শিবির-হরকত যৌথ উদ্যোগেই অঘোষিত যুদ্ধের ব্লু প্রিন্ট বাস্তবায়ন? by মামুন-অর-রশিদ
শিবিরের বীভৎস খুনের মহড়ায় দেশে লাশের মিছিল তৈরি হয়েছে। শিবির আরও লাশ চায়! গত এক সপ্তাহে বকর (ঢাবি), ফারুক (রাবি), মহিউদ্দিন (চবি) আর ফারুকের (ক্যান্টনমেন্ট) লাশ শিবিরের রক্তপিপাসা মিটাতে পারেনি।
এবার তারা নিজস্ব তালিকা অনুযায়ী জিঘাংসা চরিতার্থ করবে। গোয়েন্দারা শিবিরের পরবর্তী হত্যা মিশনের তালিকাও উদ্ধার করেছে। জটিল কৌশলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু বকর হত্যাকা-ের পর শিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারম্নক হোসেনকে হত্যা করে। এই ঘটনার দু'দিনের মাথায় শুক্রবার চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিন শিবির ক্যাডারদের হাতে জীবন দেয়। একই দিন ঢাকায় শিবির ক্যাডাররা ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা করে দেয় ছাত্রলীগ নেতা ফারম্নক হোসেনের দেহ। রাজনৈতিক প্রতিপৰকে মোকাবেলায় শিবির এখন জামায়াতী পুরনো কৌশল নরহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এভাবে একের পর এক হত্যা করে জামায়াত শিবির চক্র 'অঘোষিত যুদ্ধের বস্নুপ্রিন্ট' বাসত্মবায়নে হাত দিয়েছে। এই কাজে শিবির এক সময় শিবির থেকে বেরিয়ে যাওয়া জেএমবি, হিযবুত তাহরীর এবং অতি সম্প্রতি সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাত-উল-জিহাদকে পর্যনত্ম কাজে লাগাচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রপন্থী মৌলবাদীরা শিবির ক্যাডারদের প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করছে বলে সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে। অস্ত্র দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিবির ক্যাডারদের এ্যাসাইনমেন্টও দিয়ে দেয়া হয়েছে। হত্যা খুন রগ কাটাসহ শিবিরীয় প্রক্রিয়ায় গোটা দেশে তাদের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।শিবির ক্যাডাররা জোট শাসনামলে হত্যা করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইউনুসকে। তারা হত্যা করেছে অধ্যাপক তাহেরকে। ধর্মীয় রাজনীতির অসত্মিত্ব রৰা এবং যুদ্ধাপরাধের দায় এড়াতে জামায়াত '৭১-এর মতো হত্যা-ষড়যন্ত্রের পথ ধরেছে। জামায়াত এযাত্রা নরহত্যার ভার দিয়েছে মৌলবাদী জঙ্গী ঘাতক বাংলা ভাইয়ের আদি সংগঠন শিবিরকে। বিপুল অস্ত্র সরবরাহ করে সশস্ত্র তৎপরতায় মাঠে নামানো হয়েছে শিবিরের দুর্ধর্ষ নরঘাতক বাহিনীকে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়ের বিরম্নদ্ধে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আপীল বর্তমান সরকার তুলে নেয়ার পর এক আলোচনাসভায় জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেছেন, 'ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করে দেয়া হলে দেশে ধর্মীয় জঙ্গীবাদকে উস্কে দেয়া হবে।' সম্প্রতি শিবিরের এই ধারাবাহিক হত্যা নিজামীর বক্তব্যের মূল লৰ্য বাসত্মবায়নের নমুনা কিনা- সেই প্রশ্ন উঠেছে।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায় সুপ্রীমকোর্ট বহাল রাখার পরই জামায়াত ৰ্যাপা পাগলা হয়ে উঠেছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে। এতে জামায়াতের ধর্মের নামে রাজনীতিতে ব্যবসার আর কোন সুযোগ থাকবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া খুব শীঘ্রই শুরম্ন হতে যাচ্ছে। এতে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী জামায়াতের শীর্ষ নেতা থেকে অনেককেই আসামির কাঠগাড়ায় দাঁড়াতে হবে। সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দু'চারজনকে ফাঁসির মালাও পরতে হতে পারে। যে কারণে শিবির এখন হত্যা-খুনের মিশনে নেমেছে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগ নামধারী শিবির ক্যাডার সাইদুজ্জামান ফারম্নকের পরিকল্পনায় বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবুবকর সিদ্দিককে। এই ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পার না হতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির ক্যাডাররা হত্যা করেছে গণিত বিভাগের মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা ফারম্নক হোসেনকে। ফারম্নক হত্যার পর তার মরদেহ সেপটিক ট্যাঙ্কতে ফেলে রাখা হয়। একই দিনে ছাত্রলীগের চার নেতাকর্মীর রগ কেটে দেয় শিবির ক্যাডাররা। এই ঘটনার দু'দিন বাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিনকে হত্যা করেছে শিবির ক্যাডাররা। মহিউদ্দিনকে হত্যার পর শিবির তাকে নিজেদের দলীয় কর্মী দাবি করে। শিবিরের এই দাবির ঘোরতর প্রতিবাদ জানিয়ে মহিউদ্দিনের বাবা বলেছেন, তাঁর ছেলে কোনদিন শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। মহিউদ্দিনের ছোট ভাই ছাত্রলীগ করে। সেও দাবি করেছে তার ভাই কোনদিন শিবির করেনি। একই দিন ছাত্রশিবিরের ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে খুন হয়েছে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট শাখার সভাপতি এবিএম ফারম্নক হোসেন। এভাবে একের পর এক হত্যা ও রগ কাটার মাধ্যমে মহাজোট সরকারকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের রগ কাটা বাহিনী শিবির।
বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যনত্মরীণ নিরাপত্তা কর্তৃপৰ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অধিভুক্ত ন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর স্টাডি অব টেররিজম এ্যান্ড রেসপন্স টু টেরোরিজমের তৈরি ফাইলে ছাত্রশিবিরের কর্মকা-ে সন্ত্রাসী তৎপরতা ছাড়াও শিবির আনত্মর্জাতিক পর্যায়ে কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত বলে উলেস্নখ করা হয়। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিবিরের পরিচিতি 'রগকাটা' বাহিনী হিসেবে। '৭৫-এর আগস্টের বিয়োগানত্মক ট্র্যাজেডির পর জেনারেল জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৭ সালে শিবির আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে। আশির দশকের শুরম্নতেই শিবির 'রগ কাটা' বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, ১৯৪৭ সালে মওদুদী প্রথম এই সংগঠনের জন্ম দেন। ১৯৫৫ সালে এটি ইসলামী ছাত্রসংঘ নাম ধারণ করে। '৭৫-এর আগস্ট ট্র্যাজেডির পর ১৯৭৭-এ জেনারেল জিয়ার আশীর্বাদে শিবিরের জন্ম হয়। এরপর বিভিন্ন শিৰা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য কায়েম করতে গিয়ে তারা 'রগ কাটা' বাহিনীর 'খ্যাতি' (!) পায়। ২০০০ সালে চট্টগ্রামের বহদ্দার হাটে শিবির ব্রাশফায়ার করে ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীকে হত্যা করে। হত্যার রাজনীতিতে শিবিরের পারঙ্গমতা আজ নতুন নয়। শিবির ক্যাডাররা দুর্গম চর ও পাহাড়ী এলাকায় সশস্ত্র ট্রেনিং নেয়, যা অনেকবার আইনশৃঙ্খলা রৰাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর গত চার দশকে শিবির বিভিন্ন সময় লাশের রাজনীতিতে সহস্রাধিক ছাত্র-যুবককে হত্যা করেছে।
সারাদেশে সকল শিৰা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা সৃষ্টির বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে জামায়াত-শিবির মাঠে নেমেছে বলে সংশিস্নষ্ট একাধিক সূত্র দাবি করেছে। এই মিশন সফল করতে শিবির ক্যাডাররা এখন আর কোন জায়গায় স্থায়ীভাবে অবস্থান করে না। তারা ক্রমাগত জায়গা পরিবর্তন করছে। শিবিরের সাবেক সভাপতি যার বাড়ি দেশের দৰিণাঞ্চলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন ও সূর্যসেন হলে তাদের যে পরিমাণ কর্মী রয়েছে তাতে যে কোন সময় বিশ্ববিদ্যালয় তারা অচল করে দিতে পারে। গোয়েন্দারাও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপৰ এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানিয়েছে। শিবির নেতাদের অনেকেই বলেন, দেশের সকল শিৰা প্রতিষ্ঠান অচল করে দেয়া তাদের জন্য কোন ব্যাপার না। গত এক সপ্তাহে খুনের বীভৎস মহড়ায় শিবির যে পারঙ্গমতা দেখিয়েছে তা শিবিরের বক্তব্যের সত্যতাই তুলে ধরছে। সাংগঠনিক আত্মপ্রকাশের পর শিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় গত ৩৯ বছরে হত্যা করেছে ৬২ জনকে। জোট আমলের পাঁচ বছরে সারাদেশে শিবির হত্যা করেছে ৫০ জনকে। এসব হত্যাকা-ের কোন বিচার হয়নি। সংশিস্নষ্ট বিষয়ে একটি গবেষণা সেল সূত্রে এই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে।
এদিকে জামায়াত শিবিরের ষড়যন্ত্রের বিরম্নদ্ধে সরকারও কঠোর অবস্থানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সরকার কঠোর অবস্থান নেয়ার পরেও শিবির ক্যাডাররা তাদের হত্যা নির্যাতন এবং রগকাটার মিশন অব্যাহত রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা রৰাকারী বাহিনীর চিরম্ননি অভিযানে শিবিরের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা গ্রেফতার হচ্ছে। তবে শিবিরের দুর্ধর্ষ খুনীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা বড় বড় জামায়াত নেতার বাড়িতে জামাই আদরে অবস্থান করছেন। রগ কাটা-হত্যা খুনের মিশন সফল করার পরই তারা বড় বড় নেতার কাছে গিয়ে নিরাপদে আশ্রয় নেন।
No comments