বসন্তের প্রথম প্রভাতে প্রাণের মেলায় তারুণ্যের জোয়ার
"আজি দখিণা দুয়ার খোলা/এসো হে এসো হে এসো হে আমার বসন্ত..." কবিকণ্ঠের এই আহ্বান হৃদয়ে ধারণ করে শনিবার বসনত্মের প্রথম প্রভাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল বাঙালী।
সকলের মনে যেন রং লেগেছিল। সে রং ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। গাছের নতুন পাতা আর নানা বর্ণের ফুলে যখন ভোরবেলার কোমল রোদ তার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল, তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় প্রিয়াংকা গোপের রাগসঙ্গীতের সুর মূর্ছনা বেজে উঠল। সেই সুর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই উৎসবে মিলিত হতে আসা বাঙালীর হৃদয় থেকে হৃদয়ে। ফাগুনের আগুন মাখা রঙে সেজে আসা সকলেই সেই সুরের ঐকতানে ভেসে গিয়ে অভিবাদন জানাল ঋতুরাজ বসনত্মকে। তারপর সারাদিন গানের সুরে, কবিতার ছন্দে, নৃত্যের তালে তালে কাটিয়ে দিল বসনত্মের প্রথম দিন।সকাল থেকেই সেজেগুঁজে বসনত্ম উৎসবে শামিল হতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল নগরবাসী। কিশোরী, তরম্নণী, মহিলাদের পরনে ছিল বাসনত্মী রঙের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, আর খোঁপায় জড়ানো গাঁদা ফুলের মালা। কেউ কেউ আবার গোলাপ ফুলের মতো গায় লাল রঙের শাড়িতে, খোঁপায় গোলাপ চড়িয়ে লাল পরীর সাজে এসে মিলিত হয়েছিল। সকলেরই হাতে ছিল নানা রঙের কাঁচের চুড়ি। আর ছেলেদের পরনে ছিল রঙিন পাঞ্জাবি, ফতুয়া, টি-শার্ট। বিদেশী তরম্নণ তরম্নণীরাও এসেছিল বাঙালীর এই উৎসবে বাঙালী সাজে। চারম্নকলার বকুলতলাসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রমনা পার্ক, বইমেলা, সোহরাওয়াদর্ী উদ্যান, ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর_ সর্বত্রই ছিল যেন রঙের মেলা। পুরো এলাকায় গাঁদা ফুলের গন্ধ বলে দিচ্ছিল আজ দিন বসনত্মের। রঙের এই দিনে চারম্নকলায় নকশা আঁকিয়ে শিৰাথর্ী বন্ধুরা শিশু, কিশোর কিশোরী, তরম্নণ-তরম্নণীদের গালে কপালে চিবুকে বাহুতে ভাষার মাসের প্রতীক শহীদ মিনারসহ বাঙালী সংস্কৃতির নানা মোটিফ। শাহবাগ থেকে চারম্নকলার প্রবেশপথ, বাংলা একাডেমীর বইমেলার পথে রং তুলি হাতে এমনই শত শত শিৰাথর্ী দৃষ্টি কেড়েছে সকলের। খরচা সামান্য ছিল বলেই রঙের এই দিনে আরও রঙিন হয়ে উঠতে আগ্রহীরও অভাব ছিল না। আর পথের ধারে ফুচকা, চটপট, পিঠা খাজা গজার পসরা ও গরম গরম চা তো ছিলই। তাই ঘরে ফেরার তাড়া বোধ করেননি অনেকেই।
জাতীয় বসনত্ম উৎসব উদ্্যাপন পরিষদ এবারও বিশদ আয়োজনে স্বাগত জানাল ঋতুরাজ বসনত্মকে। সকাল থেকে চারম্নকলায় দিনব্যাপী উৎসব তো ছিলই, গতবারের মতো এবারও দুপুরের পর রবীন্দ্র সরোবরে রেখেছিল বসনত্ম উৎসবের আয়োজন। এবারের উৎসবের সেস্নাগান হলো_ এসো মিলি প্রাণের উৎসবে। সকালের অনুষ্ঠানে বকুলতলায় রাগসঙ্গীতের পর বিশিষ্ট শিল্পীরা বসনত্মকে স্বাগত জানায় সঙ্গীত নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশনার মাধ্যমে। ফুল, প্রীতিবন্ধনী ও বসনত্মের বিশেষ শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ে এক মেলবন্ধন তৈরি হয়েছিল দর্শক শিল্পীর মধ্যে। তবে এর আগে সূচনা বক্তৃতা দেন উৎসবের সদস্য সচিব আবৃত্তি শিল্পী কাজী আরিফ। বসনত্ম কথন পর্বে সংৰিপ্ত আলোচনা করেন উৎসবের চেয়ারম্যান নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের।
এদিন সব দুঃখ কষ্ট ভুলে সবাই মেতে উঠেছিল আনন্দ উৎসবে। বকুলতলায় গান, নাচ ও আবৃত্তির সকালের এই উৎসবে শিল্পীরা গেয়ে শোনাল জাগো জাগো দৰিণ হাওয়ায়.., দোলা লাগিল বনে বনে..। আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে, সে কি আমায় নিবে চিনে... প্রভৃতি গান। নৃত্যশিল্পীরা ফাগুন হাওয়ায় করেছি যে দান..., বীণা ওঠে কোন্্ সুরে বেজে..., আমি কমল মুকুল দল প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিবেশন করে দৃষ্টিনন্দন নৃত্য। আর আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, রফিকুল ইসলাম, ঝর্ণা সরকার প্রমুখ। সকালের অধিবেশন শেষ হয় বসনত্ম শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে। সকালের অনুষ্ঠান শেষ হলেও এদিন শাহবাগ থেকে শহীদ মিনার, রমনা থেকে সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানসহ পুরো এলাকার চিত্র তেমন একটা বদলায়নি। গাছের ছায়ায় বসে গল্পেসল্পে মেতে সময় কাটিয়েছে অনেকে। দুপুরের পর থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার বেড়ে গেছে লোকসমাগম। বেলা পড়ার আগেই পুরো এলাকা পরিণত হয়ে উঠেছিল বাসনত্মী রঙের বাগানে। একই অবস্থা ছিল ধানম-ির রবীন্দ্র চত্বরেও। বিকেলে উৎসবটি শুরম্ন হয় সাজেদ আকবরের রবীন্দ্র সঙ্গীত অনত্মরের বাণী তুমি বসনত্মের মাধুরী উৎসবে... গানটি দিয়ে।
এরপরেই ফাহিম হোসেন চৌধুরী ও মহাদেব সাহা গেয়ে শোনান কবিগুরম্নর সেই ভাল সেই ভালো... এবং এতদিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে গানটি। আমার ভালবাসার সাধ জাগে... ও হোলি খেলে শ্যামরাই... নজরম্নলের এ দু'টি গান পরিবেশন করেন শিল্প সালাউদ্দিন আহমেদ ও আলপনা রায়। ধীর সমীরে চঞ্চল নীড়ে রজনী কা-ের এ গানটি গীত হয়ে বাজে অনিমা রায়ের কণ্ঠে। এভাবেই তানসেন রহমান, রূপা চৌধুরী, বিশ্বজিৎ রায়, বিমল চন্দ্র বিশ্বাস, রূপু খান, আলতাফ হোসেনসহ আরও অনেক শিল্পী গেয়ে শোনান কি করি আমি কি করি বনে ফাগুন মনে আগুন..., ঠিক যেখানে দিনের শুরম্ন..., আইজ কেন রে প্রাণের সুবল..., আসায় বন্ধ দয়াময়.., এ মধু বসনত্মে পূর্ণিমার চাঁদে..., প্রাণের কোকিলরে তোর মায়া ভুলিয়া... প্রভৃতি গান। বসনত্মের এ উৎসবে দলীয় পরিবেশনায় অংশ নেয় বহ্নিশিখা, ক্রানত্মি, সত্যেন সেন শিল্পী সংস্থা, রবিরশ্মি, তালিম, সুরবিহার, বিশ্ববীণা ও নিবেদন। তাদের পরিবেশিত উলেস্নখযোগ্য গান- হলো আইলোরে বসনত্মের বাহার..., আইজ শীতের হাওয়া নাই দেশে.., আমার জন্মভূমি আমার অহঙ্কার..., আয়রে বসনত্ম তোর কিরণ মাখা পাখা তুলে..., মধুর বসনত্ম এসেছে..., বসনত্ম এলো এলো এলোরে...ম ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল... প্রভৃতি গান। এদিনের বিশেষ পরিবেশন ছিল আদিবাসীদের মণিপুরী নৃত্য। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে কেন্দ্রীয় খেলাঘর, সুকন্যা, নৃত্যালোক, দিব্য, কত্থক প্রভৃতি সংগঠন।
No comments