হাতিরঝিল প্রকল্প-শিল্পীর তুলিতে আঁকা পুনরুজ্জীবিত ঢাকার রূপরেখা by খোন্দকার শওকত হোসেন
হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে একটি আধুনিক ও পুনরুজ্জীবিত ঢাকা বিনির্মাণের নতুন রূপরেখা রচিত হলো। আজ ২ জানুয়ারি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন করবেন।
ইতিহাসের ঢাকা ও আজকের ঢাকা_ ঢাকার ইতিহাস দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হওয়ার ইতিহাস। ১৬১০ সাল থেকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছে ঢাকা। অবশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত রাজধানী ঢাকা।
আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, আবার পিছিয়ে পড়া এবং চতুর্দিকে দুর্বৃত্তায়নের উৎসব। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু নদীবেষ্টিত এবং এসব নদীর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা, বিল-জলাশয়ের প্রসাদ-বিধৌত ঢাকা এখন তার সব জলধারা বঞ্চিত। যেন সম্পদহীন, শ্রীহীন, বাসযোগ্যহীন এক পরাজিত, পরিত্যাজ্য শহর। এই প্রেক্ষাপটেই 'হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খাল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প'। ভাওয়াল রাজার হাতিশালার হাতি এখানে এনে স্নান করানো হতো। তখন এই ঝিল এবং সংলগ্ন বেগুনবাড়ী খাল ঢাকার পূর্বে বালু নদী এবং উত্তরে ও পশ্চিমে তুরাগ নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ধোলাই খাল ও এর শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে এবং দক্ষিণ-পূর্বে শীতলক্ষ্যার সঙ্গে এর নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ অব্যাহত ছিল। তখন এর নাব্যতা ছিল এবং জনপরিবহন ও মালামাল পরিবহনে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খাল গুরুত্বপূর্ণ সংযোগের ভূমিকা পালন করত। বর্ষায় যে বৃষ্টিপাত হতো, তার একটি বৃহৎ অংশ হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালের মধ্য দিয়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী নদী পর্যন্ত প্রবাহিত হতো। সময়ের বিবর্তনে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খাল এক সময় হারিয়ে যেতে থাকে। অবৈধ বসতের দখলে চলে যায় ভরাট হয়ে যাওয়া বিরাট এলাকা। ঝিল আর খালের পানি হতে থাকে দূষিত, পূতিগন্ধময়। এ রকম অপসৃত হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালকে তার হৃত মর্যাদায় পুনরুদ্ধার করা অবশ্যই অকল্পনীয়। অসম্ভব বাস্তবতাও মনে হতে পারে। কিন্তু সরকারের আন্তরিক প্রতিশ্রুতি এবং অদম্য শক্তি-সাহস শত বাধা-বিপত্তি-অন্তরায়কে অতিক্রম করে এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। অকল্পনীয়কে বাস্তব করেছে।
হাতিরঝিল, বেগুনবাড়ী খাল পুনরুদ্ধারের ফলে একটি নবসাজে সজ্জিত ৩০০ একরের বিশাল আধুনিক লেক নির্মিত হয়েছে, যার জল স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন, যা নানা ধরনের জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাসস্থল হয়ে উঠবে। এখানে অতিথি পাখির আগমনও সম্ভব। সোনারগাঁও প্যান-প্যাসিফিক হোটেল পশ্চিম পাশে এবং পূর্ব পাশে রামপুরা সেতু পর্যন্ত উভয় প্রান্তে মোট ৯ কিলোমিটার উন্নতমানের এক্সপ্রেসওয়ে, সমপরিমাণ সার্ভিসওয়ে, পূর্ণাঙ্গ সড়ক ছাড়াও প্রকল্পের উত্তর প্রান্তে দীর্ঘ ওয়াকওয়ে, দক্ষিণ প্রান্তে দুই লেনবিশিষ্ট সড়ক_ এসবই ঢাকার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ উন্নত করবে। বেগুনবাড়ী খালের ওপর চারটি নয়নকাড়া সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর বাইরে সুদৃশ্য দুটি ভায়াডাক্ট ও চারটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে ঝুলন্ত ও ভাসমান দাঁড়ানোর স্থান এবং উন্মুক্ত মঞ্চ। পুরো প্রকল্প এলাকায় রাতে থাকবে হাজার বাতির আলোকসজ্জা। চতুর্দিকে ফুল ও সবুজের সমারোহ। ওপরে দৃশ্যমান বিশাল আকাশ। বস্তুত ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে একটি অপরূপ নয়নাভিরাম সুন্দর, স্বাস্থ্যকর, উন্মুক্ত পরিবেশ। সব মিলিয়ে একটি নান্দনিক, জনবান্ধব বিশাল বিনোদন কেন্দ্র হিসেবেও এর আত্মপ্রকাশ তুলনারহিত। যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা ভাবনায় দেখা এক অপরূপ চিত্র!
প্রকল্পের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য যে অর্জিত হচ্ছে, সে তো বহুল দৃশ্যমান। তবে এ প্রকল্পের বহুমাত্রিক সফলতা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়। নদী ও জলভিত্তিক ঢাকা শহরের যে অমিত সম্ভাবনা, সেটা অর্জন করা এ প্রকল্পের অন্যতম দিক। এ প্রকল্পের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঢাকা শহর এবং দেশের অন্যান্য শহর এমনকি গ্রামাঞ্চলেও যেখানে খাল-বিল, নদী-নালা মজে গছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার ও ব্যবহারোপযোগী করার কথা সক্রিয় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। পরীক্ষা করে দেখতে পারি; ধোলাই খাল এবং পান্থপথের খাল পুনরুদ্ধার করে সেখানে খাল ও সড়কের পাশাপাশি অবস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব কি-না।
এ প্রকল্পের প্রকৃত সাফল্য প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল নয়। প্রকৃত সাফল্য নিহিত রয়েছে প্রকল্পের সফল সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার ওপর। এ ব্যাপারে রাজউককে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে ঢাকার জনসাধারণের বিশেষ করে প্রকল্প সংলগ্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমির মালিকদের দায়িত্ব রয়েছে। এ এলাকার ইমারতাদি যাতে অনুমোদিত প্ল্যানের অন্তর্গত থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনগণের দু'হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের সুবিধাদি সৃষ্টি হয়েছে। সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রকল্পের মাধ্যমে সৃষ্ট এই সংযোজিত মূল্যের প্রতিদান দিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন কিছু বিষয় উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। প্রথমত, বিশাল এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, তার মধ্যে ছিল পুনরুদ্ধারকৃত জলাশয়ের প্রবাহ যেন বালু নদী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়ে এখানে মুক্ত জলপ্রবাহ সৃষ্টি করে। তাছাড়া গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী লেকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখানেও উন্মুক্ত জলপ্রবাহ সৃষ্টি করেছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুুল মান্নান খান সার্বক্ষণিকভাবে এর অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সময়ে সময়ে উদ্ভূত নানাবিধ অসুবিধা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের নানাবিধ দুরূহ যেসব অন্তরায় ছিল তার মধ্যে বিশেষভাবে বলা যায় হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালের বিস্তৃত তলদেশে পাথরের মতো জমাট বাঁধা বিস্তর দূষিত বর্জ্য। এসব এমনভাবে স্থির ও অচল হয়েছিল, যার অপসারণ কারিগরি ও প্রকৌশলগত দিক থেকে জটিল ও দুঃসাধ্য। সেনাবাহিনী ও রাজউকের দক্ষ ও নিবেদিত প্রকৌশলীদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত প্রায় অসাধ্য এ কাজ সম্ভব হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ এবং খাস জমি দখলে নেওয়া ছিল আর একটি দুরূহতম কাজ। এ ক্ষেত্রে অন্তত ৭৮টি মামলার সম্মুখীন হয় রাজউক এবং মন্ত্রণালয়।হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালের দুই পাশে অগণিত মানুষের বহু-বিচিত্র স্বার্থ। রাজউক যথাসাধ্য প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের প্রত্যেককে ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। সর্বোপরি অর্থের সংস্থানজনিত সমস্যা। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় একটি মিডটার্ম বাজেটারি ফ্রেমওয়ার্কের (এমটি বিএফ) আওতাভুক্ত মন্ত্রণালয়। ফলে বরাদ্দের বার্ষিক খামের মধ্য থেকেই বাস্তবায়নাধীন সব প্রকল্পের অর্থসংস্থান করতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রকল্পটি ছিল এক নম্বর অগ্রাধিকার। এ প্রকল্পের কাজ যাতে কোনোমতেই বরাদ্দের অভাবে বিঘি্নত না হয়, সেদিকে মন্ত্রণালয় সার্বক্ষণিক সজাগ ছিল।
প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে এবং প্রকল্পের সর্বোচ্চ আন্তঃমন্ত্রণালয় স্টিয়ারিং কমিটির সভাপতি হিসেবে এ প্রকল্প প্রসূত হওয়ার সব যাতনা আমার পরিচিত। আমার সব সহকর্মীর সব ক্লেশ আমার পরিচিত। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের ভাষা আমার জানা নেই। রাজউক বাস্তবায়িত এই বিস্তর বাধা-বিঘ্নসাপেক্ষ অসাধারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, ঢাকা ওয়াসা, বুয়েট এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শ্রমিক সংশ্লিষ্ট, তাদের গৌরবান্বিত মুুখাবয়বের আনন্দের প্রাপ্তি তাদের সারা জীবনের পাথেয় হোক, প্রেরণা হোক_ এই প্রার্থনা।
ড. খোন্দকার শওকত হোসেন :সচিব গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়
drkhshowkat@ gmail.com
আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, আবার পিছিয়ে পড়া এবং চতুর্দিকে দুর্বৃত্তায়নের উৎসব। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু নদীবেষ্টিত এবং এসব নদীর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা, বিল-জলাশয়ের প্রসাদ-বিধৌত ঢাকা এখন তার সব জলধারা বঞ্চিত। যেন সম্পদহীন, শ্রীহীন, বাসযোগ্যহীন এক পরাজিত, পরিত্যাজ্য শহর। এই প্রেক্ষাপটেই 'হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খাল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প'। ভাওয়াল রাজার হাতিশালার হাতি এখানে এনে স্নান করানো হতো। তখন এই ঝিল এবং সংলগ্ন বেগুনবাড়ী খাল ঢাকার পূর্বে বালু নদী এবং উত্তরে ও পশ্চিমে তুরাগ নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। ধোলাই খাল ও এর শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে এবং দক্ষিণ-পূর্বে শীতলক্ষ্যার সঙ্গে এর নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ অব্যাহত ছিল। তখন এর নাব্যতা ছিল এবং জনপরিবহন ও মালামাল পরিবহনে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খাল গুরুত্বপূর্ণ সংযোগের ভূমিকা পালন করত। বর্ষায় যে বৃষ্টিপাত হতো, তার একটি বৃহৎ অংশ হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালের মধ্য দিয়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী নদী পর্যন্ত প্রবাহিত হতো। সময়ের বিবর্তনে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খাল এক সময় হারিয়ে যেতে থাকে। অবৈধ বসতের দখলে চলে যায় ভরাট হয়ে যাওয়া বিরাট এলাকা। ঝিল আর খালের পানি হতে থাকে দূষিত, পূতিগন্ধময়। এ রকম অপসৃত হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালকে তার হৃত মর্যাদায় পুনরুদ্ধার করা অবশ্যই অকল্পনীয়। অসম্ভব বাস্তবতাও মনে হতে পারে। কিন্তু সরকারের আন্তরিক প্রতিশ্রুতি এবং অদম্য শক্তি-সাহস শত বাধা-বিপত্তি-অন্তরায়কে অতিক্রম করে এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। অকল্পনীয়কে বাস্তব করেছে।
হাতিরঝিল, বেগুনবাড়ী খাল পুনরুদ্ধারের ফলে একটি নবসাজে সজ্জিত ৩০০ একরের বিশাল আধুনিক লেক নির্মিত হয়েছে, যার জল স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন, যা নানা ধরনের জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাসস্থল হয়ে উঠবে। এখানে অতিথি পাখির আগমনও সম্ভব। সোনারগাঁও প্যান-প্যাসিফিক হোটেল পশ্চিম পাশে এবং পূর্ব পাশে রামপুরা সেতু পর্যন্ত উভয় প্রান্তে মোট ৯ কিলোমিটার উন্নতমানের এক্সপ্রেসওয়ে, সমপরিমাণ সার্ভিসওয়ে, পূর্ণাঙ্গ সড়ক ছাড়াও প্রকল্পের উত্তর প্রান্তে দীর্ঘ ওয়াকওয়ে, দক্ষিণ প্রান্তে দুই লেনবিশিষ্ট সড়ক_ এসবই ঢাকার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ উন্নত করবে। বেগুনবাড়ী খালের ওপর চারটি নয়নকাড়া সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর বাইরে সুদৃশ্য দুটি ভায়াডাক্ট ও চারটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে ঝুলন্ত ও ভাসমান দাঁড়ানোর স্থান এবং উন্মুক্ত মঞ্চ। পুরো প্রকল্প এলাকায় রাতে থাকবে হাজার বাতির আলোকসজ্জা। চতুর্দিকে ফুল ও সবুজের সমারোহ। ওপরে দৃশ্যমান বিশাল আকাশ। বস্তুত ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে একটি অপরূপ নয়নাভিরাম সুন্দর, স্বাস্থ্যকর, উন্মুক্ত পরিবেশ। সব মিলিয়ে একটি নান্দনিক, জনবান্ধব বিশাল বিনোদন কেন্দ্র হিসেবেও এর আত্মপ্রকাশ তুলনারহিত। যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা ভাবনায় দেখা এক অপরূপ চিত্র!
প্রকল্পের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য যে অর্জিত হচ্ছে, সে তো বহুল দৃশ্যমান। তবে এ প্রকল্পের বহুমাত্রিক সফলতা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়। নদী ও জলভিত্তিক ঢাকা শহরের যে অমিত সম্ভাবনা, সেটা অর্জন করা এ প্রকল্পের অন্যতম দিক। এ প্রকল্পের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঢাকা শহর এবং দেশের অন্যান্য শহর এমনকি গ্রামাঞ্চলেও যেখানে খাল-বিল, নদী-নালা মজে গছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার ও ব্যবহারোপযোগী করার কথা সক্রিয় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। পরীক্ষা করে দেখতে পারি; ধোলাই খাল এবং পান্থপথের খাল পুনরুদ্ধার করে সেখানে খাল ও সড়কের পাশাপাশি অবস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব কি-না।
এ প্রকল্পের প্রকৃত সাফল্য প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল নয়। প্রকৃত সাফল্য নিহিত রয়েছে প্রকল্পের সফল সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার ওপর। এ ব্যাপারে রাজউককে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে ঢাকার জনসাধারণের বিশেষ করে প্রকল্প সংলগ্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমির মালিকদের দায়িত্ব রয়েছে। এ এলাকার ইমারতাদি যাতে অনুমোদিত প্ল্যানের অন্তর্গত থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে জনগণের দু'হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের সুবিধাদি সৃষ্টি হয়েছে। সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রকল্পের মাধ্যমে সৃষ্ট এই সংযোজিত মূল্যের প্রতিদান দিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন কিছু বিষয় উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। প্রথমত, বিশাল এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন, তার মধ্যে ছিল পুনরুদ্ধারকৃত জলাশয়ের প্রবাহ যেন বালু নদী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়ে এখানে মুক্ত জলপ্রবাহ সৃষ্টি করে। তাছাড়া গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী লেকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখানেও উন্মুক্ত জলপ্রবাহ সৃষ্টি করেছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুুল মান্নান খান সার্বক্ষণিকভাবে এর অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সময়ে সময়ে উদ্ভূত নানাবিধ অসুবিধা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের নানাবিধ দুরূহ যেসব অন্তরায় ছিল তার মধ্যে বিশেষভাবে বলা যায় হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালের বিস্তৃত তলদেশে পাথরের মতো জমাট বাঁধা বিস্তর দূষিত বর্জ্য। এসব এমনভাবে স্থির ও অচল হয়েছিল, যার অপসারণ কারিগরি ও প্রকৌশলগত দিক থেকে জটিল ও দুঃসাধ্য। সেনাবাহিনী ও রাজউকের দক্ষ ও নিবেদিত প্রকৌশলীদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত প্রায় অসাধ্য এ কাজ সম্ভব হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ এবং খাস জমি দখলে নেওয়া ছিল আর একটি দুরূহতম কাজ। এ ক্ষেত্রে অন্তত ৭৮টি মামলার সম্মুখীন হয় রাজউক এবং মন্ত্রণালয়।হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খালের দুই পাশে অগণিত মানুষের বহু-বিচিত্র স্বার্থ। রাজউক যথাসাধ্য প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তাদের প্রত্যেককে ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। সর্বোপরি অর্থের সংস্থানজনিত সমস্যা। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় একটি মিডটার্ম বাজেটারি ফ্রেমওয়ার্কের (এমটি বিএফ) আওতাভুক্ত মন্ত্রণালয়। ফলে বরাদ্দের বার্ষিক খামের মধ্য থেকেই বাস্তবায়নাধীন সব প্রকল্পের অর্থসংস্থান করতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রকল্পটি ছিল এক নম্বর অগ্রাধিকার। এ প্রকল্পের কাজ যাতে কোনোমতেই বরাদ্দের অভাবে বিঘি্নত না হয়, সেদিকে মন্ত্রণালয় সার্বক্ষণিক সজাগ ছিল।
প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে এবং প্রকল্পের সর্বোচ্চ আন্তঃমন্ত্রণালয় স্টিয়ারিং কমিটির সভাপতি হিসেবে এ প্রকল্প প্রসূত হওয়ার সব যাতনা আমার পরিচিত। আমার সব সহকর্মীর সব ক্লেশ আমার পরিচিত। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের ভাষা আমার জানা নেই। রাজউক বাস্তবায়িত এই বিস্তর বাধা-বিঘ্নসাপেক্ষ অসাধারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, ঢাকা ওয়াসা, বুয়েট এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শ্রমিক সংশ্লিষ্ট, তাদের গৌরবান্বিত মুুখাবয়বের আনন্দের প্রাপ্তি তাদের সারা জীবনের পাথেয় হোক, প্রেরণা হোক_ এই প্রার্থনা।
ড. খোন্দকার শওকত হোসেন :সচিব গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়
drkhshowkat@ gmail.com
No comments