ফরমাল চার্জ, রায় ও সাক্ষীদের বর্ণনায় গরমিল
আবদুল কাদের মোল্লাকে যে তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে তার একটি হলো সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যার ঘটনা।
এ ক্ষেত্রেও আবদুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে দু’জন সাক্ষীর শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে।
খন্দকার আবু তালেব হত্যার ঘটনা বিষয়ে একটি ক্ষেত্রে বিরাট গরমিল রয়েছে
ফরমাল চার্জ ও রায়ে বর্ণিত ঘটনার বিবরণ এবং সাক্ষীদের দেয়া জবানবন্দীর
মধ্যে। ফরমাল চার্জ ও রায়ে খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার যে বিবরণ তুলে ধরা
হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, মিরপর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে আবু তালেবকে
কাদের মোল্লা অন্যান্য আলবদর, রাজাকার ও বিহারি দুষ্কৃতকারীদের নিয়ে দড়ি
দিয়ে বেঁধে মিরপুর জল্লাদখানায় নিয়ে হত্যা করে। অপর দিকে এ ঘটনার
বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের যে দু’জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা বলেছেন
খন্দকার আবু তালেব ইত্তেফাক থেকে মিরপুর বাসায় ফেরার পথে ইত্তেফাকেরই
প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বিহারি আব্দুল হালিম তাকে বিহারিদের হাতে তুলে
দেন। আব্দুল হালিম মিরপুরে পৌঁছে দেয়ার নাম করে তার গাড়িতে খন্দকার আবু
তালেবকে তোলেন এবং তাকে কাদের মোল্লা বা বিহারিদের হাতে তুলে দেন।
খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পিতার হত্যা বিষয়ে। তবে তিনি ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার সাথে বিস্তর গরমিল রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টের। সেখানে খন্দকার আবুল আহসানের দেয়া তার পিতার হত্যার ঘটনার বর্ণনায় সেখানে আবদুল কাদের মোল্লার নামই উল্লেখ করা হয়নি।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-২ আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় দেন। ৩ নম্বর অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান বিষয়ে রায়ে বর্ণিত বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও যুক্তি এখানে তুলে ধরা হলো।
৩ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব তার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে অবস্থিত বাসা থেকে আরামবাগ যাচ্ছিলেন। তিনি মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর ইসলামী ছাত্র সংঘ নেতা আবদুল কাদের মোল্লা অন্যান্য আলবদর সদস্য, রাজাকার এবং দুষ্কৃতকারী এবং বিহারিদের সাথে নিয়ে তাকে ধরে ফেলে। তারা খন্দকার আবু তালেবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্পহাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে সেখানে হত্যা করা হয়। একজন বেসামরিক ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং সহায়তার কারণে তার বিরুদ্ধে আইনে বর্ণিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে ।
সাক্ষী : রায়ে বলা হয় এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ দুইজন সাক্ষী হাজির করেছে। তাদের মধ্যে একজন হলেন খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান (৫ নম্বর সাক্ষী) এবং অপরজন সাক্ষী হলেন খন্দকার আবু তালেবের বন্ধু সৈয়দ আব্দুল কাইউম (১০ নম্বর সাক্ষী)। তারা তখন মিরপুরে থাকতেন। তাদের দু’জনেই এ হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেছেন, দেখেননি।
সাক্ষ্য বিশ্লেষণ : সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, ২৫ মার্চ ইত্তেফাক অফিস গুঁড়িয়ে দেয়ার খবর শুনে তার পিতা খন্দকার আবু তালেব সেখানে যান তার সহকর্মীদের অবস্থা জানতে। তিনি সেখানে কিছু মৃতদেহ দেখতে পান। ২৯ মার্চ তিনি তাদের মিরপুর বাসায় আসছিলেন তার গাড়ি এবং টাকা নেয়ার জন্য। কিন্তু মিরপুর যাওয়ার পথে ইত্তেফাকের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা অবাঙালি আব্দুল হালিমের সাথে দেখা হয় তার। আব্দুল হালিম তাকে পৌঁছে দেয়ার নাম করে তার গাড়িতে ওঠান এবং আবদুল কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে যান। এরপর মিরপুর ১০ জল্লাদখানায় তার পিতাকে আবদুল কাদের মোল্লা হত্যা করে। এ সময় আবদুল কাদের মোল্লার সাথে আক্তার গুণ্ডা এবং আরো অবাঙালি দুষ্কৃৃতকারীরা ছিল।
সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান জেরায় জানান, তিনি অ্যাডভোকেট খলিলের কাছ থেকে শুনেছেন যে, ইত্তেফাকের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আব্দুুল হালিম তার পিতাকে তার গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীদের হাতে তুলে দিয়েছে। জেরায় তিনি আরো বলেন, তাদের অবাঙালি ড্রাইভার নিজাম তাকে বলেছেন যে, আব্দুল হালিম তার পিতাকে আবদুল কাদের মোল্লা এবং তার সঙ্গীদের হাতে তুলে দিয়েছে।
রায়ে বলা হয়, সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসানের জবানবন্দী এবং জেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার পিতাকে গাড়িতে করে আব্দুল হালিম কর্তৃক নিয়ে যাওয়া এবং আবদুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীদের হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা বিষয়ে সাক্ষী যে শোনা কথা বলেছেন তার বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। তিনি যাদের কাছ থেকে তার পিতাকে তুলে নেয়ার ঘটনা শুনেছেন সেই অ্যাডভোকেট খলিল এবং নিজাম ড্রাইভার কেউ জীবিত নেই।
সাক্ষী বলেছেন, তিনি নিজে তার পিতার হত্যার ঘটনা দেখেননি এবং তখনকার পরিস্থিতিতে সীমিত কিছু বাঙালি লোক ছাড়া এটা দেখা সম্ভব ছিল না। এটা থেকে তখনকার ভয়াবহ পরিস্থিতি বোঝা যায় এবং খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার ঘটনা দেখা বিষয়ে সরাসরি সাক্ষী পাওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে বলে রায়ে বলা হয়।
রায়ে বলা হয়, সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান আরো জানান যে, তিনি তাদের ড্রাইভার নিজামের কাছে শুনেছেন ১৯৭০-এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর কাদের মোল্লার নির্দেশে মিরপুরে মুসলিম বাজার, শিয়ালবাড়ি, জল্লাদখানায় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
১০ নম্বর সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম মিরপুরের বাসিন্দা এবং খন্দকার আবু তালেবের বন্ধু ছিলেন। সৈয়দ আব্দুল কাইউম ২৩ মার্চ হামলায় আহত হন এবং তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে ২৭ মার্চ তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যান। সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন, জুন মাসে ফারুক খান তাকে তার গ্রামের বাড়ি নাসিরনগরে দেখতে আসেন। ফারুক খানের কাছে তিনি শুনেছেন যে, স্থানীয় আক্তার গুণ্ডা, বিহারি এবং কাদের মোল্লা তালেব সাহেবকে হত্যা করেছে মিপুর ১০ নম্বর জল্লাদখানায়। এ ছাড়া তালেব সাহেবের ড্রাইভার নিজামের কাছ থেকেও তিনি শুনেছেন যে, খন্দকার আবু তালেব মিরপুরে তার বাসায় আসার পথে ইত্তেফাকের অবাঙালি হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আব্দুল হালিম তাকে বিহারিদের হাতে তুলে দেয় যারা তাকে মিরপুর ১০ নম্বর জল্লাদখানায় হত্যা করে।
সাক্ষ্য মূল্যায়ন : রায়ে বলা হয় খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুর ১০ নম্বর জল্লাদখানায় হত্যার ঘটনা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ৫ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত যে, খন্দকার আবু তালেব ২৯ মার্চ ইত্তেফাকের অবাঙালি অ্যাকাউনট্যান্ট আব্দুল হালিমের গাড়িতে করে মিরপুরে তার বাসায় আসছিলেন। তাকে আবদুল কাদের মোল্লার হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা অস্বীকার করেছেন আসামিপক্ষ। কিন্তু আক্তার গুণ্ডা এবং স্থানীয় বিহারি কর্তৃক তাকে হত্যার বিষয়টি অবিকৃত রয়ে গেছে।
আসামিপক্ষ ৫ নম্বর সাক্ষীর শোনা কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে সাক্ষী কর্তৃক তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত স্টেটমেন্ট এবং কোর্টে প্রদত্ত জবানবন্দীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় বলেছেন, অবাঙালি আব্দুল হালিম কর্তৃক খন্দকার আবু তালেবকে গাড়িতে করে নিয়ে আসা এবং আবদুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীদের হাতে তুলে দেয়ার কথা তার কাছে বলেননি।
আসামিপক্ষ আরো যুক্তি উপস্থাপন করেছে যে, সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান এবং সৈয়দ আব্দুল কাইউম দু’জনই বলেছেন যে, তারা আবু তালেবকে আবদুল কাদের মোল্লার হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা ড্রাইভার নিজামের কাছে শুনেছেন। কিন্তু সাক্ষী আব্দুল কাইউমও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এ কথা বলেননি। বরং এখানে যে বই প্রদর্শন করা হয়েছে (কবি মেহেরুন্নেসার ওপর লিখিত কাজী রোজীর বই) তাতে দেখা যায়, সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন, আবু তালেবকে বিহারিদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
কাজেই আবু তালেবকে আব্দুল হালিম কর্তৃক মিরপুরে নিয়ে আসা তাকে বিহারি কর্তৃক হত্যার ঘটনা আসামিপক্ষও অস্বীকার করছে না। কিন্তু শোনা সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান তার পিতাকে তুলে দেয়ার বিষয়ে কোর্টে যা বলেছেন তার সাথে অমিল রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত স্টেটমেন্টে। কাজেই আসামিপক্ষের দাবি আবু তালেবকে বিহারিদের হাতে তুলে দেয়ার সাথে কাদের মোল্লার কোনো সংযোগ ছিল না এবং তিনি এ বিষয়ে কোনো ভূমিকা পালন করেননি।
আসামিপক্ষ যুক্তি তুলে ধরে আরো বলে, ১০ নম্বর সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম এ ঘটনা প্রথম শুনেছেন ১৯৭১ সালে ফারুক খানের কাছে এবং এরপর তিনি তা শুনেছেন ১৯৭২ সালে বিহারি নিজাম ড্রাইভারের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, ফারুক খানের কাছে তিনি শুনেছেন আবু তালেবকে বিহারি, আক্তার গুণ্ডা ও কাদের মোল্লা হত্যা করেছে মুসলিম বাজারে। কিন্তু ড্রাইভার নিজাম যেটা বলেছেন তা হলো বিহারিরা এবং আক্তার গুণ্ডা আবু তালেবকে হত্যা করেছে। তার এ কথার সাথে মিল রয়েছে কাজী রোজীর লেখা বইয়ের তথ্যের সাথে। কাজেই কোনটা সত্য এ প্রশ্ন আসামিপক্ষের।
আসামিপক্ষের দাবি পরস্পরবিরোধী শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ৫ নম্বর সাক্ষী তাকে বলেছেন তিনি তার পিতাকে আব্দুল হালিমের গাড়িতে করে নিয়ে আসার ঘটনা অ্যাডভোকেট খলিলের কাছ থেকে শুনেছেন। কাজেই এটা পরস্পরবিরোধী হতে পারে না।
রায়ে বলা হয়েছে, সব ফৌজদারি কেসে মানুষের সাধারণ পর্যবেক্ষণ, সময়ের ব্যবধানে স্মৃতি লোপ পাওয়া, শোকাবহ ঘটনার কারণে মানসিক পীড়ন প্রভৃতি সাক্ষীদের সাক্ষ্যে গোলযোগ ঘটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কাজেই ছোটখাটো বৈপরিত্য, অসামাঞ্জস্য এবং অমিলের কারণে পুরো বিষয়কে বাতিল করা যায় না।
ঘটনার দিন আবু তালেবকে আব্দুল হালিম কর্তৃক গাড়িতে করে নিয়ে আসা, তাকে বিহারিদের হাতে তুলে দেয়া এবং জল্লাদখানায় হত্যার ঘটনা অবিতর্কিত অবস্থায় রয়ে গেছে। ৫ ও ১০ নম্বর সাক্ষীর শোনা কথা বিশ্বাসযোগ্য, প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় এবং এর বিচারিক মূল্য রয়েছে।
রায়ে বলা হয় ২ নম্বর সাক্ষীর (শহিদুর হক মামা) কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি আবদুল কাদের মোল্লার সহযোগী কারা ছিল এবং তাদের সাথে তার কী রকম যোগসাজশ ছিল; বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে। এটা প্রমাণিত যে, ২৫ মার্চের আগে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মিরপুর এলাকায় সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের বর্বরতা ঘটানোর ক্ষেত্রে আবদুল কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল স্থানীয় বিহারি আক্তার গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা, নেহাল, আব্বাস চেয়ারম্যান, হাসিব হাশমি। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর চার দিনের মাথায় ২৯ মার্চ আবু তালেব হত্যার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় বিহারি গুণ্ডাদের সাথে কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠতা, তার ভূমিকা এবং কর্মকাণ্ড বিষয়ে ২ নম্বর সাক্ষীর কাছ থেকে আমরা পরিষ্কার বর্ণনা পেয়েছি। কাজেই আবু তালেব হত্যায় আবদুল কাদের মোল্লা সহযোগিতার বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক।
উপরিউক্ত প্রমাণাদি এবং ৫ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য একত্র করলে দেখা যায় যে, আবদুল কাদের মোল্লা, আক্তার গুণ্ডা এবং কিছু অবাঙালি দুষ্কৃতকারী জল্লাদখানায় ছিল যখন খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আবদুল কাদের মোল্লার সহযোগিতার বিষয়টি ভালোভাবে প্রমাণিত। কাজেই আমরা নিশ্চিত যে, ৫ নম্বর সাক্ষীর শোনা কথার বিচারিক মূল্য রয়েছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক।
রায়ে বলা হয়েছে মিরপুরে ১০ ভাগ বাঙালি ছিল। নিজ বাঙালিদের সহযোগিতার বদলে আবদুল কাদের মোল্লা সব সময় বাঙালিবিদ্বেষী বিহারি গুণ্ডা বিশেষ করে আক্তার গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা, নেহাল এদের সাথে থাকত কেন? তার এ সহযোগিতা বিহারিদের স্বাধীনতাপন্থী বাঙালি নিধনে উৎসাহ জুগিয়েছে।
রায়ে বলা হয়, পারিপার্শ্বিক বিষয় সরাসরি সাক্ষ্যের তুলনায় কম মূল্য বহন করে না। ওপরে যে সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে তাতে আবু তালেব হত্যার ঘটনায় আবদুল কাদের মোল্লার জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে। আক্রমণের বিষয় এবং ধরন থেকে এটা বোঝা যায় যে, এটি ছিল নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণের একটি অংশ। খন্দকার আবু তালেব ছিলেন একজন স্বাধীনতাপন্থী নাগরিক। কাজেই এ হত্যার ঘটনা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আমরা আগেই বলেছি, অপরাধ ঘটানোর সময় অভিযুক্তের সশরীরে হাজির থাকতে হবে বিষয়টি এমন নয়। যদি এটা দেখা যায় যে, তিনি এ ঘটনা ঘটার বিষয়ে জ্ঞাত তাহলে বলা যায় তার এতে অংশগ্রহণ রয়েছে।
জল্লাদখানা জাদুঘরের ডকুমেন্টে যা রয়েছে : শহীদ খন্দকার আবু তালেব, পল্লব ও হযরত আলী হত্যাকাণ্ডসহ আরো অনেক হত্যাকাণ্ড বিষয়ে শহীদ পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের সাক্ষাৎকার, লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। এ ছাড়া লিখিত বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে জল্লাদখানা জাদুঘরে। মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পাম্পহাউজে এনে ১৯৭১ সালে বিহারিরা বাঙালিদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংক ও পার্শ্ববর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্পহাউজটিকে জল্লাদখানা জাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অংশ। জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাৎকার/বক্তব্য রেকর্ড করে তা সংরক্ষণ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
সেখানে শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব সম্পর্কে তার ছেলে খন্দকার আবুল আহসানের বক্তব্য রেকর্ড করা আছেÑ যিনি ট্রাইব্যুনালেও সাক্ষ্য দিয়েছেন। সে রেকর্ডে দেখা যায় খন্দকার আবুল আহসান তার পিতার হত্যার ঘটনার সাথে আবদুল কাদের মোল্লার নামই উল্লেখ করেননি। আসামিপক্ষ জল্লাদখানা জাদুঘরের এ ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন, তবে রায়ে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
এই ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার আগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে খন্দকার আবুল আহসান কর্তৃক আবু তালেব হত্যা ঘটনার যে বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ :
আজ দীর্ঘ ছত্রিশ বছর ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করার সমস্ত পথ পাকিস্তানি হায়েনারা বন্ধ করে দিয়ে এতিম, মাকে করেছেন উন্মাদিনী, পাগল ও বিধবা। একজনের অনুপস্থিতি একটা পরিবারের সহায়-সম্বলহীন করে দেয় তার জ্বলন্ত সাক্ষী এই শহীদ খন্দকার আবু তালেবের পরিবার।
‘আমার বাবা ছিলেন কর্মমুখী, দায়িত্বশীল, পরোপকারী এবং স্বাধীনচেতা একজন মানুষ। জ্ঞানচর্চা তার পছন্দের বিষয় ছিল। আমাদের ভাই-বোনের সাথে তার আচরণ ছিল বন্ধুসুলভ। আমাদেরকে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু বাবাকে হারানোর পর আমাদের সে রকম সুযোগ হয়নি ভালোভাবে পড়ালেখার। আমাদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত কষ্টের। যুদ্ধের সময় দেশে মা ও ভাইবোনকে টাকা পাঠাতাম ঢাকায়…. বিক্রি করে। আমাদের পরনে কাপড় পর্যন্ত ছিল না। আর্থিক দৈন্যের কারণে গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে দেখা করতে হয়েছে। বড় ভাইও অনেক কষ্ট করেছেন। স্বাধীনতার পরপরই তিনি প্রথমে গণ….’৭৪ সালে দৈনিক অবজারভারে চাকরি করে সংসারের ভরণপোষণ করেছেন। কষ্ট করতে করতে উন্মাদিনী মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আর্থিক দৈন্য না কাটলেও আমরা বেঁচে আছি।
কারো কাছে আমাদের কিছু চাওয়ার নেই। সব শহীদ পরিবারের মতো শহীদদের স্বপ্ন….. দেশই আমাদের একান্ত কাম্য।’
খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পিতার হত্যা বিষয়ে। তবে তিনি ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার সাথে বিস্তর গরমিল রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টের। সেখানে খন্দকার আবুল আহসানের দেয়া তার পিতার হত্যার ঘটনার বর্ণনায় সেখানে আবদুল কাদের মোল্লার নামই উল্লেখ করা হয়নি।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-২ আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় দেন। ৩ নম্বর অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান বিষয়ে রায়ে বর্ণিত বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও যুক্তি এখানে তুলে ধরা হলো।
৩ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব তার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে অবস্থিত বাসা থেকে আরামবাগ যাচ্ছিলেন। তিনি মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর ইসলামী ছাত্র সংঘ নেতা আবদুল কাদের মোল্লা অন্যান্য আলবদর সদস্য, রাজাকার এবং দুষ্কৃতকারী এবং বিহারিদের সাথে নিয়ে তাকে ধরে ফেলে। তারা খন্দকার আবু তালেবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্পহাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে সেখানে হত্যা করা হয়। একজন বেসামরিক ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং সহায়তার কারণে তার বিরুদ্ধে আইনে বর্ণিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে ।
সাক্ষী : রায়ে বলা হয় এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ দুইজন সাক্ষী হাজির করেছে। তাদের মধ্যে একজন হলেন খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান (৫ নম্বর সাক্ষী) এবং অপরজন সাক্ষী হলেন খন্দকার আবু তালেবের বন্ধু সৈয়দ আব্দুল কাইউম (১০ নম্বর সাক্ষী)। তারা তখন মিরপুরে থাকতেন। তাদের দু’জনেই এ হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেছেন, দেখেননি।
সাক্ষ্য বিশ্লেষণ : সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, ২৫ মার্চ ইত্তেফাক অফিস গুঁড়িয়ে দেয়ার খবর শুনে তার পিতা খন্দকার আবু তালেব সেখানে যান তার সহকর্মীদের অবস্থা জানতে। তিনি সেখানে কিছু মৃতদেহ দেখতে পান। ২৯ মার্চ তিনি তাদের মিরপুর বাসায় আসছিলেন তার গাড়ি এবং টাকা নেয়ার জন্য। কিন্তু মিরপুর যাওয়ার পথে ইত্তেফাকের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা অবাঙালি আব্দুল হালিমের সাথে দেখা হয় তার। আব্দুল হালিম তাকে পৌঁছে দেয়ার নাম করে তার গাড়িতে ওঠান এবং আবদুল কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে যান। এরপর মিরপুর ১০ জল্লাদখানায় তার পিতাকে আবদুল কাদের মোল্লা হত্যা করে। এ সময় আবদুল কাদের মোল্লার সাথে আক্তার গুণ্ডা এবং আরো অবাঙালি দুষ্কৃৃতকারীরা ছিল।
সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান জেরায় জানান, তিনি অ্যাডভোকেট খলিলের কাছ থেকে শুনেছেন যে, ইত্তেফাকের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আব্দুুল হালিম তার পিতাকে তার গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীদের হাতে তুলে দিয়েছে। জেরায় তিনি আরো বলেন, তাদের অবাঙালি ড্রাইভার নিজাম তাকে বলেছেন যে, আব্দুল হালিম তার পিতাকে আবদুল কাদের মোল্লা এবং তার সঙ্গীদের হাতে তুলে দিয়েছে।
রায়ে বলা হয়, সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসানের জবানবন্দী এবং জেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার পিতাকে গাড়িতে করে আব্দুল হালিম কর্তৃক নিয়ে যাওয়া এবং আবদুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীদের হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা বিষয়ে সাক্ষী যে শোনা কথা বলেছেন তার বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। তিনি যাদের কাছ থেকে তার পিতাকে তুলে নেয়ার ঘটনা শুনেছেন সেই অ্যাডভোকেট খলিল এবং নিজাম ড্রাইভার কেউ জীবিত নেই।
সাক্ষী বলেছেন, তিনি নিজে তার পিতার হত্যার ঘটনা দেখেননি এবং তখনকার পরিস্থিতিতে সীমিত কিছু বাঙালি লোক ছাড়া এটা দেখা সম্ভব ছিল না। এটা থেকে তখনকার ভয়াবহ পরিস্থিতি বোঝা যায় এবং খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার ঘটনা দেখা বিষয়ে সরাসরি সাক্ষী পাওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে বলে রায়ে বলা হয়।
রায়ে বলা হয়, সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান আরো জানান যে, তিনি তাদের ড্রাইভার নিজামের কাছে শুনেছেন ১৯৭০-এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর কাদের মোল্লার নির্দেশে মিরপুরে মুসলিম বাজার, শিয়ালবাড়ি, জল্লাদখানায় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।
১০ নম্বর সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম মিরপুরের বাসিন্দা এবং খন্দকার আবু তালেবের বন্ধু ছিলেন। সৈয়দ আব্দুল কাইউম ২৩ মার্চ হামলায় আহত হন এবং তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে ২৭ মার্চ তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যান। সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন, জুন মাসে ফারুক খান তাকে তার গ্রামের বাড়ি নাসিরনগরে দেখতে আসেন। ফারুক খানের কাছে তিনি শুনেছেন যে, স্থানীয় আক্তার গুণ্ডা, বিহারি এবং কাদের মোল্লা তালেব সাহেবকে হত্যা করেছে মিপুর ১০ নম্বর জল্লাদখানায়। এ ছাড়া তালেব সাহেবের ড্রাইভার নিজামের কাছ থেকেও তিনি শুনেছেন যে, খন্দকার আবু তালেব মিরপুরে তার বাসায় আসার পথে ইত্তেফাকের অবাঙালি হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আব্দুল হালিম তাকে বিহারিদের হাতে তুলে দেয় যারা তাকে মিরপুর ১০ নম্বর জল্লাদখানায় হত্যা করে।
সাক্ষ্য মূল্যায়ন : রায়ে বলা হয় খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুর ১০ নম্বর জল্লাদখানায় হত্যার ঘটনা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ৫ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমাণিত যে, খন্দকার আবু তালেব ২৯ মার্চ ইত্তেফাকের অবাঙালি অ্যাকাউনট্যান্ট আব্দুল হালিমের গাড়িতে করে মিরপুরে তার বাসায় আসছিলেন। তাকে আবদুল কাদের মোল্লার হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা অস্বীকার করেছেন আসামিপক্ষ। কিন্তু আক্তার গুণ্ডা এবং স্থানীয় বিহারি কর্তৃক তাকে হত্যার বিষয়টি অবিকৃত রয়ে গেছে।
আসামিপক্ষ ৫ নম্বর সাক্ষীর শোনা কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে সাক্ষী কর্তৃক তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত স্টেটমেন্ট এবং কোর্টে প্রদত্ত জবানবন্দীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় বলেছেন, অবাঙালি আব্দুল হালিম কর্তৃক খন্দকার আবু তালেবকে গাড়িতে করে নিয়ে আসা এবং আবদুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীদের হাতে তুলে দেয়ার কথা তার কাছে বলেননি।
আসামিপক্ষ আরো যুক্তি উপস্থাপন করেছে যে, সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান এবং সৈয়দ আব্দুল কাইউম দু’জনই বলেছেন যে, তারা আবু তালেবকে আবদুল কাদের মোল্লার হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা ড্রাইভার নিজামের কাছে শুনেছেন। কিন্তু সাক্ষী আব্দুল কাইউমও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এ কথা বলেননি। বরং এখানে যে বই প্রদর্শন করা হয়েছে (কবি মেহেরুন্নেসার ওপর লিখিত কাজী রোজীর বই) তাতে দেখা যায়, সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন, আবু তালেবকে বিহারিদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
কাজেই আবু তালেবকে আব্দুল হালিম কর্তৃক মিরপুরে নিয়ে আসা তাকে বিহারি কর্তৃক হত্যার ঘটনা আসামিপক্ষও অস্বীকার করছে না। কিন্তু শোনা সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান তার পিতাকে তুলে দেয়ার বিষয়ে কোর্টে যা বলেছেন তার সাথে অমিল রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত স্টেটমেন্টে। কাজেই আসামিপক্ষের দাবি আবু তালেবকে বিহারিদের হাতে তুলে দেয়ার সাথে কাদের মোল্লার কোনো সংযোগ ছিল না এবং তিনি এ বিষয়ে কোনো ভূমিকা পালন করেননি।
আসামিপক্ষ যুক্তি তুলে ধরে আরো বলে, ১০ নম্বর সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম এ ঘটনা প্রথম শুনেছেন ১৯৭১ সালে ফারুক খানের কাছে এবং এরপর তিনি তা শুনেছেন ১৯৭২ সালে বিহারি নিজাম ড্রাইভারের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, ফারুক খানের কাছে তিনি শুনেছেন আবু তালেবকে বিহারি, আক্তার গুণ্ডা ও কাদের মোল্লা হত্যা করেছে মুসলিম বাজারে। কিন্তু ড্রাইভার নিজাম যেটা বলেছেন তা হলো বিহারিরা এবং আক্তার গুণ্ডা আবু তালেবকে হত্যা করেছে। তার এ কথার সাথে মিল রয়েছে কাজী রোজীর লেখা বইয়ের তথ্যের সাথে। কাজেই কোনটা সত্য এ প্রশ্ন আসামিপক্ষের।
আসামিপক্ষের দাবি পরস্পরবিরোধী শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, ৫ নম্বর সাক্ষী তাকে বলেছেন তিনি তার পিতাকে আব্দুল হালিমের গাড়িতে করে নিয়ে আসার ঘটনা অ্যাডভোকেট খলিলের কাছ থেকে শুনেছেন। কাজেই এটা পরস্পরবিরোধী হতে পারে না।
রায়ে বলা হয়েছে, সব ফৌজদারি কেসে মানুষের সাধারণ পর্যবেক্ষণ, সময়ের ব্যবধানে স্মৃতি লোপ পাওয়া, শোকাবহ ঘটনার কারণে মানসিক পীড়ন প্রভৃতি সাক্ষীদের সাক্ষ্যে গোলযোগ ঘটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কাজেই ছোটখাটো বৈপরিত্য, অসামাঞ্জস্য এবং অমিলের কারণে পুরো বিষয়কে বাতিল করা যায় না।
ঘটনার দিন আবু তালেবকে আব্দুল হালিম কর্তৃক গাড়িতে করে নিয়ে আসা, তাকে বিহারিদের হাতে তুলে দেয়া এবং জল্লাদখানায় হত্যার ঘটনা অবিতর্কিত অবস্থায় রয়ে গেছে। ৫ ও ১০ নম্বর সাক্ষীর শোনা কথা বিশ্বাসযোগ্য, প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় এবং এর বিচারিক মূল্য রয়েছে।
রায়ে বলা হয় ২ নম্বর সাক্ষীর (শহিদুর হক মামা) কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি আবদুল কাদের মোল্লার সহযোগী কারা ছিল এবং তাদের সাথে তার কী রকম যোগসাজশ ছিল; বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে। এটা প্রমাণিত যে, ২৫ মার্চের আগে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মিরপুর এলাকায় সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের বর্বরতা ঘটানোর ক্ষেত্রে আবদুল কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল স্থানীয় বিহারি আক্তার গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা, নেহাল, আব্বাস চেয়ারম্যান, হাসিব হাশমি। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর চার দিনের মাথায় ২৯ মার্চ আবু তালেব হত্যার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় বিহারি গুণ্ডাদের সাথে কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠতা, তার ভূমিকা এবং কর্মকাণ্ড বিষয়ে ২ নম্বর সাক্ষীর কাছ থেকে আমরা পরিষ্কার বর্ণনা পেয়েছি। কাজেই আবু তালেব হত্যায় আবদুল কাদের মোল্লা সহযোগিতার বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক।
উপরিউক্ত প্রমাণাদি এবং ৫ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য একত্র করলে দেখা যায় যে, আবদুল কাদের মোল্লা, আক্তার গুণ্ডা এবং কিছু অবাঙালি দুষ্কৃতকারী জল্লাদখানায় ছিল যখন খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আবদুল কাদের মোল্লার সহযোগিতার বিষয়টি ভালোভাবে প্রমাণিত। কাজেই আমরা নিশ্চিত যে, ৫ নম্বর সাক্ষীর শোনা কথার বিচারিক মূল্য রয়েছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক।
রায়ে বলা হয়েছে মিরপুরে ১০ ভাগ বাঙালি ছিল। নিজ বাঙালিদের সহযোগিতার বদলে আবদুল কাদের মোল্লা সব সময় বাঙালিবিদ্বেষী বিহারি গুণ্ডা বিশেষ করে আক্তার গুণ্ডা, হাক্কা গুণ্ডা, নেহাল এদের সাথে থাকত কেন? তার এ সহযোগিতা বিহারিদের স্বাধীনতাপন্থী বাঙালি নিধনে উৎসাহ জুগিয়েছে।
রায়ে বলা হয়, পারিপার্শ্বিক বিষয় সরাসরি সাক্ষ্যের তুলনায় কম মূল্য বহন করে না। ওপরে যে সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে তাতে আবু তালেব হত্যার ঘটনায় আবদুল কাদের মোল্লার জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে। আক্রমণের বিষয় এবং ধরন থেকে এটা বোঝা যায় যে, এটি ছিল নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণের একটি অংশ। খন্দকার আবু তালেব ছিলেন একজন স্বাধীনতাপন্থী নাগরিক। কাজেই এ হত্যার ঘটনা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আমরা আগেই বলেছি, অপরাধ ঘটানোর সময় অভিযুক্তের সশরীরে হাজির থাকতে হবে বিষয়টি এমন নয়। যদি এটা দেখা যায় যে, তিনি এ ঘটনা ঘটার বিষয়ে জ্ঞাত তাহলে বলা যায় তার এতে অংশগ্রহণ রয়েছে।
জল্লাদখানা জাদুঘরের ডকুমেন্টে যা রয়েছে : শহীদ খন্দকার আবু তালেব, পল্লব ও হযরত আলী হত্যাকাণ্ডসহ আরো অনেক হত্যাকাণ্ড বিষয়ে শহীদ পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের সাক্ষাৎকার, লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। এ ছাড়া লিখিত বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে জল্লাদখানা জাদুঘরে। মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পাম্পহাউজে এনে ১৯৭১ সালে বিহারিরা বাঙালিদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংক ও পার্শ্ববর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্পহাউজটিকে জল্লাদখানা জাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অংশ। জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাৎকার/বক্তব্য রেকর্ড করে তা সংরক্ষণ করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
সেখানে শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব সম্পর্কে তার ছেলে খন্দকার আবুল আহসানের বক্তব্য রেকর্ড করা আছেÑ যিনি ট্রাইব্যুনালেও সাক্ষ্য দিয়েছেন। সে রেকর্ডে দেখা যায় খন্দকার আবুল আহসান তার পিতার হত্যার ঘটনার সাথে আবদুল কাদের মোল্লার নামই উল্লেখ করেননি। আসামিপক্ষ জল্লাদখানা জাদুঘরের এ ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন, তবে রায়ে এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
এই ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার আগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে খন্দকার আবুল আহসান কর্তৃক আবু তালেব হত্যা ঘটনার যে বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ :
আজ দীর্ঘ ছত্রিশ বছর ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করার সমস্ত পথ পাকিস্তানি হায়েনারা বন্ধ করে দিয়ে এতিম, মাকে করেছেন উন্মাদিনী, পাগল ও বিধবা। একজনের অনুপস্থিতি একটা পরিবারের সহায়-সম্বলহীন করে দেয় তার জ্বলন্ত সাক্ষী এই শহীদ খন্দকার আবু তালেবের পরিবার।
‘আমার বাবা ছিলেন কর্মমুখী, দায়িত্বশীল, পরোপকারী এবং স্বাধীনচেতা একজন মানুষ। জ্ঞানচর্চা তার পছন্দের বিষয় ছিল। আমাদের ভাই-বোনের সাথে তার আচরণ ছিল বন্ধুসুলভ। আমাদেরকে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু বাবাকে হারানোর পর আমাদের সে রকম সুযোগ হয়নি ভালোভাবে পড়ালেখার। আমাদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত কষ্টের। যুদ্ধের সময় দেশে মা ও ভাইবোনকে টাকা পাঠাতাম ঢাকায়…. বিক্রি করে। আমাদের পরনে কাপড় পর্যন্ত ছিল না। আর্থিক দৈন্যের কারণে গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে দেখা করতে হয়েছে। বড় ভাইও অনেক কষ্ট করেছেন। স্বাধীনতার পরপরই তিনি প্রথমে গণ….’৭৪ সালে দৈনিক অবজারভারে চাকরি করে সংসারের ভরণপোষণ করেছেন। কষ্ট করতে করতে উন্মাদিনী মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আর্থিক দৈন্য না কাটলেও আমরা বেঁচে আছি।
কারো কাছে আমাদের কিছু চাওয়ার নেই। সব শহীদ পরিবারের মতো শহীদদের স্বপ্ন….. দেশই আমাদের একান্ত কাম্য।’
No comments