যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে কথা বলার এখতিয়ার মন্ত্রী বা সরকারের নেই
কাজল ঘোষ: যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি। প্রয়োজনীয় লোকবল ও নিরাপত্তা সমস্যার দুর্বলতার দিকটি সরকারের নজরে আনলেও এ বিষয়ে তারা কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
জামায়াতের অর্থ ও ভয় দেখাবার শক্তি দুই-ই আছে। সরকারের এ দুটির কোনটিই নেই। আর ট্রাইব্যুনাল একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিচারিক প্রতিষ্ঠান। কত দিনের মধ্যে কতজন অপরাধীর বিচার সম্পন্ন হবে তা বলার এখতিয়ার কোন মন্ত্রীর বা সরকারের নেই। এটা পুরোপুরি ট্রাইব্যুনালের বিষয়। স্কাইপ কেলেঙ্কারি প্রকাশের পর যুদ্ধাপরাধ বিচারে আগামী দিনে কোন সঙ্কট রয়েছে কিনা, যুদ্ধাপরাধ বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নানা প্রশ্নে খোলামেলা কথা বলেছেন লেখক মানবাধিকার কর্মী ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির।প্রশ্ন : প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীপরিষদের একাধিক সদস্য বিচার নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন?
শুধু প্রধানমন্ত্রী কেন- ষড়যন্ত্রের কথাতো আমরাও চার বছর ধরে ধারাবাহিকভাবেই বলে যাচ্ছি। আমরা লক্ষ্য করেছি, বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগীরা দেশে-বিদেশে এ বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বহুমুখী তৎপরতা শুরু করেছে। তিয়াত্তরের আইন, ট্রাইব্যুনাল, ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর বিচারক নিয়োগসহ নানা বিষয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছে যার সবই উদ্দেশ্যমূলক, মিথ্যা এবং অর্ধসত্য। তাদের মূল উদ্দেশ্য একটাই বিচারকে বানচাল করা।
বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের মধ্যেই স্কাইপ কেলেঙ্কারি সংবাদ এসেছে। এতে করে প্রশ্ন: সামগ্রিক বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে কিনা?
পক্ষে-বিপক্ষের কিছু নেই। এখানে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধী বা গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল; মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এমন ব্যক্তিদের বিচার হচ্ছে। যাদের বিচার হচ্ছে তাদের আত্মীয় বা দল এই বিচার মানা না মানা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে। পক্ষ হতে পারে। ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে সরকার, তাতে তাদের পছন্দের কোন বিচারক নেই; তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই- এ প্রশ্ন করতেই পারে। এটা তারা বলবেই। এটা আসামিরা সব সময়ই বলে থাকে। পৃথিবীর কোন দেশেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার দু’পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এটা কখনও সম্ভবও নয়। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, বিজয়ীরা পরাজিতদের বিচার করে। এবং যাদের বিচার করে অর্থাৎ কোন খুনির স্বাধীনতা থাকতে পারে না যে আদালতে বলবে, এ বিচারক আমি পছন্দ করি না। আমাকে আমার পছন্দের বিচারক দিতে হবে। না হলে আমি এই বিচার মানি না। তাহলে কোনদিন খুনিদের বিচার করতে পারবেন না। রাষ্ট্রকে মানতে হবে। আইন সবার জন্য সমান। আইন অমান্যের কোন সুযোগ আছে বলে মনে করি না।
তিয়াত্তরের আইন একটি অসাধারণ আইন। সে সময় যখন আইনটি সংসদে পাস হয় তখন তৎকালীন আইনমন্ত্রী সংসদে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, যারা আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়নি এমন প্রশ্ন তুলেছেন তাদের ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। অপরাধ হয়েছে বাংলাদেশে। আমি একজন ভুক্তভোগী। আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারী বাংলাদেশের। আমার দেশে আইন আছে বিচার করার। এ দেশের আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হবে। এই বিচারের স্বত্বও বাংলাদেশের। পৃথিবীর সব দেশের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন এবং সার্বভৌম। অন্য কারও এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার এখতিয়ার নেই। যদি এ নিয়ে বাইরের কেউ প্রশ্ন তোলে তাহলে তা হবে অন্য একটি দেশের সার্বভৌমত্বকে আপনি আঘাত করছেন। সৌদি আরবের বিচার ব্যবস্থায় কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। এটা অত্যন্ত অমানবিক ও বর্বরোচিত, আদিম যুগের বিষয়। ইউরোপসহ তাবৎ দুনিয়ায় যারা মানবাধিকার নিয়ে বড় বড় কথা বলেন বা কোন দেশের সরকার আজ পর্যন্ত এ নিয়ে প্রতিবাদ করেননি। সৌদি বিচার ব্যবস্থা অমানবিক বা এটা হওয়া উচিত নয়। এটা বলা যায় না।
আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে দিয়ে জামায়াত এগুলো বলাচ্ছে। সমপ্রতি স্কাইপের যে সব বক্তব্য পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা বিচার ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই। বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিঘ্নিত করার জন্যই এটা জামায়াতের ষড়যন্ত্র। এবং এতে তারা খানিকটা সফলও হয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যানকে বিব্রত হয়ে পদত্যাগও করতে হয়েছে। আমি মনে করি, ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান এমন কোন অন্যায় করেননি যে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। তিনি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি বলেই বিচার নিয়ে কোন রকমের প্রশ্ন ওঠতে পারে বলে সরে দাঁড়িয়েছেন। জিয়াউদ্দিন আহমেদও সরকারের কোন উপদেষ্টা নন। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে তার সঙ্গে কথা বলেছেন। তা ফাঁস হয়ে গেল কিভাবে? সামপ্রতিক ঘটনার সামগ্রিক বিষয়টি জানতে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি করছি। আমরা প্রথম থেকেই ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় একথা বলছি। নিরাপত্তা বলতে বিচারকদের গানম্যান দেয়া হবে সেকথা বলছি না। গোটা ট্রাইব্যুনালকে নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র চাদরে ঢেকে ফেলতে হবে। আমরা যে কোন সময় যে কোন ট্রাইব্যুনালে চলে যাচ্ছি। যে কেউ চলে যাচ্ছে। যে কোন সময় যে কারও সঙ্গে কথা বলছি। না এধরনের ট্রাইব্যুনালে এমনটি হতে পারে না। আমরা প্রধান বিচারপতি বা ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের কম্পিউটারে ঢুকে পড়বো- এটা সাইবার ক্রাইম। আন্তর্জাতিক আদালতেও এটা অপরাধ। বিশ্ব আদালতেও এটি অপরাধ। এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। যারা বিচারকে বিঘ্নিত করতে; বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে। তারাই এ কাজগুলো করছে। সরকারের ব্যর্থতা হচ্ছে আমরা সতর্ক করা সত্ত্বেও সরকার এতে নজর দিচ্ছে না। বিচারের ব্যাপারে সরকার আন্তরিক হলেও এ বিচারের যে সমস্যা পদ্ধতি এবং জটিলতা রয়েছে এ ব্যাপারে সরকারের ধারণা এখনও স্বচ্ছ নয়। যারা এ ধরনের কাজ করেছে তারা কাল প্রধানমন্ত্রীর কম্পিউটারও হ্যাক করতে পারে। আমাদের যে কোন নিরাপত্তা সংস্থার কম্পিটউটার তারা হ্যাক করতে পারে। এর সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত। এটা পাবলিকের বিষয় নয়। তবে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
প্রশ্ন: জিয়াউদ্দিন এক লেখায় তিনি দেশের স্বার্থে এমনটি করেছেন বলে পত্র-পত্রিকায় এসেছে-
কতগুলো কথা তিনি নিশ্চয় বিচার প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করার জন্য বলেছেন। তবে কাগজে আমরা যতটুকু দেখেছি তা সমীচীন মনে হয় নি। অন্য একজন বিচারক সম্পর্কে তার এধরনের মন্তব্য উচিত হয়নি। প্রসিকিউশন সম্পর্কে ওনার কিছু বলার থাকলে তিনি সরকারকে বলবেন; বিচারককে নয়। কারণ, বিচারক প্রসিকিউটর নিয়োগ করেন নি। এগুলো আমি বলায় তিনি যদি অসন্তষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে কিছু করার থাকবে না। তবে হ্যাকারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের মন্ত্রীসহ একাধিক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছি।
প্রশ্ন: বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন কোন মেরুকরণ হচ্ছে কিনা?
আইনে পরিষ্কার বলা আছে, কোন কারণে কোন বিচারক মারা গেলে বা পদত্যাগ করলে যে পর্যন্ত বিচার চলছিল তার পর থেকে আবার শুরু হবে। আজকে অভিযুক্তরা প্রথম থেকে বিচার শুরুর যে দাবি তার কোন সুযোগ নেই। যারা দাবি করছেন তারা জেনে বুঝেই অত্যন্ত সচেতনভাবে বিচারকে বিলম্বিত করার জন্যই এ কাজটি করছেন। প্রথম থেকে বিচার শুরুর কথা এটা কূটতর্ক। পৃথিবীর কোথাও এরকম হয়নি। বিচারক রায় লিখতে লিখতে মারা গেছেন অন্য বিচারক এসে পুরো রায় লিখেছে। আমরা আশা করেছিলাম এই ডিসেম্বরের মধ্যে দু’তিনজনের রায় হবে। সেটা হয়তো এখন পিছিয়ে জানুয়ারিতে হবে। স্কাইপ নিয়ে যা হয়েছে তা জামায়াতের পক্ষেই গেছে। তারা চেয়েছিল বিচার যেন বিলম্বিত হয়। তারা মনে করে, বিচার বিলম্বিত হলে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আর ২০১৩ সালে তারা যদি ক্ষমতায় আসে তাহলেতো খালেদা জিয়া বলেই দিয়েছেন এ সরকার যা করেছে তার সব বাতিল করে দেবেন। এ আশাতেই জামায়াত বসে আছে।
প্রশ্ন: দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আলোচনাকে কিভাবে দেখছেন?
আন্তর্জাতিক একাধিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়ে তাদের প্রশ্ন শুনেছি- তাদের বেশির ভাগ প্রশ্নই মিথ্যা তথ্যের ওপর দাঁড় করানো। তাদেরকে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। তার ভিত্তিতে তারা প্রশ্ন করছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে সরকার এগুলোর জবাব দিচ্ছে না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গত নভেম্বরের ১ তারিখে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে ডিফেন্সের সাক্ষীকে ভয় ভীতি প্রদর্শন ও সরকার পক্ষের লোকজন হয়রানি করছে। কিন্তু দেখা গেছে ডিফেন্সের সাক্ষীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে ঐ মাসের ৭ তারিখে। তালিকা পাবার আগে সরকার কিভাবে তাদের হুমকি দিলো। এটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সীমাবদ্ধতা। এখানে তাদের যারা কাজ করে তাদের দেয়া তথ্যের ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। কাজেই ম্যানিপুলেট হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে সাক্ষীদের সরকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা দাবি করেছি যারা সাক্ষী দেবে তাদের তিনবছরের নিরাপত্তা দিতে হবে। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে তাই হচ্ছে। কোথাই আপনি সাক্ষীকে রাখবেন কাক পক্ষীটি পর্যন্ত টের পাবে না। আমরা সাক্ষীদের নাম প্রকাশ করে তাদেরকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। তালিকা পাওয়ার পরপরই জামায়াত তাদের কাছে চলে যাচ্ছে। হয় টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে না হয় ভয় দেখিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে। তাদেরকে দেশ ছাড়া করার ঘটনাও ঘটেছে। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাক্ষী দেশ ছেড়েছে। সুখরঞ্জন বালির কি অবস্থা সেটা আমরা এখনও জানি না। সরকারকে তদন্ত করে এ বিষয়ে আমরা জানাতে বলেছি। কিন্তু সুখরঞ্জন কেন জামায়াতের পক্ষে কথা বলবে। তারা কি হিন্দুবান্ধব দল। এটা কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে।
প্রশ্ন: ট্রাইব্যুনাল নিয়ে কি ধরনের দুর্বলতা দেখছি?
ট্রাইব্যুনালের আইনে কোন দুর্বলতা নেই। এটা সংবিধানে সুরক্ষিত আইন। এ আইনের মতো মানসম্পন্ন আইন আমাদের আগে পৃথিবীর কোন দেশ তৈরি করতে পারেনি। যারা এটাকে আন্তর্জাতিক আদালত বলেন তারা ভুল বলেন। এটা দেশীয় আদালত। আমাদের নিজস্ব আদালত। অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক। আমরা এ আইনে বিচার সম্পন্ন করতে পারলে পৃথিবীর অন্তত একশ’টি দেশ যারা যুদ্ধপরাধীদের বিচার করতে পারেনি তারা এটি অনুসরণ করবে। তা ম্যাক্সিকো থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম পর্যন্ত। দুর্বলতার দিক হচ্ছে এর গুরুত্ব ও চ্যালেঞ্জগুলো সরকার বুঝতে পারছে না।
সরকারের মন্ত্রীদের কোন এখতিয়ার নেই কতজনের বিচার কতদিনের মধ্যে তা বলার। ট্রাইব্যুনাল একটি স্বাধীন সার্বভৌম ট্রাইব্যুনাল। সরকার একটা পক্ষ। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে আদালত পরিচালনায় রসদ সরবরাহ করা। কিন্তু মন্ত্রীরা যখন বলেন এতজনের বিচার এতদিনে হবে এটা সম্পূর্ণ অনধিকার চর্চা। আমরা এটা বন্ধ করতে বলেছি। সরকারের এ বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার নেই। বিচার কিভাবে হবে? রায় কিভাবে হবে এটা ট্রাইব্যুনাল ঠিক করবে।
No comments