বিপদে সুন্দরবন ২- জেলে ও পর্যটকের উৎপাতে বিপন্ন বন by ইফতেখার মাহমুদ
অপার সৌন্দর্য আর বিস্তীর্ণ জলরাশিজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মৎস্য সম্পদ সুন্দরবনের জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। মাছ ও পোনা ধরতে গিয়ে জেলেরা বনের অনেক ক্ষতি করছেন। একটি চিংড়ি পোনা ধরতে গিয়ে সুন্দরবনের অন্য ১০০টি পোনা মারা যাচ্ছে।
আবার সৌন্দর্য দেখতে আসা পর্যটকদের উৎপাত বিরক্ত করছে প্রাণীদের।
এর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে জেলেপল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার জনৈক জহুরুল ইসলাম এটি স্থাপনের জন্য আবেদন করেছেন। এই আবদারকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করার জন্য সুপারিশ করেছেন খুলনা-৬ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ সোহরাব আলী।
তবে বন বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, ওই সাংসদের সুপারিশ মেনে মেঘনা এলাকায় জেলেপল্লি করতে গেলে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার গাছপালা কাটতে হবে। ওই এলাকার পাশেই কালীরচর, মান্দারবাড়িয়া ও পুষ্পকাঠি অভয়ারণ্য এলাকা। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সুন্দরবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণী সেখানে বসবাস করে।
বর্তমানে সুন্দরবনের দুবলা এলাকায় সাতটি চরে অস্থায়ী জেলেপল্লি রয়েছে। সেখানে প্রায় ৫০ হাজার জেলে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। একসময় দুবলা এলাকায় ঘন বন, বাঘ-হরিণসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর বসতি ছিল। এখন কালেভদ্রে হরিণ ছাড়া সেখানে আর কোনো প্রাণীর দেখা মেলে না।
সাংসদ সোহরাব আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন বিভাগের ভাবখানা এ রকম যে, যেন তারাই সব। অন্যদের সুন্দরবন নিয়ে চিন্তা নেই। বন বিভাগ আগেই জেলেপল্লির ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিল। এখন তাঁরাই আবার বিরোধিতা করছেন।’ দুবলার চরে জেলেপল্লির কারণে ওই এলাকায় সুন্দরবনের বন্য প্রাণীর অনেক ক্ষতি হয়েছিল, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাংসদ বলেন, ‘দুবলার চরের কারণে বনের ক্ষতি হলে আমাদেরটার অনুমতি দেওয়ার দরকার নেই। তাহলে দুবলার চরেরটাও বন্ধ করতে হবে।’
বাঘের ঘরে পর্যটকদের হানা: বন বিভাগের হিসাবে সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যা প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ করে বাড়ছে। আর পর্যটকেরা সুন্দরবনের বাঘ ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর জন্য নির্ধারিত অভয়ারণ্যে মাইক বাজিয়ে শব্দ করে যাতায়াত করছে। বনের ভেতরে বিপুল পরিমাণ পলিথিন, চিপসের প্যাকেট ও পানীয়ের বোতল ফেলছে তারা। বনের জন্য ক্ষতিকারক এ ধরনের তৎপরতা রোধে বন বিভাগের কোনো কর্মসূচি নেই।
বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত কটকা, কচিখালী, মান্দারবাড়িয়া, হারবাড়িয়াসহ বেশির ভাগ এলাকায় প্রতিদিন পর্যটকবাহী ১০০ থেকে ১৫০টি লঞ্চ যাতায়াত করছে। আর জালি ও জেলে নৌকার সংখ্যা দিনে হাজার ছাড়িয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বনগুলোর মধ্যে একমাত্র সুন্দরবনই এমন অনিয়ন্ত্রিতভাবে পর্যটকদের চলাচল ও মৎস্য শিকার চলছে। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ইতিমধ্যে অভয়ারণ্য এলাকায় পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) দেশীয় প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে পর্যটক চলাচল ও মাছ শিকারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও জরুরি ভিত্তিতে তা করতে হবে। না হলে দীর্ঘ মেয়াদে তা সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। অবশ্যই অভয়ারণ্যের বাইরে সুনির্দিষ্ট কিছু স্থান ছাড়া অন্য কোথাও পর্যটকদের যেতে দেওয়া উচিত না। পোনা ধরার ক্ষেত্রে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
সরেজমিন: গত ১৮ নভেম্বর মংলা থেকে চাঁদপাই বন ফাঁড়ির দিকে পশুর নদী ধরে সুন্দরবনের দিকে যেতেই পর্যটক ও পোনা-শিকারিদের উৎপাত চোখে পড়ল। ভোরে ওই পথে কিছুদূর এগোতেই অশান্ত ঢেউয়ের ওপর হাজার হাজার মশারির মতো জাল ভাসতে দেখা গেল। আরও কিছুদূরে একের পর এক মাছ ধরার নৌকা সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল।
বেলা গড়িয়ে সকাল ১০টা বাজতেই লঞ্চ আর ছোট জালি নৌকায় পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে গেল। মাইকে বিকট শব্দে হিন্দি গান বাজতে বাজতে একটার পর একটা লঞ্চ বনের ভেতরে হানা দিতে লাগল। পর্যটকদের লঞ্চ চলে যাওয়ার সময় সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক চিপসের প্যাকেট ও পলিথিন নদীতে ভাসতে দেখা গেল।
সঙ্গে থাকা লঞ্চচালক জানালেন, শীত বাড়লে সুন্দরবনের নদীগুলো শান্ত থাকে। এই সুযোগে এ সময় পর্যটকদের আসা-যাওয়াও বেড়ে যায়। পোনা ধরাও শুরু হয় এ সময়। বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য থেকে শুরু করে বনের বেশির ভাগ জায়গায় ঢুকে যায় পর্যটকেরা।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখন বছরে কমপক্ষে এক লাখ পর্যটক সুন্দরবনে বেড়াতে আসে। গত বছরের তুলনায় পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আর দিনে মাছ ধরতে সুন্দরবনে যায় প্রায় ৫০ হাজার জেলে। বন বিভাগ শুধু তাদের বনে প্রবেশের অনুমতিপত্র বা পাস দেয়। কিন্তু পর্যটকেরা কোথায় যাবে, কী কী করতে পারবে বা পারবে না তার কোনো তদারকি তারা করে না। মাছ ধরা ও পোনা আহরণের ক্ষেত্রেও একই কাণ্ড ঘটে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবন থেকে একটি চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করতে ১০০টি অন্য মাছের পোনা মারা যায়। বছর দশেক আগে সুন্দরবনের একটি মৃত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পেটে চিপসের প্যাকেট পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যটকদের অসচেতনতার কারণে বন্য প্রাণী ও বনের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। (শেষ)
এর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে জেলেপল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার জনৈক জহুরুল ইসলাম এটি স্থাপনের জন্য আবেদন করেছেন। এই আবদারকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করার জন্য সুপারিশ করেছেন খুলনা-৬ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ সোহরাব আলী।
তবে বন বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, ওই সাংসদের সুপারিশ মেনে মেঘনা এলাকায় জেলেপল্লি করতে গেলে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকার গাছপালা কাটতে হবে। ওই এলাকার পাশেই কালীরচর, মান্দারবাড়িয়া ও পুষ্পকাঠি অভয়ারণ্য এলাকা। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সুন্দরবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণী সেখানে বসবাস করে।
বর্তমানে সুন্দরবনের দুবলা এলাকায় সাতটি চরে অস্থায়ী জেলেপল্লি রয়েছে। সেখানে প্রায় ৫০ হাজার জেলে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। একসময় দুবলা এলাকায় ঘন বন, বাঘ-হরিণসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর বসতি ছিল। এখন কালেভদ্রে হরিণ ছাড়া সেখানে আর কোনো প্রাণীর দেখা মেলে না।
সাংসদ সোহরাব আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন বিভাগের ভাবখানা এ রকম যে, যেন তারাই সব। অন্যদের সুন্দরবন নিয়ে চিন্তা নেই। বন বিভাগ আগেই জেলেপল্লির ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিল। এখন তাঁরাই আবার বিরোধিতা করছেন।’ দুবলার চরে জেলেপল্লির কারণে ওই এলাকায় সুন্দরবনের বন্য প্রাণীর অনেক ক্ষতি হয়েছিল, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাংসদ বলেন, ‘দুবলার চরের কারণে বনের ক্ষতি হলে আমাদেরটার অনুমতি দেওয়ার দরকার নেই। তাহলে দুবলার চরেরটাও বন্ধ করতে হবে।’
বাঘের ঘরে পর্যটকদের হানা: বন বিভাগের হিসাবে সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যা প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ করে বাড়ছে। আর পর্যটকেরা সুন্দরবনের বাঘ ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর জন্য নির্ধারিত অভয়ারণ্যে মাইক বাজিয়ে শব্দ করে যাতায়াত করছে। বনের ভেতরে বিপুল পরিমাণ পলিথিন, চিপসের প্যাকেট ও পানীয়ের বোতল ফেলছে তারা। বনের জন্য ক্ষতিকারক এ ধরনের তৎপরতা রোধে বন বিভাগের কোনো কর্মসূচি নেই।
বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত কটকা, কচিখালী, মান্দারবাড়িয়া, হারবাড়িয়াসহ বেশির ভাগ এলাকায় প্রতিদিন পর্যটকবাহী ১০০ থেকে ১৫০টি লঞ্চ যাতায়াত করছে। আর জালি ও জেলে নৌকার সংখ্যা দিনে হাজার ছাড়িয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বনগুলোর মধ্যে একমাত্র সুন্দরবনই এমন অনিয়ন্ত্রিতভাবে পর্যটকদের চলাচল ও মৎস্য শিকার চলছে। সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ইতিমধ্যে অভয়ারণ্য এলাকায় পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) দেশীয় প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে পর্যটক চলাচল ও মাছ শিকারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও জরুরি ভিত্তিতে তা করতে হবে। না হলে দীর্ঘ মেয়াদে তা সুন্দরবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। অবশ্যই অভয়ারণ্যের বাইরে সুনির্দিষ্ট কিছু স্থান ছাড়া অন্য কোথাও পর্যটকদের যেতে দেওয়া উচিত না। পোনা ধরার ক্ষেত্রে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
সরেজমিন: গত ১৮ নভেম্বর মংলা থেকে চাঁদপাই বন ফাঁড়ির দিকে পশুর নদী ধরে সুন্দরবনের দিকে যেতেই পর্যটক ও পোনা-শিকারিদের উৎপাত চোখে পড়ল। ভোরে ওই পথে কিছুদূর এগোতেই অশান্ত ঢেউয়ের ওপর হাজার হাজার মশারির মতো জাল ভাসতে দেখা গেল। আরও কিছুদূরে একের পর এক মাছ ধরার নৌকা সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকতে দেখা গেল।
বেলা গড়িয়ে সকাল ১০টা বাজতেই লঞ্চ আর ছোট জালি নৌকায় পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে গেল। মাইকে বিকট শব্দে হিন্দি গান বাজতে বাজতে একটার পর একটা লঞ্চ বনের ভেতরে হানা দিতে লাগল। পর্যটকদের লঞ্চ চলে যাওয়ার সময় সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক চিপসের প্যাকেট ও পলিথিন নদীতে ভাসতে দেখা গেল।
সঙ্গে থাকা লঞ্চচালক জানালেন, শীত বাড়লে সুন্দরবনের নদীগুলো শান্ত থাকে। এই সুযোগে এ সময় পর্যটকদের আসা-যাওয়াও বেড়ে যায়। পোনা ধরাও শুরু হয় এ সময়। বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য থেকে শুরু করে বনের বেশির ভাগ জায়গায় ঢুকে যায় পর্যটকেরা।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এখন বছরে কমপক্ষে এক লাখ পর্যটক সুন্দরবনে বেড়াতে আসে। গত বছরের তুলনায় পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আর দিনে মাছ ধরতে সুন্দরবনে যায় প্রায় ৫০ হাজার জেলে। বন বিভাগ শুধু তাদের বনে প্রবেশের অনুমতিপত্র বা পাস দেয়। কিন্তু পর্যটকেরা কোথায় যাবে, কী কী করতে পারবে বা পারবে না তার কোনো তদারকি তারা করে না। মাছ ধরা ও পোনা আহরণের ক্ষেত্রেও একই কাণ্ড ঘটে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবন থেকে একটি চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করতে ১০০টি অন্য মাছের পোনা মারা যায়। বছর দশেক আগে সুন্দরবনের একটি মৃত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পেটে চিপসের প্যাকেট পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যটকদের অসচেতনতার কারণে বন্য প্রাণী ও বনের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। (শেষ)
No comments