পেছন ফিরে দেখা-গণতন্ত্রের নদী সময়ের মতো বহমান by নাসির আহমেদ
দেখতে দেখতে কী দ্রুত চলে গেল খ্রিস্টীয় সাল ২০১২। আমাদের সবার জীবন থেকে একটা বছর ফুরিয়ে গেল। আসলে আক্ষেপের হলেও সময় এমনই। আশ্চর্য গতিশীলতার এক প্রবাহের নাম সময়। কোনো প্রতিবন্ধকতা, স্তব্ধ করে দিতে পারে না সময়ের এই নিরন্তর চলমানতা। সময়ই সব সমস্যা মীমাংসা করে দেয়।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা অনেক সময় সেই চিরন্তন বাস্তবতাকে ভুলে যাই। সময়কে দুঃসময়ের খাঁচায় আবদ্ধ করতে চাই। গণতন্ত্রের মতো জরুরি গণঅধিকারও সামরিক শাসকরা রুদ্ধ করতে চায়। সময়ের প্রবাহ সেই বাঁধ ভেঙে দেয় ঠিকই। গণতন্ত্রের মুক্তিই অনিবার্য। তা না হলে সভ্যতা অগ্রসর হয় না।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে চলি্লশ দশকের অন্যতম প্রধান কবি আহসান হাবীবের একটি কবিতার কথা। সামরিক শাসন দ্বিতীয়টি তখনও শুরু হয়নি। সামরিক শাসনকবলিত সমাজে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ যে কী অবক্ষয়ের মুখে পড়েছিল, সেই ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশ পেয়েছিল চিত্রকল্পময় ওই কবিতায়_ 'এখন অসুখী কোনো বালকের কাছে নীল প্রজাপতি নেই/ফুলমতির মায়াজালে মাছ নেই, চুপচাপ বসে থেকে এই/পৃথিবীর ছায়া দেখে, ছায়ার ভেতরে দেখে মুণ্ডুহীন পাখির উড়াল/বৃক্ষের সভায় দেখে কেবলই ফুরিয়ে যায় পাখিদের কাল/পাখিহীন সব শাখা কী গভীর দুঃখে লীন হয়ে আছে/নদী কী নিশ্চল দেখো, সব নদী স্তব্ধতার কাছে/কী রকম নতজানু...'।
না, উদৃব্দতি বাড়াতে চাই না। একটা দুঃসময়ের চিত্র। মুণ্ডুহীন পাখির উড়াল আর বহমান স্রোত স্তব্ধতার কাছে নতুন হয়ে থাকার ভয়াল সময় কখন আসে! যখন অবক্ষয়ের পচন লাগে। আর এক সামরিক শাসকের একেবারে শেষ দিকের একটি ঘটনা। তিনিও চলি্লশের দশকের অন্যতম প্রধান লেখক। আহসান হাবীবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু_ কথাশিল্পী শওকত ওসমান। দীর্ঘ আড্ডায় মজে যেতেন শেষ বিকেলে। আহসান হাবীবের সহকারী হিসেবে সানি্নধ্যের সুযোগ ঘটেছিল, অশেষ প্রীতি লাভেরও। তো, আহসান হাবীবের মৃত্যুর পর বন্ধুপুত্র মঈনুল আহসান সাবেরের বইয়ের দোকান শান্তিনগর চৌরাস্তার কাশফীতে প্রায়ই আসতেন শওকত ওসমান। শওকত ভাই একদিন তার সদ্য প্রকাশিত নতুন বইয়ের একটি কপি উপহার দিতে। নাম লিখতে গিয়ে তিনি 'শ্রী শ্রীমান নাসির' পর্যন্ত লিখে বললেন, থুককু। একটু থামলেন, তারপর লিখলেন_ নাসির/দুঃখ শুধু মনে এটাই জাগে/আমাদের মানুষ হওয়ার আগে/হিন্দু কিংবা মুসলিম হওয়া লাগে! অশেষ শুভেচ্ছায় (স্বাক্ষর) শওকত ভাই।'
আহসান হাবীবের কবিতার সেই দুঃসময় আর শওকত ওসমানের মতো অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তার আক্ষেপের কথা এ জন্যই স্মরণে আনা যে, সামরিকতন্ত্র মানবিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে সমাজকে কেবল নির্দয়-নিষ্ঠুরতা আর সাম্প্রদায়িকতার বিভেদে বিদীর্ণ করেছে। সামরিক শাসকরা প্রায় দেড় দশকের শাসনে দেশটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখান থেকে কল্যাণময় ইতিবাচকতায় ফেরা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। অস্ত্রের রাজনীতি, কালো টাকার রাজনীতি সত্যি সত্যি 'পলিটিক্সকে ডিফিকাল্ট' করে দিয়েছে।
আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সমাজ গড়ার মতো সংবিধান পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের অল্প দিনের মধ্যেই। কিন্তু সেই সেকুলার সংবিধান ধ্বংস করা হয়েছে ১৯৭৫'র হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে। তারপরও আজকের বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ক্রমে বাড়ছে, বিদেশে কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স বাড়ছে, ব্যয়বহুল হলেও বিদ্যুৎ ঘাটতি অতীতের তুলনায় অনেক কমেছে। বিপুল জনস্ফীতি সত্ত্বেও বিদ্যুৎ, পানিসহ নৈমিত্তিক চাহিদার অনেকটা মিটছে। গার্মেন্টপণ্য রফতানিতে নারী শ্রমিকরা অনন্য অবদান রাখছেন। প্রসূতি ও শিশু মাতৃমৃত্যু হার এতটাই কমেছে, যা বিশ্বসমাজের প্রশংসা লাভ করেছে। আমাদের শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় মোবাইল ফোনে থ্রিজি যুগে প্রবেশসহ সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে বিপ্লব ঘটে গেছে প্রায়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা রাষ্ট্রই নিশ্চিত করেছে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। ফেসবুক, টুইটার, ই-মেইল ইন্টারনেটসহ কত জানালা খোলা! সবচেয়ে বড় অগ্রগতি যেখানে তা হচ্ছে, শিক্ষা এবং কৃষি খাতে। জানুয়ারির প্রথম দিনই শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। খাদ্যশস্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ।
এ রকম অনেক সাফল্যের কথাই আমরা বিদায়ী বছরের দিকে তাকিয়ে উল্লেখ করতে পারি। কিন্তু বিগত বছরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা সরকারের গত চার বছরের অনেক সাফল্যও ম্লান করে দিয়েছে। বিশেষ করে কয়েকজন মানুষের দুর্নীতি সরকারের অনেক উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। সোনালী ব্যাংকসহ কয়েকটি সরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। হলমার্কের মতো একটি প্রায় অখ্যাত প্রতিষ্ঠান কীভাবে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দিল, সে এক বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। শেয়ারবাজারে কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কারসাজি সাধারণ মানুষকে যে প্রতারিত করল, তার দায় কেন সরকার নেবে আমরা জানি না। কেন পদ্মা সেতুর মতো জাতীয় বৃহত্তর একটা স্বপ্নের প্রকল্প নিয়ে এমন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বিতর্ক উঠবে, তাও এক বিস্ময়কর জিজ্ঞাসাই বটে। ডেসটিনিসহ কয়েকটি এমএলএম কোম্পানির অবৈধ অর্থ লেনদেন ব্যবসা আর বিদেশে অর্থ পাচার সচেতন মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী, বাঙালির গত অর্ধ শতাব্দীর গৌরবময় সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে এমন কলুষিত করবে এসব। কেন ছাত্রলীগের মতো সংগঠন কলুষিত হবে কতিপয় দুর্বৃত্তের জন্য।
বিগত বছর কালের গর্ভে বিলীন বটে, কিন্তু বিলীন হবে না কতগুলো দুঃখজনক-কলঙ্কিত ঘটনা। বিশ্বজিতের মতো নিরীহ তরুণের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড যেমন ঘৃণ্য, তেমনই নিন্দনীয় মৌলবাদীদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশংসনীয় অর্জন কিন্তু গত বছরে খুব কম ছিল না। বিশেষ করে ক্রিকেটে যে সাফল্য, যা অনেক উচ্চতায় নিয়েছে আমাদের। তরুণ বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন পাট এবং পাটের মতো আরও ৫০০ উপকারী উদ্ভিদকে ধ্বংসকারী ছত্রাকের জীবন-রহস্য, যার ফলে পাটসহ একটি উদ্ভিদ রক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন ধানের এমন উন্নত জাত, যা দেশকে খাদ্যশস্যে আরও বহুগুণ সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হবে। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগের পথে যেসব অন্তরায় ছিল, বছরের শেষ প্রান্তে তার সমাধানই শুধু হয়নি, খুব সামান্য খরচে সরকারিভাবে শ্রমজীবী মানুষ মালয়েশিয়ায় চাকরির সুযোগ পাবেন। ১৩ জানুয়ারি থেকে নিবন্ধনের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মানুষ অনায়াসে এখন সহজ পন্থায় গ্রামে বসেও পাসপোর্ট করতে পারছেন। অর্থ লেনদেনে কুরিয়ার সার্ভিসও ম্লান হয়ে গেছে দ্রুতগতির মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনে। এক বিশাল সম্ভাবনার প্রশ্ন। প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে আর পারস্পরিক সহযোগিতা।
আমাদের তো এই অভিজ্ঞতা আছে, সংকটের সমাধান জনগণই করেছে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখেও হতাশ হই না। জানি, সমাধানের পথ বের হবে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে। বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফের মতো প্রবীণরা যখন বলেন, ১৯৭৫-এর মতো পরিণতি হবে এ সরকার যদি দাবি মেনে না নেয়_ তখন কেউ কেউ হতাশ হলেও আমরা হতাশ হই না। কারণ, সময়টা এখন ২০১৩। তিন দশকে অনেক কিছু বদলে গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক বিরোধিতা আর সহিংসতার চক্রান্ত চলছে। একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ, তা নিয়েও চরম সহিংসতা দেখলাম বিগত বছরে। তারপরও আমরা শান্তির সম্ভাবনাতেই বিশ্বাসী। আলোচনার মধ্য দিয়েই সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনের পন্থা উদ্ভাবন হবে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার একটি মূল্যবান মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। তাই মতৈক্য জরুরি। দুদক অতীতে কখনও ক্ষমতাসীনদের জিজ্ঞাসাবাদের সাহস পায়নি। ২০১২-তে দেখলাম, তারা মন্ত্রী-এমপি, সচিব মেনে জিজ্ঞেস করেন না। মামলা করতেও কুণ্ঠিত হন না। এটা নিঃসন্দেহে শুভ লক্ষণ। দুদক চেয়ারম্যান দুর্নীতিবাজদের আগামী নির্বাচনে ভোট না দিতেও আহ্বান জানিয়েছেন।
বিগত বছরে বহু নেতিবাচক ঘটনা আছে। আতাউস সামাদ, হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি, ফয়েজ আহমদ, সুভাষ দত্ত, খান সারওয়ার মুরশিদসহ জাতির অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তান হারানোর বেদনা আছে। সাগর-রুনির মতো সাংবাদিক হত্যার কিনারা না হওয়ার ক্ষোভ আছে। তাজরীন গার্মেন্টে ১১৩ শ্রমিকের করুণ মৃত্যুর ক্ষোভ আছে। গুম কিংবা রহস্যময় অমীমাংসিত নিখোঁজ রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলীর জন্য বেদনাবোধ আছে। পার্বত্য জনপদে বৌদ্ধপল্লীতে হামলার গ্গ্নানি আছে। তার পরও হতাশাই শেষ কথা নয়। সমাধানের পথ তৈরি করায়। তা না হলে কিন্তু বিপদ আছে। গণতন্ত্রের নদী স্তব্ধতার কাছে মুখ থুবড়ে পড়ূক, আমরা কখনও চাই না। তাতে সবার ক্ষতি।
জাতির সংকটে করণীয় অতীত থেকে শিখতে হবে আমাদের। ভারতের দিকেই তাকান, চলন্ত বাসে ধর্ষিত মেডিকেল ছাত্রীর মৃত্যু ভারতজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী, কংগ্রেসপ্রধান থেকে বিরোধীদলীয় প্রধান পর্যন্ত সবাই প্রতিবাদে শামিল। এই কলঙ্ক থেকে স্থায়ী মুক্তির উপায় নিয়ে তারা ভাবছেন। বিরোধী দল কিন্তু একবারও বলেনি, সরকার এর জন্য দায়ী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। বরং এই দুঃখজনক মর্মান্তিক ঘটনাকে তারা জাতীয় ট্র্যাজেডি হিসেবে নিয়েছে; উত্তরণের পথ বের করছে। আমাদেরও মনোভাব পাল্টাতে হবে।
নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে চলি্লশ দশকের অন্যতম প্রধান কবি আহসান হাবীবের একটি কবিতার কথা। সামরিক শাসন দ্বিতীয়টি তখনও শুরু হয়নি। সামরিক শাসনকবলিত সমাজে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ যে কী অবক্ষয়ের মুখে পড়েছিল, সেই ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশ পেয়েছিল চিত্রকল্পময় ওই কবিতায়_ 'এখন অসুখী কোনো বালকের কাছে নীল প্রজাপতি নেই/ফুলমতির মায়াজালে মাছ নেই, চুপচাপ বসে থেকে এই/পৃথিবীর ছায়া দেখে, ছায়ার ভেতরে দেখে মুণ্ডুহীন পাখির উড়াল/বৃক্ষের সভায় দেখে কেবলই ফুরিয়ে যায় পাখিদের কাল/পাখিহীন সব শাখা কী গভীর দুঃখে লীন হয়ে আছে/নদী কী নিশ্চল দেখো, সব নদী স্তব্ধতার কাছে/কী রকম নতজানু...'।
না, উদৃব্দতি বাড়াতে চাই না। একটা দুঃসময়ের চিত্র। মুণ্ডুহীন পাখির উড়াল আর বহমান স্রোত স্তব্ধতার কাছে নতুন হয়ে থাকার ভয়াল সময় কখন আসে! যখন অবক্ষয়ের পচন লাগে। আর এক সামরিক শাসকের একেবারে শেষ দিকের একটি ঘটনা। তিনিও চলি্লশের দশকের অন্যতম প্রধান লেখক। আহসান হাবীবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু_ কথাশিল্পী শওকত ওসমান। দীর্ঘ আড্ডায় মজে যেতেন শেষ বিকেলে। আহসান হাবীবের সহকারী হিসেবে সানি্নধ্যের সুযোগ ঘটেছিল, অশেষ প্রীতি লাভেরও। তো, আহসান হাবীবের মৃত্যুর পর বন্ধুপুত্র মঈনুল আহসান সাবেরের বইয়ের দোকান শান্তিনগর চৌরাস্তার কাশফীতে প্রায়ই আসতেন শওকত ওসমান। শওকত ভাই একদিন তার সদ্য প্রকাশিত নতুন বইয়ের একটি কপি উপহার দিতে। নাম লিখতে গিয়ে তিনি 'শ্রী শ্রীমান নাসির' পর্যন্ত লিখে বললেন, থুককু। একটু থামলেন, তারপর লিখলেন_ নাসির/দুঃখ শুধু মনে এটাই জাগে/আমাদের মানুষ হওয়ার আগে/হিন্দু কিংবা মুসলিম হওয়া লাগে! অশেষ শুভেচ্ছায় (স্বাক্ষর) শওকত ভাই।'
আহসান হাবীবের কবিতার সেই দুঃসময় আর শওকত ওসমানের মতো অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তার আক্ষেপের কথা এ জন্যই স্মরণে আনা যে, সামরিকতন্ত্র মানবিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে সমাজকে কেবল নির্দয়-নিষ্ঠুরতা আর সাম্প্রদায়িকতার বিভেদে বিদীর্ণ করেছে। সামরিক শাসকরা প্রায় দেড় দশকের শাসনে দেশটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখান থেকে কল্যাণময় ইতিবাচকতায় ফেরা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। অস্ত্রের রাজনীতি, কালো টাকার রাজনীতি সত্যি সত্যি 'পলিটিক্সকে ডিফিকাল্ট' করে দিয়েছে।
আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সমাজ গড়ার মতো সংবিধান পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের অল্প দিনের মধ্যেই। কিন্তু সেই সেকুলার সংবিধান ধ্বংস করা হয়েছে ১৯৭৫'র হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে। তারপরও আজকের বাংলাদেশ বহুদূর এগিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ক্রমে বাড়ছে, বিদেশে কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স বাড়ছে, ব্যয়বহুল হলেও বিদ্যুৎ ঘাটতি অতীতের তুলনায় অনেক কমেছে। বিপুল জনস্ফীতি সত্ত্বেও বিদ্যুৎ, পানিসহ নৈমিত্তিক চাহিদার অনেকটা মিটছে। গার্মেন্টপণ্য রফতানিতে নারী শ্রমিকরা অনন্য অবদান রাখছেন। প্রসূতি ও শিশু মাতৃমৃত্যু হার এতটাই কমেছে, যা বিশ্বসমাজের প্রশংসা লাভ করেছে। আমাদের শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় মোবাইল ফোনে থ্রিজি যুগে প্রবেশসহ সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে বিপ্লব ঘটে গেছে প্রায়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা রাষ্ট্রই নিশ্চিত করেছে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। ফেসবুক, টুইটার, ই-মেইল ইন্টারনেটসহ কত জানালা খোলা! সবচেয়ে বড় অগ্রগতি যেখানে তা হচ্ছে, শিক্ষা এবং কৃষি খাতে। জানুয়ারির প্রথম দিনই শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। খাদ্যশস্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ।
এ রকম অনেক সাফল্যের কথাই আমরা বিদায়ী বছরের দিকে তাকিয়ে উল্লেখ করতে পারি। কিন্তু বিগত বছরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা সরকারের গত চার বছরের অনেক সাফল্যও ম্লান করে দিয়েছে। বিশেষ করে কয়েকজন মানুষের দুর্নীতি সরকারের অনেক উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। সোনালী ব্যাংকসহ কয়েকটি সরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। হলমার্কের মতো একটি প্রায় অখ্যাত প্রতিষ্ঠান কীভাবে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দিল, সে এক বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। শেয়ারবাজারে কতিপয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কারসাজি সাধারণ মানুষকে যে প্রতারিত করল, তার দায় কেন সরকার নেবে আমরা জানি না। কেন পদ্মা সেতুর মতো জাতীয় বৃহত্তর একটা স্বপ্নের প্রকল্প নিয়ে এমন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে বিতর্ক উঠবে, তাও এক বিস্ময়কর জিজ্ঞাসাই বটে। ডেসটিনিসহ কয়েকটি এমএলএম কোম্পানির অবৈধ অর্থ লেনদেন ব্যবসা আর বিদেশে অর্থ পাচার সচেতন মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী, বাঙালির গত অর্ধ শতাব্দীর গৌরবময় সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে এমন কলুষিত করবে এসব। কেন ছাত্রলীগের মতো সংগঠন কলুষিত হবে কতিপয় দুর্বৃত্তের জন্য।
বিগত বছর কালের গর্ভে বিলীন বটে, কিন্তু বিলীন হবে না কতগুলো দুঃখজনক-কলঙ্কিত ঘটনা। বিশ্বজিতের মতো নিরীহ তরুণের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড যেমন ঘৃণ্য, তেমনই নিন্দনীয় মৌলবাদীদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশংসনীয় অর্জন কিন্তু গত বছরে খুব কম ছিল না। বিশেষ করে ক্রিকেটে যে সাফল্য, যা অনেক উচ্চতায় নিয়েছে আমাদের। তরুণ বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন পাট এবং পাটের মতো আরও ৫০০ উপকারী উদ্ভিদকে ধ্বংসকারী ছত্রাকের জীবন-রহস্য, যার ফলে পাটসহ একটি উদ্ভিদ রক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন ধানের এমন উন্নত জাত, যা দেশকে খাদ্যশস্যে আরও বহুগুণ সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হবে। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগের পথে যেসব অন্তরায় ছিল, বছরের শেষ প্রান্তে তার সমাধানই শুধু হয়নি, খুব সামান্য খরচে সরকারিভাবে শ্রমজীবী মানুষ মালয়েশিয়ায় চাকরির সুযোগ পাবেন। ১৩ জানুয়ারি থেকে নিবন্ধনের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মানুষ অনায়াসে এখন সহজ পন্থায় গ্রামে বসেও পাসপোর্ট করতে পারছেন। অর্থ লেনদেনে কুরিয়ার সার্ভিসও ম্লান হয়ে গেছে দ্রুতগতির মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনে। এক বিশাল সম্ভাবনার প্রশ্ন। প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে আর পারস্পরিক সহযোগিতা।
আমাদের তো এই অভিজ্ঞতা আছে, সংকটের সমাধান জনগণই করেছে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখেও হতাশ হই না। জানি, সমাধানের পথ বের হবে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে। বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফের মতো প্রবীণরা যখন বলেন, ১৯৭৫-এর মতো পরিণতি হবে এ সরকার যদি দাবি মেনে না নেয়_ তখন কেউ কেউ হতাশ হলেও আমরা হতাশ হই না। কারণ, সময়টা এখন ২০১৩। তিন দশকে অনেক কিছু বদলে গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক বিরোধিতা আর সহিংসতার চক্রান্ত চলছে। একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ, তা নিয়েও চরম সহিংসতা দেখলাম বিগত বছরে। তারপরও আমরা শান্তির সম্ভাবনাতেই বিশ্বাসী। আলোচনার মধ্য দিয়েই সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনের পন্থা উদ্ভাবন হবে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার একটি মূল্যবান মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। তাই মতৈক্য জরুরি। দুদক অতীতে কখনও ক্ষমতাসীনদের জিজ্ঞাসাবাদের সাহস পায়নি। ২০১২-তে দেখলাম, তারা মন্ত্রী-এমপি, সচিব মেনে জিজ্ঞেস করেন না। মামলা করতেও কুণ্ঠিত হন না। এটা নিঃসন্দেহে শুভ লক্ষণ। দুদক চেয়ারম্যান দুর্নীতিবাজদের আগামী নির্বাচনে ভোট না দিতেও আহ্বান জানিয়েছেন।
বিগত বছরে বহু নেতিবাচক ঘটনা আছে। আতাউস সামাদ, হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি, ফয়েজ আহমদ, সুভাষ দত্ত, খান সারওয়ার মুরশিদসহ জাতির অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তান হারানোর বেদনা আছে। সাগর-রুনির মতো সাংবাদিক হত্যার কিনারা না হওয়ার ক্ষোভ আছে। তাজরীন গার্মেন্টে ১১৩ শ্রমিকের করুণ মৃত্যুর ক্ষোভ আছে। গুম কিংবা রহস্যময় অমীমাংসিত নিখোঁজ রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলীর জন্য বেদনাবোধ আছে। পার্বত্য জনপদে বৌদ্ধপল্লীতে হামলার গ্গ্নানি আছে। তার পরও হতাশাই শেষ কথা নয়। সমাধানের পথ তৈরি করায়। তা না হলে কিন্তু বিপদ আছে। গণতন্ত্রের নদী স্তব্ধতার কাছে মুখ থুবড়ে পড়ূক, আমরা কখনও চাই না। তাতে সবার ক্ষতি।
জাতির সংকটে করণীয় অতীত থেকে শিখতে হবে আমাদের। ভারতের দিকেই তাকান, চলন্ত বাসে ধর্ষিত মেডিকেল ছাত্রীর মৃত্যু ভারতজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী, কংগ্রেসপ্রধান থেকে বিরোধীদলীয় প্রধান পর্যন্ত সবাই প্রতিবাদে শামিল। এই কলঙ্ক থেকে স্থায়ী মুক্তির উপায় নিয়ে তারা ভাবছেন। বিরোধী দল কিন্তু একবারও বলেনি, সরকার এর জন্য দায়ী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। বরং এই দুঃখজনক মর্মান্তিক ঘটনাকে তারা জাতীয় ট্র্যাজেডি হিসেবে নিয়েছে; উত্তরণের পথ বের করছে। আমাদেরও মনোভাব পাল্টাতে হবে।
নাসির আহমেদ : কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com
No comments