মিসরে হুমকির মুখে গণতন্ত্র by মহীউদ্দীন আহমদ
স্বস্তিতে নেই মিসরের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি। আবারো কঠিন চ্যালেঞ্জের
মুখে পড়লেন তিনি। স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের ক্ষমতা ছাড়ার দুই বছর পূর্তি
উপলক্ষে মিসরজুড়ে হয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশ।
কয়েক দিন ধরেই
উত্তপ্ত ছিল কায়রোসহ কয়েকটি শহর। একই সময়ে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে
দেখা দিলো ফুটবল দাঙ্গা মামলার রায়। মিসরের একটি আদালত ফুটবল কাব আল
মাসরির ২১ জন সমর্থককে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের
বাইরে চলে যায়। গত বছর পোর্টসাঈদের ওই দাঙ্গায় কায়রোর আল আহলি কাবের ৭৪
জন সমর্থক প্রাণ হারিয়েছিলেন। আল মাসরির সমর্থকেরা প্রতিবাদ শুরু করলে
সহিংসতা অতি দ্রুত সুয়েজ, ইসমাইলিয়া ও পোর্টসাঈদে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের
সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে উচ্ছৃঙ্খল লোকজন। সহিংসতা এড়াতে দ্রুত
হস্তক্ষেপ করেন প্রেসিডেন্ট মুরসি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন শহরে
জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং সান্ধ্যকালীন কারফিউ জারি করতে হয়েছে। কিন্তু
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে পড়তে দেখা
গিয়েছে জনতাকে। সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীও নামানো হয়। কয়েক
দিনের দাঙ্গা ও বিক্ষোভে ৬০ জনের বেশি নিহত হয়েছে। কায়রোসহ বিভিন্ন শহরে
এখনো বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পর্যন্ত হামলা
চালিয়েছে; বোমা নিক্ষেপ করেছে। আদালতের রায় নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, বলা
হচ্ছে, মোবারকের অনুগত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা আদালতকে প্রভাবিত
করেছে এ ধরনের রায় দেয়ার জন্য। জনপ্রিয় ফুটবল খেলার প্রাক্কালে সৃষ্ট
দাঙ্গায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি জনপ্রিয় ফুটবল টিমের সমর্থকদের
মৃত্যুদণ্ড দেয়ার এহেন নজির বিরল। সবকিছু ঘটেছে প্রেসিডেন্ট মুরসির
শাসনামলে আর তাই ক্ষোভের আগুন এখন তারই বিরুদ্ধে।
এমনিতেই, ক্ষমতা গ্রহণের পর নানা সঙ্কটে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট মুরসি। সংবিধান কার্যকর করার আগ পর্যন্ত নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে জারি করা একটি ডিক্রিকে কেন্দ্র করে সব বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির প্রচণ্ড প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে পড়ে যান তিনি। তা থেকে কোনো রকম বেঁচে গেছেন গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে। তখনো আশঙ্কা করা হয়েছিল এই বিরোধের পরিসমাপ্তি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, বলা দুষ্কর। তাকে ‘নতুন স্বৈরাচারী’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে এবং বামপন্থীরা এতে সফলও হয়েছেন অথচ বাস্তবতা হলো, সংবিধান কার্যকর এবং নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে প্রেসিডেন্টের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। উদ্ধারপন্থী ও বামপন্থীরা আসলে কোনো গঠনমূলক সমাধানে আসতে রাজি নন। তাই তারা বেছে নিয়েছেন সহিংসতার পথ। আর তাদের কর্মকাণ্ডে সাহস জুগিয়েছে পক্ষপাতদুষ্ট আদালতি ব্যবস্থা। বিচার বিভাগও যেন মুরসিকে স্বস্তিতে থাকতে দিতে রাজি নয়। মিসরের আদালতগুলোর বাড়াবাড়ি আর রাজনৈতিক আচরণ মিসরের নির্বাচিত সরকারের জন্য বড় একটি সমস্যা। এ দিকে দেশ পরিচালনায় প্রেসিডেন্ট মুরসির ভূমিকা নিয়ে মিসরের মাঝে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেক সাধারণ মানুষের ধারণা, প্রেসিডেন্ট বিপ্লবের মূল চেতনার অনুসরণ না করে দলীয় আদর্শ ও চিন্তাধারা থেকে দেশকে অনিশ্চয়তার পথে নিয়ে যাচ্ছেন। ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী রাজনীতিবিদেরা শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট মুরসির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং জনমত সেভাবে গড়ে তুলতে বিশেষ প্রয়াস চালিয়েছেন। মিসরের মিডিয়াগুলো সুবিধাবাদী বামপন্থী ও মোবারকপন্থীদের দখলে। ফলে প্রচার ও প্রোপাগান্ডার বাজারে বড়ই নাজুক অবস্থানে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট মুরসি ও ব্রাদারহুড। অবশ্য এই বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে যে, সব মিলিয়ে মিসরের জনমত দ্বিধাবিভক্ত। মিসরের সমাজ সুস্পষ্টভাবে দুই শিবিরে অবস্থান করছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে জনসমর্থন প্রায় সমান সমান। এহেন দ্বিধাবিভক্ত সমাজে প্রেসিডেন্টের প্রতিটি কার্যক্রমের আলোচনা ও সমালোচনা হবেই। জনগণ প্রেসিডেন্টের কার্যক্রমের মূল্যায়ন করবে নিজস্ব ধ্যান ধারণা থেকে। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশটির ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারছেন না। ফলে তার সাথে বিরোধীদের দূরত্ব বাড়ছেই।
আগামী মাসে মিসরে পার্লামেন্ট নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে সহিংসতা কাটিয়ে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান মুরসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। চলমান সঙ্কট সাম্প্রতিক গণভোট সময়কালীন পরিস্থিতির দিকে গড়ালে তা দেশের জন্য ভালো হবে না মোটেই। কেননা পার্লামেন্ট নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বিরোধীরা প্রেসিডেন্টের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না। ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার দিকে গড়াচ্ছে মিসর। অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা চাই। উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে মুরসি শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। আল বারাদি দাবি জানিয়েছেন সংলাপের আগে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের। সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হামদান সাবাহি অবশ্য বলেছেন, আমরাও সংলাপ চাই; কিন্তু সংলাপ যে সফল হবে তার নিশ্চয়তা নেই। অন্য দিকে ‘উদারপন্থী’ বলে পরিচিত বিরোধী নেতা আইমান নূর সংলাপে অংশগ্রহণ করেছেন। সংলাপের প্রস্তাব প্রধান বিরোধী দলগুলো প্রত্যাখ্যান করায় রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা আবারো তাহরির স্কোয়ার ও প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিক্ষোভ করছে। এসব বিক্ষোভকে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। জনগণ বিভ্রান্তিতে ভুগছে। সমাজের একটি বড় অংশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিরাজমান অস্থিরতা ও দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আবুল ফাত্তাহ আল সিমি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব ও মতভেদের কারণে মিসরে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এতে হুমকির মধ্যে পড়বে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তিনি সব পক্ষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, মিসর যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে তা দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য মঙ্গলজনক নয়। মিসরের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এ ধরনের রক্তপাত গ্রহণযোগ্য নয়। এ দিকে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট মুরসি বলেন, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আমি। তবে এ কথাও বলছি রক্তপাত বন্ধ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে এখন আমাকে এ ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। তিনি সহিংসতা দমনে প্রয়োজনে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ারও ঘোষণা দেন। এ দিকে বিরোধী জোট বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় জরুরি অবস্থার ছত্রচ্ছায়ায় আরো রক্তপাত ঘটলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশ্ন রয়েছে। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি রয়েছে ঠিকই। তবে তারা জনগণের ওপর চড়াও হবে না। ‘আরব বিপ্লবের শুরুতে সেনাবাহিনী বৈরী ভূমিকা রাখলেও পরে তারা জনগণের পক্ষেই ছিল। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান সরাসরি কোনো সংঘর্ষে জড়াতে চাইবেন না। মুরসিরও উচিত হবে না সেনাবাহিনীকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করা। বর্তমান পরিস্থিতির দাবি হলো, মুরসিকে অবশ্যই বিরোধী জোটের সাথে সংলাপে বসার সম্ভাব্য সব পথ অনুসরণ করতে হবে। প্রয়োজনে ছাড় দিয়ে হলেও তাদের সাথে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। অপর দিকে, সংলাপের আগে ঐকমত্যের সরকার গঠনের দাবি বাস্তবসম্মত নয়। তবুও জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে এবং মার্চে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সব পথই খোলা রাখতে হবে। মিসর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের কাজই হচ্ছে সঙ্কট উত্তরণে সম্ভাব্য সব পন্থা অনুসরণ করা। মুরসির পদত্যাগের দাবি জোরালো আকার ধারণ করার আগেই বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসার পথ খুলতে হবে। একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের এত দ্রুত পদত্যাগের দাবি ওঠাও রীতিমতো উদ্বেগজনক। এতে বিরোধী দলের অসহিষ্ণু মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটে। মিসরের জনগণ রাজনৈতিক কালচারে অভ্যন্ত নয়। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের কারণে তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সহনশীলতা গড়ে ওঠেনি, মনে হয়। প্রতিবাদের ভাষা তারা রপ্ত করেছে তাহরির স্কোয়ার থেকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। ৪০টি দল, মতাদর্শের গরমিল, নেতৃত্বের সঙ্কট সর্বোপরি গণতান্ত্রিক আচরণে অভ্যস্ত না হওয়ায় সমাজে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মোবারকবিরোধী বিপ্লবের চেতনা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ‘মোবারকবিরোধী চেতনা’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নির্বাচিত সরকার, সবার অধিকার কায়েম ও সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিই যদি মোবারকবিরোধী চেতনা হয়ে থাকে তাহলে ব্রাদারহুড সেটা ‘হাইজ্যাক’ করল কিভাবে? মুসলিম ব্রাদারহুড জন্মাবধি জনকল্যাণে কাজ করলেও আজ তারা সরকারে বসে সম্ভবত জনগণকে তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। নারীর সমঅধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামিকীকরণের বিষয়ে যে বক্তব্য বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসছে তা মূলত বিভ্রান্তিমূলক। সেকুলারপন্থীরা মিসরের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এবং প্রচারমাধ্যমে জেঁকে বসে আছে। আর তাই এদের মোকাবেলা করে উঠতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন মুরসি ও তার দল। নির্বাচনের আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ এবং কপ্টিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার দায়ভার নিতে হচ্ছে মুরসিকে। চলমান অস্থিরতার পেছনে দেশটির ভেতর ও বাইরের শক্তি তৎপর। তারা ব্রাদারহুডের সাফল্য চায় না, অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চায় মিসরের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে। পর্দার অন্তরালে, তারা হয়তো আবারো সেনাশাসন চায়। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান এবং সরকার গঠন অনেকেরই পছন্দ নয়। তাদের ভয়, পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোয় এর প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এমনিতেই ব্রাদারহুডের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাদের মতাদর্শের কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, কেউ ক্ষমতার কাছাকাছি। বিষয়টিকে বৃহৎশক্তিসহ কায়েমি স্বার্থবাদী অনেক আরব দেশ মেনে নিতে রাজি নয়। এমন বাস্তবতায় ড. মুরসিকে সতর্কভাবে অগ্রসর হতে হবে। যারা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তারা মূলত রাজনীতি থেকে ব্রাদারহুডকে বিতাড়িত করার স্বপ্ন দেখছেন। রাতারাতি মিসরে কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না, এটাও প্রমাণিত হয়েছে। চলমান আন্দোলন সফল হলে মিসরে বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক অর্জন বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়বে। তাই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ড. মুরসি ও ব্রাদারহুডকে সফলকাম হতেই হবে নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সাথে।
এমনিতেই, ক্ষমতা গ্রহণের পর নানা সঙ্কটে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট মুরসি। সংবিধান কার্যকর করার আগ পর্যন্ত নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে জারি করা একটি ডিক্রিকে কেন্দ্র করে সব বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির প্রচণ্ড প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে পড়ে যান তিনি। তা থেকে কোনো রকম বেঁচে গেছেন গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে। তখনো আশঙ্কা করা হয়েছিল এই বিরোধের পরিসমাপ্তি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, বলা দুষ্কর। তাকে ‘নতুন স্বৈরাচারী’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে এবং বামপন্থীরা এতে সফলও হয়েছেন অথচ বাস্তবতা হলো, সংবিধান কার্যকর এবং নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে প্রেসিডেন্টের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল। উদ্ধারপন্থী ও বামপন্থীরা আসলে কোনো গঠনমূলক সমাধানে আসতে রাজি নন। তাই তারা বেছে নিয়েছেন সহিংসতার পথ। আর তাদের কর্মকাণ্ডে সাহস জুগিয়েছে পক্ষপাতদুষ্ট আদালতি ব্যবস্থা। বিচার বিভাগও যেন মুরসিকে স্বস্তিতে থাকতে দিতে রাজি নয়। মিসরের আদালতগুলোর বাড়াবাড়ি আর রাজনৈতিক আচরণ মিসরের নির্বাচিত সরকারের জন্য বড় একটি সমস্যা। এ দিকে দেশ পরিচালনায় প্রেসিডেন্ট মুরসির ভূমিকা নিয়ে মিসরের মাঝে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেক সাধারণ মানুষের ধারণা, প্রেসিডেন্ট বিপ্লবের মূল চেতনার অনুসরণ না করে দলীয় আদর্শ ও চিন্তাধারা থেকে দেশকে অনিশ্চয়তার পথে নিয়ে যাচ্ছেন। ধর্মনিরপেক্ষ ও বামপন্থী রাজনীতিবিদেরা শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট মুরসির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং জনমত সেভাবে গড়ে তুলতে বিশেষ প্রয়াস চালিয়েছেন। মিসরের মিডিয়াগুলো সুবিধাবাদী বামপন্থী ও মোবারকপন্থীদের দখলে। ফলে প্রচার ও প্রোপাগান্ডার বাজারে বড়ই নাজুক অবস্থানে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট মুরসি ও ব্রাদারহুড। অবশ্য এই বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে যে, সব মিলিয়ে মিসরের জনমত দ্বিধাবিভক্ত। মিসরের সমাজ সুস্পষ্টভাবে দুই শিবিরে অবস্থান করছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে জনসমর্থন প্রায় সমান সমান। এহেন দ্বিধাবিভক্ত সমাজে প্রেসিডেন্টের প্রতিটি কার্যক্রমের আলোচনা ও সমালোচনা হবেই। জনগণ প্রেসিডেন্টের কার্যক্রমের মূল্যায়ন করবে নিজস্ব ধ্যান ধারণা থেকে। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশটির ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারছেন না। ফলে তার সাথে বিরোধীদের দূরত্ব বাড়ছেই।
আগামী মাসে মিসরে পার্লামেন্ট নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে সহিংসতা কাটিয়ে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান মুরসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। চলমান সঙ্কট সাম্প্রতিক গণভোট সময়কালীন পরিস্থিতির দিকে গড়ালে তা দেশের জন্য ভালো হবে না মোটেই। কেননা পার্লামেন্ট নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বিরোধীরা প্রেসিডেন্টের ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না। ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থার দিকে গড়াচ্ছে মিসর। অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা চাই। উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে মুরসি শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। আল বারাদি দাবি জানিয়েছেন সংলাপের আগে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের। সাবেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হামদান সাবাহি অবশ্য বলেছেন, আমরাও সংলাপ চাই; কিন্তু সংলাপ যে সফল হবে তার নিশ্চয়তা নেই। অন্য দিকে ‘উদারপন্থী’ বলে পরিচিত বিরোধী নেতা আইমান নূর সংলাপে অংশগ্রহণ করেছেন। সংলাপের প্রস্তাব প্রধান বিরোধী দলগুলো প্রত্যাখ্যান করায় রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা আবারো তাহরির স্কোয়ার ও প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিক্ষোভ করছে। এসব বিক্ষোভকে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। জনগণ বিভ্রান্তিতে ভুগছে। সমাজের একটি বড় অংশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিরাজমান অস্থিরতা ও দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল আবুল ফাত্তাহ আল সিমি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব ও মতভেদের কারণে মিসরে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এতে হুমকির মধ্যে পড়বে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তিনি সব পক্ষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, মিসর যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে তা দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য মঙ্গলজনক নয়। মিসরের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এ ধরনের রক্তপাত গ্রহণযোগ্য নয়। এ দিকে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট মুরসি বলেন, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আমি। তবে এ কথাও বলছি রক্তপাত বন্ধ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে এখন আমাকে এ ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। তিনি সহিংসতা দমনে প্রয়োজনে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ারও ঘোষণা দেন। এ দিকে বিরোধী জোট বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় জরুরি অবস্থার ছত্রচ্ছায়ায় আরো রক্তপাত ঘটলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশ্ন রয়েছে। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি রয়েছে ঠিকই। তবে তারা জনগণের ওপর চড়াও হবে না। ‘আরব বিপ্লবের শুরুতে সেনাবাহিনী বৈরী ভূমিকা রাখলেও পরে তারা জনগণের পক্ষেই ছিল। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান সরাসরি কোনো সংঘর্ষে জড়াতে চাইবেন না। মুরসিরও উচিত হবে না সেনাবাহিনীকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করা। বর্তমান পরিস্থিতির দাবি হলো, মুরসিকে অবশ্যই বিরোধী জোটের সাথে সংলাপে বসার সম্ভাব্য সব পথ অনুসরণ করতে হবে। প্রয়োজনে ছাড় দিয়ে হলেও তাদের সাথে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। অপর দিকে, সংলাপের আগে ঐকমত্যের সরকার গঠনের দাবি বাস্তবসম্মত নয়। তবুও জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে এবং মার্চে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সব পথই খোলা রাখতে হবে। মিসর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের কাজই হচ্ছে সঙ্কট উত্তরণে সম্ভাব্য সব পন্থা অনুসরণ করা। মুরসির পদত্যাগের দাবি জোরালো আকার ধারণ করার আগেই বিরোধী দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসার পথ খুলতে হবে। একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের এত দ্রুত পদত্যাগের দাবি ওঠাও রীতিমতো উদ্বেগজনক। এতে বিরোধী দলের অসহিষ্ণু মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটে। মিসরের জনগণ রাজনৈতিক কালচারে অভ্যন্ত নয়। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের কারণে তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও সহনশীলতা গড়ে ওঠেনি, মনে হয়। প্রতিবাদের ভাষা তারা রপ্ত করেছে তাহরির স্কোয়ার থেকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। ৪০টি দল, মতাদর্শের গরমিল, নেতৃত্বের সঙ্কট সর্বোপরি গণতান্ত্রিক আচরণে অভ্যস্ত না হওয়ায় সমাজে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মোবারকবিরোধী বিপ্লবের চেতনা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ‘মোবারকবিরোধী চেতনা’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নির্বাচিত সরকার, সবার অধিকার কায়েম ও সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিই যদি মোবারকবিরোধী চেতনা হয়ে থাকে তাহলে ব্রাদারহুড সেটা ‘হাইজ্যাক’ করল কিভাবে? মুসলিম ব্রাদারহুড জন্মাবধি জনকল্যাণে কাজ করলেও আজ তারা সরকারে বসে সম্ভবত জনগণকে তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। নারীর সমঅধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামিকীকরণের বিষয়ে যে বক্তব্য বিভিন্ন মহল থেকে উঠে আসছে তা মূলত বিভ্রান্তিমূলক। সেকুলারপন্থীরা মিসরের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এবং প্রচারমাধ্যমে জেঁকে বসে আছে। আর তাই এদের মোকাবেলা করে উঠতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন মুরসি ও তার দল। নির্বাচনের আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি মোতাবেক একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ এবং কপ্টিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার দায়ভার নিতে হচ্ছে মুরসিকে। চলমান অস্থিরতার পেছনে দেশটির ভেতর ও বাইরের শক্তি তৎপর। তারা ব্রাদারহুডের সাফল্য চায় না, অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চায় মিসরের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে। পর্দার অন্তরালে, তারা হয়তো আবারো সেনাশাসন চায়। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান এবং সরকার গঠন অনেকেরই পছন্দ নয়। তাদের ভয়, পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোয় এর প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এমনিতেই ব্রাদারহুডের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাদের মতাদর্শের কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, কেউ ক্ষমতার কাছাকাছি। বিষয়টিকে বৃহৎশক্তিসহ কায়েমি স্বার্থবাদী অনেক আরব দেশ মেনে নিতে রাজি নয়। এমন বাস্তবতায় ড. মুরসিকে সতর্কভাবে অগ্রসর হতে হবে। যারা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তারা মূলত রাজনীতি থেকে ব্রাদারহুডকে বিতাড়িত করার স্বপ্ন দেখছেন। রাতারাতি মিসরে কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না, এটাও প্রমাণিত হয়েছে। চলমান আন্দোলন সফল হলে মিসরে বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক অর্জন বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়বে। তাই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ড. মুরসি ও ব্রাদারহুডকে সফলকাম হতেই হবে নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সাথে।
No comments