খণ্ডে খণ্ডে গাঁথা মহাকাব্য
কোথাও চলছে গান, কোথাও দৃপ্ত স্লোগান।
রাস্তায় আঁকা হচ্ছে ব্যঙ্গচিত্র, পাশেই আবার জনতাকে উদ্বুদ্ধ করছে
মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। কোথাও চলছে নাটক, কোথাও ফাঁসিতে ঝোলানো রাজাকার
ঘাতক। কারও কারও হাতে জাতীয় পতাকা, কারও বা শরীরে প্রতিবাদী সব লেখা।
খণ্ডে
খণ্ডে এসব আয়োজন চললেও সব মিলিয়ে যেন একসূত্রে গাঁথা এক মহাকাব্য।
অগ্রন্থিত এ মহাকাব্যের ভাষা হয়তো ভিন্ন, কিন্তু বক্তব্য
একটাই—মানবতাবিরোধীদের ফাঁসি। কোলের শিশু থেকে শুরু করে সদ্য স্কুলে ভর্তি
হওয়া ছাত্র, দুরন্ত কিশোর থেকে শুরু করে সদ্যে পদার্পণ করা তারুণ্য,
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী যুবক থেকে শুরু করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা,
মন্ত্রী থেকে শুরু করে শ্রমিক—সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আছেন এই মহাকাব্যে।
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় প্রত্যাখ্যান করে গত মঙ্গলবার বিকেলে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হন জনতা। এরপর শাহবাগের ‘প্রজন্ম চত্বরে’ তৈরি হয় নবজাগরণ মঞ্চ। স্লোগানে, কবিতায়, বক্তৃতায়, প্রতিবাদে পাঁচ দিন ধরেই ওই মঞ্চ উজ্জীবিত। কিন্তু সেই মঞ্চই সব নয়। ওই মঞ্চ ঘিরে খণ্ডে খণ্ডে তৈরি হয়েছে আরও অনেক গল্প।
শুক্রবার মহাসমাবেশের পর শনিবার সকাল পেরিয়ে দুপুর। সূর্যের উত্তাপে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা দায়। কিন্তু শাহবাগ চত্বরে হাজারো মানুষের কণ্ঠে উদ্দীপ্ত স্লোগান। মূল মঞ্চের পেছনের দিকে পিজি হাসপাতালের সামনে ’৭১-এর লাল-সবুজের সেই পতাকা। মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র। ওই পতাকার চারপাশে বসে স্লোগান দিচ্ছেন কিছু মানুষ, যেন তাঁরা প্রিয় পতাকাকে আগলে রাখার শপথ নিচ্ছেন।
আর অনেকের সঙ্গেই স্কুলের পোশাক পরা একদল ছাত্রকেও দেখা গেল, পতাকা ছুঁয়ে তারা স্লোগান দিচ্ছে। তাদেরই একজন বিপ্লব সরকার জানাল, তারা বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাওহীদ, রুমন, সারোয়ারসহ তারা একদল বন্ধুবান্ধব এসেছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে। তাদের খানিকটা দূরত্বে স্লোগান দিচ্ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তৃষ্ণা। তাঁর সহপাঠীরা তাল মেলাচ্ছিলেন তাঁর সুরে।
শাহবাগ মোড়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি দাবির প্ল্যাকার্ড গায়ে লাগিয়ে সকাল থেকে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন আয়েশা আনোয়ার। কাঁটাবন যাওয়ার রাস্তার দিকে গেলেই চোখে পড়ল রাস্তায় বসে অসংখ্য মোমবাতি গোছাচ্ছেন আরেক দল তরুণ। আয়োজক জহিরুল হক জানালেন, তাঁরা সন্ধ্যার পর মোমবাতি প্রজ্বালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সামনে এগিয়ে জাদুঘরের দিকে এলে উল্টো দিকের ফুটপাতে বিশাল একটি ব্যানার চোখে পড়বে। ‘আর কতো খুন হলে হবে মৃত্যুদণ্ড, লজ্জায় আজ পড়েছে ভেঙ্গে জাতির মেরুদণ্ড’ শিরোনামে এই স্লোগানটি টানিয়েছে এক্স-ক্যাডেটস কমিউনিটি। ওই ব্যানারের পাশে বসে আছেন জনা ত্রিশেক তরুণ-তরুণী। রাজীব আহমেদ, ফেরদৌসী রহমান ও তানিয়া তন্বী জানান, ১২টি ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন এটি। মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে দুই শতাধিক তরুণ-তরুণী যোগ দিয়েছেন এই আন্দোলনে।
জাদুঘরের সামনের স্কুল-কলেজের পোশাক পরা একদল ছেলেমেয়ে চক্রাকারে ঘুরছে আর স্লোগান দিচ্ছে। হাতে তাদের জাতীয় পতাকা। তুষার, প্রীত, নাইম, লাবণ্য, দোলাসহ আরও অনেকেই জানাল, তারা ঢাকার ইমপিরিয়াল কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। শাহবাগের এই আন্দোলনের কারণে এখন তাদের অন্য কিছুতেই মন বসছে না। তাই এখানে চলে এসেছে।
জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে জাতীয় পতাকা নিয়ে নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন আরও অনেক তরুণ। তাঁরা এশিয়া প্যাসিফিক, তিতুমীর কলেজসহ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র। জাদুঘরের সামনে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের একদল শিক্ষার্থীও ছিলেন। আর ইউডার একদল শিক্ষার্থী পতাকা নিয়ে স্লোগান দিয়ে শাহবাগ থেকে চারুকলা পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর সামনে বসে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে নানা পোস্টার লিখছিলেন একদল তরুণ। তাঁদের একজন বাঁধন জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থীরা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে এসব পোস্টার লিখছেন। উপস্থিত সবার দৃপ্ত উচ্চারণ—রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা রাজপথ ছাড়বেন না।
শাহবাগ থানার সামনের পাশের রাস্তায় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান গাইছিলেন পালাকার নামের একটি সংগঠন। তারা যখন ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে, আমরা কজন নবীন মাঝি’ এই গানটি গাচ্ছিল তখন সমবেত জনতাও সেখানে গান গাইছিলেন।
চারুকলার সামনের রাস্তায় গানে আর স্লোগানে মেতে ছিলেন কয়েক শ ছাত্রছাত্রী। তাঁদের মধ্যে থাকা আশিস ও সৈকত জানালেন, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র। রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে তাঁরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।
আরেকটু এগিয়ে চারুকলার মূল গেটের সামনের রাস্তায় বাংলাদেশের একটি মানচিত্র বানিয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে ছিলেন একজন। হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা একটাই শব্দ ‘অপেক্ষা’। আশপাশের লোকজন জানালেন, লোকটির নাম শাহাদাত। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় শোনার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
চারুকলার মূল গেটে পাঁচ দিন ধরেই পথনাটক প্রদর্শন করছে নাট্যদল তীরন্দাজ। দলের মুখ্য সমন্বয়ক কাজী রাকিব বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত তাঁরা নাটক, আবৃত্তি করে জনতাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। অনেক সাধারণ মানুষও আমাদের সঙ্গে এসে গান গাইছেন।’
চারুকলার শিল্পীরা বিকেলে ১০০ ফুট লম্বা একটি জাতীয় পতাকা বানিয়ে ঝুলিয়েছেন চারুকলার উল্টো দিকের ছবির হাটে। চারুশিল্পী শহিদুজ্জামান জানান, কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের প্রতিবাদে মানবতাবিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করে তাঁরা এই পতাকা বানিয়েছেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে পতাকাটা যখন টানানো হয়, তখন সেখানে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন উপস্থিত জনতা।
জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সামনের দিকে একটি খাঁচা বানিয়ে তাতে বাংলাদেশের মানচিত্র আটকে দিয়েছে ম্যাজিক মুভমেন্ট নামে ফেসবুক গ্রুপ। খাঁচার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘এ খাঁচা আমি ভাঙ্গবো কেমন করে?’ উদ্যোক্তারা জানান, রাজাকারদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্ত হবে না। তাই এই প্রতীকী প্রতিবাদ।
শাহবাগ ঘুরে ঘুরে অনেকেই ছোট ছোট জাতীয় পতাকা ও ব্যান্ড বিক্রি করছিলেন। তাঁদেরই একজন শহীদুর জানালেন, ডিসেম্বর মাস ছাড়া এত পতাকা কখনোই বিক্রি হয় না। কিন্তু গত পাঁচ দিনে তাঁর জীবনের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
শাহবাগের এই আন্দোলনের সঙ্গে প্রথম থেকে সক্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন স্লোগান-৭১। বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়ে তারা মশাল মিছিল-মোমবাতি প্রজ্বালনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। এ ছাড়া সারা দিন উপস্থিত আন্দোলনকারীদের স্যালাইন, দুপুরে-রাতে খাবারও সরবরাহ করছে তারা। আর স্লোগান-মিছিল তো আছেই। স্লোগান-৭১-এর সভাপতি দেলোয়ার হোসেন জানান, যুদ্ধাপরাধীদের মূল শক্তি তাঁদের অর্থ। তাই রাজাকারদের সব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে তাঁরা জনসাধারণের মধ্যে সরবরাহ করছেন, যাতে এই দেশের মুক্তিকামী মানুষের একটি টাকাও রাজাকারদের প্রতিষ্ঠানে না যায়।
মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা সম্পর্কে সবাইকে জানাতে পাঁচ দিন ধরে শাহবাগে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ। সংগঠনের সভাপতি মিসবাহ আরিফ জানান, সেই রাতের কথা বলতে এসেছি, আলবদর, ওরা ১১ জন, মুক্তির গানসহ অনেক চলচ্চিত্র তাঁরা দেখাচ্ছেন। এসব চলচ্চিত্র দেখে মানুষ উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
জাতীয় জাদুঘরের সামনে মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি, চলচ্চিত্রম, বাংলাদেশে প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ ও স্টামফোর্ড স্টুডেন্টস সিনে ফোরামও যৌথভাবে চলচ্চিত্র দেখাচ্ছে। উদ্যোক্তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক জানান, ‘শেষ রাতে যখন লোকজন ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন এই চলচ্চিত্রের টানে অনেকে ভোর পর্যন্ত থাকে।’
পঞ্চম দিনে আন্দোলন: কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী কবীর সুমন একটি গান তৈরি করেছেন। সুমন গানটি লিখে ও সুরারোপ করে পাঠান শুক্রবার। এর পর থেকে ‘সীমানা চেনে না সুর’ শিরোনামের গানটি গাওয়া হচ্ছে শাহবাগে।
শনিবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল আসতে থাকে শাহবাগে; সব মিছিলে স্লোগান একটাই ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’। বিক্ষোভে সংহতি জানিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের দুই সন্তান নিতু ও মিশু। ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফীসও সংহতি জানান। বীর প্রতীক রফিকুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী উপস্থিত হয়ে আন্দোলনরতদের মধ্যে খাবার বিতরণ করেছেন।
দুপুর একটার আগেই শাহবাগ এলাকা ছিল লোকে লোকারণ্য। বিক্ষোভের মূল মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি এবং জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয়। জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতাল চট্টগ্রামবাসী প্রত্যাখ্যান করার খবর শুনে জনতা স্বাগত জানায়। একসময় মঞ্চ থেকে বলা হয়, ‘বন্ধুরা, রাজাকার গোলাম আযম এই (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে আছে। আমাদের স্লোগানে নাকি তার ঘুম হচ্ছে না। আজ আমরা এত জোরে স্লোগান দেব, যাতে রাজাকারটা হার্ট অ্যাটাক করে।’
দুপুর দুইটায় সমাবেশের মাইক থেকে জানানো হয়, শাহবাগের এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন সিডনি, নিউইয়র্ক, কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা। খবর শুনে হাততালিতে মুখর হয়ে ওঠে শাহবাগ। এর কিছুটা পরে জানানো হয়, নানা স্লোগান দিয়ে গলা বসিয়ে ফেলা বিক্ষোভকারীদের জন্য ওষুধ পাঠিয়েছেন এক হোমিও চিকিৎসক। সঙ্গে লিখে দিয়েছেন খাওয়ার নিয়ম। খোলা চিঠিতে সকালে পাঁচটি ও বিকেলে পাঁচটি বড়ি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বদরুদ্দিন নামের ওই চিকিৎসক বললেন, ‘এই ওষুধে কোনো বিশ্রাম ছাড়াই স্লোগান দিতে থাকবেন। আমার ওষুধে যদি কাজ না হয় তাহলে বুঝব, আমি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই না।’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান গতকাল শাহবাগে এসে আন্দোলনরত জনতার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণসমাজ দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তার জন্য তাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন।’
শনিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শাহবাগে আসেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনি হাত নেড়ে আন্দোলনকারীর প্রতি সমর্থন জানালেও কোনো বক্তব্য দেননি। এদিকে আইন প্রতিমন্ত্রী ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধনের ঘোষণা দিলেও আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চলবে।
রাত পৌনে একটায়ও স্লোগান চলছিল শাহবাগে। চারপাশে ছিল মোমের আলো, হাতে হাতে ছিল জাতীয় পতাকা।
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় প্রত্যাখ্যান করে গত মঙ্গলবার বিকেলে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হন জনতা। এরপর শাহবাগের ‘প্রজন্ম চত্বরে’ তৈরি হয় নবজাগরণ মঞ্চ। স্লোগানে, কবিতায়, বক্তৃতায়, প্রতিবাদে পাঁচ দিন ধরেই ওই মঞ্চ উজ্জীবিত। কিন্তু সেই মঞ্চই সব নয়। ওই মঞ্চ ঘিরে খণ্ডে খণ্ডে তৈরি হয়েছে আরও অনেক গল্প।
শুক্রবার মহাসমাবেশের পর শনিবার সকাল পেরিয়ে দুপুর। সূর্যের উত্তাপে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা দায়। কিন্তু শাহবাগ চত্বরে হাজারো মানুষের কণ্ঠে উদ্দীপ্ত স্লোগান। মূল মঞ্চের পেছনের দিকে পিজি হাসপাতালের সামনে ’৭১-এর লাল-সবুজের সেই পতাকা। মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র। ওই পতাকার চারপাশে বসে স্লোগান দিচ্ছেন কিছু মানুষ, যেন তাঁরা প্রিয় পতাকাকে আগলে রাখার শপথ নিচ্ছেন।
আর অনেকের সঙ্গেই স্কুলের পোশাক পরা একদল ছাত্রকেও দেখা গেল, পতাকা ছুঁয়ে তারা স্লোগান দিচ্ছে। তাদেরই একজন বিপ্লব সরকার জানাল, তারা বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাওহীদ, রুমন, সারোয়ারসহ তারা একদল বন্ধুবান্ধব এসেছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি নিয়ে। তাদের খানিকটা দূরত্বে স্লোগান দিচ্ছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তৃষ্ণা। তাঁর সহপাঠীরা তাল মেলাচ্ছিলেন তাঁর সুরে।
শাহবাগ মোড়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি দাবির প্ল্যাকার্ড গায়ে লাগিয়ে সকাল থেকে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন আয়েশা আনোয়ার। কাঁটাবন যাওয়ার রাস্তার দিকে গেলেই চোখে পড়ল রাস্তায় বসে অসংখ্য মোমবাতি গোছাচ্ছেন আরেক দল তরুণ। আয়োজক জহিরুল হক জানালেন, তাঁরা সন্ধ্যার পর মোমবাতি প্রজ্বালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সামনে এগিয়ে জাদুঘরের দিকে এলে উল্টো দিকের ফুটপাতে বিশাল একটি ব্যানার চোখে পড়বে। ‘আর কতো খুন হলে হবে মৃত্যুদণ্ড, লজ্জায় আজ পড়েছে ভেঙ্গে জাতির মেরুদণ্ড’ শিরোনামে এই স্লোগানটি টানিয়েছে এক্স-ক্যাডেটস কমিউনিটি। ওই ব্যানারের পাশে বসে আছেন জনা ত্রিশেক তরুণ-তরুণী। রাজীব আহমেদ, ফেরদৌসী রহমান ও তানিয়া তন্বী জানান, ১২টি ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন এটি। মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবিতে দুই শতাধিক তরুণ-তরুণী যোগ দিয়েছেন এই আন্দোলনে।
জাদুঘরের সামনের স্কুল-কলেজের পোশাক পরা একদল ছেলেমেয়ে চক্রাকারে ঘুরছে আর স্লোগান দিচ্ছে। হাতে তাদের জাতীয় পতাকা। তুষার, প্রীত, নাইম, লাবণ্য, দোলাসহ আরও অনেকেই জানাল, তারা ঢাকার ইমপিরিয়াল কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। শাহবাগের এই আন্দোলনের কারণে এখন তাদের অন্য কিছুতেই মন বসছে না। তাই এখানে চলে এসেছে।
জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে জাতীয় পতাকা নিয়ে নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন আরও অনেক তরুণ। তাঁরা এশিয়া প্যাসিফিক, তিতুমীর কলেজসহ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র। জাদুঘরের সামনে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের একদল শিক্ষার্থীও ছিলেন। আর ইউডার একদল শিক্ষার্থী পতাকা নিয়ে স্লোগান দিয়ে শাহবাগ থেকে চারুকলা পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর সামনে বসে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে নানা পোস্টার লিখছিলেন একদল তরুণ। তাঁদের একজন বাঁধন জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থীরা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে এসব পোস্টার লিখছেন। উপস্থিত সবার দৃপ্ত উচ্চারণ—রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ড না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা রাজপথ ছাড়বেন না।
শাহবাগ থানার সামনের পাশের রাস্তায় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে গান গাইছিলেন পালাকার নামের একটি সংগঠন। তারা যখন ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে, আমরা কজন নবীন মাঝি’ এই গানটি গাচ্ছিল তখন সমবেত জনতাও সেখানে গান গাইছিলেন।
চারুকলার সামনের রাস্তায় গানে আর স্লোগানে মেতে ছিলেন কয়েক শ ছাত্রছাত্রী। তাঁদের মধ্যে থাকা আশিস ও সৈকত জানালেন, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র। রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে তাঁরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।
আরেকটু এগিয়ে চারুকলার মূল গেটের সামনের রাস্তায় বাংলাদেশের একটি মানচিত্র বানিয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে ছিলেন একজন। হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা একটাই শব্দ ‘অপেক্ষা’। আশপাশের লোকজন জানালেন, লোকটির নাম শাহাদাত। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় শোনার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
চারুকলার মূল গেটে পাঁচ দিন ধরেই পথনাটক প্রদর্শন করছে নাট্যদল তীরন্দাজ। দলের মুখ্য সমন্বয়ক কাজী রাকিব বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত তাঁরা নাটক, আবৃত্তি করে জনতাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। অনেক সাধারণ মানুষও আমাদের সঙ্গে এসে গান গাইছেন।’
চারুকলার শিল্পীরা বিকেলে ১০০ ফুট লম্বা একটি জাতীয় পতাকা বানিয়ে ঝুলিয়েছেন চারুকলার উল্টো দিকের ছবির হাটে। চারুশিল্পী শহিদুজ্জামান জানান, কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের প্রতিবাদে মানবতাবিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করে তাঁরা এই পতাকা বানিয়েছেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে পতাকাটা যখন টানানো হয়, তখন সেখানে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন উপস্থিত জনতা।
জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সামনের দিকে একটি খাঁচা বানিয়ে তাতে বাংলাদেশের মানচিত্র আটকে দিয়েছে ম্যাজিক মুভমেন্ট নামে ফেসবুক গ্রুপ। খাঁচার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘এ খাঁচা আমি ভাঙ্গবো কেমন করে?’ উদ্যোক্তারা জানান, রাজাকারদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্ত হবে না। তাই এই প্রতীকী প্রতিবাদ।
শাহবাগ ঘুরে ঘুরে অনেকেই ছোট ছোট জাতীয় পতাকা ও ব্যান্ড বিক্রি করছিলেন। তাঁদেরই একজন শহীদুর জানালেন, ডিসেম্বর মাস ছাড়া এত পতাকা কখনোই বিক্রি হয় না। কিন্তু গত পাঁচ দিনে তাঁর জীবনের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
শাহবাগের এই আন্দোলনের সঙ্গে প্রথম থেকে সক্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন স্লোগান-৭১। বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়ে তারা মশাল মিছিল-মোমবাতি প্রজ্বালনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। এ ছাড়া সারা দিন উপস্থিত আন্দোলনকারীদের স্যালাইন, দুপুরে-রাতে খাবারও সরবরাহ করছে তারা। আর স্লোগান-মিছিল তো আছেই। স্লোগান-৭১-এর সভাপতি দেলোয়ার হোসেন জানান, যুদ্ধাপরাধীদের মূল শক্তি তাঁদের অর্থ। তাই রাজাকারদের সব প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে তাঁরা জনসাধারণের মধ্যে সরবরাহ করছেন, যাতে এই দেশের মুক্তিকামী মানুষের একটি টাকাও রাজাকারদের প্রতিষ্ঠানে না যায়।
মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা সম্পর্কে সবাইকে জানাতে পাঁচ দিন ধরে শাহবাগে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ। সংগঠনের সভাপতি মিসবাহ আরিফ জানান, সেই রাতের কথা বলতে এসেছি, আলবদর, ওরা ১১ জন, মুক্তির গানসহ অনেক চলচ্চিত্র তাঁরা দেখাচ্ছেন। এসব চলচ্চিত্র দেখে মানুষ উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
জাতীয় জাদুঘরের সামনে মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি, চলচ্চিত্রম, বাংলাদেশে প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ ও স্টামফোর্ড স্টুডেন্টস সিনে ফোরামও যৌথভাবে চলচ্চিত্র দেখাচ্ছে। উদ্যোক্তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক জানান, ‘শেষ রাতে যখন লোকজন ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন এই চলচ্চিত্রের টানে অনেকে ভোর পর্যন্ত থাকে।’
পঞ্চম দিনে আন্দোলন: কাদের মোল্লাসহ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী কবীর সুমন একটি গান তৈরি করেছেন। সুমন গানটি লিখে ও সুরারোপ করে পাঠান শুক্রবার। এর পর থেকে ‘সীমানা চেনে না সুর’ শিরোনামের গানটি গাওয়া হচ্ছে শাহবাগে।
শনিবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল আসতে থাকে শাহবাগে; সব মিছিলে স্লোগান একটাই ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’। বিক্ষোভে সংহতি জানিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের দুই সন্তান নিতু ও মিশু। ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফীসও সংহতি জানান। বীর প্রতীক রফিকুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী উপস্থিত হয়ে আন্দোলনরতদের মধ্যে খাবার বিতরণ করেছেন।
দুপুর একটার আগেই শাহবাগ এলাকা ছিল লোকে লোকারণ্য। বিক্ষোভের মূল মঞ্চ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি এবং জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয়। জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতাল চট্টগ্রামবাসী প্রত্যাখ্যান করার খবর শুনে জনতা স্বাগত জানায়। একসময় মঞ্চ থেকে বলা হয়, ‘বন্ধুরা, রাজাকার গোলাম আযম এই (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে আছে। আমাদের স্লোগানে নাকি তার ঘুম হচ্ছে না। আজ আমরা এত জোরে স্লোগান দেব, যাতে রাজাকারটা হার্ট অ্যাটাক করে।’
দুপুর দুইটায় সমাবেশের মাইক থেকে জানানো হয়, শাহবাগের এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন সিডনি, নিউইয়র্ক, কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা। খবর শুনে হাততালিতে মুখর হয়ে ওঠে শাহবাগ। এর কিছুটা পরে জানানো হয়, নানা স্লোগান দিয়ে গলা বসিয়ে ফেলা বিক্ষোভকারীদের জন্য ওষুধ পাঠিয়েছেন এক হোমিও চিকিৎসক। সঙ্গে লিখে দিয়েছেন খাওয়ার নিয়ম। খোলা চিঠিতে সকালে পাঁচটি ও বিকেলে পাঁচটি বড়ি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বদরুদ্দিন নামের ওই চিকিৎসক বললেন, ‘এই ওষুধে কোনো বিশ্রাম ছাড়াই স্লোগান দিতে থাকবেন। আমার ওষুধে যদি কাজ না হয় তাহলে বুঝব, আমি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই না।’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান গতকাল শাহবাগে এসে আন্দোলনরত জনতার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণসমাজ দেশকে ভালোবেসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তার জন্য তাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন।’
শনিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শাহবাগে আসেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনি হাত নেড়ে আন্দোলনকারীর প্রতি সমর্থন জানালেও কোনো বক্তব্য দেননি। এদিকে আইন প্রতিমন্ত্রী ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধনের ঘোষণা দিলেও আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চলবে।
রাত পৌনে একটায়ও স্লোগান চলছিল শাহবাগে। চারপাশে ছিল মোমের আলো, হাতে হাতে ছিল জাতীয় পতাকা।
No comments