২০১৩ : আন্তর্জাতিক রাজনীতি by তারেক শামসুর রেহমান
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অনেক ঘটনা ও অঘটনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সাল পার হলো। কেমন হবে ২০১৩ সাল? ২০১২ সালের যে পরিবর্তনগুলো লক্ষ করেছিলাম, তার ধারাবাহিকতায় কি কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন আমরা প্রত্যক্ষ করব? এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ২০১২ সালের কোনো কোনো
ঘটনা ২০১৩ সালের রাজনীতিতেও কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। প্রথমেই বলতে হয়, মিসরের ঘটনাবলির কথা। ২০১১ সালের 'আরব বসন্ত' ৩০ বছরের ক্ষমতায় থাকা হোসনি মুবারককে উৎখাত করেছিল। আরব বসন্ত মিসরে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনার জন্ম দিলেও, সেই সম্ভাবনা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। যে সংবিধান সেখানে প্রণয়ন করা হয়েছে এবং পর পর দুইবারের গণভোটে যা অনুমোদিতও হয়েছে, সেই সংবিধান মিসরবাসীকে বিভক্ত করেছে। মুবারকবিরোধী আন্দোলনে ইসলামপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, সমাজতন্ত্রী, তথা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট- সবাইকে একত্রিত করেছিল। তাহরির স্কয়ারের ১৭ দিনের 'বিপ্লব' ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হোসনি মুবারকের উৎখাতের মধ্য দিয়ে নতুন একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল; কিন্তু দেখা গেল, ইসলামপন্থীরা এককভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইসলামিক ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা 'ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস' পার্টির প্রার্থী হিসেবে মুরসি বিজয়ী হলেও তিনি মিসরবাসীকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান উপহার দিতে পারেননি। বরং খসড়া সংবিধানে বলা হয়েছে, আইনের প্রধান উৎস হবে শরিয়াহ। শরিয়াহ আইন প্রবর্তিত হলে অমুসলমান, বিশেষ করে কপটিক খ্রিস্টানরা বৈষম্যের শিকার হবেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে নারীদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে বলেও নারীসমাজের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে। দুই মাস পর সেখানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর তাতে করে ইসলামপন্থীরা বিজয়ী হবে, এটাও ধারণা করা যায়। ২০১৩ সালে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সংঘাত ও দ্বন্দ্ব আরো বাড়বে। তবে অনেকেরই দৃষ্টি থাকবে সালাফিস্টদের দিকে। এরা কট্টরপন্থী ইসলামিক আদর্শে বিশ্বাসী। সংবিধান গঠন করার জন্য যে সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে অবশ্য সালাফিস্টরা খুব সুবিধা করতে পারেনি। তবে স্পষ্টতই মিসরের রাজনৈতিক উত্থান-পতন আরব বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে তিউনিসিয়া। সেখানে নির্বাচন হয়ে গেছে এবং ইসলামপন্থীদের সঙ্গে গণতন্ত্রমনা তথা সমাজতন্ত্রীদের একটা সমঝোতা হয়েছে। এই সমঝোতা ভেঙে যায় কি না, ২০১৩ সালে এটা হবে আলোচনার অন্যতম বিষয়। সিরিয়ার পরিস্থিতি ২০১২ সালে ব্যাপক দৃষ্টি কাড়লেও, কোনো সমাধান হয়নি। চলতি বছর সিরিয়ায় একটা 'সমাধান' আমরা দেখতে পারব। তবে সিরিয়ায় যে নয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকশিত হচ্ছে, তাতে আসাদের আদৌ কোনো ভূমিকা থাকবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। সিরিয়া সংকটের শুরুতে প্রথমদিকে মনে করা হয়েছিল, আসাদ হয়তো টিকে যাবেন; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আসাদের বিদায় সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু যে প্রশ্নটি পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, তা হচ্ছে আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ায় কারা ক্ষমতাসীন হচ্ছেন। সেখানে আদৌ জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে কি না, এদিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে দুটি মন্তব্য করা যায়। এক. সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ দেশটিকে আরেকটি লেবাননে পরিণত করতে পারে। দুই. সিরিয়ায় আল-কায়েদার প্রভাব বাড়তে পারে। তবে সিরিয়ার রাজনীতিতে আগামী দিনগুলোতে তুরস্কের একটি বড় ভূমিকা থাকবে। ২০১৩ সালের রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের দিকেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের উদ্বিগ্নতা ও একটি সমঝোতা প্রত্যাশিত হলেও, ২০১৩ সালে বড় ধরনের একটি বিপর্যয়ের মুখোমুখিও হতে পারে বিশ্ব। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে ইসরায়েলি বিমান হামলার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। তাঁর প্রশাসন নতুন একজন পররাষ্ট্রসচিব পাবে। তবে এতে করে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। মার্কিন প্রশাসনে ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটলেও, নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। এ ক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটনের পরিবর্তে জন কেরি দায়িত্ব পেলেও, মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। তবে ২০১৩ সাল ওবামার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হবে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি থেকে। ওবামার জন্য তাই যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সেখানে বিকল্প একটি বাহিনী রেখে যাওয়া। এটা অনেকটা নিশ্চিত, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন তথা ন্যাটোর সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হলে আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল তালেবানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। হামিদ কারজাই শুধু কাবুলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বেন। তালেবানদের সঙ্গে আলোচনাও ফলপ্রসূ হয়নি। ওবামা প্রশাসন মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে বিকল্প একটি বাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তানে এখনো যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্য-এশিয়ায় তার উপস্থিতি নিশ্চিত করার স্বার্থে আফগানিস্তানে তাদের 'টোকেন' উপস্থিতিও থাকবে। ২০১৪-পরবর্তী আফগান রাজনীতিতে ভারতেরও একটা বড় ভূমিকা থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে 'সামরিক ঐক্য' গড়ে উঠেছে, তা ২০১৪-পরবর্তী আফগানিস্তানে একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে রাশিয়ার পুতিন প্রশাসনের সম্পর্কের দিকেও অনেকের দৃষ্টি থাকবে। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের নৌ উপস্থিতি বাড়ানোর কথা বলেছে। এতে করে পরোক্ষভাবে চীনের ওপর একটি 'চাপ' সৃষ্টি করা হবে। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে রাশিয়ার স্প্রিট বাড়ানোর কথা বলেছে। ২০১৩ সালে দুই পরাশক্তির এই অঞ্চলে উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। তৃতীয়ত, চীনের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, ২০১৩ সালে সে ব্যাপারে পর্যবেক্ষকদের লক্ষ্য থাকবে।
ক্রেমলিনে আবার পুতিনের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব আসরে রাশিয়ার তৎপরতা বেড়েছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করেই ডিসেম্বরের (২০১২) শেষদিকে পুতিন ভারত সফর করেছেন এবং ৭৫০ কোটি ডলারের একটি অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এই চুক্তির আওতায় রাশিয়া থেকে ভারত ৪২টি এমইউ-৩০ জঙ্গিবিমান, ৭১ এমআইএল এমআই-১৭ হেলিকপ্টার ও ৯৭০ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন কিনবে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া ভারতের সঙ্গে তাদের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল, তা দৃঢ় করল। রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি ইউরো-এশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে। অনেকটা ইউ অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন মডেলে। ইতিমধ্যে কাজাখস্তান ও বেলারুশকে দিয়ে রাশিয়া একটি কাস্টমস ইউনিয়ন গঠন করেছে। রাশিয়া চাচ্ছে এই কাস্টমস ইউনিয়নে ইউক্রেন, কিরঘিজস্তান ও তাজিকিস্তান যোগ দিক। ২০১৩ সালে রাশিয়া এ লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। একই সঙ্গে সামরিক জোট CSTO (Collective Security Treaty Organization)-এর ব্যাপারেও আগ্রহ থাকবে অনেকের। CSTO মূলত একটি সামরিক জোট। রাশিয়ার উদ্যোগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে নিয়েই এই CSTO গঠিত হয়েছে। স্পটতই রাশিয়া CSTO-এর মাধ্যমে War show Treaty Organization (গঠিত ১৯৫৫)-কে পুনরুজ্জীবিত করতে চাচ্ছে। একই সঙ্গে SCO বা সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের কথাও উল্লেখ করা যায়। চীন সামরিক জোট SCO-এর সদস্য। একই সঙ্গে মধ্য এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশগুলোও এর সদস্য। দুটো কারণে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আছে এ অঞ্চলে। এক. মধ্য এশিয়ার জ্বালানিসম্পদ। দুই. এ অঞ্চলে আল-কায়েদার উত্থান। এ অঞ্চলজুড়ে রয়েছে চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। সুতরাং চীনের স্বার্থ অনেক বেশি। এ অঞ্চল থেকে চীন গ্যাস আমদানি করছে। মধ্য এশিয়ার গ্যাস অন্যত্র রপ্তানি করতে মার্কিন কম্পানিগুলোর বড় বিনিয়োগে রয়েছে এ অঞ্চলে। ফলে এ অঞ্চলজুড়ে ২০১৩ সালে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যাবে। এখানে আরো একটা কথাও উল্লেখ করা যায়। চীনে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আসছে। ২০১৩ সালের মার্চে শি জিন পিং রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন লি কে কিয়াং। শি জিন পিং বেশ কিছুদিন ক্ষমতায় থাকবেন। তিনি আগামী দশকে চীনকে নেতৃত্ব দেবেন। তিনি আধুনিকমনস্ক একজন নেতা। তিনি চীনে কতটুকু সংস্কার আনেন, সেটাও দেখার বিষয়। বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছুই এখন চীনা নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করছে। কেননা অর্থনৈতিক মন্দার কবল থেকে বিশ্ব এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে মন্দাভাব এখনো বিরাজ করছে। গ্রিসে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। গ্রিস ইউরো জোনে থাকবে কি না, সে প্রশ্ন জোরদার হচ্ছে। স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ও ফ্রান্সের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে। ২০১৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকবে- এ ক্ষেত্রে চীন বড় ভূমিকা নিতে পারে। বিশ্ব জিডিপির ২৩ শতাংশ এখন যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদন করে। চীন ও ভারতের অবদান ১৭ ও ৭ শতাংশ; কিন্তু চীনের অবদান বাড়ছে। OECD'র হিসাব মতে, ২০৬০ সালের দিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান থাকবে ২৫ শতাংশ, ভারতের ১৮ শতাংশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ শতাংশ। চীন ও ভারত জি-৭-এর জিডিপির প্রায় অর্ধেক উৎপাদন করে। ২০৬০ সালে এদের অবদান জি-৭-এর মোট অবদানের ১.৫ গুণ বেড়ে যাবে। সুতরাং চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে Strategic Reassurance-এর যে নীতি বুশ প্রশাসনের আমলে ঘোষিত হয়েছিল (China responsible stakeholder), তা অব্যাহত থাকলে বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস পাবে। তাই ২০১৩ সালে ওবামা প্রশাসনের ভূমিকার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। তাঁর প্রশাসন নতুন একজন পররাষ্ট্রসচিব পাবে। তবে এতে করে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। মার্কিন প্রশাসনে ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটলেও, নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। এ ক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটনের পরিবর্তে জন কেরি দায়িত্ব পেলেও, মার্কিন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। তবে ২০১৩ সাল ওবামার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হবে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি থেকে। ওবামার জন্য তাই যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সেখানে বিকল্প একটি বাহিনী রেখে যাওয়া। এটা অনেকটা নিশ্চিত, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন তথা ন্যাটোর সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হলে আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চল তালেবানদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। হামিদ কারজাই শুধু কাবুলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বেন। তালেবানদের সঙ্গে আলোচনাও ফলপ্রসূ হয়নি। ওবামা প্রশাসন মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে বিকল্প একটি বাহিনী গঠন করার উদ্যোগ নিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তানে এখনো যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্য-এশিয়ায় তার উপস্থিতি নিশ্চিত করার স্বার্থে আফগানিস্তানে তাদের 'টোকেন' উপস্থিতিও থাকবে। ২০১৪-পরবর্তী আফগান রাজনীতিতে ভারতেরও একটা বড় ভূমিকা থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে 'সামরিক ঐক্য' গড়ে উঠেছে, তা ২০১৪-পরবর্তী আফগানিস্তানে একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে রাশিয়ার পুতিন প্রশাসনের সম্পর্কের দিকেও অনেকের দৃষ্টি থাকবে। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের নৌ উপস্থিতি বাড়ানোর কথা বলেছে। এতে করে পরোক্ষভাবে চীনের ওপর একটি 'চাপ' সৃষ্টি করা হবে। রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে রাশিয়ার স্প্রিট বাড়ানোর কথা বলেছে। ২০১৩ সালে দুই পরাশক্তির এই অঞ্চলে উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। তৃতীয়ত, চীনের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, ২০১৩ সালে সে ব্যাপারে পর্যবেক্ষকদের লক্ষ্য থাকবে।
ক্রেমলিনে আবার পুতিনের প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব আসরে রাশিয়ার তৎপরতা বেড়েছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করেই ডিসেম্বরের (২০১২) শেষদিকে পুতিন ভারত সফর করেছেন এবং ৭৫০ কোটি ডলারের একটি অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এই চুক্তির আওতায় রাশিয়া থেকে ভারত ৪২টি এমইউ-৩০ জঙ্গিবিমান, ৭১ এমআইএল এমআই-১৭ হেলিকপ্টার ও ৯৭০ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন কিনবে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া ভারতের সঙ্গে তাদের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল, তা দৃঢ় করল। রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি ইউরো-এশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে। অনেকটা ইউ অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন মডেলে। ইতিমধ্যে কাজাখস্তান ও বেলারুশকে দিয়ে রাশিয়া একটি কাস্টমস ইউনিয়ন গঠন করেছে। রাশিয়া চাচ্ছে এই কাস্টমস ইউনিয়নে ইউক্রেন, কিরঘিজস্তান ও তাজিকিস্তান যোগ দিক। ২০১৩ সালে রাশিয়া এ লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। একই সঙ্গে সামরিক জোট CSTO (Collective Security Treaty Organization)-এর ব্যাপারেও আগ্রহ থাকবে অনেকের। CSTO মূলত একটি সামরিক জোট। রাশিয়ার উদ্যোগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে নিয়েই এই CSTO গঠিত হয়েছে। স্পটতই রাশিয়া CSTO-এর মাধ্যমে War show Treaty Organization (গঠিত ১৯৫৫)-কে পুনরুজ্জীবিত করতে চাচ্ছে। একই সঙ্গে SCO বা সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের কথাও উল্লেখ করা যায়। চীন সামরিক জোট SCO-এর সদস্য। একই সঙ্গে মধ্য এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশগুলোও এর সদস্য। দুটো কারণে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আছে এ অঞ্চলে। এক. মধ্য এশিয়ার জ্বালানিসম্পদ। দুই. এ অঞ্চলে আল-কায়েদার উত্থান। এ অঞ্চলজুড়ে রয়েছে চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। সুতরাং চীনের স্বার্থ অনেক বেশি। এ অঞ্চল থেকে চীন গ্যাস আমদানি করছে। মধ্য এশিয়ার গ্যাস অন্যত্র রপ্তানি করতে মার্কিন কম্পানিগুলোর বড় বিনিয়োগে রয়েছে এ অঞ্চলে। ফলে এ অঞ্চলজুড়ে ২০১৩ সালে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা যাবে। এখানে আরো একটা কথাও উল্লেখ করা যায়। চীনে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন আসছে। ২০১৩ সালের মার্চে শি জিন পিং রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন লি কে কিয়াং। শি জিন পিং বেশ কিছুদিন ক্ষমতায় থাকবেন। তিনি আগামী দশকে চীনকে নেতৃত্ব দেবেন। তিনি আধুনিকমনস্ক একজন নেতা। তিনি চীনে কতটুকু সংস্কার আনেন, সেটাও দেখার বিষয়। বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছুই এখন চীনা নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করছে। কেননা অর্থনৈতিক মন্দার কবল থেকে বিশ্ব এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে মন্দাভাব এখনো বিরাজ করছে। গ্রিসে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। গ্রিস ইউরো জোনে থাকবে কি না, সে প্রশ্ন জোরদার হচ্ছে। স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি ও ফ্রান্সের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে। ২০১৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকবে- এ ক্ষেত্রে চীন বড় ভূমিকা নিতে পারে। বিশ্ব জিডিপির ২৩ শতাংশ এখন যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদন করে। চীন ও ভারতের অবদান ১৭ ও ৭ শতাংশ; কিন্তু চীনের অবদান বাড়ছে। OECD'র হিসাব মতে, ২০৬০ সালের দিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবদান থাকবে ২৫ শতাংশ, ভারতের ১৮ শতাংশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ শতাংশ। চীন ও ভারত জি-৭-এর জিডিপির প্রায় অর্ধেক উৎপাদন করে। ২০৬০ সালে এদের অবদান জি-৭-এর মোট অবদানের ১.৫ গুণ বেড়ে যাবে। সুতরাং চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে Strategic Reassurance-এর যে নীতি বুশ প্রশাসনের আমলে ঘোষিত হয়েছিল (China responsible stakeholder), তা অব্যাহত থাকলে বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস পাবে। তাই ২০১৩ সালে ওবামা প্রশাসনের ভূমিকার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments