সাগর-রুনি হত্যার কারণ জানা যায়নি এক বছরেও by আবু সালেহ আকন
আজ ১১ ফেব্রুয়ারি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের এক বছর। এক
বছরেও এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি র্যাব-পুলিশ।
তৎকালীন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম, আইজিপির প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতির
গল্প, ডিএমপি কমিশনারের পুলিশের প্রতি আস্থা আবেদন, ডিএমপির মুখপাত্রের
‘শিগগিরই ভালো খবর দেয়া’র ওয়াদাÑ কোনোই কাজে আসেনি। র্যাবের ডিজি
সর্বশেষ গত শনিবার বলেছেন, আরো অপেক্ষা করতে হবে খুনের রহস্য জানতে। এ দিকে
এক বছরেও খুনের রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় এবং আসল খুনি গ্রেফতার না
হওয়ায় হতাশ সাগর-রুনির পরিবার, বন্ধু-সহকর্মী এবং সাংবাদিকসমাজ। আজ বেলা
১১টায় এই হত্যার বিচার চেয়ে জাতীয় প্রেস কাবের সামনে সমাবেশ করবে
সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো।
গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর রাজাবাজারের ওই বাসায় যান তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার এবং র্যাবের ডিজিসহ সরকার ও প্রশাসনের অনেক কর্তাব্যক্তি। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইমাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই রহস্য উদঘাটনের চেষ্টায় আছে পুলিশ।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া সময় শেষ হওয়ার পর ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুলিশ সদরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘মামলার তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া সময়ের ব্যাপারে আইজিপি বলেন, ‘বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে শতভাগ কাজ করা সব সময় সম্ভব হয় না।’ ওই দিন তিনি বলেছিলেন, আশা করছি শিগগির ইতিবাচক কিছু খবর দেয়া যাবে। তদন্তে ইতিবাচক অগ্রগতি পাওয়া গেছে। তদন্তকাজে পুলিশের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।
নিজের বেঁধে দেয়া সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি কোস্টগার্ডের ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠান শেষে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা অপেক্ষা করুন, যেকোনো সময় সুখবর শুনতে পাবেন। তদন্তকাজে অগ্রগতি হয়েছে। সেখানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তকাজ যেন দ্রুত হয় সে জন্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ওই দিন আইজিপি বলেন, তদন্তকাজ চলছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি গেন্ডারিয়া মিলব্যারাক শুটিং রেঞ্জের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হবেই। ওই সময় তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কাউকে বাঁচাতে আসল ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে কি না। জবাবে মন্ত্রী বলেছিলেন ‘আমি মামলাটি মনিটরিং করছি। কারো চাপ বা প্রভাবে এ মামলা ধামাচাপা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। দোষীদের আড়াল করতে প্রভাবশালী কারো চাপ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে প্রভাবশালী আর কে আছেন? তিনি নিজেই মামলার বিষয়টি তদারকি করছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। আর তাই পুলিশ মামলাটি ধামাচাপা দিতে পারে না। এমনকি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাও করবে না।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আশ্বস্ত করতে চাই, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হবেই।’
এরই মধ্যে এক দিন প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের ওপর আস্থা রাখুন।
২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ দিকে ২৮ ফেব্রুয়ারি এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে অগ্রগতির সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে না দিতে পুলিশের প্রতি নির্দেশ দেন। এরপরই পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথম দিকে মামলা তদন্তের দায়িত্ব শেরেবাংলা থানা পুলিশের কাছে ছিল। একপর্যায়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি পুলিশ) কাছে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তদন্তের একপর্যায়ে গ্রিল কাটা চোরদের ধরে এনে তদন্ত শেষ করার চেষ্টা করে ডিবি পুলিশ। ডিবির তদন্তের বিষয়ে তথ্য পাওয়ার পর এ ধরনের তদন্তকে আরেকটি জজ মিয়া নাটক উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ করে আন্দোলনে নামে সাংবাদিকসমাজ। আদালত ২২ মার্চের মধ্যে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দেন। ২০ মার্চ অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়। প্রতিবেদন দেখে আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ডিসি-ডিবি মনিরুল ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রবিউল আলমকে ১৮ এপ্রিল বুধবার তলব করেন। ১৮ এপ্রিল তারা আদালতে হাজির হয়ে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেন। মামলাটি ডিবি থেকে র্যাবে হস্তান্তরের জন্য পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দেন আদালত।
তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আদালতের অনুমতিক্রমে ২৬ এপ্রিল কবর থেকে সাগর-রুনির লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হয়। সন্দেহভাজনদের ডিএনএ নমুনা পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
ঘটনার আট মাস পর গত ৯ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ওই সময় তিনি সাতজনকে গ্রেফতারের কথা বলেন। তারা হলেন রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল, সন্দেহভাজন চোর রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, মো: সাঈদ ও ডা: নিতাইয়ের গাড়িচালক কামরুল হাসান অরুণ। তাদের মধ্যে পাঁচজনই চিকিৎসক নেতা ডা: নারায়ণ চন্দ্র দত্ত হত্যা মামলার আসামি। অপর সন্দেহভাজন এনামুলকে গ্রেফতারের ব্যাপারে তখন ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গত শনিবার ভোরে বিবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে এনামুলকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এ দিকে সাংবাদিকেরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে লাগাতার আন্দোলন করছেন। আজো জাতীয় প্রেস কাবের সামনে সমাবেশ করবেন সাংবাদিকেরা। এত কিছুর পরও এক বছরেও জানা যায়নি সাগর-রুনি হত্যার কারণ এবং আসলেই এর সাথে কারা জড়িত। তবে সাংবাদিক নেতারা বলে আসছেন, এ ঘটনার সাথে প্রভাবশালীরা জড়িত। প্রভাবশালীদের চাপের কারণেই খুনিরা ধরা পড়ছে না এবং খুনের রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না।
দারোয়ান এনাম ৮ দিনের রিমান্ডে
আদালত প্রতিবেদক জানান, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া এনাম আহমেদকে আট দিনের রিমান্ডে দেয়া হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাবের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো: জাফরুউল্লাহ তাকে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। ঢাকার মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান শুনানি শেষে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আসামি এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিরকে বেলা ১১টায় আদালতে বিশেষ পাহারায় হাজির করা হয়। বেলা ৩টায় তাকে আদালতে হাজিরের পর শুনানি হয়। আসামিপক্ষে জামিন চাওয়া হয়। আদালত শুনানি শেষে জামিন আবেদন নাকচ করে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
র্যাব-৯, ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যদের সহায়তায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে এনামকে আটক করা হয়। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যে সে এই মামলার ঘটনায় জড়িত মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে এ আসামিকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে মামলার হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উৎপাটনসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে মর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে।
অত্র মামলাটি একটি স্পর্শকাতর এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী হত্যা মামলা। যে মামলার ঘটনার কারণে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনসহ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অন্যান্য সহযোগী আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ এবং আসামিকে আরো ব্যাপক ও বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।
এ মামলার প্রসঙ্গে ও সূত্রে বর্ণিত মামলার সঠিক তথ্য উদঘাটন ও আসামির শনাক্তকরণের লক্ষে আগে প্রেরিত ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউকিক এসিড) প্রোফাইলের সাথে ম্যাচিং করার নিমিত্তে ধৃত আসামির রক্ত সংগ্রহ করে আমেরিকায় পাঠানো প্রয়োজন। সে জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।’
আসামিপক্ষে শুনানিকালে আদালতে এনাম আহমেদের আইনজীবী সুলতান মাহমুদ বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিকে রিমান্ডে নিতে চান না, কেবল ইতঃপূর্বে আমেরিকায় পাঠানো ডিএনএ প্রোফাইলের সাথে ম্যাচিং করার জন্য আসামির রক্ত সংগ্রহ করতে চান। আসামির রক্ত এভাবে সংগ্রহ করার জন্য রিমান্ডের প্রয়োজন হয় না। তাকে রিমান্ডে নিয়ে কেবল রক্ত সংগ্রহ নয়; নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে চান।
গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর রাজাবাজারের ওই বাসায় যান তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার এবং র্যাবের ডিজিসহ সরকার ও প্রশাসনের অনেক কর্তাব্যক্তি। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
১২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইমাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই রহস্য উদঘাটনের চেষ্টায় আছে পুলিশ।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া সময় শেষ হওয়ার পর ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুলিশ সদরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘মামলার তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেঁধে দেয়া সময়ের ব্যাপারে আইজিপি বলেন, ‘বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে শতভাগ কাজ করা সব সময় সম্ভব হয় না।’ ওই দিন তিনি বলেছিলেন, আশা করছি শিগগির ইতিবাচক কিছু খবর দেয়া যাবে। তদন্তে ইতিবাচক অগ্রগতি পাওয়া গেছে। তদন্তকাজে পুলিশের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।
নিজের বেঁধে দেয়া সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি কোস্টগার্ডের ১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠান শেষে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা অপেক্ষা করুন, যেকোনো সময় সুখবর শুনতে পাবেন। তদন্তকাজে অগ্রগতি হয়েছে। সেখানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তকাজ যেন দ্রুত হয় সে জন্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ওই দিন আইজিপি বলেন, তদন্তকাজ চলছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি গেন্ডারিয়া মিলব্যারাক শুটিং রেঞ্জের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হবেই। ওই সময় তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কাউকে বাঁচাতে আসল ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে কি না। জবাবে মন্ত্রী বলেছিলেন ‘আমি মামলাটি মনিটরিং করছি। কারো চাপ বা প্রভাবে এ মামলা ধামাচাপা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। দোষীদের আড়াল করতে প্রভাবশালী কারো চাপ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে প্রভাবশালী আর কে আছেন? তিনি নিজেই মামলার বিষয়টি তদারকি করছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। আর তাই পুলিশ মামলাটি ধামাচাপা দিতে পারে না। এমনকি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাও করবে না।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আশ্বস্ত করতে চাই, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হবেই।’
এরই মধ্যে এক দিন প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের ওপর আস্থা রাখুন।
২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সাংবাদিক দম্পতি হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ দিকে ২৮ ফেব্রুয়ারি এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে অগ্রগতির সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে না দিতে পুলিশের প্রতি নির্দেশ দেন। এরপরই পুলিশ কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথম দিকে মামলা তদন্তের দায়িত্ব শেরেবাংলা থানা পুলিশের কাছে ছিল। একপর্যায়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি পুলিশ) কাছে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তদন্তের একপর্যায়ে গ্রিল কাটা চোরদের ধরে এনে তদন্ত শেষ করার চেষ্টা করে ডিবি পুলিশ। ডিবির তদন্তের বিষয়ে তথ্য পাওয়ার পর এ ধরনের তদন্তকে আরেকটি জজ মিয়া নাটক উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ করে আন্দোলনে নামে সাংবাদিকসমাজ। আদালত ২২ মার্চের মধ্যে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দেন। ২০ মার্চ অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হয়। প্রতিবেদন দেখে আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ডিসি-ডিবি মনিরুল ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রবিউল আলমকে ১৮ এপ্রিল বুধবার তলব করেন। ১৮ এপ্রিল তারা আদালতে হাজির হয়ে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেন। মামলাটি ডিবি থেকে র্যাবে হস্তান্তরের জন্য পুলিশের আইজিকে নির্দেশ দেন আদালত।
তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আদালতের অনুমতিক্রমে ২৬ এপ্রিল কবর থেকে সাগর-রুনির লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হয়। সন্দেহভাজনদের ডিএনএ নমুনা পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
ঘটনার আট মাস পর গত ৯ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ওই সময় তিনি সাতজনকে গ্রেফতারের কথা বলেন। তারা হলেন রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল, সন্দেহভাজন চোর রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, মো: সাঈদ ও ডা: নিতাইয়ের গাড়িচালক কামরুল হাসান অরুণ। তাদের মধ্যে পাঁচজনই চিকিৎসক নেতা ডা: নারায়ণ চন্দ্র দত্ত হত্যা মামলার আসামি। অপর সন্দেহভাজন এনামুলকে গ্রেফতারের ব্যাপারে তখন ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গত শনিবার ভোরে বিবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে এনামুলকে গ্রেফতার করে র্যাব।
এ দিকে সাংবাদিকেরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে লাগাতার আন্দোলন করছেন। আজো জাতীয় প্রেস কাবের সামনে সমাবেশ করবেন সাংবাদিকেরা। এত কিছুর পরও এক বছরেও জানা যায়নি সাগর-রুনি হত্যার কারণ এবং আসলেই এর সাথে কারা জড়িত। তবে সাংবাদিক নেতারা বলে আসছেন, এ ঘটনার সাথে প্রভাবশালীরা জড়িত। প্রভাবশালীদের চাপের কারণেই খুনিরা ধরা পড়ছে না এবং খুনের রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না।
দারোয়ান এনাম ৮ দিনের রিমান্ডে
আদালত প্রতিবেদক জানান, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া এনাম আহমেদকে আট দিনের রিমান্ডে দেয়া হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাবের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো: জাফরুউল্লাহ তাকে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। ঢাকার মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান শুনানি শেষে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আসামি এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিরকে বেলা ১১টায় আদালতে বিশেষ পাহারায় হাজির করা হয়। বেলা ৩টায় তাকে আদালতে হাজিরের পর শুনানি হয়। আসামিপক্ষে জামিন চাওয়া হয়। আদালত শুনানি শেষে জামিন আবেদন নাকচ করে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
র্যাব-৯, ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যদের সহায়তায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে এনামকে আটক করা হয়। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যে সে এই মামলার ঘটনায় জড়িত মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচারের স্বার্থে এ আসামিকে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে মামলার হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উৎপাটনসহ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে মর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে।
অত্র মামলাটি একটি স্পর্শকাতর এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী হত্যা মামলা। যে মামলার ঘটনার কারণে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনসহ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অন্যান্য সহযোগী আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ এবং আসামিকে আরো ব্যাপক ও বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।
এ মামলার প্রসঙ্গে ও সূত্রে বর্ণিত মামলার সঠিক তথ্য উদঘাটন ও আসামির শনাক্তকরণের লক্ষে আগে প্রেরিত ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউকিক এসিড) প্রোফাইলের সাথে ম্যাচিং করার নিমিত্তে ধৃত আসামির রক্ত সংগ্রহ করে আমেরিকায় পাঠানো প্রয়োজন। সে জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।’
আসামিপক্ষে শুনানিকালে আদালতে এনাম আহমেদের আইনজীবী সুলতান মাহমুদ বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিকে রিমান্ডে নিতে চান না, কেবল ইতঃপূর্বে আমেরিকায় পাঠানো ডিএনএ প্রোফাইলের সাথে ম্যাচিং করার জন্য আসামির রক্ত সংগ্রহ করতে চান। আসামির রক্ত এভাবে সংগ্রহ করার জন্য রিমান্ডের প্রয়োজন হয় না। তাকে রিমান্ডে নিয়ে কেবল রক্ত সংগ্রহ নয়; নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে চান।
No comments