দুই এলাকার আলোর নিচে ১৩ এলাকার আঁধার by অমিতোষ পাল
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে সংসদীয় এলাকার সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে ১৩টি এলাকার রাস্তাঘাটে মহাজোট সরকারের গত চার বছরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। এসব এলাকার রাস্তাঘাটের চেহারা চার বছর আগে যেমন ছিল, এখন তার চেয়ে খারাপ।
অবশ্য ব্যতিক্রমীভাবে দুটি এলাকায় চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন কাজ হয়েছে। দুই এলাকায় এমপিদের সক্রিয় তৎপরতার সুবাদেই এটা হয়েছে বলে এলাকাবাসী মনে করেন। খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে রাজধানীর ওয়ার্ডগুলো কাউন্সিলরশূন্য থাকায় এলাকার উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়ার বিশেষ কেউ নেই। রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের বিস্তর অভিযোগ। কিন্তু শোনার লোক নেই। স্থানীয় সংসদ সদস্যরা রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের আশ্বাস দিলেও তার বাস্তবায়ন ঘটেনি রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায়। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট এমপিদের অনেকেই তাঁদের এলাকায় উন্নয়ন না হওয়ার বিষয়টি মেনে নেননি।
সরেজমিনে ঘুরে এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা-১২ (ধানমণ্ডি ও লালবাগ থানার অংশবিশেষ) ও ঢাকা-১৩ (মোহাম্মদপুর ও শেরে বাংলানগর থানার পশ্চিম আগারগাঁও অংশ) আসন ছাড়া রাজধানীর অন্য কোনো সংসদীয় আসনে উন্নয়ন কাজ তেমন একটা হয়নি। ঢাকা-১২ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। এই দুটি এলাকার চেহারা গত চার বছরে অনেকটাই পাল্টেছে। বর্তমানে দুই এলাকায় বেশ কিছু সড়ক-উপসড়কে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। এতে এসব এলাকার বাসিন্দারা খুশি হলেও অন্য এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের ভোগান্তির কারণে বেশ ক্ষুব্ধ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ধানমণ্ডি ৫০ বছর আগের উন্নত এলাকা। সেখানে আগে থেকেই রাস্তা ভালো। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরে কেজ (ক্লিন এয়ার সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট) প্রকল্প থেকে আলাদা উন্নয়ন কাজ হয়েছিল। অন্যদিকে খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন এলাকায় রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ। ড্রেনেজ সুবিধা নেই। আবার রাস্তা করলেও বেশি দিন টেকে না। জলাবদ্ধতার কারণে ঘরের ভেতর পানি উঠে যায়। এখন যেসব এলাকার অবস্থা খারাপ, সে দিকে বেশি বরাদ্দ দিয়ে আমরা সমতা আনার চেষ্টা করছি।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে উত্তর মিরপুর এলাকা। এ এলাকার সংসদ সদস্য হলেন কামাল আহমেদ মজুমদার ও ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। এ ছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নির্বাচনী এলাকার কিছু অংশও মিরপুরে পড়েছে। তাঁর অধীনে পড়া ভাষানটেক এলাকার উন্নয়ন চিত্রও হতাশাজনক।
সরেজমিন : মিরপুর এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হলো দক্ষিণ গাবতলী থেকে শুরু হয়ে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে কচুক্ষেত হয়ে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত সড়ক। মিরপুর থেকে এয়ারপোর্ট রোডে যাওয়ার এটাই একমাত্র সড়ক। বিগত ১২ বছরে এই সড়কটির কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাস্তাটির সর্বত্র খানাখন্দে ভরা, বৃষ্টি হলেই সড়কের ওপর যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে। সড়কটির বেশ কয়েকটি পয়েন্টের অবস্থা খুবই নাজুক। বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনের অংশ ইট-সুরকি উঠে গিয়ে বেহাল হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা হারমেইন মেইনার স্কুল, পুলিশ স্টাফ কলেজ, ১৪ নম্বরের ডেন্টাল কলেজ, সিআরপি হাসপাতাল, ন্যাম ভিলেজ, বনফুল, মিরপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ইব্রাহিমপুর শাখা এলাকার সড়কের। হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তির শিকার হন এই পথে চলাচল করতে গিয়ে। সরকারি অর্থে সড়কটির উন্নয়ন হবে- এ কথা বলে সিটি করপোরেশন ১০ বছর ধরে কোনো কাজ করেনি।
আরো খারাপ অবস্থা মিরপুরের সিরামিক রোডের। এ সড়কে যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। মিরপুর ১২ নম্বর বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে বঙ্গবন্ধু কলেজ (সাগুফতা হাউজিং এলাকা) হয়ে জিয়া কলোনি পর্যন্ত ৭৫ ফুট চওড়া এ সংযোগ সড়কটি কোনো কাজে আসছে না। সড়কটি উন্নয়নের জন্য অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) কর্তৃপক্ষ চেষ্টা-তদবির করেও সরকারি বরাদ্দ আনতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিগত চার বছরে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরাও সরকারি অর্থায়নের বন্দোবস্ত করতে পারেননি। এ ছাড়া মিরপুর এলাকার দেওয়ানপাড়া, বালুঘাট, মাটিকাটা, ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থাও বেশ খারাপ।
উত্তরার চিত্র : রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাত ও ডিভাইডার না করেই দুই দশকেরও বেশি সময় আগে পরিকল্পিত এই বিশাল আবাসিক এলাকাটি ডিসিসির কাছে হস্তান্তর করেছিল রাজউক। এলাকার প্রধান কয়েকটি সড়ক ছাড়া অন্য সব সড়কের উন্নয়ন নিয়ে শুরু থেকেই হিমশিম খাচ্ছে ডিসিসি। উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান, অন্য ওয়ার্ডের এলাকার চেয়ে আটগুণ বেশি হলেও এখানে একটি মাত্র ওয়ার্ড। ওয়ার্ডভিত্তিক প্রতিবছর এক কোটি-দেড় কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ হয়। ওই অর্থ দিয়ে এত বড় এলাকার উন্নয়ন সম্ভব হয় না। সংসদ সদস্যরাও এলাকার উন্নয়ন বরাদ্দ আনতে তেমন সক্রিয় নন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এ এলাকার সংসদ সদস্য হলেন ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নির্বাচনী এলাকারও কিছু অংশ উত্তরার মধ্যে পড়েছে। আর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দারা এ আসনের ভোটার হলেও এখানকার উন্নয়নকাজ করে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড।
অন্যান্য এলাকা : গুলশান এলাকার চেহারা অপেক্ষাকৃত ভালো হলেও গুলশান লেক পার হলেই দৃশ্যপট পুরোপুরি উল্টো। নতুনবাজার, বাড্ডা, শাহজাদপুর, কালাচাঁদপুর, বারিধারা জে ব্লক, বাড্ডার পূর্ব পাশ, সাঁতারকুল থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত এলাকার প্রধান সড়ক প্রগতি সরণি বাদ দিলে পাড়া-মহল্লার সব রাস্তাই খারাপ। নেই কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা। যে যার মতো ঘরবাড়ি তুলে পুরো এলাকাকে ঘিঞ্জি করে ফেলেছে। আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত রাস্তাগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। শুষ্ক মৌসুমেও পানি জমে থাকে। ময়লা-আবর্জনার জন্য হাঁটাচলাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই এলাকার সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ। এ ছাড়া অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের নির্বাচনী এলাকার কিছু অংশও এর মধ্যে রয়েছে।
একই অবস্থা রাজধানীর ডেমরা, পুরান ঢাকা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, মতিঝিল, তেজগাঁও, লালবাগ, সূত্রাপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকার। এসব এলাকার সংসদ সদস্যরা হলেন- হাবিবুর রহমান মোল্লা, মিজানুর রহমান খান দিপু, সানজিদা খানম, সাবের হোসেন চৌধুরী, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও আসাদুজ্জামান খান কামাল।
ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুর : গত চার বছরের মধ্যে এ দুটি এলাকার জন্য পৃথক দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ডিসিসি। একটির নাম মোহাম্মদপুর-আদাবর উন্নয়ন প্রকল্প। অন্যটি কেজ প্রজেক্ট। এর আওতায় দুটি এলাকায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ার্ডভিত্তিক রুটিন বরাদ্দ, সমগ্র মহানগরী এলাকার উন্নয়নে গৃহীত মহানগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট উন্নয়ন মেরামত প্রকল্প থেকেও এ দুটি এলাকায় উন্নয়ন কাজ হয়েছে। পাশাপাশি এমপি প্রজেক্ট নামে নেওয়া নতুন প্রকল্পের অধীনেও এখানে উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকেও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে এ এলাকায় কাজ হয়েছে। এসব কারণেই এ দুটি এলাকায় উন্নয়নের মাত্রা বেশি।
এসব বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মামুন রেজা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এলাকা দেখে বরাদ্দ দিচ্ছি না। যেখানে প্রয়োজন সেখানেই কাজ করা হচ্ছে। বর্তমানে উত্তর এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থাও ভালো।'
সংসদ সদস্যরা যা বলেন : ঢাকা-৫ (যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকা) আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নানক সাহেব প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কিছু সুবিধা ও বরাদ্দ বেশি পাবেন এটাই স্বাভাবিক। আর ধানমণ্ডি অনেক আগে থেকেই বনেদি এলাকা। এ জন্য সেটাও বেশি গুরুত্ব পাবে। তাই বলে আমার এলাকায় কাজ হয়নি, তা বলা যাবে না। ধানমণ্ডি এলাকার ১০টি রাস্তার সমান আমার এলাকার একটি রাস্তা। আমরা যা বরাদ্দ পাই, তা দিয়ে চাহিদা মতো কাজ করা যায় না। এর পরও আমার এলাকায় অনেক কাজ হয়েছে।'
ঢাকা-১৪ আসনের (গাবতলী ও মিরপুর ১ নম্বর এলাকা) সংসদ সদস্য আসলামুল হক আসলাম বলেন, 'আমার এলাকায় ১০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছি। ১৮টি চিকন রাস্তাকে ৩০ ফুট চওড়া করেছি। জোর দিয়ে বলতে পারি, নানক ভাইয়ের এলাকা ছাড়া আর কোনো এমপির এলাকায় আমার এলাকার চেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়নি। মাজার রোডের কাজ শেষের পথে। যে দুই-একটা রাস্তা এখনো আধুনিকায়ন করা হয়নি, সেগুলো আগামী জুনের মধ্যে শেষ করে ফেলব। এখন আমি ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে লোকজনকে বলেছি কার এলাকায় কী সমস্যা আছে সেটা জানানোর জন্য। রাস্তাঘাট খারাপ আছে কি না, মাদকের কী অবস্থা, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ আছে কি না। তারা ই-মেইলের মাধ্যমে জানাবে।'
সরেজমিনে ঘুরে এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা-১২ (ধানমণ্ডি ও লালবাগ থানার অংশবিশেষ) ও ঢাকা-১৩ (মোহাম্মদপুর ও শেরে বাংলানগর থানার পশ্চিম আগারগাঁও অংশ) আসন ছাড়া রাজধানীর অন্য কোনো সংসদীয় আসনে উন্নয়ন কাজ তেমন একটা হয়নি। ঢাকা-১২ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। এই দুটি এলাকার চেহারা গত চার বছরে অনেকটাই পাল্টেছে। বর্তমানে দুই এলাকায় বেশ কিছু সড়ক-উপসড়কে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। এতে এসব এলাকার বাসিন্দারা খুশি হলেও অন্য এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের ভোগান্তির কারণে বেশ ক্ষুব্ধ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ধানমণ্ডি ৫০ বছর আগের উন্নত এলাকা। সেখানে আগে থেকেই রাস্তা ভালো। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরে কেজ (ক্লিন এয়ার সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট) প্রকল্প থেকে আলাদা উন্নয়ন কাজ হয়েছিল। অন্যদিকে খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন এলাকায় রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ। ড্রেনেজ সুবিধা নেই। আবার রাস্তা করলেও বেশি দিন টেকে না। জলাবদ্ধতার কারণে ঘরের ভেতর পানি উঠে যায়। এখন যেসব এলাকার অবস্থা খারাপ, সে দিকে বেশি বরাদ্দ দিয়ে আমরা সমতা আনার চেষ্টা করছি।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে উত্তর মিরপুর এলাকা। এ এলাকার সংসদ সদস্য হলেন কামাল আহমেদ মজুমদার ও ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। এ ছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নির্বাচনী এলাকার কিছু অংশও মিরপুরে পড়েছে। তাঁর অধীনে পড়া ভাষানটেক এলাকার উন্নয়ন চিত্রও হতাশাজনক।
সরেজমিন : মিরপুর এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হলো দক্ষিণ গাবতলী থেকে শুরু হয়ে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে কচুক্ষেত হয়ে ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত সড়ক। মিরপুর থেকে এয়ারপোর্ট রোডে যাওয়ার এটাই একমাত্র সড়ক। বিগত ১২ বছরে এই সড়কটির কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাস্তাটির সর্বত্র খানাখন্দে ভরা, বৃষ্টি হলেই সড়কের ওপর যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে। সড়কটির বেশ কয়েকটি পয়েন্টের অবস্থা খুবই নাজুক। বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনের অংশ ইট-সুরকি উঠে গিয়ে বেহাল হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা হারমেইন মেইনার স্কুল, পুলিশ স্টাফ কলেজ, ১৪ নম্বরের ডেন্টাল কলেজ, সিআরপি হাসপাতাল, ন্যাম ভিলেজ, বনফুল, মিরপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ইব্রাহিমপুর শাখা এলাকার সড়কের। হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তির শিকার হন এই পথে চলাচল করতে গিয়ে। সরকারি অর্থে সড়কটির উন্নয়ন হবে- এ কথা বলে সিটি করপোরেশন ১০ বছর ধরে কোনো কাজ করেনি।
আরো খারাপ অবস্থা মিরপুরের সিরামিক রোডের। এ সড়কে যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। মিরপুর ১২ নম্বর বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে বঙ্গবন্ধু কলেজ (সাগুফতা হাউজিং এলাকা) হয়ে জিয়া কলোনি পর্যন্ত ৭৫ ফুট চওড়া এ সংযোগ সড়কটি কোনো কাজে আসছে না। সড়কটি উন্নয়নের জন্য অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) কর্তৃপক্ষ চেষ্টা-তদবির করেও সরকারি বরাদ্দ আনতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিগত চার বছরে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরাও সরকারি অর্থায়নের বন্দোবস্ত করতে পারেননি। এ ছাড়া মিরপুর এলাকার দেওয়ানপাড়া, বালুঘাট, মাটিকাটা, ক্যান্টনমেন্টের আশপাশের এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থাও বেশ খারাপ।
উত্তরার চিত্র : রাস্তা, ড্রেন, ফুটপাত ও ডিভাইডার না করেই দুই দশকেরও বেশি সময় আগে পরিকল্পিত এই বিশাল আবাসিক এলাকাটি ডিসিসির কাছে হস্তান্তর করেছিল রাজউক। এলাকার প্রধান কয়েকটি সড়ক ছাড়া অন্য সব সড়কের উন্নয়ন নিয়ে শুরু থেকেই হিমশিম খাচ্ছে ডিসিসি। উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান, অন্য ওয়ার্ডের এলাকার চেয়ে আটগুণ বেশি হলেও এখানে একটি মাত্র ওয়ার্ড। ওয়ার্ডভিত্তিক প্রতিবছর এক কোটি-দেড় কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ হয়। ওই অর্থ দিয়ে এত বড় এলাকার উন্নয়ন সম্ভব হয় না। সংসদ সদস্যরাও এলাকার উন্নয়ন বরাদ্দ আনতে তেমন সক্রিয় নন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এ এলাকার সংসদ সদস্য হলেন ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নির্বাচনী এলাকারও কিছু অংশ উত্তরার মধ্যে পড়েছে। আর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দারা এ আসনের ভোটার হলেও এখানকার উন্নয়নকাজ করে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড।
অন্যান্য এলাকা : গুলশান এলাকার চেহারা অপেক্ষাকৃত ভালো হলেও গুলশান লেক পার হলেই দৃশ্যপট পুরোপুরি উল্টো। নতুনবাজার, বাড্ডা, শাহজাদপুর, কালাচাঁদপুর, বারিধারা জে ব্লক, বাড্ডার পূর্ব পাশ, সাঁতারকুল থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত এলাকার প্রধান সড়ক প্রগতি সরণি বাদ দিলে পাড়া-মহল্লার সব রাস্তাই খারাপ। নেই কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা। যে যার মতো ঘরবাড়ি তুলে পুরো এলাকাকে ঘিঞ্জি করে ফেলেছে। আঁকাবাঁকা অপ্রশস্ত রাস্তাগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। শুষ্ক মৌসুমেও পানি জমে থাকে। ময়লা-আবর্জনার জন্য হাঁটাচলাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। এই এলাকার সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহ। এ ছাড়া অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের নির্বাচনী এলাকার কিছু অংশও এর মধ্যে রয়েছে।
একই অবস্থা রাজধানীর ডেমরা, পুরান ঢাকা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, মতিঝিল, তেজগাঁও, লালবাগ, সূত্রাপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকার। এসব এলাকার সংসদ সদস্যরা হলেন- হাবিবুর রহমান মোল্লা, মিজানুর রহমান খান দিপু, সানজিদা খানম, সাবের হোসেন চৌধুরী, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও আসাদুজ্জামান খান কামাল।
ধানমণ্ডি-মোহাম্মদপুর : গত চার বছরের মধ্যে এ দুটি এলাকার জন্য পৃথক দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ডিসিসি। একটির নাম মোহাম্মদপুর-আদাবর উন্নয়ন প্রকল্প। অন্যটি কেজ প্রজেক্ট। এর আওতায় দুটি এলাকায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ার্ডভিত্তিক রুটিন বরাদ্দ, সমগ্র মহানগরী এলাকার উন্নয়নে গৃহীত মহানগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট উন্নয়ন মেরামত প্রকল্প থেকেও এ দুটি এলাকায় উন্নয়ন কাজ হয়েছে। পাশাপাশি এমপি প্রজেক্ট নামে নেওয়া নতুন প্রকল্পের অধীনেও এখানে উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকেও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে এ এলাকায় কাজ হয়েছে। এসব কারণেই এ দুটি এলাকায় উন্নয়নের মাত্রা বেশি।
এসব বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মামুন রেজা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা এলাকা দেখে বরাদ্দ দিচ্ছি না। যেখানে প্রয়োজন সেখানেই কাজ করা হচ্ছে। বর্তমানে উত্তর এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থাও ভালো।'
সংসদ সদস্যরা যা বলেন : ঢাকা-৫ (যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকা) আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নানক সাহেব প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কিছু সুবিধা ও বরাদ্দ বেশি পাবেন এটাই স্বাভাবিক। আর ধানমণ্ডি অনেক আগে থেকেই বনেদি এলাকা। এ জন্য সেটাও বেশি গুরুত্ব পাবে। তাই বলে আমার এলাকায় কাজ হয়নি, তা বলা যাবে না। ধানমণ্ডি এলাকার ১০টি রাস্তার সমান আমার এলাকার একটি রাস্তা। আমরা যা বরাদ্দ পাই, তা দিয়ে চাহিদা মতো কাজ করা যায় না। এর পরও আমার এলাকায় অনেক কাজ হয়েছে।'
ঢাকা-১৪ আসনের (গাবতলী ও মিরপুর ১ নম্বর এলাকা) সংসদ সদস্য আসলামুল হক আসলাম বলেন, 'আমার এলাকায় ১০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করেছি। ১৮টি চিকন রাস্তাকে ৩০ ফুট চওড়া করেছি। জোর দিয়ে বলতে পারি, নানক ভাইয়ের এলাকা ছাড়া আর কোনো এমপির এলাকায় আমার এলাকার চেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়নি। মাজার রোডের কাজ শেষের পথে। যে দুই-একটা রাস্তা এখনো আধুনিকায়ন করা হয়নি, সেগুলো আগামী জুনের মধ্যে শেষ করে ফেলব। এখন আমি ই-মেইল ঠিকানা দিয়ে লোকজনকে বলেছি কার এলাকায় কী সমস্যা আছে সেটা জানানোর জন্য। রাস্তাঘাট খারাপ আছে কি না, মাদকের কী অবস্থা, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ আছে কি না। তারা ই-মেইলের মাধ্যমে জানাবে।'
No comments