুলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলন এবং নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যে নানা কারণে দুঃখজনক বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়। উলেস্নখ্য যে, একজন মানুষ হিসেবে নারীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে এই নারীবাদী আন্দোলনে যে কেবল নারীরাই সামিল হয়েছেন তা নয়, দেশে দেশে উদার যুক্তিবাদী গণতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন মহৎ পুরম্নষরাও এতে যুক্ত হয়েছেন। ১৮৬৬ সালে দার্শনিক ও আইনজ্ঞ জন স্টুয়ার্ট মিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট সদস্য হবার পর নারীর ভোটাধিকারসহ নারীর অধিকারের প েবিখ্যাত বই নারীর অধীনতা (ঞযব ংঁনলবপঃরড়হ ড়ভ ডড়সবহ) রচনা করেন। এরও আগে ১৮২৫ সালে ইংল্যান্ডে নারীর অধিকারের প েপ্রথম পুরম্নষ দার্শনিক উইলিয়াম টমসনের বই_ 'পুরম্নষের অহঙ্কারের বিরম্নদ্ধে মানবজাতির অর্ধেক অংশ নারীর আবেদন বাকি অর্ধেক অংশের কাছে' (ঞযব যধষভ ঢ়ড়ৎঃরড়হ ড়ভ সধহশরহফ ড়িসবহ্থং ধঢ়ঢ়বধষ ঃড় ঃযব ৎবংঃ ঢ়ড়ৎঃরড়হ ধমধরহংঃ সধষব পযধাঁরহরংস) প্রকাশিত হয়। এছাড়াও মার্কস-এঙ্গেলস রচিত বিশ্বখ্যাত কমিউনিস্ট ইশতেহার (১৯৪৮), এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব (১৮৮৪), অগাস্ট বেবেল-এর নারী : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত এবং নারী ও সমাজতন্ত্র এসব গ্রন্থ নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দিকদর্শনরূপে চিহ্নিত হয়েছে। ১৮৭৯ সালে বিখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেন-এর কালজয়ী নাটক পুতুলের খেলাঘর (ঞযব উড়ষষং ঐড়ঁংব)-এর নায়িকা নোরা চরিত্রটির মাধ্যমে আধুনিক নারীবাদী চেতনা মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।
আধুনিক নারীবাদীদের মধ্যে ভার্জিনিয়া উল্ফ-এর সাহিত্যকর্ম, সিমোন দ্য বোভেয়ারের কালজয়ী রচনা সেকেন্ড সেক্স (ঝবপড়হফ ঝবী) ও সেক্সুয়াল পলিটিক্স (ঝবীঁধষ চড়ষরঃরপং), ১৯৬৬ সালে বেটি ফ্রাইডান রচিত দি ফেমিনিন মিস্টিক (ঞযব ঋবসরহরহব গুংঃরপ), ১৯৭০ সালে জার্মেইন গ্রিয়ার-এর দি ফিমেল ইউনাক (ঞযব ঋবসধষব ঊঁহধপ), শুলাস্মিথ ফায়ার স্টোন-এর ডায়ালেকটিকস অব সেক্স (উরধষবপঃরপং ড়ভ ঝবী), আলেকজান্দ্রা কোলনতাই-এর সেক্সুয়াল রিলেশন এ্যান্ড কাস স্ট্রাগেল (ঝবীঁধষ জবষধঃরড়হ ধহফ ঈষধংং ঝঃৎঁমমষব), এরিকা ইয়ং রচিত ফিয়ার ফর ফাইং (ঋবধৎ ভড়ৎ ঋষুরহম), কেটি রোইফে-এর বিউটি মিথ (ইবধঁঃু গুঃয) ও ফায়ার উইথ ফায়ার (ঋরৎব রিঃয ঋরৎব) প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থ নারীবাদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। আরব বিশ্বের মুসলিম নারীবাদীদের মধ্যে মরক্কোর ফাতিমা মারনিসি ও মিসরের নওএল সাদাওয়ি প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। ফাতিমা মারনিসির মুসলমানের অবচেতনায় নারী এবং নওএলের আরব বিশ্বে নারী ও হাওয়ায় লুকানো মুখ ইত্যাদি গ্রন্থে আধুনিক নারীবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে।
উলেস্নখ্য যে, নারীবাদ কোন একক ও অভিন্ন ধারণা নয়, নারীবাদের রয়েছে নানা ধারা ও উপধারা। তবে নারীবাদের সব ধারারই মূল সুর এক। আর তা হলো না নারীর ওপর পুরম্নষের কতর্ৃত্ব, আধিপত্য, শোষণ-শাসন, নিয়ন্ত্রণের অবসান এবং মানুষ হিসেবে পুুরম্নষের মতো সবেেত্র নারীর সমান অধিকার।
নারী আন্দোলন : জাতীয় প্রোপট
দুনিয়ার সব দেশে একই রূপে একই মাত্রায় নারীবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেনি। বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক বাসত্মবতায় নানাভাবে নারীবাদী আন্দোলন বিকশিত হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ তথা তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে নারীবাদী ধ্যান-ধারণা পরিপুষ্ট হতে শুরম্ন করে। এখানে উলেস্নখ্য যে, তৎকালীন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণে ছিল নানাভাবে জর্জরিত। নারীরা তো দূরের কথা পুরম্নষরাই ছিল অধিকারবঞ্চিত। সঙ্গত কারণেই তাই নারীবাদী আন্দোলন এবং ব্রিটিশ শাসন বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অনেক সময় একই মোহনায় মিলিত হয়েছে। নারীর শোচনীয় দুরবস্থার বিরম্নদ্ধে এবং নারীর অধিকারের সপ েপ্রথম সোচ্চার হন একজন নারীবাদী পুরম্নষ_ রাজা রামমোহন রায়। ১৮১৮ সালে তিনি কলকাতায় সহমরণ বা সতীদাহ প্রথা বিলোপের উদ্যোগ নেন। যার ফলে ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেন। অন্যদিকে নারীকে ধর্মশাস্ত্রের উৎপীড়ন থেকে রা করতে সচেষ্ট হন আরেক মহৎ পুরম্নষ_ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি প্রথমে নারীর শিার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মেরি ককের সঙ্গে মিলে মোট ৪৩টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৮৫০-৫৫ এ সময়ে বিধবা বিবাহের সপওে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৮৬৭ সাল নাগাদ নিজে ৬০টি বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে থেকেই কৃষ্ণভামিনী দাসী, কামিনী সুন্দরী, বামাসুন্দরী দেবী, মোদাদায়িনী প্রমুখ নারীরা লেখালেখির মাধ্যমে প্রথম সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন। সেই সময়ে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী কবি খ্যাতি লাভ করেন এবং ১৮৭৩ সালে কুমিলস্নায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয় ও ১৮৯৩ সালে জেনানা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার প্রথম নারীবাদী সংগঠন 'সখী সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৮৫ সালে এবং তিনি লাঠি খেলা ও অস্ত্র চালনা প্রশিণের মাধ্যমে তরম্নণ-তরম্নণীর মধ্যে দেশপ্রেম সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট হন। এ সময়ে সমাজের নানা অনুশাসনের বেড়াজাল ছিন্ন করে নারীরা ক্রমবর্ধমান হারে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে থাকে। ১৮৮৯ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে ৬ জন নারী যোগ দেন। সরোজীনি নাইডু ও সরলা দেবী চৌধুরানী প্রমুখ নারী নেত্রীরা কংগ্রেসের সভাপ্রধানের পদেও অধিষ্ঠিত হন। ১৮৮৯ সালে ভারতবর্ষের প্রথম সংগঠিত নারীবাদী আন্দোলনের রূপকার মহারাষ্ট্রের পণ্ডিত রমাবাঈ প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামেন এবং পুনায় নারীমুক্তি সম্বন্ধে বক্তৃতা প্রদান করেন। অন্যদিকে বাংলার প্রথম নারীবাদী রূপে খ্যাত সরলা দেবী চৌধুরানী কতর্ৃক ১৯১০ সালে সর্বভারতীয় নারী সংগঠন ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে বিংশ শতাব্দীর শুরম্নতেই বাংলার প্রথম নারীবাদী প্রবন্ধ স্ত্রী জাতির অবনতি প্রকাশের মাধ্যমে যে অনন্য সাধারণ নারীবাদী প্রবক্তার উত্থান ঘটে তিনি হলেন রোকেয়া সাখাওয়াত। রোকেয়ার সমগ্র জীবন ও কর্ম বাংলায় আধুনিক নারীবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছে। মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদ অংশের ভেতর থেকে কীভাবে রোকেয়া এমন বৈশ্বিক মানের নারীবাদী চৈতন্য অর্জন করল তা আজও পাশ্চাত্যের কাছে বিস্ময়ের কারণ। কেতকী কুশারী ডাইসন তাই তাঁকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে যে, 'যদিও বঙ্গদেশে স্ত্রী শিা বিসত্মারে হিন্দু সমাজই অগ্রণী, তবুও বিশ শতকের গোড়ায় বঙ্গ ললনাদের মধ্যে সব থেকে রেডিক্যাল, বৈপস্নবিক, প্রতিবাদে দৃঢ় কণ্ঠস্বর একজন মুসলমান মহিলার। তাঁর নাম বেগম রোকেয়া।... রোকেয়াই আধুনিক অর্থে বাংলার প্রথম প্রকৃত ফেমিনিস্ট (নারীবাদী) নারী।"
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে রোকেয়া সাখাওয়াত, সরলা দেবী এবং পণ্ডিত রমাবাঈ হলো তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের নারীবাদী চিনত্মার জনক। বিংশ শতাব্দীর শুরম্ন থেকে ১৯৪৭ এর ব্রিটিশ শাসন অবসান ও দেশ বিভাগ অবধি নানা নারী সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং অসংখ্য নারী স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন ধারায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। এছাড়াও কমিউনিস্ট আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন (তেভাগা, নানকার, টংক, তেলেঙ্গানা প্রভৃতি) সমাজের বিভিন্ন সত্মরের উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক নারী অংশগ্রহণ করে ইতিহাস রচনা করেছেন। এদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলেন কংগ্রেস পরিচালিত স্বদেশী আন্দোলনে_ সরোজিনী নাইডু, জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী, মাতঙ্গিনী হাজরা, সরলা দেবী, উর্মিলা দেবী, আশালতা সেন, কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায়, প্রভাবতী বসু, অরম্নণা আসফ আলী, লীলা নাগ; ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপস্নবী আন্দোলনে- প্রীতিলতা ওয়েদেদ্দার, কল্পনা দত্ত, শানত্মি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, রীনা দাস, ননী বালা, দুকড়ি বালা দেবী, চারুশীলা দেবী; কমিউনিস্ট ও শ্রমিক আন্দোলনে- সাকিনা বেগম, প্রভাবতী দাসগুপ্ত, সনত্মোষকুমারী দেবী, দুঃখুমত বিবি; কৃষক আন্দোলনে_ রানী গুহ, হিরন্ময়ী ঘোষ, মনোরমা বসু, কনক মুখার্জী, হেনা দাস, চারুলতা ঘোষ প্রমুখ। এছাড়াও ১৯১৭ সালে তৎকালীন ভারতে নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরম্ন হয় এবং ১৯১৯ সালে এই দাবিতে নারীদের একটি প্রতিনিধি দল ব্রিটেনে গমন করে। পূর্বেই উলেস্নখ করা হয়েছে যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বহাল থাকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরম্ন থেকে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পর্যনত্ম এদেশে নারীবাদী চেতনা মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের আধারে বিকশিত হওয়ায় স্বাতন্ত্র্য কোন রূপ পরিগ্রহ করেনি, ব্রিটিশ শাসনবিরোধী সংগ্রামের স্রোতধারায় মিলিত হয়েছে মূলত নারীবাদী আন্দোলন। ১৯৪৮-১৯৭১ সালে এই ধারাবাহিকতার বাঙালী জাতির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়েছে নারীমুক্তি আন্দোলন। ৬০-এর দশক থেকে আশির দশক পর্যনত্ম মহীয়সী নারী কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে এদেশে নারী আন্দোলন বেগবান হয় এবং তা সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সহযোগী হয়ে ওঠে। তবে পরবর্তী সময়ে ৮০ ও ৯০ দশকে দাতা সংস্থাগুলোর আর্থিক সহায়তায় অনেক নারী সংগঠন জন্মলাভ করলেও তা মূলত নারী উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই কেবল নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। নারীবাদী চেতনা সমৃদ্ধ কোন শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সম হয়নি এখনও। অবশ্য শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এনজিও এবং এনজিওধর্মী নারী সংগঠনগুলো তৃণমূলে নারী জাগরণ সৃষ্টি করার েেত্র বিশেষ অবদান রাখছে।
নারীবাদ : আনত্মর্জাতিক প্রোপট
অতীতের ইতিহাসে এমন অনেক নারীর উদাহরণ পাওয়া যায় যারা ছিলেন প্রচণ্ড মতা, সাহস আর প্রতিভার অধিকারী। এসব নারীরা বিখ্যাত সম্রাজ্ঞী বা রানী, সাহসী নারীযোদ্ধা, সন্ন্যাসিনী, ডাইনী (তথাকথিত), বিজ্ঞানী, কবি, শিল্পী ইত্যাদি পরিচয়ে আমাদের কাছে পরিচিত। তাঁরা হলেন নারীর ইতিহাসের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, একক ব্যতিক্রমরূপে যাদের উত্থান ঘটেছে। কিন্তু এঁরা কেউই অধিকাংশ সাধারণ নির্যাতিতা নারীর স্বাধীনতা বৃদ্ধিতে কোন অবদান রাখতে সম হননি। এটা তাঁদের ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, যুগের সীমাবদ্ধতা। তাই নারীর অধসত্মন অবস্থা পরিবর্তনের প্রচেষ্টার প্রক্রিয়ার সঙ্গে নারীবাদ সম্পর্কিত। কখন নারীবাদের উন্মেষ ঘটেছে এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, যখনই নারীরা তাদের পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট বৃহৎ পরিসরে এবং যথেষ্ট কার্যকরভাবে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে শুরম্ন করেছে, তখন থেকেই নারীবাদের যাত্রা শুরম্ন।
১৬৬২ সালে ওলন্দাজ নারী মার্গারেট লুকাস রচিত নারী ভাষণ (ঋবসধষব ঙৎধঃরড়হং) বিশ্বের জ্ঞাত ইতিহাসে প্রথম নারীবাদী সাহিত্য যেখানে নারীর পরাধীনতা ও অসম অধিকারের বিষয়টি বিধৃত হয়েছে। নারীবাদের ইতিহাসে প্রথম নারীবাদী যার নাম পাওয়া যায় তিনি হলেন সতেরো শতকের ফরাসী নারী পলেইন ডি লা ব্যারে। সেই সময়েই তিনি লিখেন, পুরম্নষ কতর্ৃক নারী সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়েছে তার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে হবে। কারণ এেেত্র পুরম্নষ একই সঙ্গে অভিযুক্ত এবং বিচারকের আসনে আসীন। উলেস্নখ্য যে, ১৭৮৯ সালের মহান ফরাসী বিপস্নবের সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বাণী সারা বিশ্বের নারীবাদীদের কাছে অভূতপূর্ব অনুপ্রেরণার উৎস রূপে কাজ করে। সেই সময় 'মানুষের অধিকার'-এর ঘোষণাপত্রের সময় নারীবাদী ওল্যাম্প দু্য গুৎজ প্রশ্ন উত্থাপন করেন, নারীদের যদি ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে, তবে পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন? ফরাসী সরকার পরে এই মহান নারীবাদীকে সত্যি সত্যিই ফাঁসি দেয়। নারীবাদকে প্রথম সংগঠিত আকারে উপস্থিত করেন ইংল্যান্ডের মেরি ওলস্টোনক্রাফট তাঁর বিখ্যাত সাড়া জাগানো বই 'নারীর অধিকারের ন্যায্যতা'য় (ঠরহফরপধঃরড়হ ড়ভ জরমযঃং ড়ভ ডড়সবহ) ১৭৯২ সালে। এই বইয়ের মূল বক্তব্য হলো নারীরা কোন ভোগের সামগ্রী বা যৌন জীব নয়, তারাও বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ- তাই তাদের স্বাধিকার দিতে হবে। সমসাময়িককালে আমেরিকার জুডিথ সারজেন্ট মুরে লিঙ্গ বৈষম্য প্রসঙ্গে (ঙহ ঃযব রহবয়ঁধষরঃরবং ড়ভ ঃযব ংবী) শিরোনামে কতগুলো নিবন্ধ রচনা করে দেখান যে নারীরা কখনই জন্মগত কারণে পুরম্নষের চাইতে কম দ নয়। ১৮৩৭ সালে আমেরিকায় প্রথম দাসপ্রথাবিরোধী নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যার মাধ্যমে মার্কিন নারীরা রাজনীতি করার অধিকার ও সুযোগ পায়। ১৮৪০ সাল থেকে আমেরিকার দাসপ্রথা ও মদ্যপান বিলোপ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারীবাদী চেতনা আরও বিকশিত হয়। এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন, লুক্রেশিয়া মটো, সুশান বি এ্যান্থনী, লুসি স্টোন, এ্যাঞ্জেলিকা এম গ্রিমকে, সারা এম গ্রিমকে প্রমুখ নারীবাদী বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এদের মধ্যে এ্যাঞ্জেলিকা এম গ্রিমকে এবং সারা এম গ্রিমকে- প্রথম যুগের মার্কিন নারীবাদী এই দুই নিগ্রো বোন নারী ও পুরম্নষের সাম্যের প েপ্রচারণা চালান। ১৮৯১ সালে এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন আরও ২৩ জন নারীসহ মিলিতভাবে রচনা করেন নারীর বাইবেল (ডড়সবহং ইরনষব)। তাঁরা এই গ্রন্থে খ্রিস্টধর্মে বর্ণিত নারীর অধীনসত্মতাকে চ্যালেঞ্জ করেন। এছাড়াও কেডি স্ট্যান্টন ও সুশান বি এ্যান্থনি মিলে ১৮৬৮ সালে নর-নারীর অভিন্ন অধিকার প্রচারের ল্যে নারীবাদী সাময়িকী দি রেভোলিউশন প্রকাশ করেন। ১৮৪৮ সালের ১৯-২০ জুলাই নারীবাদীদের উদ্যোগ নিউইয়র্কের সেনেকা ফলস এ বিশ্বের প্রথম নারীর অধিকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমেরিকার ঘোষণাপত্রের অনুরূপ 'ডিকারেশন অব সেন্টিমেন্ট' ঘোষণা করা হয়। এখানে উলেস্নখ্য যে, আমেরিকার শ্রমজীবী নারীদের লড়াই-সংগ্রাম নারীবাদী চেতনার বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। ১৮৫৭ সাল থেকে নিউইয়র্কের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা ভোটাধিকার, উন্নত কর্ম পরিবেশ, শ্রম সময়-হ্রাস ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের দাবিতে এক রক্তয়ী সংগ্রামের সূচনা করে। এর ফলে ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরের কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের ল্যে নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার নারী-শ্রমিকদের এই আত্মত্যাগী মহৎ সংগ্রামের কথা স্মরণ করে ১৯১০ সালে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী কারা জেটকিন কতর্ৃক আনত্মর্জাতিক শ্রমজীবী নারী সম্মেলনে উত্থাপিত প্রসত্মাব অনুযায়ী ১৯১৪ সালে প্রতি বছর ৮ মার্চ আনত্মর্জাতিক নারী দিবস পালনের সিদ্ধানত্ম গৃহীত হয়। অবশ্য এরপর থেকে ৭০ বছর যাবত দিবসটি বিশ্বব্যাপী কেবল কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী নারীরাই পালন করতো। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আনত্মর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় বর্তমানে এ দিবসটি সার্বজনীনভাবে জাতীয় ও আনত্মর্জাতিক পরিসরে পালিত হচ্ছে।
ইউরোপে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কমিউনিস্ট-সমাজতান্ত্রিক আদর্শে শ্রমজীবী নারীদের নানা আন্দোলন নারীবাদের বিকাশকে আরও প্রভাবিত করে। এর মধ্যে নারীদের ট্রেড ইউনিয়ন ও ভোটাধিকার আন্দোলন অন্যতম। ফ্রান্সে নারীবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৮৩০-এর দশকে। এ সময় বিবাহ েেত্র সমঅধিকার ও ভোটাধিকারসহ নানা সম রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের দাবিতে বিভিন্ন নারী সংগঠন জন্ম লাভ করে। বিভিন্ন নারীবাদী পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো ১৮৪৮ সালে নিবয়েটের সম্পাদনায় প্রকাশিত নারীদের কণ্ঠস্বর (ডড়সবহ ঠড়রপব) পত্রিকা। ১৮৭১ সালে ফ্রান্সে শ্রমজীবী জনগণের প্রথম কমিউনিস্ট সমাজ নির্মাণের মহৎ প্রচেষ্টা 'প্যারি কমিউন'- এ হাজার হাজার শ্রমজীবী নারীর অংশগ্রহণ নারীবাদকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করে এবং শ্রমজীবী জনগণের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে নারীবাদের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। জার্মানিতে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী ও আনত্মর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চের রূপকার কারা জেটকিন মার্কসবাদ তথা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে নারীবাদের সেতুবন্ধন ঘটান। বস্তুত দেখা যায় যে বিশ্বজুড়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরম্ন থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যনত্ম নারীবাদী আন্দোলন ও শ্রমজীবী নারী আন্দোলন হাত ধরাধরি করে চলেছে। নারীদের সম স্বার্থ ও সম অধিকারের দাবি একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে। ভোটাধিকার, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ অধিকার, নারীর উত্তরাধিকার ও সম্পত্তির দাবিকে সমর্থন করেছে সব শ্রমজীবী নারী সংগঠনগুলো। পানত্মরে নারী শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও সুরা, উন্নত কর্মপরিবেশ, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ইত্যাদি দাবিকেও সমর্থন যুগিয়েছে নারীবাদী সংগঠনগুলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শ্রমজীবী নারীদের আন্দোলন এবং নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যে নানা কারণে দুঃখজনক বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়। উলেস্নখ্য যে, একজন মানুষ হিসেবে নারীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে এই নারীবাদী আন্দোলনে যে কেবল নারীরাই সামিল হয়েছেন তা নয়, দেশে দেশে উদার যুক্তিবাদী গণতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন মহৎ পুরম্নষরাও এতে যুক্ত হয়েছেন। ১৮৬৬ সালে দার্শনিক ও আইনজ্ঞ জন স্টুয়ার্ট মিল ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট সদস্য হবার পর নারীর ভোটাধিকারসহ নারীর অধিকারের প েবিখ্যাত বই নারীর অধীনতা (ঞযব ংঁনলবপঃরড়হ ড়ভ ডড়সবহ) রচনা করেন। এরও আগে ১৮২৫ সালে ইংল্যান্ডে নারীর অধিকারের প েপ্রথম পুরম্নষ দার্শনিক উইলিয়াম টমসনের বই_ 'পুরম্নষের অহঙ্কারের বিরম্নদ্ধে মানবজাতির অর্ধেক অংশ নারীর আবেদন বাকি অর্ধেক অংশের কাছে' (ঞযব যধষভ ঢ়ড়ৎঃরড়হ ড়ভ সধহশরহফ ড়িসবহ্থং ধঢ়ঢ়বধষ ঃড় ঃযব ৎবংঃ ঢ়ড়ৎঃরড়হ ধমধরহংঃ সধষব পযধাঁরহরংস) প্রকাশিত হয়। এছাড়াও মার্কস-এঙ্গেলস রচিত বিশ্বখ্যাত কমিউনিস্ট ইশতেহার (১৯৪৮), এঙ্গেলসের পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব (১৮৮৪), অগাস্ট বেবেল-এর নারী : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত এবং নারী ও সমাজতন্ত্র এসব গ্রন্থ নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দিকদর্শনরূপে চিহ্নিত হয়েছে। ১৮৭৯ সালে বিখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেন-এর কালজয়ী নাটক পুতুলের খেলাঘর (ঞযব উড়ষষং ঐড়ঁংব)-এর নায়িকা নোরা চরিত্রটির মাধ্যমে আধুনিক নারীবাদী চেতনা মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।
আধুনিক নারীবাদীদের মধ্যে ভার্জিনিয়া উল্ফ-এর সাহিত্যকর্ম, সিমোন দ্য বোভেয়ারের কালজয়ী রচনা সেকেন্ড সেক্স (ঝবপড়হফ ঝবী) ও সেক্সুয়াল পলিটিক্স (ঝবীঁধষ চড়ষরঃরপং), ১৯৬৬ সালে বেটি ফ্রাইডান রচিত দি ফেমিনিন মিস্টিক (ঞযব ঋবসরহরহব গুংঃরপ), ১৯৭০ সালে জার্মেইন গ্রিয়ার-এর দি ফিমেল ইউনাক (ঞযব ঋবসধষব ঊঁহধপ), শুলাস্মিথ ফায়ার স্টোন-এর ডায়ালেকটিকস অব সেক্স (উরধষবপঃরপং ড়ভ ঝবী), আলেকজান্দ্রা কোলনতাই-এর সেক্সুয়াল রিলেশন এ্যান্ড কাস স্ট্রাগেল (ঝবীঁধষ জবষধঃরড়হ ধহফ ঈষধংং ঝঃৎঁমমষব), এরিকা ইয়ং রচিত ফিয়ার ফর ফাইং (ঋবধৎ ভড়ৎ ঋষুরহম), কেটি রোইফে-এর বিউটি মিথ (ইবধঁঃু গুঃয) ও ফায়ার উইথ ফায়ার (ঋরৎব রিঃয ঋরৎব) প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থ নারীবাদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। আরব বিশ্বের মুসলিম নারীবাদীদের মধ্যে মরক্কোর ফাতিমা মারনিসি ও মিসরের নওএল সাদাওয়ি প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। ফাতিমা মারনিসির মুসলমানের অবচেতনায় নারী এবং নওএলের আরব বিশ্বে নারী ও হাওয়ায় লুকানো মুখ ইত্যাদি গ্রন্থে আধুনিক নারীবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে।
উলেস্নখ্য যে, নারীবাদ কোন একক ও অভিন্ন ধারণা নয়, নারীবাদের রয়েছে নানা ধারা ও উপধারা। তবে নারীবাদের সব ধারারই মূল সুর এক। আর তা হলো না নারীর ওপর পুরম্নষের কতর্ৃত্ব, আধিপত্য, শোষণ-শাসন, নিয়ন্ত্রণের অবসান এবং মানুষ হিসেবে পুুরম্নষের মতো সবেেত্র নারীর সমান অধিকার।
নারী আন্দোলন : জাতীয় প্রোপট
দুনিয়ার সব দেশে একই রূপে একই মাত্রায় নারীবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেনি। বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক বাসত্মবতায় নানাভাবে নারীবাদী আন্দোলন বিকশিত হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশ তথা তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে নারীবাদী ধ্যান-ধারণা পরিপুষ্ট হতে শুরম্ন করে। এখানে উলেস্নখ্য যে, তৎকালীন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণে ছিল নানাভাবে জর্জরিত। নারীরা তো দূরের কথা পুরম্নষরাই ছিল অধিকারবঞ্চিত। সঙ্গত কারণেই তাই নারীবাদী আন্দোলন এবং ব্রিটিশ শাসন বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অনেক সময় একই মোহনায় মিলিত হয়েছে। নারীর শোচনীয় দুরবস্থার বিরম্নদ্ধে এবং নারীর অধিকারের সপ েপ্রথম সোচ্চার হন একজন নারীবাদী পুরম্নষ_ রাজা রামমোহন রায়। ১৮১৮ সালে তিনি কলকাতায় সহমরণ বা সতীদাহ প্রথা বিলোপের উদ্যোগ নেন। যার ফলে ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেন। অন্যদিকে নারীকে ধর্মশাস্ত্রের উৎপীড়ন থেকে রা করতে সচেষ্ট হন আরেক মহৎ পুরম্নষ_ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি প্রথমে নারীর শিার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মেরি ককের সঙ্গে মিলে মোট ৪৩টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৮৫০-৫৫ এ সময়ে বিধবা বিবাহের সপওে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৮৬৭ সাল নাগাদ নিজে ৬০টি বিধবা বিবাহের আয়োজন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে থেকেই কৃষ্ণভামিনী দাসী, কামিনী সুন্দরী, বামাসুন্দরী দেবী, মোদাদায়িনী প্রমুখ নারীরা লেখালেখির মাধ্যমে প্রথম সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন। সেই সময়ে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী কবি খ্যাতি লাভ করেন এবং ১৮৭৩ সালে কুমিলস্নায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয় ও ১৮৯৩ সালে জেনানা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার প্রথম নারীবাদী সংগঠন 'সখী সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী ১৮৮৫ সালে এবং তিনি লাঠি খেলা ও অস্ত্র চালনা প্রশিণের মাধ্যমে তরম্নণ-তরম্নণীর মধ্যে দেশপ্রেম সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট হন। এ সময়ে সমাজের নানা অনুশাসনের বেড়াজাল ছিন্ন করে নারীরা ক্রমবর্ধমান হারে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে থাকে। ১৮৮৯ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে ৬ জন নারী যোগ দেন। সরোজীনি নাইডু ও সরলা দেবী চৌধুরানী প্রমুখ নারী নেত্রীরা কংগ্রেসের সভাপ্রধানের পদেও অধিষ্ঠিত হন। ১৮৮৯ সালে ভারতবর্ষের প্রথম সংগঠিত নারীবাদী আন্দোলনের রূপকার মহারাষ্ট্রের পণ্ডিত রমাবাঈ প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামেন এবং পুনায় নারীমুক্তি সম্বন্ধে বক্তৃতা প্রদান করেন। অন্যদিকে বাংলার প্রথম নারীবাদী রূপে খ্যাত সরলা দেবী চৌধুরানী কতর্ৃক ১৯১০ সালে সর্বভারতীয় নারী সংগঠন ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে বিংশ শতাব্দীর শুরম্নতেই বাংলার প্রথম নারীবাদী প্রবন্ধ স্ত্রী জাতির অবনতি প্রকাশের মাধ্যমে যে অনন্য সাধারণ নারীবাদী প্রবক্তার উত্থান ঘটে তিনি হলেন রোকেয়া সাখাওয়াত। রোকেয়ার সমগ্র জীবন ও কর্ম বাংলায় আধুনিক নারীবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছে। মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদ অংশের ভেতর থেকে কীভাবে রোকেয়া এমন বৈশ্বিক মানের নারীবাদী চৈতন্য অর্জন করল তা আজও পাশ্চাত্যের কাছে বিস্ময়ের কারণ। কেতকী কুশারী ডাইসন তাই তাঁকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে যে, 'যদিও বঙ্গদেশে স্ত্রী শিা বিসত্মারে হিন্দু সমাজই অগ্রণী, তবুও বিশ শতকের গোড়ায় বঙ্গ ললনাদের মধ্যে সব থেকে রেডিক্যাল, বৈপস্নবিক, প্রতিবাদে দৃঢ় কণ্ঠস্বর একজন মুসলমান মহিলার। তাঁর নাম বেগম রোকেয়া।... রোকেয়াই আধুনিক অর্থে বাংলার প্রথম প্রকৃত ফেমিনিস্ট (নারীবাদী) নারী।"
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে রোকেয়া সাখাওয়াত, সরলা দেবী এবং পণ্ডিত রমাবাঈ হলো তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের নারীবাদী চিনত্মার জনক। বিংশ শতাব্দীর শুরম্ন থেকে ১৯৪৭ এর ব্রিটিশ শাসন অবসান ও দেশ বিভাগ অবধি নানা নারী সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং অসংখ্য নারী স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন ধারায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। এছাড়াও কমিউনিস্ট আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন (তেভাগা, নানকার, টংক, তেলেঙ্গানা প্রভৃতি) সমাজের বিভিন্ন সত্মরের উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক নারী অংশগ্রহণ করে ইতিহাস রচনা করেছেন। এদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলেন কংগ্রেস পরিচালিত স্বদেশী আন্দোলনে_ সরোজিনী নাইডু, জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী, মাতঙ্গিনী হাজরা, সরলা দেবী, উর্মিলা দেবী, আশালতা সেন, কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায়, প্রভাবতী বসু, অরম্নণা আসফ আলী, লীলা নাগ; ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপস্নবী আন্দোলনে- প্রীতিলতা ওয়েদেদ্দার, কল্পনা দত্ত, শানত্মি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, রীনা দাস, ননী বালা, দুকড়ি বালা দেবী, চারুশীলা দেবী; কমিউনিস্ট ও শ্রমিক আন্দোলনে- সাকিনা বেগম, প্রভাবতী দাসগুপ্ত, সনত্মোষকুমারী দেবী, দুঃখুমত বিবি; কৃষক আন্দোলনে_ রানী গুহ, হিরন্ময়ী ঘোষ, মনোরমা বসু, কনক মুখার্জী, হেনা দাস, চারুলতা ঘোষ প্রমুখ। এছাড়াও ১৯১৭ সালে তৎকালীন ভারতে নারীদের ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরম্ন হয় এবং ১৯১৯ সালে এই দাবিতে নারীদের একটি প্রতিনিধি দল ব্রিটেনে গমন করে। পূর্বেই উলেস্নখ করা হয়েছে যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বহাল থাকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরম্ন থেকে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পর্যনত্ম এদেশে নারীবাদী চেতনা মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের আধারে বিকশিত হওয়ায় স্বাতন্ত্র্য কোন রূপ পরিগ্রহ করেনি, ব্রিটিশ শাসনবিরোধী সংগ্রামের স্রোতধারায় মিলিত হয়েছে মূলত নারীবাদী আন্দোলন। ১৯৪৮-১৯৭১ সালে এই ধারাবাহিকতার বাঙালী জাতির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়েছে নারীমুক্তি আন্দোলন। ৬০-এর দশক থেকে আশির দশক পর্যনত্ম মহীয়সী নারী কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে এদেশে নারী আন্দোলন বেগবান হয় এবং তা সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন সহযোগী হয়ে ওঠে। তবে পরবর্তী সময়ে ৮০ ও ৯০ দশকে দাতা সংস্থাগুলোর আর্থিক সহায়তায় অনেক নারী সংগঠন জন্মলাভ করলেও তা মূলত নারী উন্নয়নমূলক বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই কেবল নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। নারীবাদী চেতনা সমৃদ্ধ কোন শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সম হয়নি এখনও। অবশ্য শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এনজিও এবং এনজিওধর্মী নারী সংগঠনগুলো তৃণমূলে নারী জাগরণ সৃষ্টি করার েেত্র বিশেষ অবদান রাখছে।
No comments