ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তন- চলতে ফিরতে দেখা by ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
এখন যেসব তরুণ ছাত্রলীগের রাজনীতি করে, তাদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়,
ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ কী?
ধারণা করি, বেশির ভাগই এর
কোনো সঠিক জবাব দিতে পারবে না। কেউ কেউ হয়তো বলবে আওয়ামী লীগের আদর্শ
বাঙালি জাতীয়তাবাদ। আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ কীÑ এ প্রশ্নের জবাব দেয়া অনেক
আওয়ামী লীগারের পক্ষেও সম্ভব হবে না। কেননা জাতীয়তাবাদ কোনো ভাষাভিত্তিক
পরিচিতি নয়। এই পরিচিতি জাতিভিত্তিক। ভাষাভিত্তিক পরিচয়ই যদি হতো তাহলে
পৃথিবীতে ইংরেজি জাতীয়তাবাদ বলে একটি কথা বহু আগেই প্রচলিত হতো। কিন্তু
ইংরেজি জাতীয়তাবাদ, ফ্রেঞ্চ বা স্প্যানিশ জাতীয়তাবাদ বলে পৃথিবীতে কোনো
আদর্শের জন্ম হয়নি। ব্রিটেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া,
নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি। কিন্তু ইংরেজ বলে কোনো জাতি
নেই। কেউ ব্রিটিশ, কেউ কানাডিয়ান, কেউ মার্কিন, কেউ অস্ট্রেলিয়ান আবার কেউ
নাইজেরিয়ান। অর্থাৎ ভাষা যা-ই হোক, একটি দেশের জাতিসত্তা নির্ধারিত হয় সে
দেশের মানুষের আচার-আচরণ আর ধর্ম দিয়ে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদীর কথা আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেই প্রথম শুনেছি। তার অর্থ তিনি বোধ করি বলতে চেয়েছিলেন যে, বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে, তারা বাঙালি এবং সেটাই তাদের জাতীয়তাবাদ। বাংলা ভাষায় বাংলাদেশীরা যেমন কথা বলে, তেমনি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়েরও অনেক লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু তারা নিজেদের কখনো বাঙালি জাতি বলে দাবি করেনি। এটাই খুব স্বাভাবিক। নাইজেরিয়রা কখনো নিজেদের ইংরেজ ভাবে না। তারা নাইজেরিয়ান। তাদের আচার, আচরণ, ধর্ম, সংস্কৃতি ব্রিটিশদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র আলাদা জাতি। তারা নিজেদের ইংরেজ জাতীয়তাবাদী ভাবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সম্ভবত এই সত্য অস্পষ্ট ছিল। আর অস্পষ্ট ছিল বলেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ এখনো সেই বিভ্রান্তির ডুগডুগি বাজিয়েই চলেছে।
আজকের দিনে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে তার যদি এ কথা বলত যে, তাদের আদর্শ গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র কিংবা অন্য কোনো মতবাদ, তাহলে তার একটা অর্থ হতো। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদ এক অর্থহীন হুজুগ ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যদি এমন প্রশ্ন করি যে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ এই অর্থহীন প্রলাপেরই অংশ, তাহলে সম্ভবত সেটা ভুল হবে না। আর সে কারণেই আওয়ামী লীগে যা কয়েম হয়েছে, তা হলো লুটপাটতন্ত্র। পিস্তল-চাপাতিতন্ত্র। খুনতন্ত্র। যেকোনো উপায়েই হোক, প্রতিপক্ষকে দমন করা বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া আওয়ামী রাজনীতির আদর্শ।
শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে যা লিখেছেন, ধারণা করি, ছাত্রলীগ কেন, আওয়ামী লীগের নেতারাও গ্রন্থটি পড়ে দেখেননি। যদি পড়তেন, তাহলে তাদের বিভ্রম ইতোমধ্যেই অনেকাংশে কমে আসত। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতবর্ষে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করেছেন। এ কথা তিনি বারবার বলেছেন যে, পাকিস্তান গঠন ছাড়া এ দেশের মুসলমানদের মুক্তির কোনো উপায় নেই। আর অভিন্ন পাকিস্তানের জন্য তিনি পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-পূর্ব আমলে তুমুল আন্দোলন করেছেন। মুসলিম লীগের অপশাসন যখন চূড়ান্ত রূপ নেয়, তখন তিনি পাকিস্তানব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে অভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ওই বইয়ের ছত্রে ছত্রে তার উল্লেখ আছে। সেখানেও তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেননি। এমনকি রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রেও তার মত ছিল বাংলা ও উর্দু দু’টি ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হোক। সেটাই সম্ভবত খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যাযজ্ঞের পর পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ধারণাই ছিল না। নয় মাস বন্দী জীবনের পর তিনি যখন পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন, তখনই তিনি বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, পূর্ব পাকিস্তার বাংলাদেশ হিসেবে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং তিনি সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
তারপর পরিস্থিতি ভারী এলোমেলো হয়ে যায়। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার করণীয় ও আদর্শিক ভিত্তি কী হবে, সেটি তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। ফলে হুট করেই বলে দিলেন সেটি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ রকম একটি অর্থহীন ও ইতিহাস অনভিজ্ঞ হাওয়াই আদর্শ যখন সামনে থাকে তখন অরাজকতা জেঁকে বসতে বাধ্য। ফলে বাংলাদেশে অরাজকতার যাত্রা শুরু হয়। তার আদর্শ পরিণত হয় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হেন কোনো ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ নেই যা নেয়া হয়নি। আর সে কারণেই তিনি ক্ষমতায় আসীন হয়েই বিরোধী মত দলনে এবং বিরোধী রাজনীতি নিশ্চিহ্নকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই সে সময়ের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বিরুদ্ধে তিনি খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন। ওই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জেলে ঢুকান। রক্ষীবাহিনী গঠন করে বিরোধী দলের ওপর বর্বর নির্যাতনের পথ বেছে নেন। সেভাবে রক্ষীবাহিনী শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে প্রায় ৩০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করে। এ দেশের মানুষের কাছে সেটি ছিল অকল্পনীয় ঘটনা। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর তার এই নির্যাতন নিঃসন্দেহে মুসলিম লীগকেও হার মানিয়ে যায়।
কিন্তু এভাবে জনগণের কণ্ঠ যে স্তব্ধ করা যায় না। তাদের প্রতিবাদের ভাষাকে যে রুখে দেয়া যায় না। সেই উপলব্ধি শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল বলে মনে হয় না। অথচ তার রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা জুড়েই তিনি এই চণ্ড-নীতির প্রতিবাদ করে এসেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি কেন যে, এটি উপলব্ধি করতে পারলেন না সেটি ভিন্ন বিবেচনার বিষয়। যখন দেখা গেল, এই হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বিরোধী মত দমন করা যাচ্ছে না, তখন একেবারেই ফ্যাসিস্ট কায়দায় তিনি বিরোধী রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করতে উঠেপড়ে লেগে গেলেন। জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্য পত্রপত্রিকার বিরুদ্ধে প্রথমে আঘাত হানলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মত প্রকাশের স্বাধীনতা দলনের জন্য এমন আইন করে বসলেন যে, মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাও তাতে বাধাগ্রস্ত হতে থাকল। সরকারি কর্মকর্তা কেউ কবিতা লিখলেও তা সরকারকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে, এমন আইনও তিনি জারি করেছিলেন। তাতেও যখন তার সরকারের জুলুমের বিরোধিতা থামানো যাচ্ছিল না, তখন তিনি সংবিধান সংশোধন করে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। সব সরকারি কর্মকর্তা ও সশস্ত্রবাহিনীর সবার জন্য এই দলে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। আর অন্য সব রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিষিদ্ধ করা হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার লক্ষ্যে চারটি ছাড়া তিনি দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন। এ যেন চোখ বন্ধ করে প্রলয় ঠেকানোর কৌশল। সেভাবেই ১৯৭২-৭৫ সালে এ দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল।
১৯৯৬-২০০১-এ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনো অসহিষ্ণুতা ছিল। বিরোধী দলকে দলন নির্যাতন ছিল। কিন্তু এভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়নি। এবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শেখ মুজিব যে বাকশাল গঠন করেছিলেন, তাতেও এমনই আয়োজন ছিল। যেন তিনি চিরজীবী হবেন এবং তারপর আর এ দেশে কোনো সরকার আসবে না। সংবিধান সংশোধন করে যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল তাতে শেখ মুজিবুর রহমান এমনভাবে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন ‘যেন তিনি নির্বাচিত হইয়াছেন’। কিন্তু তার প্রস্থানের কোনো পথ ছিল না। তবে তাকে বিদায় নিতেই হয়েছে। সেটি ছিল ‘অমোঘ নিয়তি’।
বর্তমান মেয়াদে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই পরিত্যক্ত পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছেন। বিরোধী দল দমনে হেন কোনো ইতর পথ নেই, যে পথে তিনি পা বাড়াচ্ছেন না। এমনকি ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিব যাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন সাধারণ ক্ষমায়, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে, বিরোধী দল দমনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ৪১ বছর পর শেখ হাসিনা তাদের বিচার শুরু করেছেন। দেশে-বিদেশে কারো কাছে এখন আর এটা অস্পষ্ট নেই যে, এর লক্ষ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। শুধু জামায়াত বলে কথা নয়, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ওপরও তিনি খড়গহস্ত। ঠুনকো কারণ দেখিয়ে আর অবাস্তব যুক্তি উপস্থাপন করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কারাবন্দী রাখা হয়েছে। পুলিশের সাথে নামিয়ে দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগের রক্তপিপাসু ক্যাডারদের এবং কী আশ্চর্য, পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েই তারা অস্ত্রে মহড়া দিচ্ছে। গুলি শেষ হয়ে গেল ম্যাগাজিন ভরছে। রামদা নিয়ে বিরোধী দল কিংবা প্রতিপক্ষকে এমনকি নিরীহ পথচারীকেও কুপিয়ে হত্যা করছে। পুলিশ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকছে। এর পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে অতীত থেকে সে শিক্ষা আওয়ামী লীগ মোটেও গ্রহণ করেনি। আর এসব ক্ষেত্রে ছাত্রলীগকে রেহাই দেয়ার জন্য পুলিশ, প্রশাসন, সরকার সবাই একযোগে কাজ করছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিপক্ষ দমনে ছাত্রলীগ, যুবলীগকে মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর শান্তিপূর্ণ সমাবেশে এক পুলিশ কর্মকর্তা পৈশাচিকভাবে হামলে পড়ে। তাকে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ বছর রাষ্ট্রপতির পদকে ভূষিত করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুক ফুলিয়ে বলেছেন, হ্যাঁ, জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর পৈশাচিক হামলা চালানোই তার বীরত্বপূর্ণ অবদান এবং সে কারণেই তাকে রাষ্ট্রপতির পদকে ভূষিত করা হয়েছে। এটি সভ্য জগতে অকল্পনীয়। বর্বর আদিম সমাজে হয়তো সম্ভব ছিল। এখন আমরা তেমনই একদল বর্বর শাসকের অধীনে কালাতিপাত করছি। আদিম সমাজের পর গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে জার্মানির শাসনক্ষমতায় এসেছিলেন এডলফ হিটলার। আর ইতালির শাসনক্ষমতায় এসেছিলেন মুসোলিনি। তাদের শাসনকালে ওই সমাজে এমন অবস্থা ঘটেছিল, যা এখন বাংলাদেশে চলছে।
হিটলার কিংবা মুসোলিনি, কারো শাসনক্ষমতাই ওই দু’টি দেশে চিরস্থায়ী হয়নি। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগের শাসন কী, সে সম্পর্কে অবহিত নয়। তারা হয়তো ফ্যাসিবাদের নাম শুনেছে। এখন তার নমুনা দেখছে। সম্ভবত এটিরও প্রয়োজন ছিল। হিটলার-মুসোলিনি ইতিহাসে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। বাংলাদেশেও বর্তমান অন্ধকার যুগ কোনো দিন চিরস্থায়ী হবে না। আর এই শাসকেরা ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে এ দেশের ইতিহাসে অনন্তকাল ধরে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। সন্ধ্যা নামলে সকাল হয়ই। আমরা সেই উজ্জ্বল প্রত্যুষের আশায় বুক বেঁধে আছি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
বাঙালি জাতীয়তাবাদীর কথা আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেই প্রথম শুনেছি। তার অর্থ তিনি বোধ করি বলতে চেয়েছিলেন যে, বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে, তারা বাঙালি এবং সেটাই তাদের জাতীয়তাবাদ। বাংলা ভাষায় বাংলাদেশীরা যেমন কথা বলে, তেমনি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়েরও অনেক লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু তারা নিজেদের কখনো বাঙালি জাতি বলে দাবি করেনি। এটাই খুব স্বাভাবিক। নাইজেরিয়রা কখনো নিজেদের ইংরেজ ভাবে না। তারা নাইজেরিয়ান। তাদের আচার, আচরণ, ধর্ম, সংস্কৃতি ব্রিটিশদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র আলাদা জাতি। তারা নিজেদের ইংরেজ জাতীয়তাবাদী ভাবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সম্ভবত এই সত্য অস্পষ্ট ছিল। আর অস্পষ্ট ছিল বলেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগ এখনো সেই বিভ্রান্তির ডুগডুগি বাজিয়েই চলেছে।
আজকের দিনে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে তার যদি এ কথা বলত যে, তাদের আদর্শ গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র কিংবা অন্য কোনো মতবাদ, তাহলে তার একটা অর্থ হতো। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদ এক অর্থহীন হুজুগ ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যদি এমন প্রশ্ন করি যে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ এই অর্থহীন প্রলাপেরই অংশ, তাহলে সম্ভবত সেটা ভুল হবে না। আর সে কারণেই আওয়ামী লীগে যা কয়েম হয়েছে, তা হলো লুটপাটতন্ত্র। পিস্তল-চাপাতিতন্ত্র। খুনতন্ত্র। যেকোনো উপায়েই হোক, প্রতিপক্ষকে দমন করা বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া আওয়ামী রাজনীতির আদর্শ।
শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে যা লিখেছেন, ধারণা করি, ছাত্রলীগ কেন, আওয়ামী লীগের নেতারাও গ্রন্থটি পড়ে দেখেননি। যদি পড়তেন, তাহলে তাদের বিভ্রম ইতোমধ্যেই অনেকাংশে কমে আসত। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতবর্ষে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করেছেন। এ কথা তিনি বারবার বলেছেন যে, পাকিস্তান গঠন ছাড়া এ দেশের মুসলমানদের মুক্তির কোনো উপায় নেই। আর অভিন্ন পাকিস্তানের জন্য তিনি পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-পূর্ব আমলে তুমুল আন্দোলন করেছেন। মুসলিম লীগের অপশাসন যখন চূড়ান্ত রূপ নেয়, তখন তিনি পাকিস্তানব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে অভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ওই বইয়ের ছত্রে ছত্রে তার উল্লেখ আছে। সেখানেও তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেননি। এমনকি রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রেও তার মত ছিল বাংলা ও উর্দু দু’টি ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হোক। সেটাই সম্ভবত খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যাযজ্ঞের পর পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ধারণাই ছিল না। নয় মাস বন্দী জীবনের পর তিনি যখন পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন, তখনই তিনি বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, পূর্ব পাকিস্তার বাংলাদেশ হিসেবে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং তিনি সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
তারপর পরিস্থিতি ভারী এলোমেলো হয়ে যায়। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার করণীয় ও আদর্শিক ভিত্তি কী হবে, সেটি তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। ফলে হুট করেই বলে দিলেন সেটি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এ রকম একটি অর্থহীন ও ইতিহাস অনভিজ্ঞ হাওয়াই আদর্শ যখন সামনে থাকে তখন অরাজকতা জেঁকে বসতে বাধ্য। ফলে বাংলাদেশে অরাজকতার যাত্রা শুরু হয়। তার আদর্শ পরিণত হয় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হেন কোনো ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ নেই যা নেয়া হয়নি। আর সে কারণেই তিনি ক্ষমতায় আসীন হয়েই বিরোধী মত দলনে এবং বিরোধী রাজনীতি নিশ্চিহ্নকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেন। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই সে সময়ের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বিরুদ্ধে তিনি খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন। ওই দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জেলে ঢুকান। রক্ষীবাহিনী গঠন করে বিরোধী দলের ওপর বর্বর নির্যাতনের পথ বেছে নেন। সেভাবে রক্ষীবাহিনী শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে প্রায় ৩০ হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে হত্যা করে। এ দেশের মানুষের কাছে সেটি ছিল অকল্পনীয় ঘটনা। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর তার এই নির্যাতন নিঃসন্দেহে মুসলিম লীগকেও হার মানিয়ে যায়।
কিন্তু এভাবে জনগণের কণ্ঠ যে স্তব্ধ করা যায় না। তাদের প্রতিবাদের ভাষাকে যে রুখে দেয়া যায় না। সেই উপলব্ধি শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল বলে মনে হয় না। অথচ তার রাজনৈতিক জীবনের পুরোটা জুড়েই তিনি এই চণ্ড-নীতির প্রতিবাদ করে এসেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি কেন যে, এটি উপলব্ধি করতে পারলেন না সেটি ভিন্ন বিবেচনার বিষয়। যখন দেখা গেল, এই হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বিরোধী মত দমন করা যাচ্ছে না, তখন একেবারেই ফ্যাসিস্ট কায়দায় তিনি বিরোধী রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করতে উঠেপড়ে লেগে গেলেন। জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্য পত্রপত্রিকার বিরুদ্ধে প্রথমে আঘাত হানলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মত প্রকাশের স্বাধীনতা দলনের জন্য এমন আইন করে বসলেন যে, মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাও তাতে বাধাগ্রস্ত হতে থাকল। সরকারি কর্মকর্তা কেউ কবিতা লিখলেও তা সরকারকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে, এমন আইনও তিনি জারি করেছিলেন। তাতেও যখন তার সরকারের জুলুমের বিরোধিতা থামানো যাচ্ছিল না, তখন তিনি সংবিধান সংশোধন করে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। সব সরকারি কর্মকর্তা ও সশস্ত্রবাহিনীর সবার জন্য এই দলে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। আর অন্য সব রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা নিষিদ্ধ করা হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার লক্ষ্যে চারটি ছাড়া তিনি দেশের সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন। এ যেন চোখ বন্ধ করে প্রলয় ঠেকানোর কৌশল। সেভাবেই ১৯৭২-৭৫ সালে এ দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল।
১৯৯৬-২০০১-এ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনো অসহিষ্ণুতা ছিল। বিরোধী দলকে দলন নির্যাতন ছিল। কিন্তু এভাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়নি। এবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শেখ মুজিব যে বাকশাল গঠন করেছিলেন, তাতেও এমনই আয়োজন ছিল। যেন তিনি চিরজীবী হবেন এবং তারপর আর এ দেশে কোনো সরকার আসবে না। সংবিধান সংশোধন করে যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল তাতে শেখ মুজিবুর রহমান এমনভাবে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন ‘যেন তিনি নির্বাচিত হইয়াছেন’। কিন্তু তার প্রস্থানের কোনো পথ ছিল না। তবে তাকে বিদায় নিতেই হয়েছে। সেটি ছিল ‘অমোঘ নিয়তি’।
বর্তমান মেয়াদে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই পরিত্যক্ত পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছেন। বিরোধী দল দমনে হেন কোনো ইতর পথ নেই, যে পথে তিনি পা বাড়াচ্ছেন না। এমনকি ১৯৭৩ সালে শেখ মুজিব যাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন সাধারণ ক্ষমায়, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে, বিরোধী দল দমনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ৪১ বছর পর শেখ হাসিনা তাদের বিচার শুরু করেছেন। দেশে-বিদেশে কারো কাছে এখন আর এটা অস্পষ্ট নেই যে, এর লক্ষ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। শুধু জামায়াত বলে কথা নয়, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ওপরও তিনি খড়গহস্ত। ঠুনকো কারণ দেখিয়ে আর অবাস্তব যুক্তি উপস্থাপন করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কারাবন্দী রাখা হয়েছে। পুলিশের সাথে নামিয়ে দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগের রক্তপিপাসু ক্যাডারদের এবং কী আশ্চর্য, পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েই তারা অস্ত্রে মহড়া দিচ্ছে। গুলি শেষ হয়ে গেল ম্যাগাজিন ভরছে। রামদা নিয়ে বিরোধী দল কিংবা প্রতিপক্ষকে এমনকি নিরীহ পথচারীকেও কুপিয়ে হত্যা করছে। পুলিশ নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকছে। এর পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে অতীত থেকে সে শিক্ষা আওয়ামী লীগ মোটেও গ্রহণ করেনি। আর এসব ক্ষেত্রে ছাত্রলীগকে রেহাই দেয়ার জন্য পুলিশ, প্রশাসন, সরকার সবাই একযোগে কাজ করছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিপক্ষ দমনে ছাত্রলীগ, যুবলীগকে মাঠে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর শান্তিপূর্ণ সমাবেশে এক পুলিশ কর্মকর্তা পৈশাচিকভাবে হামলে পড়ে। তাকে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ বছর রাষ্ট্রপতির পদকে ভূষিত করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুক ফুলিয়ে বলেছেন, হ্যাঁ, জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর পৈশাচিক হামলা চালানোই তার বীরত্বপূর্ণ অবদান এবং সে কারণেই তাকে রাষ্ট্রপতির পদকে ভূষিত করা হয়েছে। এটি সভ্য জগতে অকল্পনীয়। বর্বর আদিম সমাজে হয়তো সম্ভব ছিল। এখন আমরা তেমনই একদল বর্বর শাসকের অধীনে কালাতিপাত করছি। আদিম সমাজের পর গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে জার্মানির শাসনক্ষমতায় এসেছিলেন এডলফ হিটলার। আর ইতালির শাসনক্ষমতায় এসেছিলেন মুসোলিনি। তাদের শাসনকালে ওই সমাজে এমন অবস্থা ঘটেছিল, যা এখন বাংলাদেশে চলছে।
হিটলার কিংবা মুসোলিনি, কারো শাসনক্ষমতাই ওই দু’টি দেশে চিরস্থায়ী হয়নি। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগের শাসন কী, সে সম্পর্কে অবহিত নয়। তারা হয়তো ফ্যাসিবাদের নাম শুনেছে। এখন তার নমুনা দেখছে। সম্ভবত এটিরও প্রয়োজন ছিল। হিটলার-মুসোলিনি ইতিহাসে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। বাংলাদেশেও বর্তমান অন্ধকার যুগ কোনো দিন চিরস্থায়ী হবে না। আর এই শাসকেরা ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে এ দেশের ইতিহাসে অনন্তকাল ধরে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। সন্ধ্যা নামলে সকাল হয়ই। আমরা সেই উজ্জ্বল প্রত্যুষের আশায় বুক বেঁধে আছি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
No comments