ক্ষমতাসীনেরা কেন পুনর্নির্বাচিত হয় না? by ইকতেদার আহমেদ
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক বা যৌথভাবে
সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনপ্রাপ্ত দল বা দলগুলো মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে সরকার
পরিচালনা করে থাকে।
সরকার পরিচালনাকারী দলটিকে বলা হয় ক্ষমতাসীন দল।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলই নির্বাচন পূর্ববর্তী তাদের নির্বাচনী
ইশতেহারের মাধ্যমে নির্বাচিত হলে সরকার পরিচালনা, দেশের আর্থসামাজিক
উন্নয়ন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা,
স্থানীয় সরকার, পররাষ্ট্রনীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য, আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য
প্রভৃতি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে তাদের পরিকল্পনা দেশবাসীর কাছে পেশ করে
থাকে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় দেশবাসী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের
ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারের চেয়ে নির্বাচন পূর্ববর্তী
ক্ষমতাসীন সরকারের কার্যক্রম মূল্যায়নে অধিক গুরুত্ব প্রদান করছে।
যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত দল আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিচারব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণ, যোগাযোগব্যবস্থা ও সাধারণ জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রসার প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারলে ওই দলের পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পথ সুগম হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী গণতন্ত্রের নবতররূপে বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হলে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যতীত এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত অপর চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল পুনর্নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হয়েছে। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর বর্জনের মাধ্যমে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সম্মিলিতভাবে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনসংক্রান্ত আইন প্রণয়নের অব্যবহিত পর এক মাসেরও কম সময়ের ব্যাপ্তিতে বিলুপ্ত হয়।
দীর্ঘ নয় বছরের অধিককাল ক্ষমতা থেকে বাইরে থাকার পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার পরিচালনার সুযোগ পায়। অপর দিকে দীর্ঘ প্রায় সতের বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে পঞ্চম ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও আওয়ামী লীগ যতটা না সংযতভাব প্রদর্শন করে তা অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও আওয়ামী লীগ কর্তৃক সরকার গঠনের পর যথাক্রমে পরিলক্ষিত হয়নি এবং হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে নিজ নিজ দলের নেত্রীর নেতৃত্ব ও অবস্থান অনুপম, অদ্বিতীয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অবিসংবাদিত। উভয় দলের নেতাকর্মীদের কাছে নিজ নিজ দলের নেত্রীর সিদ্ধান্ত শিরোধার্য। উভয় দলে কোনো নেতাকর্মী নেত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তার দলে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ে বিধায় সচরাচর কেউ এ পথে পা বাড়ায় না।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পরবর্তী এ যাবৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে অপর কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠনের সক্ষমতা অর্জন না করায় এ দেশের গণমানুষ আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় বিএনপিকে এবং বিএনপির ব্যর্থতায় আওয়ামী লীগকে বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করে থাকে এবং সে দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখেই ভোটাধিকার প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪০ ও ৮৮। এ নির্বাচনে ১৮ আসন লাভকারী জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। অতঃপর ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আসন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪৬ ও ১১৬। এ নির্বাচনে একটি করে আসন লাভকারী জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ও জাসদ (রব)-এর সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং উভয় দলের প্রধানকে মন্ত্রিত্ব পদ প্রদান করে। এরপর ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আসনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৯৩ ও ৬২। এ নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে ১৭টি আসন লাভ করে এবং মন্ত্রিসভায় দুটি মন্ত্রিত্ব পদ গ্রহণ করে। সর্বশেষে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আসনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৩০ ও ৩০। এ নির্বাচনে ২৭ আসন লাভকারী জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে মন্ত্রিসভায় একটি মন্ত্রিত্ব পদ গ্রহণ করে।
রাজনৈতিক সমঝোতার অনুপস্থিতিতে সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। আর যদি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয় সে ক্ষেত্রে হয়তো ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক সমঝোতার অনুপস্থিতিতে সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশের স্থিতিশীলতা যে বিঘিœত হবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে ও পরে দেশের দু’টি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা দুই ধরনের দু’টি জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত জরিপে শতকরা হিসেবে দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের জনসমর্থন কত ভাগ সেটি দেখানো হয়। এতে দেখা যায় আওয়ামী লীগের জনসমর্থন রয়েছে ৩৭ ভাগ, বিএনপির ৪৩ ভাগ, জাতীয় পার্টির ০৫ ভাগ ও জামায়াতের ০৬ ভাগ। যুগান্তর পরিচালিত জরিপে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের আসনপ্রাপ্তির হিসাব দেখানো হয়েছে। এতে দাবি করা হয়েছে এ মুহূর্তে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ৬৯, বিএনপি ১৭০, জাতীয় পার্টি ২৩ ও জামায়াত ১৪টি আসন পাবে এবং তা ছাড়া ২১টি আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। সরকারের চতুর্থ বছর পূর্তির পর প্রথম আলো পত্রিকা যে জনমত জরিপ প্রকাশ করে তাতে দেখা যায় আওয়ামী লীগের জনসমর্থন শতকরা ৩৫ ভাগ, বিএনপির ৪৫ ভাগ, জাতীয় পার্টির ১২ ভাগ ও জামায়াতের ০৩ ভাগ। এ বছর যুগান্তর জরিপে আসনপ্রাপ্তির পরিবর্তে শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি জনসমর্থনের শতকরা হার দেখানো হয়েছে। তাতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন শতকরা ২৮ ভাগ এবং বিএনপির প্রতি জনসমর্থন ৩৫ ভাগ। এ জরিপে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের জনসমর্থনের শতকরা হার দেখানো হয়নি।
যদিও জনমত জরিপের ফলাফল শতভাগ কার্যকর হবে এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না কিন্তু এতদসত্ত্বেও আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রাক্কালে সামগ্রিক জনসমর্থন ও আসন ভিত্তিতে পরিচালিত জনমত জরিপ ক্ষমতাসীন দলকে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে কী কারণে তাদের জনসমর্থনে কমেছে এবং কী পন্থা অবলম্বন করলে এ জনসমর্থন কমার প্রবণতা প্রতিরোধ করে উত্তরণ সম্ভব?
আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তি এবং দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর এক বিপুল অংশ মনে করেন ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিপুল বিজয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে তাতে অভিজ্ঞ, ত্যাগী ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাচিতদের স্থান না দিয়ে অনভিজ্ঞ, দলের নীতি আদর্শ ও নেতাকর্মীদের প্রতি উদাসীন এবং অনির্বাচিত এমন কিছু ব্যক্তিকে ঠাঁই দেওয়ায় তারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কার্য পরিচালনায় পারদর্শিতার ছাপ রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তা ছাড়া মন্ত্রী পদমর্যাদায় আসীন অনির্বাচিত উপদেষ্টাদের সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপ দেখভালের দায়িত্ব দেয়ায় দ্বৈত কর্তৃত্বের কারণে নির্বাচিত মন্ত্রীদের অনেকেই নিজ দায়িত্ব স্বচ্ছন্দের সাথে পালন না করতে পেরে অনেকটা ক্ষুব্ধ। অনির্র্বাচিত মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের বিষয়ে দলের অনেক নেতাকর্মীকে বলতে শোনা যায়, তারা যদি এতই যোগ্য ও উপযুক্ত হয়ে থাকেন তাহলে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে বিজয়ী হয়ে জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারবেন কি? আর যদি প্রমাণ রাখতে না-ই পারেন তবে বৃথা কেন তাদের এ উপদেষ্টা ও মন্ত্রীর পদ প্রদান?
নির্বাচন পূর্ববর্তী যে কোনো দল ইশতেহারের মাধ্যমে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা সফল হলে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ে, অপর দিকে বিফল হলে জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক পরিচালিত সরকারের তিন বছর ও চার বছর মেয়াদ অন্তে তারা কতটুকু সফল বা বিফল তা নির্ণয়ে দেশের দু’টি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা কর্তৃক পরিচালিত জরিপের ফলাফল গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে ।
ভোটাধিকারপ্রাপ্ত দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্্র অংশ সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে দলের সফলতা ও ব্যর্থতার চেয়ে দলীয় আনুগত্য এদের প্রধান বিবেচ্য। দেশের অবশিষ্ট জনগোষ্ঠী সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না হলেও সার্বিক বিবেচনায় রাজনৈতিকভাবে সচেতন। জনসংখ্যার এ বৃহৎ অংশ ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, সহনীয় মূল্যে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, শিক্ষা সহজলভ্যকরণ, জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার মূল্যায়নে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি।
ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল দিয়ে যেমন মহাদেশ ও মহাসাগরের সৃষ্টি হয় ঠিক তেমন ছোট ছোট ব্যর্থতা বিপর্যয় বা মহাবিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে। প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগের গতিশীলতা যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। আর এ সাফল্য অর্জন কাক্সিত মাত্রায় তখনই সম্ভব যখন এ তিনটি বিভাগসহ দেশের অপর সব বিভাগে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার ব্যত্যয়ে সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় অপরের অধিকার ক্ষুণœ করে একজন ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করা হলে ক্ষমতাসীনদের হয়তো দু-চার-দশটি ভোট নিশ্চিত হতে পারে কিন্তু এতে করে যে দু-চার-দশ লাখ ভোট অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সে দিকে দৃষ্টি দেয়া কতটুকু জরুরি তা কি ক্ষমতাসীনেরা অনুধাবন করতে পারেন? আর অনুধাবন করতে না পারলে এ ধরনের গুটিকয়েক ঘটনা যেমন ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সংশোধিত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা তালিকার দুই শতের কাছাকাছি সংখ্যক কর্মকর্তাকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও অতিক্রান্ত করে এরশাদের সামরিক শাসনামলে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত বিশেষ ব্যবস্থায় মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে মুন্সেফ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৩০-৩৪০ নম্বর ক্রমিকের মধ্যে অবস্থানকারী জনৈক কর্মকর্তাকে প্রথমত ঢাকার জেলা জজ ও অতঃপর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগ এবং উক্ত কর্মকর্তার চেয়ে তুলনামূলক নি¤œতর যোগ্যতাসম্পন্ন ৩৮০-৩৯০ নম্বর ক্রমিকের মধ্যে অবস্থানকারী অপর এক কর্মকর্তাকে অপরাপর সব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার যোগ্যতা, সততা ও দক্ষতার অবমূল্যায়নে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সচিব পদের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা ভোটের হিসেবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আসনপ্রাপ্তিতে অসম্মানজনক অবস্থার সৃষ্টি করলে তা হবে মহাবিপর্যয়েরই ইঙ্গিতবহ। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকারের মহাবিপর্যয়ের কারণগুলোর অন্যতম একটি ছিল উপরিউক্ত জ্যেষ্ঠতা তালিকার ৮০-৯০ নম্বর ক্রমিকের মধ্যে অবস্থানকারী জনৈক কর্মকর্তাকে পঞ্চাশোর্র্ধ্ব কর্মকর্তার জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার অবমূল্যায়নে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ। সাবেক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কর্র্তৃক এতদ্সংক্রান্ত নথি অনুমোদনের আগে যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার অতিক্রান্তের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করার প্রয়াস নেয়া হলে তাদের উভয়ের পক্ষে নথিদ্বয়ে অনুমোদন করা সম্ভব ছিল কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদ ও ভূ-ভাগ সীমিত কিন্তু যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের নেতৃস্থানীয়রা যদি নিজ ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমস্যা সমাধানে ব্রতী হয় সে ক্ষেত্রে হয়তো ক্ষমতাসীনদের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার অন্তরায়গুলো অতিক্রমের পথ অনেকটা সুগম হবে।
লেখক : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত দল আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিচারব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণ, যোগাযোগব্যবস্থা ও সাধারণ জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রসার প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারলে ওই দলের পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পথ সুগম হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী গণতন্ত্রের নবতররূপে বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হলে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যতীত এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত অপর চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল পুনর্নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হয়েছে। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর বর্জনের মাধ্যমে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সম্মিলিতভাবে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনসংক্রান্ত আইন প্রণয়নের অব্যবহিত পর এক মাসেরও কম সময়ের ব্যাপ্তিতে বিলুপ্ত হয়।
দীর্ঘ নয় বছরের অধিককাল ক্ষমতা থেকে বাইরে থাকার পর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকার পরিচালনার সুযোগ পায়। অপর দিকে দীর্ঘ প্রায় সতের বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে পঞ্চম ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও আওয়ামী লীগ যতটা না সংযতভাব প্রদর্শন করে তা অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও আওয়ামী লীগ কর্তৃক সরকার গঠনের পর যথাক্রমে পরিলক্ষিত হয়নি এবং হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে নিজ নিজ দলের নেত্রীর নেতৃত্ব ও অবস্থান অনুপম, অদ্বিতীয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অবিসংবাদিত। উভয় দলের নেতাকর্মীদের কাছে নিজ নিজ দলের নেত্রীর সিদ্ধান্ত শিরোধার্য। উভয় দলে কোনো নেতাকর্মী নেত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তার দলে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ে বিধায় সচরাচর কেউ এ পথে পা বাড়ায় না।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পরবর্তী এ যাবৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে অপর কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠনের সক্ষমতা অর্জন না করায় এ দেশের গণমানুষ আওয়ামী লীগের ব্যর্থতায় বিএনপিকে এবং বিএনপির ব্যর্থতায় আওয়ামী লীগকে বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করে থাকে এবং সে দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখেই ভোটাধিকার প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।
পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪০ ও ৮৮। এ নির্বাচনে ১৮ আসন লাভকারী জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। অতঃপর ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আসন সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪৬ ও ১১৬। এ নির্বাচনে একটি করে আসন লাভকারী জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ও জাসদ (রব)-এর সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং উভয় দলের প্রধানকে মন্ত্রিত্ব পদ প্রদান করে। এরপর ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আসনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৯৩ ও ৬২। এ নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে ১৭টি আসন লাভ করে এবং মন্ত্রিসভায় দুটি মন্ত্রিত্ব পদ গ্রহণ করে। সর্বশেষে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আসনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৩০ ও ৩০। এ নির্বাচনে ২৭ আসন লাভকারী জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে মন্ত্রিসভায় একটি মন্ত্রিত্ব পদ গ্রহণ করে।
রাজনৈতিক সমঝোতার অনুপস্থিতিতে সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। আর যদি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয় সে ক্ষেত্রে হয়তো ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক সমঝোতার অনুপস্থিতিতে সংবিধানের বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশের স্থিতিশীলতা যে বিঘিœত হবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে ও পরে দেশের দু’টি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা দুই ধরনের দু’টি জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত জরিপে শতকরা হিসেবে দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের জনসমর্থন কত ভাগ সেটি দেখানো হয়। এতে দেখা যায় আওয়ামী লীগের জনসমর্থন রয়েছে ৩৭ ভাগ, বিএনপির ৪৩ ভাগ, জাতীয় পার্টির ০৫ ভাগ ও জামায়াতের ০৬ ভাগ। যুগান্তর পরিচালিত জরিপে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের আসনপ্রাপ্তির হিসাব দেখানো হয়েছে। এতে দাবি করা হয়েছে এ মুহূর্তে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ৬৯, বিএনপি ১৭০, জাতীয় পার্টি ২৩ ও জামায়াত ১৪টি আসন পাবে এবং তা ছাড়া ২১টি আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। সরকারের চতুর্থ বছর পূর্তির পর প্রথম আলো পত্রিকা যে জনমত জরিপ প্রকাশ করে তাতে দেখা যায় আওয়ামী লীগের জনসমর্থন শতকরা ৩৫ ভাগ, বিএনপির ৪৫ ভাগ, জাতীয় পার্টির ১২ ভাগ ও জামায়াতের ০৩ ভাগ। এ বছর যুগান্তর জরিপে আসনপ্রাপ্তির পরিবর্তে শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি জনসমর্থনের শতকরা হার দেখানো হয়েছে। তাতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন শতকরা ২৮ ভাগ এবং বিএনপির প্রতি জনসমর্থন ৩৫ ভাগ। এ জরিপে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের জনসমর্থনের শতকরা হার দেখানো হয়নি।
যদিও জনমত জরিপের ফলাফল শতভাগ কার্যকর হবে এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না কিন্তু এতদসত্ত্বেও আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রাক্কালে সামগ্রিক জনসমর্থন ও আসন ভিত্তিতে পরিচালিত জনমত জরিপ ক্ষমতাসীন দলকে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে কী কারণে তাদের জনসমর্থনে কমেছে এবং কী পন্থা অবলম্বন করলে এ জনসমর্থন কমার প্রবণতা প্রতিরোধ করে উত্তরণ সম্ভব?
আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তি এবং দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর এক বিপুল অংশ মনে করেন ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিপুল বিজয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে তাতে অভিজ্ঞ, ত্যাগী ও ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাচিতদের স্থান না দিয়ে অনভিজ্ঞ, দলের নীতি আদর্শ ও নেতাকর্মীদের প্রতি উদাসীন এবং অনির্বাচিত এমন কিছু ব্যক্তিকে ঠাঁই দেওয়ায় তারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কার্য পরিচালনায় পারদর্শিতার ছাপ রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তা ছাড়া মন্ত্রী পদমর্যাদায় আসীন অনির্বাচিত উপদেষ্টাদের সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যকলাপ দেখভালের দায়িত্ব দেয়ায় দ্বৈত কর্তৃত্বের কারণে নির্বাচিত মন্ত্রীদের অনেকেই নিজ দায়িত্ব স্বচ্ছন্দের সাথে পালন না করতে পেরে অনেকটা ক্ষুব্ধ। অনির্র্বাচিত মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের বিষয়ে দলের অনেক নেতাকর্মীকে বলতে শোনা যায়, তারা যদি এতই যোগ্য ও উপযুক্ত হয়ে থাকেন তাহলে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে বিজয়ী হয়ে জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারবেন কি? আর যদি প্রমাণ রাখতে না-ই পারেন তবে বৃথা কেন তাদের এ উপদেষ্টা ও মন্ত্রীর পদ প্রদান?
নির্বাচন পূর্ববর্তী যে কোনো দল ইশতেহারের মাধ্যমে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা সফল হলে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ে, অপর দিকে বিফল হলে জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক পরিচালিত সরকারের তিন বছর ও চার বছর মেয়াদ অন্তে তারা কতটুকু সফল বা বিফল তা নির্ণয়ে দেশের দু’টি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা কর্তৃক পরিচালিত জরিপের ফলাফল গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে ।
ভোটাধিকারপ্রাপ্ত দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্্র অংশ সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে দলের সফলতা ও ব্যর্থতার চেয়ে দলীয় আনুগত্য এদের প্রধান বিবেচ্য। দেশের অবশিষ্ট জনগোষ্ঠী সরাসরি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না হলেও সার্বিক বিবেচনায় রাজনৈতিকভাবে সচেতন। জনসংখ্যার এ বৃহৎ অংশ ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, সহনীয় মূল্যে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, শিক্ষা সহজলভ্যকরণ, জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার মূল্যায়নে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি।
ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল দিয়ে যেমন মহাদেশ ও মহাসাগরের সৃষ্টি হয় ঠিক তেমন ছোট ছোট ব্যর্থতা বিপর্যয় বা মহাবিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে। প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগের গতিশীলতা যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। আর এ সাফল্য অর্জন কাক্সিত মাত্রায় তখনই সম্ভব যখন এ তিনটি বিভাগসহ দেশের অপর সব বিভাগে নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার ব্যত্যয়ে সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় অপরের অধিকার ক্ষুণœ করে একজন ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করা হলে ক্ষমতাসীনদের হয়তো দু-চার-দশটি ভোট নিশ্চিত হতে পারে কিন্তু এতে করে যে দু-চার-দশ লাখ ভোট অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সে দিকে দৃষ্টি দেয়া কতটুকু জরুরি তা কি ক্ষমতাসীনেরা অনুধাবন করতে পারেন? আর অনুধাবন করতে না পারলে এ ধরনের গুটিকয়েক ঘটনা যেমন ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সংশোধিত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা তালিকার দুই শতের কাছাকাছি সংখ্যক কর্মকর্তাকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও অতিক্রান্ত করে এরশাদের সামরিক শাসনামলে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত বিশেষ ব্যবস্থায় মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে মুন্সেফ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৩০-৩৪০ নম্বর ক্রমিকের মধ্যে অবস্থানকারী জনৈক কর্মকর্তাকে প্রথমত ঢাকার জেলা জজ ও অতঃপর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক নিয়োগ এবং উক্ত কর্মকর্তার চেয়ে তুলনামূলক নি¤œতর যোগ্যতাসম্পন্ন ৩৮০-৩৯০ নম্বর ক্রমিকের মধ্যে অবস্থানকারী অপর এক কর্মকর্তাকে অপরাপর সব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার যোগ্যতা, সততা ও দক্ষতার অবমূল্যায়নে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সচিব পদের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা ভোটের হিসেবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আসনপ্রাপ্তিতে অসম্মানজনক অবস্থার সৃষ্টি করলে তা হবে মহাবিপর্যয়েরই ইঙ্গিতবহ। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকারের মহাবিপর্যয়ের কারণগুলোর অন্যতম একটি ছিল উপরিউক্ত জ্যেষ্ঠতা তালিকার ৮০-৯০ নম্বর ক্রমিকের মধ্যে অবস্থানকারী জনৈক কর্মকর্তাকে পঞ্চাশোর্র্ধ্ব কর্মকর্তার জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার অবমূল্যায়নে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ। সাবেক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কর্র্তৃক এতদ্সংক্রান্ত নথি অনুমোদনের আগে যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার অতিক্রান্তের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে অবহিত করার প্রয়াস নেয়া হলে তাদের উভয়ের পক্ষে নথিদ্বয়ে অনুমোদন করা সম্ভব ছিল কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আমাদের জনসংখ্যার তুলনায় সম্পদ ও ভূ-ভাগ সীমিত কিন্তু যেকোনো ক্ষমতাসীন দলের নেতৃস্থানীয়রা যদি নিজ ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমস্যা সমাধানে ব্রতী হয় সে ক্ষেত্রে হয়তো ক্ষমতাসীনদের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার অন্তরায়গুলো অতিক্রমের পথ অনেকটা সুগম হবে।
লেখক : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
No comments