চারদিক- শ্রমিকের জীবন আজীবন যন্ত্রণা by সৈয়দ আশরাফুল জামান
কোন কথাটা আগে বলব? চাচাতো ভাইটির লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি। ভাইয়ের লাশ খুঁজে পাওয়াটা যেমন ভাবনার বিষয়, এই মাসের বেতন পাওয়ার ভাবনাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় আমার কাছে। মাসটা যেতে না-যেতেই যে বাড়িওয়ালা এসে দাঁড়াবেন দরজায়।
বাড়িভাড়া শোধ করতে না পারলে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আমি, সৈয়দ আশরাফুল জামান, গার্মেন্টসের লোকেরা কল্লোল নামে চেনে আমাকে। একা হলে সমস্যা ছিল না কোনো। বাড়িভাড়া দিতে হবে। সারা মাস তো চালিয়েছি বাকিতে চাল-ডাল এনে। দিতে হবে চাল-ডালসহ খেয়ে বাঁচার জন্য বাকিতে যেসব কেনাকাটা করেছি, সেগুলোর দামও।
সারাক্ষণ মনে ভাবনা আসছে। ভাবছি, সামনের মাসে নতুন একটা চাকরি পাব কি? না পেলে সংসার চালাব কীভাবে? এসব ভাবনা মাথায় এলেই মনে হচ্ছে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসাটা বোধ হয় একটু ভুল হলো! আগুনে পুড়ে মরে গেলে এমন কিছু ক্ষতি হতো কি?
আসলে শ্রমিকের জীবন একটা আজীবন যন্ত্রণার নাম। নিজের যন্ত্রণায় পুড়ে যাচ্ছি আমি। আবার ভাবছি, ভাইয়ের লাশ না পেলে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যাবে কি না? ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পারলে চাচা-চাচিকে কী বলব? লজ্জাও লাগছে। মনে হচ্ছে, ভাইয়ের মৃত্যুর চেয়ে ভাইয়ের মৃত্যুর বিনিময়ে প্রাপ্য অর্থ আদায় করা আমার কাছে বড় হয়ে যাচ্ছে।
বারবার মনে হচ্ছে, লাশ না পেয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে গেলে সন্দেহ করা হবে আমাদের। বড়লোকের সন্দেহ আমাদের জীবনের চেয়েও দামি। আমরা দিনের পর দিন কারখানায় কাজ করি। আমাদের ঘামে-শ্রমে কারখানার মালিকদের আয়-উন্নতি বাড়ে। আমরাই নাকি দেশের কাছে দুগ্ধবতী গাভির মতো। আমাদের দোহন করে দেশের সমৃদ্ধি ঘটে। টাকার পাহাড় গড়েন আমাদের মালিকেরা। অথচ কী আশ্চর্য এই মালিকেরা আমাদের কানাকড়ি দিয়েও বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করলে আগুনের লেলিহান শিখার মাঝখানে আমাদের আটকে রাখতে পারতেন না।
আমাদের প্রতি যদি মালিকদের একটু বিশ্বাস থাকত, তাহলে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগার পরও বের হওয়ার কলাপসিবল গেটগুলোতে তালা দিতে পারতেন না। প্রতিটি তলায় কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজ্জাক ও কোয়ালিটি ম্যানেজার দুলাল। আমি নিশ্চিত, তালা লাগানো না হলে আরও অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পারতেন।
দু-তিন দিন ধরে ঘুরেফিরে সাংবাদিকদের কাছে এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সাংবাদিকেরা বিশ্বাসই করতে পারছেন না, ভেতরে শত শত নারী-পুরুষকে আটকে রেখে কীভাবে তালা দেন মালিকপক্ষের লোকজন? তালা তাঁরা দিতে পারেন। কারণ, তাঁদের এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আমরা আগুনের ভয়ে পালানোর সময়ও কিছু জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে আসতে পারি।
অবশ্য আমাদের তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনাটা বোধ হয় আরও বড় কিছু। আমরা শুনেছি আমাদের মালিকের ব্যাংকে অনেক ঋণ ছিল। দেনার দায়ে তিনি আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন। কারখানা পুড়িয়ে দিয়ে তিনি সেসব ঋণ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন হয়তো। যদি মালিকপক্ষের ইন্ধনে আগুন লাগানো হয়, তাহলে শ্রমিকদের আটকে রাখা গেলে অগ্নিকাণ্ডটাকে আরও স্বাভাবিক চেহারা দেওয়া যাবে।
আমাদের তুবা গ্রুপের মালিক সত্যিই দেনার দায়ে ডুবে ছিলেন কি না, আমার মতো সাধারণ একজন শ্রমিকের তা জানার কথা নয়। তবে আমরা যাঁরা তাজরীনের শ্রমিক, তাঁরা জানি, আমাদের বেতন অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের বেতন দেওয়া হতো ভেঙে ভেঙে। এক মাসের বেতন দিতে আরেক মাস লাগিয়ে দেওয়া হতো। অবশ্য মালিকেরা যে সব সময় টাকার অভাবে বেতন অনিয়মিত করে দেন, তা সত্য না-ও হতে পারে। বেতন আটকা পড়ে গেলে আমাদের পক্ষে চাকরি ছেড়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
আমি জানি, আমার সহকর্মীদের অনেকেই বেশ কিছুদিন ধরেই সুযোগ পেলে তাজরীনের চাকরি ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সত্যি যদি তা করতে পারতেন তাহলে তাঁদের অনেকেই এখন বেঁচে থাকতেন। ভাবুন তো, আমার এক সহকর্মী যখন তাঁর মাকে শেষবারের মতো ফোন করে বলেছেন, ‘আমি বাঁচব না। আমার কোমরে বাঁধা শার্ট দেখে আমার লাশটি শনাক্ত করে নিয়ো’—তখন ওর মায়ের কী অবস্থা হয়েছিল! আমি তো পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে নেমেছি পাশের টিনশেড বাড়ির চালায়। ১০ তলা থেকে বাঁশ বেয়ে নেমেছেন আমার সহকর্মী মাবিয়া। অথচ আগুন লাগার পরপরই যদি আমাদের নামতে দেওয়া হতো, তাহলে বেঁচে থাকতেন জয়ামণির মা রোকসানা। দুই দিন আগেই জয়ামণির কথা ছাপা হয়েছে প্রথম আলোয়। বললে বিশ্বাস করবেন না, জয়ামণি এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না ওর মা আর ফিরে আসবে না। জয়া অভিমানে কাঁদছে ওর মা হাসপাতাল থেকে ফিরে আসতে এত দেরি করছে কেন?
সত্যি বলতে কি, যখন নিজের কথা ভাবি তখন সবার জন্য আমার এসব ভাবনা মিথ্যে হয়ে যায়। আমি আমার নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে ভয়ে আঁতকে উঠি।
সৈয়দ আশরাফুল জামান
আগুনে পুড়ে যাওয়া তাজরীন ফ্যাশনসের কর্মী
সারাক্ষণ মনে ভাবনা আসছে। ভাবছি, সামনের মাসে নতুন একটা চাকরি পাব কি? না পেলে সংসার চালাব কীভাবে? এসব ভাবনা মাথায় এলেই মনে হচ্ছে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসাটা বোধ হয় একটু ভুল হলো! আগুনে পুড়ে মরে গেলে এমন কিছু ক্ষতি হতো কি?
আসলে শ্রমিকের জীবন একটা আজীবন যন্ত্রণার নাম। নিজের যন্ত্রণায় পুড়ে যাচ্ছি আমি। আবার ভাবছি, ভাইয়ের লাশ না পেলে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যাবে কি না? ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পারলে চাচা-চাচিকে কী বলব? লজ্জাও লাগছে। মনে হচ্ছে, ভাইয়ের মৃত্যুর চেয়ে ভাইয়ের মৃত্যুর বিনিময়ে প্রাপ্য অর্থ আদায় করা আমার কাছে বড় হয়ে যাচ্ছে।
বারবার মনে হচ্ছে, লাশ না পেয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে গেলে সন্দেহ করা হবে আমাদের। বড়লোকের সন্দেহ আমাদের জীবনের চেয়েও দামি। আমরা দিনের পর দিন কারখানায় কাজ করি। আমাদের ঘামে-শ্রমে কারখানার মালিকদের আয়-উন্নতি বাড়ে। আমরাই নাকি দেশের কাছে দুগ্ধবতী গাভির মতো। আমাদের দোহন করে দেশের সমৃদ্ধি ঘটে। টাকার পাহাড় গড়েন আমাদের মালিকেরা। অথচ কী আশ্চর্য এই মালিকেরা আমাদের কানাকড়ি দিয়েও বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করলে আগুনের লেলিহান শিখার মাঝখানে আমাদের আটকে রাখতে পারতেন না।
আমাদের প্রতি যদি মালিকদের একটু বিশ্বাস থাকত, তাহলে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগার পরও বের হওয়ার কলাপসিবল গেটগুলোতে তালা দিতে পারতেন না। প্রতিটি তলায় কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন প্রোডাকশন ম্যানেজার রাজ্জাক ও কোয়ালিটি ম্যানেজার দুলাল। আমি নিশ্চিত, তালা লাগানো না হলে আরও অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পারতেন।
দু-তিন দিন ধরে ঘুরেফিরে সাংবাদিকদের কাছে এই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সাংবাদিকেরা বিশ্বাসই করতে পারছেন না, ভেতরে শত শত নারী-পুরুষকে আটকে রেখে কীভাবে তালা দেন মালিকপক্ষের লোকজন? তালা তাঁরা দিতে পারেন। কারণ, তাঁদের এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আমরা আগুনের ভয়ে পালানোর সময়ও কিছু জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে আসতে পারি।
অবশ্য আমাদের তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনাটা বোধ হয় আরও বড় কিছু। আমরা শুনেছি আমাদের মালিকের ব্যাংকে অনেক ঋণ ছিল। দেনার দায়ে তিনি আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন। কারখানা পুড়িয়ে দিয়ে তিনি সেসব ঋণ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন হয়তো। যদি মালিকপক্ষের ইন্ধনে আগুন লাগানো হয়, তাহলে শ্রমিকদের আটকে রাখা গেলে অগ্নিকাণ্ডটাকে আরও স্বাভাবিক চেহারা দেওয়া যাবে।
আমাদের তুবা গ্রুপের মালিক সত্যিই দেনার দায়ে ডুবে ছিলেন কি না, আমার মতো সাধারণ একজন শ্রমিকের তা জানার কথা নয়। তবে আমরা যাঁরা তাজরীনের শ্রমিক, তাঁরা জানি, আমাদের বেতন অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের বেতন দেওয়া হতো ভেঙে ভেঙে। এক মাসের বেতন দিতে আরেক মাস লাগিয়ে দেওয়া হতো। অবশ্য মালিকেরা যে সব সময় টাকার অভাবে বেতন অনিয়মিত করে দেন, তা সত্য না-ও হতে পারে। বেতন আটকা পড়ে গেলে আমাদের পক্ষে চাকরি ছেড়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
আমি জানি, আমার সহকর্মীদের অনেকেই বেশ কিছুদিন ধরেই সুযোগ পেলে তাজরীনের চাকরি ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সত্যি যদি তা করতে পারতেন তাহলে তাঁদের অনেকেই এখন বেঁচে থাকতেন। ভাবুন তো, আমার এক সহকর্মী যখন তাঁর মাকে শেষবারের মতো ফোন করে বলেছেন, ‘আমি বাঁচব না। আমার কোমরে বাঁধা শার্ট দেখে আমার লাশটি শনাক্ত করে নিয়ো’—তখন ওর মায়ের কী অবস্থা হয়েছিল! আমি তো পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে নেমেছি পাশের টিনশেড বাড়ির চালায়। ১০ তলা থেকে বাঁশ বেয়ে নেমেছেন আমার সহকর্মী মাবিয়া। অথচ আগুন লাগার পরপরই যদি আমাদের নামতে দেওয়া হতো, তাহলে বেঁচে থাকতেন জয়ামণির মা রোকসানা। দুই দিন আগেই জয়ামণির কথা ছাপা হয়েছে প্রথম আলোয়। বললে বিশ্বাস করবেন না, জয়ামণি এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না ওর মা আর ফিরে আসবে না। জয়া অভিমানে কাঁদছে ওর মা হাসপাতাল থেকে ফিরে আসতে এত দেরি করছে কেন?
সত্যি বলতে কি, যখন নিজের কথা ভাবি তখন সবার জন্য আমার এসব ভাবনা মিথ্যে হয়ে যায়। আমি আমার নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে ভয়ে আঁতকে উঠি।
সৈয়দ আশরাফুল জামান
আগুনে পুড়ে যাওয়া তাজরীন ফ্যাশনসের কর্মী
No comments