আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা! by প্রভাষ আমিন
প্রিয় পাঠক, শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি একটি ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি বলে। ব্যক্তিগত হলেও আমার অভিজ্ঞতা অনেককে সাহায্য করতে পারে ভেবেই লিখতে বসা। গত ২০ নভেম্বর সকালে বাসা থেকে অফিসে যাচ্ছিলাম।
মানিক মিয়া এভিনিউতে হঠাৎ এক ট্রাফিক সার্জেন্ট গাড়ি থামানোর ইঙ্গিত দিলেন। ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই তিনি কাগজপত্র চাইলেন। আমি জানি, আমার গাড়ির সব কাগজপত্র আপটুডেট আর আমরা কোনো ট্রাফিক আইন বা সিগন্যালও অমান্য করিনি। তাই আমি নিশ্চিন্তে বসে ছিলাম। শুধু অফিসে যাওয়ার তাড়া ছিল। একটু পরই ড্রাইভার এসে বলল, 'স্যার কেইস লিখতাছে।' তখন আমি নেমে গেলাম ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে। জানতে চাইলাম, 'ভাই আমার অপরাধ কী?' ততক্ষণে তার কেইস অর্ধেক লেখা হয়ে গেছে। নির্বিকার ভঙ্গিতে মাথা তুলে বললেন, 'আপনার গাড়ির সামনের নম্বর প্লেট এক লাইনে লেখা।' এবার আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। আমার গাড়ির বিরুদ্ধে কেস করছেন, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। অপরাধ করলে মামলা হতেই পারে, হওয়াই উচিত। সাংবাদিক হিসেবে আমি কোনো বাড়তি সুবিধা চাইনি, এমনকি পুরো ঘটনায় একবারও আমার পরিচয়ও দিইনি। আমার বিস্ময়ের কারণ ছিল, অপরাধের ধরন। নম্বর প্লেট এক লাইনে লেখাটা অপরাধ- এটা আমার জানা ছিল না। আপনারা কেউ কি জানেন? আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলাম, ভাই এক লাইনে নম্বর প্লেট লেখাটা কি সত্যি অপরাধ। উনি আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যেন আমার মতো মূর্খ লোক আর দেখেননি। আমি তাঁকে জানালাম, এই নম্বর প্লেটে আমি সাড়ে ছয় বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। তার চেয়ে বড় কথা, এই নম্বর প্লেট আমাকে র্যাংগস মোটর্স থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে। গাড়ি কেনার পর আমি তাতে কোনো বিকৃতি ঘটাইনি। ট্রাফিক সার্জেন্ট আরিফ মাহামুদ (ততক্ষণে নেম প্লেট দেখে সার্জেন্ট সাহেবের নাম জেনেছি) বললেন, 'সাড়ে ছয় বছর ধরে আমরা অপরাধ করছি। আরো আগেই আমার বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত ছিল।' নিজের মূর্খতায় লজ্জিত আমি হাত বাড়িয়ে মামলার কাগজটি নিলাম। তখন আমার বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। সেই কাগজে ধারাসহ মোট ১৫ ধরনের অপরাধের উল্লেখ আছে। কিন্তু তাতেও নেই এক লাইনে নম্বর প্লেট লেখার বিষয়টি। আরিফ মাহামুদ সাহেব আমার অপরাধটি হাতে লিখে মামলা করেছেন। তখন আমি পরিচিত এক ঊর্ধ্বতন ট্রাফিক কর্তাকে ফোন করলাম। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, 'মামলা যেহেতু লেখা হয়ে গেছে, তাই এখন আর কিছু করার নেই।' তিনি বললেন, মামলার কাগজটি কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে, সমাধান করে দেবেন। কিন্তু আমি তাঁকে বললাম, 'আমি তো সমাধান চাইতে ফোন করিনি। এক লাইনে নম্বর প্লেট লেখাটা যদি সত্যি অপরাধ হয়, তাহলে মামলা সামলাতে আমার আপত্তি নেই।' পরে আমি সেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে যাইওনি। ৫০০ টাকা জরিমানা দিয়েই আমার কাগজ ছাড়িয়ে এনেছি। কিন্তু পুরো ঘটনায় আমার মনে হয়েছে, থামানোর সময়ই ট্রাফিক সার্জেন্ট আমার গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। নম্বর প্লেট দুই লাইনে থাকলেও মামলা হতো, তখন হয়তো অন্য কোনো অপরাধ খুঁজে বের করতেন। সেই গল্পের মতো- এক ঝরনায় পানি খেতে গিয়ে এক সিংহ দেখল একটি হরিণও এসেছে পানি খেতে। সিংহের ইচ্ছা হলো হরিণটিকে সে খাবে। তাই বলল, 'এই তুই আমার পানি ঘোলা করছিস কেন। তোকে আমি খাব। হরিণ বলল, 'মহারাজ, আমি তো ভাটিতে, আমার পক্ষে তো আপনার পানি ঘোলা করা সম্ভব নয়।' তখন নাছোড়বান্দা সিংহ বলল, 'তাহলে তোর বাবা পানি ঘোলা করেছে। এই অপরাধে আমি এখন তোকে খাব।' পরে অবশ্য ট্রাফিক সার্জেন্ট আরিফ মাহামুদ স্বীকারও করলেন। বললেন, 'ভাই আমাদের প্রতিদিন মামলার টার্গেট দেওয়া থাকে। যেকোনোভাবেই আমাদের সেটা পূরণ করতে হয়।' কিন্তু আমি নিশ্চিত, টার্গেট পূরণ করার জন্যও ট্রাফিক ভাইয়েরা কখনো দামি জিপ আটকাবেন না, এমপি-মন্ত্রীদের গাড়ি আটকানোর কথা তো তাঁরা দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেন না। সাধারণ মানুষের গাড়ি আটকিয়েই তাঁদের টার্গেট পূরণ করতে হবে- অপরাধ থাকুক আর নাই থাকুক।
আমি আট বছর ধরে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালাই। চেষ্টা করি ট্রাফিক আইন মেনে চলতে। চেষ্টা করি সব ধরনের কাগজপত্র, লাইসেন্স আপটুডেট রাখতে। আমার ড্রাইভারকে নিয়োগ দেওয়ার আগে সব ধরনের ট্রাফিক আইন মেনে চলার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া থাকে। ড্রাইভারকে বলা আছে, সাংবাদিকের গাড়ি বলে যেন রাস্তায় কোনো বাড়তি সুবিধা চাওয়া বা নেওয়া না হয়। সত্যি সত্যি নম্বর প্লেট এক লাইনে লেখা যে অপরাধ এটা আমার জানা ছিল না। জানা থাকলে অবশ্যই এটা আমি বদলে ফেলতাম। এখন আমার প্রশ্ন হলো- এটা যে অপরাধ সেটা আমি জানব কোত্থেকে। আমি আইনের ছাত্র নই। গাড়ি কেনার সময়, রেজিস্ট্রেশনের সময়, গাড়ি চালানো শেখার সময়, লাইসেন্স নেওয়ার সময়- কখনোই কোনো ট্রাফিক আইনের ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। আমার সাধারণ জ্ঞানে যেটুকু মনে হয়েছে, সেটুকু মেনে চলেছি। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ গাড়ি চালায়। তারা কি ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জানে? কোত্থেকে জানবে, তাদের কে জানাবে? এই দায়িত্ব নিশ্চয়ই ট্রাফিক বিভাগের। কিন্তু তারা কি কখনো সেই দায়িত্ব পালন করেছে। যদি নম্বর প্লেট এক লাইনে লেখাটা অপরাধই হবে, তাহলে ট্রাফিক বিভাগের উচিত তা সবাইকে জানানো। আর সবাইকে না জানিয়ে গাড়ি যেখান থেকে বিক্রি হয়, সেখানে আর বিআরটিএতে জানিয়ে দিলেই তো হয়। তাহলেই তো কেউ আর এক লাইনে নম্বর প্লেট রাখতে পারবে না। টার্গেট পূরণ করার নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা কেন। আজ না হয় জানলাম এক লাইনে নম্বর প্লেট লেখা অপরাধ। কাল হয়তো নতুন কোনো ধারা বেরোবে। কথায় আছে- আকাশে যত তারা, পুলিশের তত ধারা।
লেখক : সাংবাদিক
probhash2000@gmail.com
আমি আট বছর ধরে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালাই। চেষ্টা করি ট্রাফিক আইন মেনে চলতে। চেষ্টা করি সব ধরনের কাগজপত্র, লাইসেন্স আপটুডেট রাখতে। আমার ড্রাইভারকে নিয়োগ দেওয়ার আগে সব ধরনের ট্রাফিক আইন মেনে চলার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া থাকে। ড্রাইভারকে বলা আছে, সাংবাদিকের গাড়ি বলে যেন রাস্তায় কোনো বাড়তি সুবিধা চাওয়া বা নেওয়া না হয়। সত্যি সত্যি নম্বর প্লেট এক লাইনে লেখা যে অপরাধ এটা আমার জানা ছিল না। জানা থাকলে অবশ্যই এটা আমি বদলে ফেলতাম। এখন আমার প্রশ্ন হলো- এটা যে অপরাধ সেটা আমি জানব কোত্থেকে। আমি আইনের ছাত্র নই। গাড়ি কেনার সময়, রেজিস্ট্রেশনের সময়, গাড়ি চালানো শেখার সময়, লাইসেন্স নেওয়ার সময়- কখনোই কোনো ট্রাফিক আইনের ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। আমার সাধারণ জ্ঞানে যেটুকু মনে হয়েছে, সেটুকু মেনে চলেছি। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ গাড়ি চালায়। তারা কি ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জানে? কোত্থেকে জানবে, তাদের কে জানাবে? এই দায়িত্ব নিশ্চয়ই ট্রাফিক বিভাগের। কিন্তু তারা কি কখনো সেই দায়িত্ব পালন করেছে। যদি নম্বর প্লেট এক লাইনে লেখাটা অপরাধই হবে, তাহলে ট্রাফিক বিভাগের উচিত তা সবাইকে জানানো। আর সবাইকে না জানিয়ে গাড়ি যেখান থেকে বিক্রি হয়, সেখানে আর বিআরটিএতে জানিয়ে দিলেই তো হয়। তাহলেই তো কেউ আর এক লাইনে নম্বর প্লেট রাখতে পারবে না। টার্গেট পূরণ করার নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা কেন। আজ না হয় জানলাম এক লাইনে নম্বর প্লেট লেখা অপরাধ। কাল হয়তো নতুন কোনো ধারা বেরোবে। কথায় আছে- আকাশে যত তারা, পুলিশের তত ধারা।
লেখক : সাংবাদিক
probhash2000@gmail.com
No comments