ঢাকাবাসীর নতুন বিনোদন কেন্দ্র নান্দনিক হাতিরঝিল by মেজর (অব.) সুধীর সাহা
গত ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, নতুন বছরের শুরুতে ঢাকাবাসীর জন্য উপহার এই প্রকল্প। সত্যিই এটি ঢাকাবাসীর জন্য একটি চমৎকার সামাজিক অবদান।
সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পাঁচ বছর ধরে কাজ চালিয়ে এ প্রকল্পটি বর্তমান সরকার বাস্তবায়িত করেছে। এ প্রকল্পের মূল দায়িত্বে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন। প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অবু সাঈদ এম মাসুদের নেতৃত্বে এবং রাজউক, ঢাকা ওয়াসা, এলজিইডি ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের যৌথ সমন্বয়ে বাস্তবায়িত এ প্রকল্পটি মানুষ দিয়ে ভরা ঢাকা শহরের চিত্রটি কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে। এক হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০২ একর জমির ওপর বিস্তৃত এ প্রকল্পে ৮.৮ কিলোমিটার সার্ভিস রোড, আট কিলোমিটার এক্সপ্রেস রোড, ২৬০ মিটার ভায়োড্যাকট, ১০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, চারটি ব্রিজ ও চারটি ওভারপাস। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর একনেকে এক হাজার ৪৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকার এ প্রকল্পটি পাস করা হয়েছিল। পরে ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়সহ সংশোধিত প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৯৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রকল্পে আরো আছে ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধানে ডাইভারশন স্যুয়ারেজ এবং স্পেশাল ডাইভারশন স্ট্রাকচার নির্মাণ। আরো যুক্ত হয়েছে গুলশান সংযোগকারী একটি ব্রিজ এবং রামপুরা ব্রিজের দুই পাশে দুটি ইউলুপ। এ দুটি ইউলুপের ফলে হাতিরঝিল থেকে আসা সড়কটি রামপুরা প্রগতি সরণিতে এসে মিলেছে।
নেগেটিভ সংবাদ শুনতে শুনতে যখন অনেকটাই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, সেই সময়ে ঢাকা শহরের এমন একটি উন্নয়নের খবরে বেশ আপ্লুত হলাম। এমন সুন্দর খবর তো বাংলাদেশের মানুষের জন্য অহরহ জোটে না। এ ধরনের প্রকল্প যে বাংলাদেশে হয় না, তা কিন্তু নয়। তবে প্রকল্পের ভালো দিকগুলো সংবাদ হয়ে না এসে বরং প্রকল্পের দুর্নীতির সংবাদটি, ঘুষ-কেলেঙ্কারির খবরটি অথবা প্রকল্পটি শুরু হতে না হতেই কী কী সমস্যা হয়েছে, সে খবরটিই আমাদের জানতে হয় বেশি। সেসব নেগেটিভ সংবাদের মধ্যে এ প্রকল্পের সংবাদটি ছিল পজিটিভ একটি সংবাদ। এ প্রকল্পটি শুরু করেছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ত্বরিত গতিতে তারা হাতিরঝিল, বেগুনবাড়ীর অবৈধ স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। জরুরি অবস্থার কারণে সেই সময়ে অবৈধ দখলকারীরা বড় রকম কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারেনি। আমাদের মনে আছে, হাজার হাজার বস্তি দিয়ে ঠাসা ছিল ঝিলের চারপাশ। পাকা দালান, পাকা ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমনকি পাঁচতারা হোটেলের জায়গা স্থির করা বিজ্ঞাপনও ছিল এ অঞ্চলে। বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক প্রজেক্ট বাতিল করলেও শহরবাসীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং ঢাকা শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের একটি বড় মাধ্যম এই হাতিরঝিল প্রকল্পটি বাতিল করেনি; বরং সেনাবাহিনীর সাহায্যে প্রকল্পটি সুসম্পন্ন করার শেষ প্রান্তে নেওয়ার যত রকম ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, তারা তা করেছে। এদিক থেকে বর্তমান সরকার এ প্রকল্পের জন্য অনেক সাধুবাদ পেতে পারে। এ প্রকল্পটি সরকারের জনদরদি প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম আলোচিত প্রকল্প বলেই গণ্য হবে। এক সময় হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালে দুর্গন্ধময় ময়লা পানি ছিল, চারদিকে ছিল মশা তৈরির কারখানা। আজ সেই খালটিই পরিণত হলো নগরীর সবচেয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের সূত্র হিসেবে। দৃষ্টিনন্দন এই ঝিলে এখন মানুষ প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে এই জায়গা হবে নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রকল্পটির আরো কিছু কাজ বাকি অছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আড়াই হাজার আসনবিশিষ্ট দেশের বৃহত্তম উন্মুক্ত মঞ্চ, ভিউইং ডেক, ওয়াটার ট্যাক্সি টার্মিনাল, ফুটব্রিজ এবং সাংস্কৃতিক ও ব্যবস্থাপনা ভবন নির্মিত হবে।
ঢাকা শহরে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা হাতেগোনা। রমনা পার্কে মানুষ একটুখানি খালি জায়গা পায় নিঃশ্বাস ছাড়তে। ধানমণ্ডি ও গুলশান লেকের পাশে আর মানুষের জন্য খোলা জায়গা নেই। বেদখলের সঙ্গে সঙ্গে লেক দুটি ছোট হতে হতে প্রায় শেষ হওয়ার পথে। মানুষের ভিড়ে ভরা থাকে সব সময়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা আর হয়ে ওঠে না ওইসব স্থানে। অন্যদিকে হাতেগোনা দু-একটা পার্ক আছে সর্বসাধারণের জন্য, যা ঢাকাবাসীর জন্য খুবই অপ্রতুল। জনগণের জন্য নিবেদিত এমন ভালো প্রকল্পকে তাই আমরা শুধুই সাধুবাদ জানাতে চাই। এর সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে উৎসাহিত করতে চাই, তারা যেন এমন ধরনের প্রকল্প আরো হাতে নেয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, এমন কিছু প্রকল্প গড়ে উঠুক বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে। বুড়িগঙ্গার তীর বেদখল থেকে মুক্ত হোক এবং তীর ঘেঁষে এমন ধরনের দৃষ্টিনন্দন কিছু পাবলিক বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠুক। পৃথিবীর অনেক দেশের রাজধানীর ভাগ্যেই ঢাকা মহানগরীর বুড়িগঙ্গা নদীর মতো বয়ে যাওয়া নদী জোটেনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বহন করছে বুড়িগঙ্গা নদী। কিন্তু সেই নদীকে দৃষ্টিনন্দন করে পাবলিক বিনোদন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব এ দেশের জনগণের। হাতিরঝিল প্রকল্পটি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সাধ্যের মধ্যে এবং নিজস্ব তত্ত্বাবধানে এমন চমৎকার সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারক প্রকল্প যে করা যায়, এমন একটি বিশ্বাস প্রদান করেছে আমাদের সবাইকে এ প্রকল্পটি। বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ এবং আশুলিয়া ঝিলের তীরেও এমন ধরনের প্রকল্প হতে পারে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের কথা ভাবতে ভাবতে চোখে ভেসে উঠল বিজিএমইএর ভবনটি। এ প্রকল্পের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা এবং বাস্তবতার মাঝখানে বসে আছে বিজিএমইএর ভবনটি। দুই বছর আগে হাইকোর্ট ভবনটি ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজ হাইকোর্টের রায়ের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। ছয় সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে ১৮ মাস আগেই, কিন্তু মামলা শুনানিতে উঠছে না। স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্ট আমলে নেওয়ায় আপিল বিভাগে মামলার তদবিরকারক নেই। ভবনটি বেগুনবাড়ী খালের পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং হাতিরঝিল প্রকল্পে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এ ভবনের উপস্থিতির কারণে হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল নকশা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএর এ ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৬ সালে এ ভবনটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ভবনটি ভেঙে ফেলার দাবিতে মানববন্ধন, স্মারকলিপি দেওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সময়। আমরা আশা করব, অচিরেই সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি শুনানিতে উঠবে এবং ভবনটির ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। বিজিএমইএর সদস্যদেরও এই অনুরোধ জানালে সম্ভবত ভুল হবে না, তাঁরা যেন বিষয়টি নিজেরাই একটু গভীরভাবে ভেবে দেখেন। এমন একটি চমৎকার প্রকল্পের মূল নকশা অনুযায়ী কাজ করার স্বার্থে এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের স্বার্থে বিজিএমইএ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ ভবনটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারে। বিজিএমইএর ভবনটির ব্যাপারে সরকার খুব জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থে তৎপরতার অংশ হিসেবে রাজউক বা পূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উত্তরা বা পূর্বাচলে উপযুক্ত একটি জায়গা বিজিএমইএকে দিতে পারে। সরকার এবং বিজিএমইএ যৌথভাবে জনস্বার্থে এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করলে একটি বড় ধরনের সামাজিক সমস্যার সমাধান হতে পারে এবং তা হওয়া খুবই জরুরি সব পক্ষের স্বার্থেই।
বিজিএমইএর ভবনজনিত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা হাতিরঝিল প্রকল্পের সফল পরিণতির জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং সেনাবাহিনীকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই। এ প্রকল্প সরকার এবং সেনাবাহিনীর প্রযুক্তিগত দক্ষতারই স্বাক্ষর বহন করছে। সঙ্গে সঙ্গে দেশের উন্নয়ন, বিশেষ করে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কারে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে এই হাতিরঝিল প্রকল্পটি। সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস আগেই বনানী উড়াল সড়ক নির্মাণ করে একই ধরনের সাফল্য দেখিয়েছে।
শেষ কথাটি এভাবেই বলতে চাই, রাজধানীর যানজট কমিয়ে আনার পাশাপাশি নগরবাসীর বিনোদনের ক্ষেত্রে হাতিরঝিল প্রকল্পটি ভবিষ্যতে কতটুকু অবদান রাখবে, তা নির্ভর করবে এ প্রকল্পের সঠিক পরিচর্যার ওপর। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই সেদিকে সরকার সজাগ দৃষ্টি রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রধান বিরোধী দলসহ সব বিরোধী দলকে এমন ধরনের ভালো কাজের উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর মতো উদারতায় সিক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই।
লেখক : কলামিস্ট
নেগেটিভ সংবাদ শুনতে শুনতে যখন অনেকটাই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, সেই সময়ে ঢাকা শহরের এমন একটি উন্নয়নের খবরে বেশ আপ্লুত হলাম। এমন সুন্দর খবর তো বাংলাদেশের মানুষের জন্য অহরহ জোটে না। এ ধরনের প্রকল্প যে বাংলাদেশে হয় না, তা কিন্তু নয়। তবে প্রকল্পের ভালো দিকগুলো সংবাদ হয়ে না এসে বরং প্রকল্পের দুর্নীতির সংবাদটি, ঘুষ-কেলেঙ্কারির খবরটি অথবা প্রকল্পটি শুরু হতে না হতেই কী কী সমস্যা হয়েছে, সে খবরটিই আমাদের জানতে হয় বেশি। সেসব নেগেটিভ সংবাদের মধ্যে এ প্রকল্পের সংবাদটি ছিল পজিটিভ একটি সংবাদ। এ প্রকল্পটি শুরু করেছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ত্বরিত গতিতে তারা হাতিরঝিল, বেগুনবাড়ীর অবৈধ স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। জরুরি অবস্থার কারণে সেই সময়ে অবৈধ দখলকারীরা বড় রকম কোনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারেনি। আমাদের মনে আছে, হাজার হাজার বস্তি দিয়ে ঠাসা ছিল ঝিলের চারপাশ। পাকা দালান, পাকা ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমনকি পাঁচতারা হোটেলের জায়গা স্থির করা বিজ্ঞাপনও ছিল এ অঞ্চলে। বর্তমান সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক প্রজেক্ট বাতিল করলেও শহরবাসীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং ঢাকা শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের একটি বড় মাধ্যম এই হাতিরঝিল প্রকল্পটি বাতিল করেনি; বরং সেনাবাহিনীর সাহায্যে প্রকল্পটি সুসম্পন্ন করার শেষ প্রান্তে নেওয়ার যত রকম ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, তারা তা করেছে। এদিক থেকে বর্তমান সরকার এ প্রকল্পের জন্য অনেক সাধুবাদ পেতে পারে। এ প্রকল্পটি সরকারের জনদরদি প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম আলোচিত প্রকল্প বলেই গণ্য হবে। এক সময় হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালে দুর্গন্ধময় ময়লা পানি ছিল, চারদিকে ছিল মশা তৈরির কারখানা। আজ সেই খালটিই পরিণত হলো নগরীর সবচেয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের সূত্র হিসেবে। দৃষ্টিনন্দন এই ঝিলে এখন মানুষ প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে এই জায়গা হবে নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রকল্পটির আরো কিছু কাজ বাকি অছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আড়াই হাজার আসনবিশিষ্ট দেশের বৃহত্তম উন্মুক্ত মঞ্চ, ভিউইং ডেক, ওয়াটার ট্যাক্সি টার্মিনাল, ফুটব্রিজ এবং সাংস্কৃতিক ও ব্যবস্থাপনা ভবন নির্মিত হবে।
ঢাকা শহরে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা হাতেগোনা। রমনা পার্কে মানুষ একটুখানি খালি জায়গা পায় নিঃশ্বাস ছাড়তে। ধানমণ্ডি ও গুলশান লেকের পাশে আর মানুষের জন্য খোলা জায়গা নেই। বেদখলের সঙ্গে সঙ্গে লেক দুটি ছোট হতে হতে প্রায় শেষ হওয়ার পথে। মানুষের ভিড়ে ভরা থাকে সব সময়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা আর হয়ে ওঠে না ওইসব স্থানে। অন্যদিকে হাতেগোনা দু-একটা পার্ক আছে সর্বসাধারণের জন্য, যা ঢাকাবাসীর জন্য খুবই অপ্রতুল। জনগণের জন্য নিবেদিত এমন ভালো প্রকল্পকে তাই আমরা শুধুই সাধুবাদ জানাতে চাই। এর সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে উৎসাহিত করতে চাই, তারা যেন এমন ধরনের প্রকল্প আরো হাতে নেয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, এমন কিছু প্রকল্প গড়ে উঠুক বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে। বুড়িগঙ্গার তীর বেদখল থেকে মুক্ত হোক এবং তীর ঘেঁষে এমন ধরনের দৃষ্টিনন্দন কিছু পাবলিক বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠুক। পৃথিবীর অনেক দেশের রাজধানীর ভাগ্যেই ঢাকা মহানগরীর বুড়িগঙ্গা নদীর মতো বয়ে যাওয়া নদী জোটেনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বহন করছে বুড়িগঙ্গা নদী। কিন্তু সেই নদীকে দৃষ্টিনন্দন করে পাবলিক বিনোদন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব এ দেশের জনগণের। হাতিরঝিল প্রকল্পটি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সাধ্যের মধ্যে এবং নিজস্ব তত্ত্বাবধানে এমন চমৎকার সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারক প্রকল্প যে করা যায়, এমন একটি বিশ্বাস প্রদান করেছে আমাদের সবাইকে এ প্রকল্পটি। বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ এবং আশুলিয়া ঝিলের তীরেও এমন ধরনের প্রকল্প হতে পারে।
হাতিরঝিল প্রকল্পের কথা ভাবতে ভাবতে চোখে ভেসে উঠল বিজিএমইএর ভবনটি। এ প্রকল্পের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা এবং বাস্তবতার মাঝখানে বসে আছে বিজিএমইএর ভবনটি। দুই বছর আগে হাইকোর্ট ভবনটি ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজ হাইকোর্টের রায়ের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। ছয় সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে ১৮ মাস আগেই, কিন্তু মামলা শুনানিতে উঠছে না। স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্ট আমলে নেওয়ায় আপিল বিভাগে মামলার তদবিরকারক নেই। ভবনটি বেগুনবাড়ী খালের পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং হাতিরঝিল প্রকল্পে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এ ভবনের উপস্থিতির কারণে হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল নকশা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএর এ ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৬ সালে এ ভবনটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ভবনটি ভেঙে ফেলার দাবিতে মানববন্ধন, স্মারকলিপি দেওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সময়। আমরা আশা করব, অচিরেই সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি শুনানিতে উঠবে এবং ভবনটির ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। বিজিএমইএর সদস্যদেরও এই অনুরোধ জানালে সম্ভবত ভুল হবে না, তাঁরা যেন বিষয়টি নিজেরাই একটু গভীরভাবে ভেবে দেখেন। এমন একটি চমৎকার প্রকল্পের মূল নকশা অনুযায়ী কাজ করার স্বার্থে এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের স্বার্থে বিজিএমইএ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ ভবনটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারে। বিজিএমইএর ভবনটির ব্যাপারে সরকার খুব জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থে তৎপরতার অংশ হিসেবে রাজউক বা পূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উত্তরা বা পূর্বাচলে উপযুক্ত একটি জায়গা বিজিএমইএকে দিতে পারে। সরকার এবং বিজিএমইএ যৌথভাবে জনস্বার্থে এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করলে একটি বড় ধরনের সামাজিক সমস্যার সমাধান হতে পারে এবং তা হওয়া খুবই জরুরি সব পক্ষের স্বার্থেই।
বিজিএমইএর ভবনজনিত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমরা হাতিরঝিল প্রকল্পের সফল পরিণতির জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং সেনাবাহিনীকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে চাই। এ প্রকল্প সরকার এবং সেনাবাহিনীর প্রযুক্তিগত দক্ষতারই স্বাক্ষর বহন করছে। সঙ্গে সঙ্গে দেশের উন্নয়ন, বিশেষ করে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কারে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে এই হাতিরঝিল প্রকল্পটি। সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস আগেই বনানী উড়াল সড়ক নির্মাণ করে একই ধরনের সাফল্য দেখিয়েছে।
শেষ কথাটি এভাবেই বলতে চাই, রাজধানীর যানজট কমিয়ে আনার পাশাপাশি নগরবাসীর বিনোদনের ক্ষেত্রে হাতিরঝিল প্রকল্পটি ভবিষ্যতে কতটুকু অবদান রাখবে, তা নির্ভর করবে এ প্রকল্পের সঠিক পরিচর্যার ওপর। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই সেদিকে সরকার সজাগ দৃষ্টি রাখবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রধান বিরোধী দলসহ সব বিরোধী দলকে এমন ধরনের ভালো কাজের উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর মতো উদারতায় সিক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই।
লেখক : কলামিস্ট
No comments