লাশটা পাইলেও নাড়িচাড়ি মাটি দিবার পাইনো হয় by ইসমাইল হোসেন
প্রতি বছরই হেমন্তে, মাঠজুড়ে সোনা রঙের ধান দেখে খুশিতে দোলে লতিফপুরবাসীর মন। সোনালী রঙের মাঠের হাসি ছড়িয়ে পড়ে চাষী-মা-ঝিদের মুখ থেকে গাঁয়ের প্রতিটি বাড়িতে, উঠোন থেকে উঠোনে।
এবারও দখিণা বাতাসে মৃদুমন্দ, মাঠে মাঠে দুলছে সোনারঙের ধান, কিন্তু এবার আর হাসি নেই লতিফপুরের সহজ সরল মানুষগুলোর মুখে। ছোট্ট এই গাঁ থেকে অনেকদূরের আশুলিয়ার আগুন কেড়ে নিয়েছে সবুজ-শ্যামল পাড়া-গাঁয়ের এই চিরদুঃখী মানুষগুলোর শেষ আশা, শেষ আহ্বলাদটুকুও। শোক আর বেদনায় মুহ্যমান পুরো গ্রাম। যেন গাঁয়ের আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে স্বজন হারানো মানুষগুলোর আহাজারি। কে দেবে এই মানুষগুলোকে সান্ত্বনা? কে দেবে ভরসা?
রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ায় নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনে সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সরকারি হিসেবে প্রাণ হারানো ১১৪ জনের ১৭ জনই এই ইউনিয়নের বাসিন্দা।
২১ নভেম্বরের সেই ভয়াল রাতে লাগা আগুনে রংপুরের লতিফপুরসহ শুধু মিঠাপুকুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামেই মৃতের সংখ্যা ৩৬ জন। লতিফপুরে একই পরিবারের চারজনসহ এখনও নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত নয়জন।
ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে মিঠাপুকুরের জায়গীর বাসস্ট্যান্ড থেকে পশ্চিমদিকে প্রায় দুই কিলোমিটার পেরোলেই লতিফপুর ইউনিয়ন।
বুধবার সরেজমিনে লতিফপুর গিয়ে দেখা গেলো শোকের মাতম চলছে প্রতি বাড়িতে।
কেউ লাশ পেয়ে লাশ না পাওয়াদের দেখে মিথ্যে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করছেন।
পরিবারের আয়ের একমাত্র অবলম্বন, উপার্জনক্ষম মানুষগুলোর মৃত্যুতে পরিবার-পরিজনের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে গাঁয়ের আকাশ-বাতাস।
কোনো জায়গায় জটলা হয়ে, আবার কোনো জায়গায় একে অপরের গলা ধরে কাঁদছেন শোকার্ত মানুষগুলো। আর প্রিয়জন হারানো গৃহবধূ অথবা সন্তানহারা মাও কাঁদছেন নির্জন গৃহকোণে।
প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কোরআন তেলাওয়াতের সুর।
জানা গেলো বড়বাড়ি গ্রামের একই পরিবারের নিখোঁজ রয়েছেন চারজন। আহমেদ হোসেনের জামাতা নজরুল ইসলাম (৪৫), নজরুলের স্ত্রী আমেনা খাতুন (৪০), নজরুলের ছেলে নয়ন (২০) ও ছেলের বউ মনিরা খাতুন (১৮) আগুনে পুড়ে গেছে। লাশতো দূরের কথা তাদের শেষ অবশিষ্টাংশটুকুও পাওয়া যায়নি।
মেয়ে, মেয়ে জামাই, নাতি ও নাতবউকে হারিয়ে এখনও গুমরে গুমরে কাঁদছেন আহমদ ও তার স্ত্রী সোবেরা খাতুন, তবে শুকিয়ে গেছে তাদের চোখের অশ্রুধারা। এত শোক মুছে দিতে গিয়ে আপনা থেকেই শুকিয়ে গেছে চোখের জমানো যত জল।
মেয়ে আর নাতির ছবি হাতে নিয়ে নির্বাক নানা আহমদও (৬০)।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তবুও শুকনো কণ্ঠে বলেন, “আগুন লাগার খবর পায়া রাইত ১১টায় গাড়িত উঠনু। সকাল সাতটাত ঢাকাত নামি সবার গলা ধরি কান্দিনু। লাশগুলা স্কুলের ফিল্ডোত শোতাইলো, মুই হাডফেল নাগবার ধরচুনু গো। কিন্তুক হামার কাকো পানু ন্যা। মেডিকেলোতও খুঁজি পাও নাই। পরে চলি আসনু বাহে.... চলি আসনু”।
মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় সংসদ সদস্য এইচ এন আশিকুর রহমান এই পরিবারের কাছে এক লাখ টাকা হস্তান্তর করেন। ২৫ হাজার করে টাকা দেন আরও কয়েকজনকে।
কিন্তু টাকা কি ঢাকতে পারবে নজরুলের আট বছরের ছেলে রতনের কষ্টকে?
অগ্নিকাণ্ড কেড়ে নিয়েছে রতনের বাবা-মা, ভাই-ভাবির জীবন। বাবা ও ভাই নয়নের ছবি হাতে নিয়ে রতন বলে, “মাও মোক ভাল মানুষ হবার কইছে। বলচে ভাল করে পড়েন, টাকা নাগলে মোবাইল করেন। এখন আর কে মোক ভাল মানুষ হবার কইবে?”
এ প্রশ্ন যেনো শুধু প্রতিবেদকের প্রতি নয়, রতন যেনো এ প্রশ্ন রাখলো পুরো জাতির প্রতি, ততক্ষণে প্রতিবেদকের চোখেও জল।
পাশের বাড়ির আমসারের স্ত্রী মাকসুদা (৩৫) ও মেয়ে রোজিনাও (১৮) নিখোঁজ রয়েছেন, তারাও কাজ করতেন তাজরীন ফ্যাশনে। আর আমসার রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন সাভারে। স্ত্রী ও মেয়ের খোঁজে এখনও তিনি রয়ে গেছেন নিশ্চিন্তপুরে।
আমসারের তিন বোন সাজেদা, রাশেদা ও রোমেজা সদ্য নির্মিত টিনের একটি ঘরের সামনে ভাবী ও ভাতিজির ছবি নিয়ে কাঁদছেন, কিন্তু চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে তাদেরও।
বড় বোন সাজেদা বলতে থাকেন, “ভাবি হামার ঘর তুলি থাকপার চাইছিল। কিন্তুক তার আগে দুনিয়া থাকি চলিয়া গেল। ঘরোত এখন কায় থাকবে বাবা? লাশটা পাইলেও নাড়িচাড়ি মাটি দিবার পাইনো হয় হামরা”। কে বইবে সাজেদার এই শোক?
ইউনিয়নের বড়বাড়ির পলাশ মিয়া (১৮), আব্দুল্লাপুরের রহিমা বেগম (৪২) ও বালুয়াপাড়ার জান্নাতুল ফেরদৌস সীমার (২৪) লাশ দাফন করা হয়েছে স্থানীয়ভাবে।
পরিবারের উপার্জনক্ষম নিহত পলাশের ছবি নিয়ে বিলাপ করছেন মা গোলাপী। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে গেছে তার।
বিলাপ করতে করতে মা গোলাপী বলতে থাকেন, “হামার সোনা মোবাইলোত কইছে- মা হামরা বাথরুমোত নুকি আছি, মরি যাওচি। কমরোত শার্ট, ড্যানাত (হাত) তাবিজ বান্দা আছে, সেটা দেখি হামাক চিনি নেন”।
তবে প্রাণে বাচঁতে না পারলেও পূর্ণ হয়েছে ছেলে পলাশের শেষ ইচ্ছা। জীবন্ত না পেলেও ওই শার্ট ও তাবিজ দেখেই পলাশকে চিনে নিয়েছেন মা গোলাপী। তাকে দাফন করা হয়েছে পারিবারিক গোরস্থানে।
“ওরে সোনার দলা, হামাক থুয়া কোনঠে গেলুরে...”- এভাবে বিলাপ করতে করতে কান্নার শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসে গোলাপীর। গোলাপীর এই চাপা কান্না দেখে কান্না ধরে রাখতে পারছেন না আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলোও।
রহিমা বেগমের লাশ দাফন হয়েছে আব্দুল্লাপুর কবরস্থানে। কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন রহিমার চার মেয়ে- হাওয়া, হনুফা, আঁখি ও আশরিন এবং হাওয়ার স্বামী সজল।
চারদিন ধরে তারা কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে ফেলেছেন চোখের পানি। বাইরে থেকে কেউ এলে এখন শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকছেন তারা।
রহিমার মেয়েজামাই সজল জানান, “মুখ দেখে চিনতে না পারলেও তার শ্বশুর হাতের চুড়ি, নাকফুল ও সিটি গোল্ডের চেইন দেখে লাশ সনাক্ত করেন”।
লতিফপুর বউ বাজারের মোক্তারুলের মেয়ে মুক্তা (১৩), মণ্ডলপাড়ার শাহিন (২৭) ও তার স্ত্রী জান্নাতি (২২) নিখোঁজ রয়েছেন। হাজীপাড়ার আনোয়ারার (২৮) লাশ পাওয়া গেলেও নিখোঁজ রয়েছেন স্বামী হাবিব ওরফে বিপুল (৩৫)।
নিখোঁজ হাবিবের আট বছরের একমাত্র মেয়ে রিক্তা বানু রয়েছে ঢাকায়, ডিএনএ টেস্ট করে জুরাইনে দাফন করা লাশগুলোর একটির অবিভাবক হবার আশায়।
তাজরীনে আগুন জ্বলার সময় ওপর থেকে লাফ দিয়ে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন শ্রমিক বলেছেন, কলাপসিবল গেইটে তালা থাকায় হতাহতের সংখ্যা এতো বেড়েছে।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, ফায়ার ব্রিগেড ও পুলিশের পক্ষ থেকেও আলাদা কমিটি করা হয়েছে। জড়িত সন্দেহে আটক করা হয়েছে তিন জনকে। দেশব্যাপী শোক পালন করা হয় মঙ্গলবার। শোক আচ্ছন্ন করে রেখেছে লতিফপুরের প্রত্যেকটি মানুষকে।
আগুনের সময় গেটে কেন তালা মারা হল- এ প্রশ্ন মনে রেখে শোক ছাপিয়ে বার বার বিচারের দাবি উঠছিল লতিফপুরের সাধারণ মানুষের মুখে।
বড়বাড়ির ষাটোর্ধ আফজাল হোসেন বলেন, “হামরা গরিব মানুষ। হামার মানুষগুল্যাক তালা দিয়ো ক্যান মারি ফেলিল বাহে? হামার দুঃখ তোমরা বুঝব্যার ন্যান!”
উল্লেখ্য, তাজরীন ট্রাজেডিতে পুড়ে যাওয়া ৫২ জনের লাশ শনাক্ত করতে না পারায় ডিএনএ টেস্ট করে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয় রাজধানীর জুরাইনে।
No comments