আলাউদ্দিন খাঁর গ্রামের বাড়ি by সুমন মোল্লা
আজ থেকে শুরু উচ্চাঙ্গসংগীতের চার দিনের উৎসবটি যাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে, তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। আমাদের মাটির সন্তান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ। উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের অন্যতম পুরোধা আলাউদ্দিন খাঁ সম্পর্কে কিছু কথা হোক।
চলুন, আমরা ঘুরে আসি তাঁর ভিটেবাড়ি থেকে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের শিবপুর গ্রামে খাঁ বাড়ির গলিতে ঢোকার মুখেই একটি চায়ের দোকান। রোকেয়া বেগম নামের এক নারী এ দোকানের মালিক। তাঁকে প্রশ্ন করি, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে চেনেন?’
সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি বলেন, ‘আলাউদ্দিন খাঁ তো বাজনা শিল্পী। তাঁর জন্ম না হইলে এই গ্রাম চিনত কেডা? অত বড় বড় কাস্টমার পাইতামনি?’
খাঁ পাড়া জামে মসজিদের সঙ্গেই গ্রামের একমাত্র কলেজ। গ্রামবাসী শ্রদ্ধার উপহার হিসেবে কলেজটির নামকরণ করেছেন ‘সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ মহাবিদ্যালয়’। এই কলেজের ছাত্রী বলে কাজী তানিয়ার গর্বের শেষ নেই। তানিয়া বলেন, ‘মাঝে মাঝে ভাবি, সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ কি সত্যি সত্যি আমাদের এই গ্রামের সন্তান?’
১৮৬২ সালে আলাউদ্দিন খাঁর জন্ম। আদর করে বাবা সাধু খান তাঁকে ডাকতেন আলম নামে। বাবা আর বড় ভাই ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ তাঁকে সুরের প্রতি আকৃষ্ট করেন। সুরপাগল এই ছেলে নাকি একদিন হঠাৎ গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমান। সুরের পথে এক চিত্তাকর্ষক ভ্রমণ ছিল তাঁর। কলকাতায় গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে ধ্রুপদ, ধামার আর খেয়ালের শিক্ষা নেন। তবলা, পাখওয়াজকেও তিনি ভালোবেসে ফেলেন এ সময়। কয়েক বছর পর মুক্তাগাছায় ওস্তাদ আহমেদ আলী খানের সরোদ শোনেন। সরোদের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর। তিনি ওস্তাদকে বলেন শিখিয়ে দিতে। ওস্তাদের সঙ্গে তিনি দিনাজপুরে যান, এরপর রামপুরে। সরোদ শিখতেই হবে। শেষ পর্যন্ত রামপুরের মোহাম্মাদ ওয়াজির খানের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন।
এর পর কত ঘটনা ঘটেছে তাঁর জীবনে। শিষ্য হিসেবে পেয়েছেন ছেলে আকবর আলী খান, মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবী, পণ্ডিত তিমিরবরণ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, মাইহারের মহারাজা ব্রিজনাথ সিংসহ আরও কত স্বনামধন্য সংগীতকারকে! প্রখ্যাত নৃত্য-ব্যক্তিত্ব উদয় শংকরের সঙ্গে করেছেন ইউরোপ ভ্রমণ। আমাদের এই উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতকে বিশ্ববাসীর সঙ্গে করেছেন পরিচিত।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ দীর্ঘ সময় পর গ্রামে ফিরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। নাম দেন ‘খাঁ পাড়া জামে মসজিদ’। এখান থেকে ফিরে গিয়েই তানসেন বংশীয় বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খানের কাছ থেকে সুরের ভান্ডার পূর্ণ করে আবার গ্রামে আসেন। তখন বসতঘরের কাছে পাশাপাশি সমাহিত বাবা সবদর হোসেন খান ও মা সুন্দরী বেগমের কবর পাকা করেন। এবারই শেষবারের মতো গ্রাম ছেড়ে যান তিনি।
বাড়িটি এখন পতিত। ভিটার চিহ্নও নেই। মসজিদ আর বাবা-মায়ের কবর ছাড়া বসতবাড়ির আর কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট নেই।
আলাউদ্দিন খাঁর বিশেষ স্মৃতি বলতে খাঁ পাড়া জামে মসজিদটি। নির্মাণ সাল ১৮৯৮, ৭ মার্চ। আছে আগের মতোই। স্মৃতি ধরে রাখতে মসজিদে নতুন করে সংস্কার করা হয়নি। খুব বেশি নষ্ট হয়নি মূল কাঠামো। তবে প্রাচীরের বেশির ভাগ অংশ ভেঙে পড়েছে।
বাড়ির কাছের সড়কের পাশে রফিকের চায়ের দোকান। ওইখানে কথা হয় বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে। আলাউদ্দিন খাঁ প্রসঙ্গ তুলতেই গ্রামের কৃষক শহীদ মিয়া বলেন, ‘আস্তে আস্তে এই নামডা (আলাউদ্দিন খাঁ) ভাইসা উঠতাছে।’
গোলাম হোসেন নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘এই নামের সম্মানই আলাদা। কী কমু, কওয়ার কিছু নাই। সুরের এই গ্রামে তহন অসুরের বাস আছিল। বাইচ্চা থাকতে খুব বেশি সম্মান দিতে পারি নাই।’
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৭২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আলাউদ্দিন খাঁর চার সন্তান—আলী আকবর খাঁ, সরিজা খাতুন, জাহানারা বেগম ও রওশন আরা অন্নপূর্ণা। বড় মেয়ে সরিজা খাতুন বাংলাদেশে জন্মেছেন। অন্নপূর্ণা ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। গ্রামের বাড়িতে তাঁদের খুব বেশি আসা হয়নি। আলাউদ্দিন খাঁর বড় ভাই সমির উদ্দিন খাঁ, ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ, ছোট ভাই আয়েত আলী খাঁ আর মুন্সী নায়েব আলী খাঁর মধ্যে শুধু সমির উদ্দিনের বংশধরেরা গ্রামের বাড়িতে বাস করছেন। অন্যরা বাইরে থাকলেও সময় সময় গ্রামে আসেন।
আলাউদ্দিন খাঁ, আয়েত আলী খাঁ ও নায়েব আলী খাঁর ভিটে পতিত পড়ে আছে। আফতাব উদ্দিনের ভিটেয় তাঁর মেয়ের ঘরের ছেলের বউ কদর চান বসবাস করেন। কদর চানের ঘরে আলাউদ্দিনসহ খাঁ তাঁদের বংশের অন্যদের কিছু দুর্লভ ছবি চোখে পড়ে।
গত শুক্রবার আমরা যখন শিবপুরে যাই, সেদিন ঢাকা থেকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তিন বংশধর আয়েত আলী খাঁর ছেলে বিটোফেন খাঁ, সমীরউদ্দিন খাঁর নাতি তানসেন খাঁ ও আবির হোসেন খাঁর ছেলে শাহদাত হোসেন খাঁ এসেছিলেন।
বিটোফেন খাঁ বললেন, আলাউদ্দিন খাঁ সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ বাড়ছে। বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ উপেক্ষা করে জন্মভিটা দেখতে আসছে মানুষ। জাহাঙ্গীর আলম ওরফে তানসেন খাঁর কষ্ট সুর সম্রাটের জন্মস্থান নিয়ে প্রশাসনের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এখানে একটি কমপ্লেক্স হলে দূরের লোকজন এসে অনেক কিছু দেখতে পারত।
আমরা ফিরে আসি এক অসাধারণ অনুভূতি নিয়ে। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সংগীতগুরুদের অন্যতম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে—এই ইতিবাচক অনুভূতি আমাদের শান্তি দেয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের শিবপুর গ্রামে খাঁ বাড়ির গলিতে ঢোকার মুখেই একটি চায়ের দোকান। রোকেয়া বেগম নামের এক নারী এ দোকানের মালিক। তাঁকে প্রশ্ন করি, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে চেনেন?’
সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি বলেন, ‘আলাউদ্দিন খাঁ তো বাজনা শিল্পী। তাঁর জন্ম না হইলে এই গ্রাম চিনত কেডা? অত বড় বড় কাস্টমার পাইতামনি?’
খাঁ পাড়া জামে মসজিদের সঙ্গেই গ্রামের একমাত্র কলেজ। গ্রামবাসী শ্রদ্ধার উপহার হিসেবে কলেজটির নামকরণ করেছেন ‘সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ মহাবিদ্যালয়’। এই কলেজের ছাত্রী বলে কাজী তানিয়ার গর্বের শেষ নেই। তানিয়া বলেন, ‘মাঝে মাঝে ভাবি, সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ কি সত্যি সত্যি আমাদের এই গ্রামের সন্তান?’
১৮৬২ সালে আলাউদ্দিন খাঁর জন্ম। আদর করে বাবা সাধু খান তাঁকে ডাকতেন আলম নামে। বাবা আর বড় ভাই ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ তাঁকে সুরের প্রতি আকৃষ্ট করেন। সুরপাগল এই ছেলে নাকি একদিন হঠাৎ গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমান। সুরের পথে এক চিত্তাকর্ষক ভ্রমণ ছিল তাঁর। কলকাতায় গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে ধ্রুপদ, ধামার আর খেয়ালের শিক্ষা নেন। তবলা, পাখওয়াজকেও তিনি ভালোবেসে ফেলেন এ সময়। কয়েক বছর পর মুক্তাগাছায় ওস্তাদ আহমেদ আলী খানের সরোদ শোনেন। সরোদের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর। তিনি ওস্তাদকে বলেন শিখিয়ে দিতে। ওস্তাদের সঙ্গে তিনি দিনাজপুরে যান, এরপর রামপুরে। সরোদ শিখতেই হবে। শেষ পর্যন্ত রামপুরের মোহাম্মাদ ওয়াজির খানের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন।
এর পর কত ঘটনা ঘটেছে তাঁর জীবনে। শিষ্য হিসেবে পেয়েছেন ছেলে আকবর আলী খান, মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবী, পণ্ডিত তিমিরবরণ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, মাইহারের মহারাজা ব্রিজনাথ সিংসহ আরও কত স্বনামধন্য সংগীতকারকে! প্রখ্যাত নৃত্য-ব্যক্তিত্ব উদয় শংকরের সঙ্গে করেছেন ইউরোপ ভ্রমণ। আমাদের এই উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতকে বিশ্ববাসীর সঙ্গে করেছেন পরিচিত।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ দীর্ঘ সময় পর গ্রামে ফিরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। নাম দেন ‘খাঁ পাড়া জামে মসজিদ’। এখান থেকে ফিরে গিয়েই তানসেন বংশীয় বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খানের কাছ থেকে সুরের ভান্ডার পূর্ণ করে আবার গ্রামে আসেন। তখন বসতঘরের কাছে পাশাপাশি সমাহিত বাবা সবদর হোসেন খান ও মা সুন্দরী বেগমের কবর পাকা করেন। এবারই শেষবারের মতো গ্রাম ছেড়ে যান তিনি।
বাড়িটি এখন পতিত। ভিটার চিহ্নও নেই। মসজিদ আর বাবা-মায়ের কবর ছাড়া বসতবাড়ির আর কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট নেই।
আলাউদ্দিন খাঁর বিশেষ স্মৃতি বলতে খাঁ পাড়া জামে মসজিদটি। নির্মাণ সাল ১৮৯৮, ৭ মার্চ। আছে আগের মতোই। স্মৃতি ধরে রাখতে মসজিদে নতুন করে সংস্কার করা হয়নি। খুব বেশি নষ্ট হয়নি মূল কাঠামো। তবে প্রাচীরের বেশির ভাগ অংশ ভেঙে পড়েছে।
বাড়ির কাছের সড়কের পাশে রফিকের চায়ের দোকান। ওইখানে কথা হয় বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে। আলাউদ্দিন খাঁ প্রসঙ্গ তুলতেই গ্রামের কৃষক শহীদ মিয়া বলেন, ‘আস্তে আস্তে এই নামডা (আলাউদ্দিন খাঁ) ভাইসা উঠতাছে।’
গোলাম হোসেন নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘এই নামের সম্মানই আলাদা। কী কমু, কওয়ার কিছু নাই। সুরের এই গ্রামে তহন অসুরের বাস আছিল। বাইচ্চা থাকতে খুব বেশি সম্মান দিতে পারি নাই।’
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৭২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আলাউদ্দিন খাঁর চার সন্তান—আলী আকবর খাঁ, সরিজা খাতুন, জাহানারা বেগম ও রওশন আরা অন্নপূর্ণা। বড় মেয়ে সরিজা খাতুন বাংলাদেশে জন্মেছেন। অন্নপূর্ণা ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। গ্রামের বাড়িতে তাঁদের খুব বেশি আসা হয়নি। আলাউদ্দিন খাঁর বড় ভাই সমির উদ্দিন খাঁ, ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ, ছোট ভাই আয়েত আলী খাঁ আর মুন্সী নায়েব আলী খাঁর মধ্যে শুধু সমির উদ্দিনের বংশধরেরা গ্রামের বাড়িতে বাস করছেন। অন্যরা বাইরে থাকলেও সময় সময় গ্রামে আসেন।
আলাউদ্দিন খাঁ, আয়েত আলী খাঁ ও নায়েব আলী খাঁর ভিটে পতিত পড়ে আছে। আফতাব উদ্দিনের ভিটেয় তাঁর মেয়ের ঘরের ছেলের বউ কদর চান বসবাস করেন। কদর চানের ঘরে আলাউদ্দিনসহ খাঁ তাঁদের বংশের অন্যদের কিছু দুর্লভ ছবি চোখে পড়ে।
গত শুক্রবার আমরা যখন শিবপুরে যাই, সেদিন ঢাকা থেকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তিন বংশধর আয়েত আলী খাঁর ছেলে বিটোফেন খাঁ, সমীরউদ্দিন খাঁর নাতি তানসেন খাঁ ও আবির হোসেন খাঁর ছেলে শাহদাত হোসেন খাঁ এসেছিলেন।
বিটোফেন খাঁ বললেন, আলাউদ্দিন খাঁ সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহ বাড়ছে। বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ উপেক্ষা করে জন্মভিটা দেখতে আসছে মানুষ। জাহাঙ্গীর আলম ওরফে তানসেন খাঁর কষ্ট সুর সম্রাটের জন্মস্থান নিয়ে প্রশাসনের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এখানে একটি কমপ্লেক্স হলে দূরের লোকজন এসে অনেক কিছু দেখতে পারত।
আমরা ফিরে আসি এক অসাধারণ অনুভূতি নিয়ে। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সংগীতগুরুদের অন্যতম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে—এই ইতিবাচক অনুভূতি আমাদের শান্তি দেয়।
No comments