বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৮২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুর রউফ শরীফ, বীর প্রতীক সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনীর কয়েকটি দল একযোগে আক্রমণ চালায় পঞ্চগড় জেলার বোদা থানায় (বর্তমানে উপজেলা)।
এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর একটি উপদলের (সেকশন) নেতৃত্ব দেন আবদুর রউফ শরীফ। তাঁরা ১ ডিসেম্বর বোদা থানা দখল করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী বোদা থেকে পশ্চাদপসরণ করে নতুন স্থানে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সেই সুযোগ না দিয়ে ধাওয়া করেন। পাকিস্তানিরা আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে, কিন্তু টিকতে পারেনি।
তারা ভুল্লী সেতু পার হয়ে মুক্তিবাহিনীকে ঠেকানোর জন্য সেতুটি বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা সেখানে থেমে যায়। এই সুযোগে পাকিস্তানিরা সেখানে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে।
নদীর এক পাড়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সেনা, অপর পাড়ে পাকিস্তানি সেনারা। দুপর থেকে সেখানে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। দুই পক্ষে তুমুল গোলাগুলি চলে। আবদুর রউফ শরীফ ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিক্রমের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। পাকিস্তানিদের সেখান থেকে হটানোর জন্য তাঁরা নানাভাবে চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানিরা সড়ক বরাবর মাটি কামড়ে পড়ে থাকে।
এ অবস্থায় মুক্তি ও মিত্র বাহিনীকে যুদ্ধের কৌশল কিছুটা পাল্টাতে হয়। দুই বাহিনীর অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নেন, মুক্তিবাহিনীর একটি দল দূর দিয়ে নদী পার হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালাবে। এই দলে অন্তর্ভুক্ত হন আবদুর রউফ শরীফ ও তাঁর সহযোদ্ধারা। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিকেলের মধ্যেই নদী পার হন।
আবদুর রউফ শরীফ সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঝোড়ো গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তানিরা চিন্তাও করেনি এই কৌশল। আক্রমণে তারা বিস্মিত হয়ে পড়ে। একই সময়ে সামনে থেকেও যৌথ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড আক্রমণে হতাহত হয় কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা।
নদী পার হয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের ঝোড়ো আক্রমণে আধা ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তখন পাকিস্তানি সেনারা নিহত সহযোদ্ধাদের ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। মুক্ত হয় ভুল্লী। এই যুদ্ধে আবদুর রউফ শরীফ অত্যন্ত বিক্রম ও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ভুল্লী মুক্ত হওয়ায় যৌথ বাহিনী খুব সহজেই ঠাকুরগাঁও জেলা (তখন মহকুমা) শহর দখল করতে সক্ষম হয়।
আবদুর রউফ শরীফ ১৯৭১ সালে দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের অধীন ঠাকুরগাঁও উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) কর্মরত ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। ২৫ মার্চ রাতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার খবর তাঁরা ২৬ মার্চ দুপুর পর্যন্ত পাননি। তাঁদের অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি। বাঙালি সেনা কর্মকর্তা কেউ তখন সেখানে ছিলেন না।
অধিনায়ক ২৬ মার্চ বিকেল থেকে ঠাকুরগাঁও শহরে সান্ধ্য আইন জারি করেন। তাঁর নির্দেশে বাঙালি-অবাঙালি ইপিআর সৈনিকেরা উইংয়ের চারদিকে বাংকার খুঁড়ে অবস্থান নেন এবং শহরে টহল শুরু করেন। এরপর ঠাকুরগাঁও শহর ও উইংয়ে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে।
২৮ মার্চ গভীর রাতে আবদুর রউফ শরীফসহ বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তখন অবাঙালি ইপিআরদের সঙ্গে তাঁদের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয়। বেশির ভাগ অবাঙালি ইপিআর সৈনিক এই যুদ্ধে নিহত হয়। ২৯ মার্চ দুপুরে ইপিআর উইং তাঁদের দখলে আসে।
এরপর তাঁরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে তেঁতুলিয়ায় যান। পুনরায় সংগঠিত হওয়ার পর ৬ নম্বর সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরের আওতাধীন এলাকার বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুর রউফ শরীফকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৯৭।
আবদুর রউফ শরীফ স্বাধীনতার পর বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) থেকে সুবেদার হিসেবে ১৯৮৮ সালে অবসর নেন। তিনি ১৯৯৩ সালে মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার (ডাকঘর ফুকরা) তাড়াইল গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আলেম শরীফ, মা মাজেদা খাতুন। স্ত্রী হামিদা বেগম। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, নূরুল ইসলাম তালুকদার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.