চরাচর-চান্দিনার খাদি by আনন্দ কুমার ভৌমিক
ইংরেজ শাসনামল। উপমহাদেশ ইংরেজদের পণ্যে সয়লাব। এক পর্যায়ে শুরু হলো স্বদেশি আন্দোলন। বিদেশি পণ্য প্রত্যাহার করে নিজেদের পণ্য ব্যবহারে সচেষ্ট হয়ে উঠল এই উপমহাদেশের মানুষ। তখন থেকে নিজেদের পোশাকের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে চরকায় খাদি কাপড় বোনা শুরু হয়।
তারপর শুরু হয় খাদি আন্দোলন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯২০ সালে ভারতে প্রথম খাদি তৈরি শুরু হয়। কুমিল্লায় আসতে তেমন সময় লাগেনি। কুমিল্লায় প্রথম অভয়াশ্রমে খাদি তৈরি শুরু হয়। পরে তা শহর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে চান্দিনাসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, যা 'খাদি আন্দোলনে' গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তখন থেকে এ অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদি পাঠানো হতো। খাদি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা প্রয়াত হলেও তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে আছে বংশ পরম্পরায়। বর্তমানে এই শিল্পের সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার মানুষ জড়িত। সময়ের পরিক্রমায় খাদি আজ বিশ্বনন্দিত। বহুবার সম্মানিত হয়েছে চান্দিনার খাদি। আয় করছে বিদেশি অর্থ। খাদি শুধু আমাদের দেশের সম্পদ নয়, এটি সারা বিশ্বের পোশাক শিল্পের অন্যতম সম্পদ। চান্দিনার গ্রামে গ্রামে তুলা থেকে সুতা তৈরি হয় আর সেই সুতা থেকে তৈরি হয় খাদি কাপড়। খাদি কাপড়ে তৈরি হয় ফতুয়া, হাফ শার্ট, মেয়েদের পোশাক, বিছানার চাদর, বালিশের কভার, শীতের চাদর, বিভিন্ন রকমের পাঞ্জাবি, নববর্ষের বিশেষ পোশাক ইত্যাদি। এক সময় হাতে ব্যবহৃত চরকায় তাঁতিরা সুতা তৈরি করতেন ও কাপড় বুনতেন। তাঁতপল্লীতে এখন আধুনিকতার ছোঁয়া, হাতের বদলে শোভা পাচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। কাজ হয়েছে সহজতর। ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন রং, যাতে বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। তবে রং, সুতা ও যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, শ্রমিকদের আয়ের নিশ্চয়তা, সঠিক বাজারজাতকরণ ও ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর আরো গুরুত্ব দিলে খাদির মহিমা আরো আলোকিত হবে। চান্দিনা থেকে খাদি কাপড় ঢাকাসহ দেশের অনেকাংশেই সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশের বাজারের মতো খাদি সমান কদর পাচ্ছে বিদেশের মাটিতে। দেশি-বিদেশি অনেক নামিদামি লোকের পায়ের ছাপ পড়েছে চান্দিনার তাঁতপল্লীতে। নিজেদের ও পরিবারের লোকদের জন্য খাদির কাপড় নিতে ভোলেননি। অনেকে আবার গবেষণার জন্য এসেছেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। খাদি কাপড় তৈরির যন্ত্রপাতি ও বিনিয়োগের সহযোগিতা পেয়ে ব্যবসায়ীরা খুশি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি নিজেদের ব্যবহারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে খাদির গুণাগুণ তুলে ধরছেন, প্রচার করছেন, ব্যবহারে আগ্রহ সৃষ্টি করছেন। গ্রামগুলোতে রয়েছে অনেক তাঁত। তাঁতিরা সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন সুতা তৈরি, সুতায় রং লাগানো, শুকানো ও কাপড় বোনাতে। প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে বাহারি থান কাপড়। নিজেদের নৈমিত্তিক খরচ মিটিয়ে আয়ের মুখ দেখেছে অনেক তাঁতি পরিবার। তাদের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। লাভের অর্থ দিয়ে বেশি উপার্জন করার লক্ষ্যে অনেক পরিবারের সদস্য বিদেশে অবস্থান করছে। শ্রমিক থেকে অনেকে উদ্যোক্তা হয়েছেন। খাদি কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে অনেকেরই। কুমিল্লা শহরে রয়েছে খাদির এক বিশাল বাজার। এগুলোতে পছন্দমতো তৈরি পোশাক ও কাপড় পাওয়া যায়।
আনন্দ কুমার ভৌমিক
আনন্দ কুমার ভৌমিক
No comments