তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনে একাত্ম সংসদ- খন্দকার মাহবুবের ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার বক্তব্যে উত্তপ্ত আলোচনা
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে
তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন ও গণজাগরণের প্রতি সর্বসম্মতিক্রমে একাত্মতা প্রকাশ
করেছে জাতীয় সংসদ। যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবি
জানিয়ে বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্যে ফুঁসে উঠেছিল রবিবারের
অধিবেশন।
প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টাব্যাপী অনির্ধারিত উত্তপ্ত
আলোচনায় মহাজোটের সংসদ সদস্যরা অবিলম্বে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
নিষিদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদদাতাদের বিচার এবং
সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে আর্থিকভাবে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অবিলম্বে
বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে জাতীয় সংসদের নতুন প্রজন্মের আন্দোলনের
সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে প্রস্তাব গ্রহণ এবং সংসদের পক্ষ থেকে একটি
প্রতিনিধি দল শাহবাগে প্রেরণ করে সংহতি প্রকাশেরও দাবি জানান।
ডেপুটি স্পীকার কর্নেল (অব) শওকত আলীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়া মাত্রই পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেনের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার দাবির বিষয়ে সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান সরকারী দলের সিনিয়র সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। উত্তপ্ত অধিবেশনে প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টাব্যাপী চলা এ বিতর্কে মহাজোটের ৩২ জন সদস্য অংশ নেন। তবে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিম ট্রাইব্যুনালের বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সকল সংসদ সদস্য। তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে স্পীকার মাইক বন্ধ করে দিলে ফজলুল আজিম সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন। আলোচনার সময় বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন উপস্থিত।
আলোচনার সূত্রপাত করে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, যখন শাহবাগের নতুন প্রজন্মের নবজাগরণে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে এককাট্টা হয়েছে তখন বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দিতে বলেছেন। এর আগে খালেদা জিয়া ও জামায়াতে ইসলামীও ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার দাবিসহ কুখ্যাত গোলাম আযম, নিজামী, সাইদির মুক্তির দাবি করেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কখনও আঁতাত বা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে না, বিশ্বাসও করে না। বিএনপির ইতিহাসই হচ্ছে আঁতাত ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। খালেদা জিয়া ওয়াশিংটন টাইমস-এ নিবন্ধ লিখে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বাংলাদেশে নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হচ্ছে। তিনি বলেন, একাত্তরে যাঁরা গণহত্যা করেছে, মা- বোনের ইজ্জত হরণ করেছে তারা কোনদিন কারও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হতে পারে না, এরা ক্রিমিনাল, দেশ ও জাতির শত্রু। খালেদা জিয়ার নিবন্ধ পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই লজ্জা পাবে।
ষড়যন্ত্র ছেড়ে দিয়ে জনতার কাতারে আসার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক ষড়যন্ত্র করেছেন, বহু অপকর্ম করেছেন এসব বন্ধ করুন। আপনি ও আপনার স্বামী দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করেছেন। আর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করবেন না। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক ও মীরজাফরদের কোন স্থান নেই। এখনও সময় আছে খালেদা জিয়া ঠিক পথে চলুন, নইলে পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে জেগে উঠেছে, একদিন যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী ও রক্ষাকারী হিসেবে খালেদা জিয়ারও বিচার করবে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাজনীতি চলবে না। জনগণের বিরুদ্ধে গেলে খালেদা জিয়ারও মুসলিম লীগের মতো অবস্থা হবে।
প্রবীণ জননেতা তোফায়েল আহমেদ তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে বলেন, তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। সমস্ত বাঙালী জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করেছে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মতোই তরুণ প্রজন্ম আবার জেগে উঠেছে। গর্জে উঠেছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শাহবাগের প্রজন্ম গোটা বাংলাদেশেই গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছে। জামায়াতের ডাকা হরতাল জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। সারাদেশে এখন এক আওয়াজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ঘরে ফিরে যাব না। পৃথিবীর কোন শক্তিই এ বিচার রোধ করতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে সেসব নতুন প্রজন্ম সারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি সর্বসম্মতিক্রমে সংহতি প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন তিনি।
কৃষিমন্ত্রী ও অগ্নিকন্যাখ্যাত বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, শাবাশ তরুণ প্রজন্ম, আমাদের সন্তানরা। স্বাধীনতা শক্তির বিরুদ্ধে তোমাদের যে বাঁধভাঙ্গা সুশৃঙ্খল প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে হাত তুলে সালাম জানাই। তরুণ প্রজন্ম আজ ফুঁসে উঠেছে, রূখে দাঁড়িয়েছে। তোমাদের গণজাগরণ দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অভিভূত হয়ে বলেছেন, এখন মরে গেলেও আমরা দুঃখ নেই। তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠে প্রমাণ করেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের সন্তান। স্বাধীন দেশের নাগরিক। তিনি বলেন, জেনারেল জিয়া পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এ বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও বিএনপির পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ জানানো হয়নি। ইতিহাসে এ সত্য আজ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, জামায়াতকে সারাদেশে ঘেরাও করে শাস্তি দেয়ার জন্য উদ্যত, তখন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া-খন্দকার মাহবুবরা মাঠে নেমেছেন। লজ্জার মাথা খেয়ে খালেদা জিয়া বলেন, গোলাম আজম-নিজামীরা যুদ্ধাপরাধী নন। তবে কি আপনি একাই যুদ্ধাপরাধী? আপনি ও আপনার স্বামী জেনালে জিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করেছেন। আপনার পাপ ও অপরাধ জাতির সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। খালেদা জিয়া শাহবাগে যান আপনাকে তরুণ প্রজন্ম কিভাবে অভ্যর্থনা জানায়।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আগে মধ্যরাতের টক শো ও বিএনপি-জামায়াতের মুখে শুনেছি দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না, শুধু চান শেখ হাসিনা। যাঁরা এসব কথা বলেছেন তাঁরা শাহবাগসহ সারাদেশে তারুণ্যের নবজাগরণ দেখে যান। তারুণ্যের এমন বিস্ফোরণ দেখে আমি আনন্দিত, অভিভূত। বাঙালীর জয় হবেই। যাঁরা ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলছে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানানোর পাশাপাশি আন্দোলনরত তরুণ প্রজন্মকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, একাত্তরের পুনজন্ম হয়েছে। প্রজন্ম চত্ব¡রের আওয়াজ সংসদ থেকে উঠছে, পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছে। গোটা জাতিই আজ জেগে উঠেছে। জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী কোন রাজনৈতিক দল স্বাধীন দেশে রাজনীতি করতে পারে না। জঙ্গীবাদের অর্থায়নকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। জঙ্গীবাদী ও যুদ্ধাপরাধীদের যেসব প্রতিষ্ঠান অর্থায়ণ করছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকেও বন্ধ করতে হবে।
জাসদের মইনউদ্দিন খান বাদল বলেন, ১৯৭১ আবার ফিরে এসেছে, জেগে উঠেছে, নব প্রজন্ম এখন যুদ্ধ করছে। নবপ্রজন্ম যে আগুন জ্বালিয়েছে সেই আগুন সবাইকে শুদ্ধ করছে। এই আন্দোলন দেখেও বিএনপি ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার সাহস দেখাচ্ছে। শাহবাগ স্কয়ারে তরুণ প্রজন্মের এই এমন আন্দোলন সারাবিশ্বে নজির নেই। মিসরের তাহরির স্কয়ারের আন্দোলন, তিউনিসিয়ার আন্দোলন হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে, আর শাহবাগের মুক্তিযুদ্ধের নবপ্রজন্ম এ সংসদ বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়, আন্দোলন করছে য্দ্ধুাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে। বিশ্বের জামায়াতে ইসলামী একটিমাত্র রাজনৈতিক দল যে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সময় এসেছে বিষধর এই কালোসাপকে যথাযথ স্থানে ফেরত পাঠাতে হবে।
চীফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, তরুণ প্রজন্মের দাবির সঙ্গে কিছু স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া জাতীয় সংসদের সকল সংসদ সদস্যই একমত। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দিন শেষ হয়ে গেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা সাবধান হোন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি আন্দোলকারীদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জনগণের, আওয়ামী লীগেরও। সেই কারণে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। আগামীতে জনগণের দাবি অনুযায়ী রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে এটাই সবার প্রত্যাশা। তিনি জানান, আপীল সংক্রান্ত বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করা হবে এবং এই সংসদেই পাস হবে।
সিনিয়র সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, নতুন প্রজন্ম গোটা জাতিকে একটি স্রোতে মিলিত করেছে। জাতি ঐক্যবদ্ধ হলেও বিএনপি-জামায়াত ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রশ্ন নয়, রায় জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। যে ট্রাইব্যুনালকে ঘিরে ৪২ বছর পর জাতির আশা-আকাক্সক্ষার সৃষ্টি হয়েছে। কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় দেশের মানুষের মধ্যে শঙ্কা জেগেছে, বাকি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রেও এমন রায় হবে কি না? বিচার বানচাল করতে খালেদা জিয়া জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামী কোন রাজনৈতিক দল নয়, এই দলটি গণহত্যা, মা- বোনের ইজ্জত হরণের জন্য গঠিত হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এমন ঐকমত্য ভবিষ্যতে কোনদিন হবে না। মন্ত্রিসভার বৈঠকে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে আপীল করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করে একটি প্রতিনিধি দল শাহবাগে পাঠিয়ে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশের দাবি জানিয়ে বলেন, রোদ, বৃষ্টি ও শীত উপেক্ষা করে দেশের তরুণ প্রজন্মের সন্তানরা শাহবাগে গত ৬দিন ধরে কুখ্যাত কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করছে। গত ৪২ বছরে ধরে কেউ যা করতে পারেনি, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের ঢেউয়ে গোটা বাংলাদেশই আজ জেগে উঠেছে। তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে আপীলের সুযোগ সৃষ্টি এবং ট্রাইব্যুনালে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের দাবি জানিয়ে বলেন, আগামীতে যাতে কোন রাজাকার আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে।
একমাত্র স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিম ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে মহাজোটের সংসদ সদস্যরা একযোগে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। সবাই দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তীব্র হৈচৈ-এর মধ্যে ফজলুল আজিম বলেন, শাহবাগে জনতার আন্দোলন চলছে, কোন রাজনৈতিক আন্দোলন চলছে না। আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এই আন্দোলন দেখে কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের উৎসাহিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরাও চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। তবে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে। দেশে-বিদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। যাতে কোনভাবেই রাজনীতিকরণ করা না হয়। কেন ট্রাইব্যুনাল এমন পশ্নবিদ্ধ হলো? এই কথা বলা মাত্রই সকল সংসদ সদস্য আবারও প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এ পর্যায়ে স্পীকার তাঁর মাইক বন্ধ করে দিলে ফজলুল আজিম সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম-নিজামী-সাঈদী-সাকা চৌধুরীদের দেশের কলঙ্ক ও বিষাক্ত সাপ উল্লেখ করে বলেন, এসব বিষাক্ত যতদিন থাকবে ততদিন দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে না। খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ, হান্নান শাহসহ বিএনপি-জামায়াতের যেসব নেতা ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্র করছেনÑ তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানান তিনি।
সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতুত্বে আমরা যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সেই চেতনা হারিয়ে গিয়েছিল। শাহবাগ স্কয়ারে নতুন প্রজন্ম আমাদের দেখিয়েছে ওই চেতনা হারিয়ে যাবার নয়। আমরা তাদের সালাম জানাই। তিনি বলেন, সংবিধানে সকলের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই আইনে সেই অধিকার সংরক্ষণ করা হয়নি। আইনে আসামিপক্ষের আপীলের সুযোগ রাখা হলেও অপর্যাপ্ত শাস্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আপীলের সুযোগ নেই। তাই সমঅধিকার নিশ্চিত করতে আইন সংশোধনের দাবি উঠেছে।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ’৭৫ পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারীরা দেশের যুব সমাজকে অন্ধকারে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। তরুণ প্রজন্ম আজ একাত্তরের মতোই জেগে উঠেছে, সারাদেশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে প্রকম্পিত করে তুলেছে। শাহবাগ থেকে সারাদেশের প্রতিটি স্থানে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদদাতাদেরও বিচার করার দাবি উঠেছে। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে জোট বাঁধার সর্বনাশা খেলা থেকে খালেদা জিয়া বের হয়ে না এলে তিনিও আন্দোলনের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবেন।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার দাবিকারীদেরও অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে বলেন, নতুন প্রজন্মের আন্দোলনের ঢেউয়ে দেশের ৫৫ হাজার বর্গমাইলই আজ জেগে উঠেছে। যে রক্ত (বঙ্গবন্ধু) বলেছেন প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, দেশের মানুষের অধিকার চাই। সেই রক্তের উত্তরাধিকার কোনদিন স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে আপোস করতে পারে না।
এ্যাডভোকেট তারানা হালিম বলেন, দেশের তরুণ প্রজন্ম যখন জেগে উঠেছে, বাংলাদেশের মানুষকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। দেশের প্রতিটি নাগরিকের দাবি সকল রাজাকারকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলাতেই হবে। যারা একাত্তর দেখেনি, তারা ২০১৩ সাল দেখছে, নতুন প্রজন্মের গণজাগরণ দেখছে। আইন সংশোধন করতে হবে। সকল রাজাকারের ফাঁসি চাই। রাষ্ট্রপক্ষ অবশ্যই আপীল করবে, যতদিন সর্বোচ্চ রায় না হবে ততদিন শাহবাগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে যাব।
খান টিপু সুলতান বলেন, শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের গর্জনে গোটা জাতি আজ ফুঁসে উঠেছে। নিজামী-মুহাজিদদের গাড়িতে রক্ত¯œাত পতাকা তুলে দিয়েছিল, আর তাঁর স্বামী ছিলেন আইএসআই’র প্রতিনিধি। নতুন প্রজন্মের অনুভূতিকে সম্মান জানাতে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতেই হবে।
ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পি বলেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র তরুণ প্রজন্ম সহ্য করবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মরা আজ জেগে উঠেছে। শত ষড়যন্ত্র করেও কেউ এ বিচার ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। যারা স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আপোস করে ষড়যন্ত্র করছে, বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে তারাই একদিন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
আরও বক্তব্য রাখেন মেজর জেনারেল (অব) সুবিদ আলী ভূঁইয়া, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ইস্রাফিল আলম, অপু উকিল, চেমন আরা বেগম, শাহীন মনোয়ারা হক, জুনাইদ আহমেদ পোলক, আকম মোজাম্মেল হক, তাজুল ইসলাম, কামাল আহমেদ মজুমদার, পারভীন আখতার তালুকদার, শাহেদা তারেক দিপ্তী, ডা. মুরাদ হাসান ও জাসদের শাহ জিকরুল আহমেদ।
ডেপুটি স্পীকার কর্নেল (অব) শওকত আলীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন শুরু হওয়া মাত্রই পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেনের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার দাবির বিষয়ে সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান সরকারী দলের সিনিয়র সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। উত্তপ্ত অধিবেশনে প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টাব্যাপী চলা এ বিতর্কে মহাজোটের ৩২ জন সদস্য অংশ নেন। তবে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিম ট্রাইব্যুনালের বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সকল সংসদ সদস্য। তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে স্পীকার মাইক বন্ধ করে দিলে ফজলুল আজিম সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন। আলোচনার সময় বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন উপস্থিত।
আলোচনার সূত্রপাত করে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, যখন শাহবাগের নতুন প্রজন্মের নবজাগরণে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে এককাট্টা হয়েছে তখন বিএনপি নেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দিতে বলেছেন। এর আগে খালেদা জিয়া ও জামায়াতে ইসলামীও ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার দাবিসহ কুখ্যাত গোলাম আযম, নিজামী, সাইদির মুক্তির দাবি করেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কখনও আঁতাত বা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে না, বিশ্বাসও করে না। বিএনপির ইতিহাসই হচ্ছে আঁতাত ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। খালেদা জিয়া ওয়াশিংটন টাইমস-এ নিবন্ধ লিখে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বাংলাদেশে নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হচ্ছে। তিনি বলেন, একাত্তরে যাঁরা গণহত্যা করেছে, মা- বোনের ইজ্জত হরণ করেছে তারা কোনদিন কারও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হতে পারে না, এরা ক্রিমিনাল, দেশ ও জাতির শত্রু। খালেদা জিয়ার নিবন্ধ পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই লজ্জা পাবে।
ষড়যন্ত্র ছেড়ে দিয়ে জনতার কাতারে আসার জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক ষড়যন্ত্র করেছেন, বহু অপকর্ম করেছেন এসব বন্ধ করুন। আপনি ও আপনার স্বামী দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করেছেন। আর যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করবেন না। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক ও মীরজাফরদের কোন স্থান নেই। এখনও সময় আছে খালেদা জিয়া ঠিক পথে চলুন, নইলে পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে জেগে উঠেছে, একদিন যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী ও রক্ষাকারী হিসেবে খালেদা জিয়ারও বিচার করবে। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাজনীতি চলবে না। জনগণের বিরুদ্ধে গেলে খালেদা জিয়ারও মুসলিম লীগের মতো অবস্থা হবে।
প্রবীণ জননেতা তোফায়েল আহমেদ তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে বলেন, তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। সমস্ত বাঙালী জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করেছে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মতোই তরুণ প্রজন্ম আবার জেগে উঠেছে। গর্জে উঠেছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শাহবাগের প্রজন্ম গোটা বাংলাদেশেই গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছে। জামায়াতের ডাকা হরতাল জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। সারাদেশে এখন এক আওয়াজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ঘরে ফিরে যাব না। পৃথিবীর কোন শক্তিই এ বিচার রোধ করতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে সেসব নতুন প্রজন্ম সারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি সর্বসম্মতিক্রমে সংহতি প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন তিনি।
কৃষিমন্ত্রী ও অগ্নিকন্যাখ্যাত বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, শাবাশ তরুণ প্রজন্ম, আমাদের সন্তানরা। স্বাধীনতা শক্তির বিরুদ্ধে তোমাদের যে বাঁধভাঙ্গা সুশৃঙ্খল প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে হাত তুলে সালাম জানাই। তরুণ প্রজন্ম আজ ফুঁসে উঠেছে, রূখে দাঁড়িয়েছে। তোমাদের গণজাগরণ দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অভিভূত হয়ে বলেছেন, এখন মরে গেলেও আমরা দুঃখ নেই। তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠে প্রমাণ করেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের সন্তান। স্বাধীন দেশের নাগরিক। তিনি বলেন, জেনারেল জিয়া পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এ বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও বিএনপির পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ জানানো হয়নি। ইতিহাসে এ সত্য আজ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, জামায়াতকে সারাদেশে ঘেরাও করে শাস্তি দেয়ার জন্য উদ্যত, তখন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া-খন্দকার মাহবুবরা মাঠে নেমেছেন। লজ্জার মাথা খেয়ে খালেদা জিয়া বলেন, গোলাম আজম-নিজামীরা যুদ্ধাপরাধী নন। তবে কি আপনি একাই যুদ্ধাপরাধী? আপনি ও আপনার স্বামী জেনালে জিয়া স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করেছেন। আপনার পাপ ও অপরাধ জাতির সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। খালেদা জিয়া শাহবাগে যান আপনাকে তরুণ প্রজন্ম কিভাবে অভ্যর্থনা জানায়।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আগে মধ্যরাতের টক শো ও বিএনপি-জামায়াতের মুখে শুনেছি দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না, শুধু চান শেখ হাসিনা। যাঁরা এসব কথা বলেছেন তাঁরা শাহবাগসহ সারাদেশে তারুণ্যের নবজাগরণ দেখে যান। তারুণ্যের এমন বিস্ফোরণ দেখে আমি আনন্দিত, অভিভূত। বাঙালীর জয় হবেই। যাঁরা ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলছে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানানোর পাশাপাশি আন্দোলনরত তরুণ প্রজন্মকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, একাত্তরের পুনজন্ম হয়েছে। প্রজন্ম চত্ব¡রের আওয়াজ সংসদ থেকে উঠছে, পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছে। গোটা জাতিই আজ জেগে উঠেছে। জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী কোন রাজনৈতিক দল স্বাধীন দেশে রাজনীতি করতে পারে না। জঙ্গীবাদের অর্থায়নকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। জঙ্গীবাদী ও যুদ্ধাপরাধীদের যেসব প্রতিষ্ঠান অর্থায়ণ করছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকেও বন্ধ করতে হবে।
জাসদের মইনউদ্দিন খান বাদল বলেন, ১৯৭১ আবার ফিরে এসেছে, জেগে উঠেছে, নব প্রজন্ম এখন যুদ্ধ করছে। নবপ্রজন্ম যে আগুন জ্বালিয়েছে সেই আগুন সবাইকে শুদ্ধ করছে। এই আন্দোলন দেখেও বিএনপি ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার সাহস দেখাচ্ছে। শাহবাগ স্কয়ারে তরুণ প্রজন্মের এই এমন আন্দোলন সারাবিশ্বে নজির নেই। মিসরের তাহরির স্কয়ারের আন্দোলন, তিউনিসিয়ার আন্দোলন হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে, আর শাহবাগের মুক্তিযুদ্ধের নবপ্রজন্ম এ সংসদ বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়, আন্দোলন করছে য্দ্ধুাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে। বিশ্বের জামায়াতে ইসলামী একটিমাত্র রাজনৈতিক দল যে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সময় এসেছে বিষধর এই কালোসাপকে যথাযথ স্থানে ফেরত পাঠাতে হবে।
চীফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেন, তরুণ প্রজন্মের দাবির সঙ্গে কিছু স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া জাতীয় সংসদের সকল সংসদ সদস্যই একমত। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দিন শেষ হয়ে গেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা সাবধান হোন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি আন্দোলকারীদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জনগণের, আওয়ামী লীগেরও। সেই কারণে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। আগামীতে জনগণের দাবি অনুযায়ী রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে এটাই সবার প্রত্যাশা। তিনি জানান, আপীল সংক্রান্ত বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করা হবে এবং এই সংসদেই পাস হবে।
সিনিয়র সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, নতুন প্রজন্ম গোটা জাতিকে একটি স্রোতে মিলিত করেছে। জাতি ঐক্যবদ্ধ হলেও বিএনপি-জামায়াত ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রশ্ন নয়, রায় জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। যে ট্রাইব্যুনালকে ঘিরে ৪২ বছর পর জাতির আশা-আকাক্সক্ষার সৃষ্টি হয়েছে। কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় দেশের মানুষের মধ্যে শঙ্কা জেগেছে, বাকি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রেও এমন রায় হবে কি না? বিচার বানচাল করতে খালেদা জিয়া জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামী কোন রাজনৈতিক দল নয়, এই দলটি গণহত্যা, মা- বোনের ইজ্জত হরণের জন্য গঠিত হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এমন ঐকমত্য ভবিষ্যতে কোনদিন হবে না। মন্ত্রিসভার বৈঠকে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে আপীল করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করে একটি প্রতিনিধি দল শাহবাগে পাঠিয়ে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশের দাবি জানিয়ে বলেন, রোদ, বৃষ্টি ও শীত উপেক্ষা করে দেশের তরুণ প্রজন্মের সন্তানরা শাহবাগে গত ৬দিন ধরে কুখ্যাত কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করছে। গত ৪২ বছরে ধরে কেউ যা করতে পারেনি, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের ঢেউয়ে গোটা বাংলাদেশই আজ জেগে উঠেছে। তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে আপীলের সুযোগ সৃষ্টি এবং ট্রাইব্যুনালে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের দাবি জানিয়ে বলেন, আগামীতে যাতে কোন রাজাকার আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে।
একমাত্র স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিম ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে মহাজোটের সংসদ সদস্যরা একযোগে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। সবাই দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তীব্র হৈচৈ-এর মধ্যে ফজলুল আজিম বলেন, শাহবাগে জনতার আন্দোলন চলছে, কোন রাজনৈতিক আন্দোলন চলছে না। আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এই আন্দোলন দেখে কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের উৎসাহিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরাও চাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। তবে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে। দেশে-বিদেশের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। যাতে কোনভাবেই রাজনীতিকরণ করা না হয়। কেন ট্রাইব্যুনাল এমন পশ্নবিদ্ধ হলো? এই কথা বলা মাত্রই সকল সংসদ সদস্য আবারও প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এ পর্যায়ে স্পীকার তাঁর মাইক বন্ধ করে দিলে ফজলুল আজিম সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম-নিজামী-সাঈদী-সাকা চৌধুরীদের দেশের কলঙ্ক ও বিষাক্ত সাপ উল্লেখ করে বলেন, এসব বিষাক্ত যতদিন থাকবে ততদিন দেশ ও জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে না। খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ, হান্নান শাহসহ বিএনপি-জামায়াতের যেসব নেতা ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার ষড়যন্ত্র করছেনÑ তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানান তিনি।
সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতুত্বে আমরা যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সেই চেতনা হারিয়ে গিয়েছিল। শাহবাগ স্কয়ারে নতুন প্রজন্ম আমাদের দেখিয়েছে ওই চেতনা হারিয়ে যাবার নয়। আমরা তাদের সালাম জানাই। তিনি বলেন, সংবিধানে সকলের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই আইনে সেই অধিকার সংরক্ষণ করা হয়নি। আইনে আসামিপক্ষের আপীলের সুযোগ রাখা হলেও অপর্যাপ্ত শাস্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আপীলের সুযোগ নেই। তাই সমঅধিকার নিশ্চিত করতে আইন সংশোধনের দাবি উঠেছে।
বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ’৭৫ পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারীরা দেশের যুব সমাজকে অন্ধকারে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। তরুণ প্রজন্ম আজ একাত্তরের মতোই জেগে উঠেছে, সারাদেশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে প্রকম্পিত করে তুলেছে। শাহবাগ থেকে সারাদেশের প্রতিটি স্থানে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদদাতাদেরও বিচার করার দাবি উঠেছে। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে জোট বাঁধার সর্বনাশা খেলা থেকে খালেদা জিয়া বের হয়ে না এলে তিনিও আন্দোলনের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবেন।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেয়ার দাবিকারীদেরও অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে বলেন, নতুন প্রজন্মের আন্দোলনের ঢেউয়ে দেশের ৫৫ হাজার বর্গমাইলই আজ জেগে উঠেছে। যে রক্ত (বঙ্গবন্ধু) বলেছেন প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, দেশের মানুষের অধিকার চাই। সেই রক্তের উত্তরাধিকার কোনদিন স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের সঙ্গে আপোস করতে পারে না।
এ্যাডভোকেট তারানা হালিম বলেন, দেশের তরুণ প্রজন্ম যখন জেগে উঠেছে, বাংলাদেশের মানুষকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। দেশের প্রতিটি নাগরিকের দাবি সকল রাজাকারকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলাতেই হবে। যারা একাত্তর দেখেনি, তারা ২০১৩ সাল দেখছে, নতুন প্রজন্মের গণজাগরণ দেখছে। আইন সংশোধন করতে হবে। সকল রাজাকারের ফাঁসি চাই। রাষ্ট্রপক্ষ অবশ্যই আপীল করবে, যতদিন সর্বোচ্চ রায় না হবে ততদিন শাহবাগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে যাব।
খান টিপু সুলতান বলেন, শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের গর্জনে গোটা জাতি আজ ফুঁসে উঠেছে। নিজামী-মুহাজিদদের গাড়িতে রক্ত¯œাত পতাকা তুলে দিয়েছিল, আর তাঁর স্বামী ছিলেন আইএসআই’র প্রতিনিধি। নতুন প্রজন্মের অনুভূতিকে সম্মান জানাতে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতেই হবে।
ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পি বলেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কোন ধরনের ষড়যন্ত্র তরুণ প্রজন্ম সহ্য করবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মরা আজ জেগে উঠেছে। শত ষড়যন্ত্র করেও কেউ এ বিচার ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। যারা স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আপোস করে ষড়যন্ত্র করছে, বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে তারাই একদিন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
আরও বক্তব্য রাখেন মেজর জেনারেল (অব) সুবিদ আলী ভূঁইয়া, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ইস্রাফিল আলম, অপু উকিল, চেমন আরা বেগম, শাহীন মনোয়ারা হক, জুনাইদ আহমেদ পোলক, আকম মোজাম্মেল হক, তাজুল ইসলাম, কামাল আহমেদ মজুমদার, পারভীন আখতার তালুকদার, শাহেদা তারেক দিপ্তী, ডা. মুরাদ হাসান ও জাসদের শাহ জিকরুল আহমেদ।
No comments