একটি চাবির অভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৭ জনের করম্নণ মৃত্যু- জাপান গার্ডেন সিটির হাইরাইজ ভবনে ছিল না জরুরী বহির্গমন সিঁড়ি, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি
একটি চাবির অভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলের ঢলে পড়তে হয়েছে একই পরিবারের ৭ জনকে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভবনে জরুরী বহির্গমন সিঁড়ি ও আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা ভবনের বাসিন্দাদের মুখে মুখে ফিরছে।
ভয়ে কেউ জাপান গার্ডেন সিটির হাইরাইজ ভবনগুলোতে বসবাস করতে চাইছে না। এ ব্যাপারে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে ৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১০টায় রাজধানীর আদাবর থানাধীন জাপান গার্ডেন সিটির ৬ নম্বর ভবনে অগি্নকা-ের সূত্রপাত। জাপান গার্ডেন সিটির ৬ নম্বর ভবনের ১৪ তলার ফ্যাটে কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার ভাটিয়া গ্রামের সহোদর রফিকুল ইসলাম ও তারিকুল ইসলাম সপরিবারে ভাড়ায় বসবাস করে আসছিলেন। দিন কাটছিল আনন্দেই। সব আনন্দ শেষ হয়ে গেল সামান্য একটি চাবির জন্য।প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার রাতেও তারা সবাই মিলে গল্প করছিলেন। হঠাৎ করেই নিচ তলার একটি ফ্যাট থেকে প্রচ- ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। মুহূর্তেই দাউ দাউ করে আগুন উপরের দিকে ছড়াতে থাকে। এ সময় ফ্যাটের বাসিন্দারা প্রাণ বাঁচাতে চিৎকার দিতে থাকে। নিচ তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ায় বাসিন্দারা নিচের সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে প্রচন্ড তাপে আর যেতে পারেনি। পরে ফ্যাটের বাসিন্দারা আবার নিজ ফ্যাটে ফিরে আসে। প্রাণ বাঁচাতে এভাবেই উপরে-নিচে দৌড়াতে থাকে তারা। সর্বশেষ কাজের মেয়েকে ছাদের চাবি আনতে নিচে পাঠায়। বাকি ছয়জনে মিলে কিল, ঘুষি, লাথি দিয়ে ছাদের দরজা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেন। কাজের মেয়ে রোজিনা আক্তার (১৫) চাবি খুঁজতে ফ্যাটে গিয়ে আগুনের কবলে পড়ে। রোজিনা দগ্ধ হয়ে চিৎকার করতে করতেই মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই রোজিনার চিৎকার ছাদ থেকে শোনা যায়নি। এক পর্যায়ে ছাদের দরজার কাছেই তারা শ্বাসরম্নদ্ধ হয়ে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েন।
ফায়ার সার্ভিস ও দমকল বিভাগের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শেখ মোঃ শাহজালাল জানান, ১৫তলা ভবনের ১১ তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত। এই তলায় প্রচুর কাঠের জিনিসপত্র ছিল। ওই ফ্যাটে অভ্যনত্মরীণ সাজসরঞ্জামের কাজ চলছিল। দীর্ঘদিন ধরেই ফ্যাটটিতে কাঠমিস্ত্রিরা কাজ করছিল। শুকনো কাঠের মধ্যে ফেলে দেয়া জ্বলনত্ম সিগারেট থেকে এ অগি্নকা-ের ঘটনা ঘটতে পারে। দমকল বাহিনী প্রায় ২ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রাত দেড়টার দিকে দমকল বাহিনী ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় ১৪ তলার ফ্যাট থেকে গৃহকর্মী রোজিনার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর পুরো ভবনে তলস্নাশি চালিয়ে ১৫ তলার ছাদের দরজার কাছ থেকে রফিকুল ইসলাম (৫৭), তাঁর স্ত্রী রাশিদা ইসলাম (৪৫), ছেলে তারেক বিন ফাহিম (১৫) ও মেয়ে আয়েশা আক্তার (৬) ও রফিকুলের সহোদর তারিকুল ইসলাম (৪৭) ও তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাতেমা রূপার (৩৮) মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সবাই মিলে দরজা ভেঙ্গে ফেলার জন্য জীবনের সমসত্ম শক্তি দিয়ে চেষ্টা চালিয়েছেন। দরজায় লাগানো তালায় লাথি, ইটের আঘাত রয়েছে। এছাড়া সবাই মিলে জীবন বাঁচাতে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কিল, ঘুষি, লাথি দেয়ায় তাদের হাতে-পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ছাদের দরজায় খুবই বড় আকারের একটি তালা লাগানো ছিল। হাজার চেষ্টাতেও তালা ভাঙ্গতে পারেননি হতভাগ্যরা। পরে সেখানেই তাদের মৃতু্য হয়েছে। একজনের ওপর আরেকজনের লাশ ছিল। ধারণা করা হয়, যখনই কেউ মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েছেন তখনই অনত্মিম সানত্ম্বনা দেয়ার জন্য তাকে জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন অন্যরা। একে একে সবাই এভাবেই মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েছেন। নিহতরা চাবি খুঁজে পাননি, নাকি ছাদের তালার চাবি তাঁদের কাছে ছিল না, তা জানা যায়নি।
সকালে নিহত দু'পরিবারের ছয়জনকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। গৃহকর্মী রোজিনার মৃতদেহ রংপুর জেলার পীরগঞ্জে তাঁর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের পানি কমে আসে। এ সময় পর্যাপ্ত পানির জন্য ভবনের নিচে থাকা ট্যাঙ্কিতে দমকল বাহিনীর হোস পাইপ লাগানো হয়। কিন্তু ট্যাঙ্কিতে কোন পানি ছিল না। হাইরাইজ ভবনের জন্য রিজার্ভ ট্যাঙ্কিতে পানি না থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে দমকল বাহিনী। এত বড় ভবনের জন্য জরম্নরী কাজের পানি না থাকাকে ভিন্নভাবে দেখছেন তাঁরা। কিন্তু ডেভেলপার কোম্পানির দাবি, বিদু্যত না থাকায় রিজার্ভ ট্যাঙ্কিতে পানি জমা করতে পারেননি। দমকল বাহিনী জানায়, রিজার্ভ ট্যাঙ্কিতে পানি থাকলে হয়ত এত বড় দূর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। এছাড়া অগি্ননির্বাপণের জন্য থাকা সমসত্ম যন্ত্রপাতিও অকোজো। যারা ভবনের দায়িত্ব পালন করছিলেন তাদের কারো অগি্ননির্বাপণের জ্ঞান নেই। ভবনের জরম্নরী বহির্গমন সিঁড়িও না থাকার মতো। এ ধরনের ভবন তৈরির অনুমতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে জাপান গার্ডেন সিটিতে চলছে শোকের মাতম। এ শোক ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। জাপান গার্ডেন সিটিতে মোট ২৬টি হাইরাইজ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি ভবনে বসবাস শুরম্ন হয়েছে। বাকি ৩টি ভবন তৈরির কাজ শেষ হয়নি। ২৩টি ভবনে ১৮শ' ফ্যাটের মধ্যে ১৫শ' ফ্যাটে বসবাস শুরম্ন হয়েছে। এসব ভবনে জরম্নরী বহির্গমন সিঁড়ি নেই। এমনকি অগি্ন নির্বাপণ ব্যবস্থাও খুবই দুর্বল। পুরো সিটি ঘুরে দেখা গেছে ভবনের গায়ে যেসব অগি্ননির্বাপন যন্ত্রপাতি রয়েছে তার বেশির ভাগই অকেজো। এছাড়া এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার মতো প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ নেই। সেসব নিরাপত্তা রৰী ভবন রৰণাবেৰণের দায়িত্বে রয়েছেন তারা এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন_ তারা কেউই অগি্ন নির্বাপণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারেন না। এমনকি এ বিষয়ে তাদের কোন ট্রেনিং নেই। এদিকে ঘটনার পর পরই স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, ভবন গুলো বিধি মোতাবেক গড়ে উঠেছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হবে। এমনকি দোষীদের দৃষ্টানত্মমূলক শাসত্মির ব্যবস্থা করা হবে। পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মোঃ শাহিদুলস্নাহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। অগি্নকান্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে উপপরিচালক আব্দুস সালামকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদনত্ম কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হচ্ছেন সহকারী পরিচালক (অয়্যার হাউস) জহিরম্নল, সংশিস্নষ্ট ফায়ার স্টেশনের একজন উপ সহকারী পরিচালক ও একজন ইন্সপেক্টর। কমিটিকে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে তদনত্ম রিপোর্ট দাখিল করতে বলা হয়েছে।
No comments