মোহাম্মদপুরে গার্মেন্টে আগুন- ৭ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে সাত
শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন অপর ১৫ জন।
গতকাল বেলা ৩টার
দিকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় তিন রাস্তার মোড়ের খান মার্কেটের দ্বিতীয়
তলায় অবস্থিত স্মার্ট ফ্যাশন কারখানায় এ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। আহতদের
স্থানীয় শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া
হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও চিকিৎসকেরা বলছেন, ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ, পদদলিত ও
লাফিয়ে পড়ে শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট
প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। আগুনে ওই কারখানার সব
মালামাল পুড়ে গেছে। এ দিকে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর
কবির নানক ও পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও
সিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে যান। অগ্নিদগ্ধ
জ্যোৎস্না আক্তারকে (২০) দুর্ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে
নেয়ার পর মারা যান। সেখানে লিজা নামে আরো একজন শ্রমিক চিকিৎসাধীন রয়েছেন
বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া নাসিমা বেগম (১৮), নাসিমা আক্তার
(১৭), কোহিনুর আক্তার (১৬), ফাতেমা আক্তার (১৭) ও নাজিয়া আক্তার (১৭) মারা
যান শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এ ছাড়া ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত
শ্রমিক লাইজু (১৬) বসিলা রোডের বাসায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যায় মারা
যান।
ওই গার্মেন্টের শ্রমিক মমতাজ বেগম জানান, আগুন লাগার আগে তিনি ফিনিশিং সেকশনে কাজ করছিলেন। আয়রন সেকশন থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে তিনি শুনেছেন। ওই কারখানায় প্রায় সাড়ে ৩০০ শ্রমিক কাজ করে জানিয়ে তিনি বলেন, লাঞ্চের পর পর আগুন লাগে। তবে এ সময় কারখানায় শ্রমিক উপস্থিতি কম ছিল। কারখানার নিরাপত্তাকর্মী ফরিদ আলম পুলিশকে জানিয়েছেন, গত শুক্রবার ওই কারখানার বয়লার নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ঠিক করা হয়। গতকাল ওই বয়লার থেকে আগুন লাগতে দেখেছেন তিনি।
ওই গার্মেন্টের শ্রমিক আলেয়া জানান, দুপুরে লাঞ্চের পর তারা কাজ শুরু করেন। বেলা ৩টার দিকে হঠাৎ শুনতে পান গার্মেন্টে আগুন লেগেছে। এ সময় শ্রমিকেরা আগুন থেকে বাঁচতে একসাথে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু একটা দরজা দিয়ে সবাই বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছিল না। এ দিকে আগুন দাউ দাউ করে তাদের দিকে ধেয়ে আসছিল। পরে শ্রমিকেরা যে যার মতো দ্বিতীয় তলার জানালা, দরজা দিয়ে লাফিয়ে নিচে পড়তে থাকেন। তিনি আরো জানান, যারা পেছনে বের হয়েছেন তাদের অনেকে ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ ছাড়া বাকিরা লাফিয়ে নিচে পড়ার কারণে মারা গেছেন। ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হালিম বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে দোতলা ওই কারখানাটির পেছন দিকে রাখা ঝুটের গুদামে প্রথমে আগুন লাগে। সেখান থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকেরা বাঁচার জন্য ছোটাছুটি শুরু করেন। এ সময় আগুন থেকে বাঁচতে দ্বিতীয় তলা থেকে লাফিয়ে অনেকেই নিচে পড়তে থাকেন। কারণ এর আগে আশুলিয়ায় তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে বিপুল শ্রমিকের মৃত্যু হওয়ায় সব শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছিল। গতকাল বিকেলে শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পদদলিত হয়ে নিহত পাঁচজনকে জরুরি বিভাগের বারান্দায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে তাদের স্বজনের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। নাসিমার স্বামী শফিক জানান, তিনি নিজে আগে রিকশা চালাতেন। এখন প্রাইভেট কারচালক হিসেবে কাজ করেন। তার স্ত্রী নাসিমা প্রায় বছরখানেক ওই গার্মেন্টে অপারেটর হিসেবে কাজ করত। তারা মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিংয়ে থাকেন। গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনে। তিনি বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘সকালে নাসিমা আমারে সাবধানে গাড়ি চালাতে বইলা বাড়ি থিকা বারাইয়্যা নিজেই আমাগো ছাইড়া চইলা গেল। এখন আমার দুই সন্তানের কী হইব? আমি তাদের কিভাবে মানুষ করব?’ নাসিমার পাশে একই নামে আরেক তরুণীকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার শিয়রে বসে কাঁদছিলেন বড় বোন আঞ্জুমান আরা। একটু পাশেই বসে মাথায় হাত রেখে চোখের পানি মুছছেন বাবা নয়া মিয়া। তিনি জানান, বেড়িবাঁধের কোম্পানি বাড়িতে থাকেন তারা। আগুনের খবর পেয়ে আগে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরে শিকদার মেডিক্যালে গিয়ে মেয়ের লাশ দেখতে পান। নাসিমার পাশে শোয়ানো কোহিনুরের লাশ। বোনের লাশ জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলেন বড় বোন মাহিনুর। তার কান্নায় আশপাশের অনেকেই চোখের পানি আটকাতে পারেননি। একটু দূরে বাবা জাভেদ চোখের পানি মুছছিলেন। বছিলা সিটি গার্ডেন এলাকার বাসিন্দা জাভেদ জানান, সংসারে অভাব অনটনের কারণে মেয়েকে গার্মেন্টে দিয়েছিলেন। সেই মেয়ের এমন নির্মম মৃত্যু হবে তা কখনো কল্পনাও করেননি। নিহত রাজিয়ার বোন মাফিয়া জানান, সাত ভাইবোনের মধ্যে রাজিয়া চতুর্থ ছিল। তাদের বাবার নাম আলতাফ। চাঁদ উদ্যান বস্তিতে থাকেন তারা। গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুরে। এ দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিহত জোছনার বাবার নাম কাওসার মিয়া। গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহান উদ্দিনে। মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের ৪ নম্বর সড়কে থাকতেন তিনি। নিহত লাইজুর বাবা আবুল হোসেন জানান, মেয়ের গার্মেন্টে আগুনের খবর পেয়ে তিনি দৌড়ে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন তার মেয়েকে লোকজন ধরাধরি করে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে আনছে। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা গেলে তার লাশ বছিলা রোডের বাড়িতে নেয়া হয়।
এ দিকে অগ্নিকাণ্ডের খবরে শিকদার মেডিক্যাল কলেজে স্বজনের সান্ত্বনা দিতে ছুটে যান স্থানীয় সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি এ সময় বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা কতটা কষ্টের এটা আমি বুঝি। আমি আমার সন্তান হারিয়েছি। যে সাতজন মারা গেছে তারা আমার বোনের মতো, সন্তানের মতো। তাদের পরিবারকে সরকারের প থেকে যথোপযুক্ত সহযোগিতা করা হবে। তিনি বলেন, একই সাথে নির্মম এই ঘটনা কিভাবে ঘটল তা তদন্ত করতে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মালিকের গাফিলতি ও গেট তালাবন্ধের প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রেড ক্রিসেন্টের যুব সদস্য মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করি। এখান থেকে পাঁচটি লাশ উদ্ধার করে সিকদার মেডিক্যাল ও ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে। ধোঁয়া, পদদলিত এবং ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে মাহফুজুর রহমান জানান। আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, আগুন লাগার কারণ এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে বিষয়টি তদন্ত করা হবে। তিনি আরো বলেন, শুনেছি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কয়েকজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নির্দেশ দিয়েছি এ ধরনের কিছু হলে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আবাসিক এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা গার্মেন্ট কারখানা উচ্ছেদ করা হবে। এখন থেকে আবাসিক এলাকায় আর কোনো গার্মেন্ট কারখানা গড়ে উঠতে দেয়া হবে না। এসব কারখানাকে শিল্পাঞ্চলে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক অঞ্জন লাল ঘোষ বলেন, হাসপাতালে পাঁচজন নারীশ্রমিককে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। বিজেএমইএ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের প্রধান মনছুর খালেদ বলেন, কারখানাটি বিজিএমইএ’র কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেয়নি। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। খালেদা জিয়ার শোক : বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া আগুনে নিহত গার্মেন্টশ্রমিকদের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি নিহতদের স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। গত রাতে এক বিবৃতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাদের রফতানি আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্টের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। সেখানে শ্রমিকদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। অথচ ব্যর্থ সরকার এ ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো কিছু তো করতেই পারছে না, উপরন্তু তাদের একের পর এক ভুল পদক্ষেপে পুরো গার্মেন্টশিল্প অস্থির হয়ে উঠেছে। ফলে গার্মেন্টশিল্প বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম। তিনি এ অবস্থার অবসানে ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বেগম খালেদা জিয়া অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
ওই গার্মেন্টের শ্রমিক মমতাজ বেগম জানান, আগুন লাগার আগে তিনি ফিনিশিং সেকশনে কাজ করছিলেন। আয়রন সেকশন থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে বলে তিনি শুনেছেন। ওই কারখানায় প্রায় সাড়ে ৩০০ শ্রমিক কাজ করে জানিয়ে তিনি বলেন, লাঞ্চের পর পর আগুন লাগে। তবে এ সময় কারখানায় শ্রমিক উপস্থিতি কম ছিল। কারখানার নিরাপত্তাকর্মী ফরিদ আলম পুলিশকে জানিয়েছেন, গত শুক্রবার ওই কারখানার বয়লার নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ঠিক করা হয়। গতকাল ওই বয়লার থেকে আগুন লাগতে দেখেছেন তিনি।
ওই গার্মেন্টের শ্রমিক আলেয়া জানান, দুপুরে লাঞ্চের পর তারা কাজ শুরু করেন। বেলা ৩টার দিকে হঠাৎ শুনতে পান গার্মেন্টে আগুন লেগেছে। এ সময় শ্রমিকেরা আগুন থেকে বাঁচতে একসাথে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু একটা দরজা দিয়ে সবাই বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছিল না। এ দিকে আগুন দাউ দাউ করে তাদের দিকে ধেয়ে আসছিল। পরে শ্রমিকেরা যে যার মতো দ্বিতীয় তলার জানালা, দরজা দিয়ে লাফিয়ে নিচে পড়তে থাকেন। তিনি আরো জানান, যারা পেছনে বের হয়েছেন তাদের অনেকে ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ ছাড়া বাকিরা লাফিয়ে নিচে পড়ার কারণে মারা গেছেন। ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হালিম বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে দোতলা ওই কারখানাটির পেছন দিকে রাখা ঝুটের গুদামে প্রথমে আগুন লাগে। সেখান থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকেরা বাঁচার জন্য ছোটাছুটি শুরু করেন। এ সময় আগুন থেকে বাঁচতে দ্বিতীয় তলা থেকে লাফিয়ে অনেকেই নিচে পড়তে থাকেন। কারণ এর আগে আশুলিয়ায় তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে বিপুল শ্রমিকের মৃত্যু হওয়ায় সব শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছিল। গতকাল বিকেলে শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পদদলিত হয়ে নিহত পাঁচজনকে জরুরি বিভাগের বারান্দায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে তাদের স্বজনের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। নাসিমার স্বামী শফিক জানান, তিনি নিজে আগে রিকশা চালাতেন। এখন প্রাইভেট কারচালক হিসেবে কাজ করেন। তার স্ত্রী নাসিমা প্রায় বছরখানেক ওই গার্মেন্টে অপারেটর হিসেবে কাজ করত। তারা মোহাম্মদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিংয়ে থাকেন। গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনে। তিনি বিলাপ করে বলতে থাকেন, ‘সকালে নাসিমা আমারে সাবধানে গাড়ি চালাতে বইলা বাড়ি থিকা বারাইয়্যা নিজেই আমাগো ছাইড়া চইলা গেল। এখন আমার দুই সন্তানের কী হইব? আমি তাদের কিভাবে মানুষ করব?’ নাসিমার পাশে একই নামে আরেক তরুণীকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার শিয়রে বসে কাঁদছিলেন বড় বোন আঞ্জুমান আরা। একটু পাশেই বসে মাথায় হাত রেখে চোখের পানি মুছছেন বাবা নয়া মিয়া। তিনি জানান, বেড়িবাঁধের কোম্পানি বাড়িতে থাকেন তারা। আগুনের খবর পেয়ে আগে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরে শিকদার মেডিক্যালে গিয়ে মেয়ের লাশ দেখতে পান। নাসিমার পাশে শোয়ানো কোহিনুরের লাশ। বোনের লাশ জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছিলেন বড় বোন মাহিনুর। তার কান্নায় আশপাশের অনেকেই চোখের পানি আটকাতে পারেননি। একটু দূরে বাবা জাভেদ চোখের পানি মুছছিলেন। বছিলা সিটি গার্ডেন এলাকার বাসিন্দা জাভেদ জানান, সংসারে অভাব অনটনের কারণে মেয়েকে গার্মেন্টে দিয়েছিলেন। সেই মেয়ের এমন নির্মম মৃত্যু হবে তা কখনো কল্পনাও করেননি। নিহত রাজিয়ার বোন মাফিয়া জানান, সাত ভাইবোনের মধ্যে রাজিয়া চতুর্থ ছিল। তাদের বাবার নাম আলতাফ। চাঁদ উদ্যান বস্তিতে থাকেন তারা। গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির রাজাপুরে। এ দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিহত জোছনার বাবার নাম কাওসার মিয়া। গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহান উদ্দিনে। মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের ৪ নম্বর সড়কে থাকতেন তিনি। নিহত লাইজুর বাবা আবুল হোসেন জানান, মেয়ের গার্মেন্টে আগুনের খবর পেয়ে তিনি দৌড়ে ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন তার মেয়েকে লোকজন ধরাধরি করে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে আনছে। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা গেলে তার লাশ বছিলা রোডের বাড়িতে নেয়া হয়।
এ দিকে অগ্নিকাণ্ডের খবরে শিকদার মেডিক্যাল কলেজে স্বজনের সান্ত্বনা দিতে ছুটে যান স্থানীয় সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি এ সময় বলেন, স্বজন হারানোর বেদনা কতটা কষ্টের এটা আমি বুঝি। আমি আমার সন্তান হারিয়েছি। যে সাতজন মারা গেছে তারা আমার বোনের মতো, সন্তানের মতো। তাদের পরিবারকে সরকারের প থেকে যথোপযুক্ত সহযোগিতা করা হবে। তিনি বলেন, একই সাথে নির্মম এই ঘটনা কিভাবে ঘটল তা তদন্ত করতে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মালিকের গাফিলতি ও গেট তালাবন্ধের প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রেড ক্রিসেন্টের যুব সদস্য মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা অগ্নিকাণ্ডের খবর শুনে ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করি। এখান থেকে পাঁচটি লাশ উদ্ধার করে সিকদার মেডিক্যাল ও ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে। ধোঁয়া, পদদলিত এবং ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে মাহফুজুর রহমান জানান। আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, আগুন লাগার কারণ এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে বিষয়টি তদন্ত করা হবে। তিনি আরো বলেন, শুনেছি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কয়েকজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নির্দেশ দিয়েছি এ ধরনের কিছু হলে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরো বলেন, আবাসিক এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা গার্মেন্ট কারখানা উচ্ছেদ করা হবে। এখন থেকে আবাসিক এলাকায় আর কোনো গার্মেন্ট কারখানা গড়ে উঠতে দেয়া হবে না। এসব কারখানাকে শিল্পাঞ্চলে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক অঞ্জন লাল ঘোষ বলেন, হাসপাতালে পাঁচজন নারীশ্রমিককে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। বিজেএমইএ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের প্রধান মনছুর খালেদ বলেন, কারখানাটি বিজিএমইএ’র কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেয়নি। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। খালেদা জিয়ার শোক : বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া আগুনে নিহত গার্মেন্টশ্রমিকদের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি নিহতদের স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। গত রাতে এক বিবৃতিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাদের রফতানি আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্টের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। সেখানে শ্রমিকদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। অথচ ব্যর্থ সরকার এ ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো কিছু তো করতেই পারছে না, উপরন্তু তাদের একের পর এক ভুল পদক্ষেপে পুরো গার্মেন্টশিল্প অস্থির হয়ে উঠেছে। ফলে গার্মেন্টশিল্প বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম। তিনি এ অবস্থার অবসানে ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
বেগম খালেদা জিয়া অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
No comments