'বিচ্ছিন্ন ঘটনা কারে কয়' by এ কে এম শাহনাওয়াজ
জুনায়েদ মণ্ডল মাঝ বয়সী সদালাপী মানুষ। হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করেন। বেশ রাজনীতিসচেতন। তাঁর ডাক্তারখানাসংলগ্ন একটি পত্রিকা বিক্রির স্টল আছে। নিজে একটি পত্রিকা রাখেন আর স্টল থেকে ধার করে আরো কয়েকটি পড়েন। রাজনৈতিক কলাম পড়ায় তাঁর নেশা আছে।
তাই আমি এদিকটায় এলে কলাম লেখক হিসেবে একটু বাড়তি সমাদর পাই। দোকানে বসে এক কাপ চা খেতে হয়। তারপর আমাকে মনোযোগী শ্রোতা বানিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শুরু করেন। এক পক্ষে তো জমে না, আমাকেও অংশ নিতে হয়। আলোচনা-সমালোচনায় এর মধ্যে একটি নিরপেক্ষতা কাজ করে। তবে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতে রাজি নন তিনি। এখানটাতেই তিনি কিছুটা রক্ষণশীল। বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা সহ্য করবেন না।
মণ্ডল সাহেব রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। গত রবিবার বিকেলে তাঁর চায়ের আড্ডায় রবীন্দ্রসংগীতের প্যারোডি করেই বললেন, 'স্যার, বিচ্ছিন্ন ঘটনা কারে কয়?' তিনি নিজে 'মণ্ডল' বলেই কি না কে জানে কেরানীগঞ্জের পরাগ মণ্ডল অপহরণ ও অতঃপর খুঁজে পাওয়াসংক্রান্ত ঘটনাবলি জুনায়েদ মণ্ডলকে বেশ ভাবিয়েছে। অবশ্য ঘটনাটি দেশের বিবেকবান সব মানুষকেই আতঙ্কিত করেছে। আমাদের ডাক্তার সাহেব বেশি চিন্তিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের অপহরণ ঘটনাকে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে মন্তব্য করায়! তিনি এখন জানতে চান, এই 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' কথাটির অর্থটি কী?
মণ্ডল সাহেবের প্রশ্নটি স্পষ্ট। যদি এ দেশে অপহরণ-সন্ত্রাসজাতীয় ঘটনা দৈবাৎ ঘটত আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত, তবে এক-দুটি অপহরণের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যেত। তাহলে দিবালোকে মা-বোন আর গাড়ির ড্রাইভারকে গুলি করে ছোট পরাগকে ছিনিয়ে নেওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে পারতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের মানুষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ছিনতাই, খুনের ঘটনা অহরহ পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকছে। রাজনৈতিক হানাহানি তো চলছেই। গুমের ঘটনা ও অজ্ঞাতপরিচয় লাশের অভাব হচ্ছে না। তেমন এক বাস্তবতায় পরাগ মণ্ডলের অপহরণ কোন বিচারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে যায়?
আসলে আমাদের মনে হয়, মন্ত্রীর চেয়ারটাই বোধ করি ওরকম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ারে সাহারা খাতুন আসীন থাকুন বা মহীউদ্দীন খান আলমগীর অধিষ্ঠিত হোন সবার সীমাবদ্ধতা ও অসহায়ত্বই বোধ হয় এক। তাই ভাষায় ও ব্যাখ্যায় তেমন গুণগত পার্থক্য দেখা যায় না।
বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পরাগ মণ্ডলের অপহরণ নিয়ে যে রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো, অপহরণকারীরা প্রধান সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্কিত। ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পর পথে ফেলে গেছে পরাগকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, তাকে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কৌশলী হতে হয়েছে। তাই ছোটখাটোরা ধরা পড়লেও পালের গোদা ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণ মানুষ দেখেছে পরাগ উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নেই। হয়তো মুক্তিপণের টাকা পেয়ে পরাগকে অপহরণকারীরা পথের পাশে ফেলে গেছে।
নাটক আরো রয়েছে। শুরু থেকে মুক্তিপণ দেওয়ার ব্যাপারটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বীকার করেনি। পরাগের বাবাও অস্বীকার করেছেন। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেনি। করেনি এ জন্য যে এত বড় ফিল্মি কায়দায় তিনজন মানুষকে গুলিতে আহত করে ছিনিয়ে নেওয়া কিশোরকে কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই মুক্ত করে দিল। তাও যদি হতো পুলিশি কঠিন চিরুনি অভিযানে দিশেহারা হয়ে বাধ্য হয়েছে মুক্তি দিতে। মূল নায়কদের নাম-পরিচয় যা পাওয়া যাচ্ছে, তারা তো বেশ সেয়ানা। 'মুরগি কলজের নয়'। নানা রকম কানেকশন থাকা এই রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীরা অনেক কঠিন মামলা ঘাড়ে রেখে সদম্ভে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন। এদিকে র্যাব ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেওয়ার কথা মেনে নিয়ে বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
এটিও খুব হতাশার কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক পক্ষ র্যাব স্বীকার করছে, পরাগের বাবা ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন। অন্য পক্ষ ডিবি নিজেদের কৃতিত্ব প্রকাশ করছে। জানাচ্ছে, কোনো মুক্তিপণ নয়। তারা কৌশল করে, ফাঁদ পেতে উদ্ধার করেছে পরাগকে (কালের কণ্ঠ, ১৭ নভেম্বর)। একই সূত্রে বলা হয়েছে, স্থানীয় মানুষ মনে করছে, 'ভয়ে' ও 'চাপে' পরাগের পরিবার মুখ খুলছে না। এ ভয়টা কি সন্ত্রাসীর আর চাপটা কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর?
এমন একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যান্ত্রিক ভাষায় যদি পরাগ মণ্ডলের অপহরণকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেন, তাহলে সাধারণ মানুষের হতাশা বাড়বে বৈ কমবে না। আমরা বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রাখতে চাই। বিপন্ন মানুষের সামনে যখন দায়িত্বশীল পদাধিকারীরা বাস্তবতাবর্জিত কথা বলেন, তখন মানুষ আরো বেশি বিপন্ন বোধ করে। গত বিএনপি সরকারের আমলে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে সাধারণ মানুষ যখন বিপর্যস্ত, তখন প্রায় প্রতি বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলে কণ্ঠশীলন করেছেন।
এ দেশের মানুষ নির্বোধ নয়। তারা জানে রাতারাতি জগদ্দল পাথর সরানো যাবে না। দেশের বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে নষ্ট-রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে সক্ষমতা থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও অনেক সময় হাত-পা বাঁধা থাকে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে দিন দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশের নৈতিক স্খলন ঘটানো হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক দূরদর্শী নীতিনির্ধারণ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট আর অব্যবস্থা মোকাবিলা সম্ভব নয়। তাই রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন ছাড়া সমাজ দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না।
এসব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রকৃত সত্য আড়াল করার দরকার কী। বরং সংকটকে মেনেই তা মোকাবিলা করতে হবে। আমরা মনে করি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সম্ভব নয়। তার আগে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে যে দল বা দল সমন্বয় থাকবে, সেসব দলের নীতিনির্ধারকদের প্রথমে আত্মশুদ্ধি করে নিশ্চিত হতে হবে যে তাঁরা গণতান্ত্রিক চেতনাসমৃদ্ধ হয়েছেন। এখন বুকের ভেতর অনুভব করছেন দেশপ্রেম। তখনই ক্ষমতাপ্রেম ও এর অনুষঙ্গে অন্ধ দলপ্রেম প্রকট হবে না।
এমন স্বপি্নল অবস্থা সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক দলে যুক্ত থাকা বা দলের নাম ভাঙানো মাস্তানরা, জমি দখল, চাঁদবাজি, টেন্ডারবাজি ও অস্ত্রবাজি বুক ফুলিয়ে করতে পারবে না। তাদের গডফাদাররা সরকারের ভেতর বা আশপাশে বসে মদদ দিতে পারবে না। থানা আদালত সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ক্ষমতায় থাকার দাপটে দলে দলে অপরাধী রাজনৈতিক মামলার নামে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে মুক্ত হয়ে যাবে না। অপ্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির মহান পদটাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে তাঁকে দিয়ে দলীয় সন্ত্রাসী-খুনিদের মার্জনা করানো হবে না।
এমন একটি অবস্থা তৈরি করা খুব যে কঠিন তা নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক সততা ও দেশপ্রেম। প্রকৃত গণতান্ত্রিক বোধ ছাড়া তা সম্ভবও নয়। আমরা প্রতিদিনই প্রত্যাশা করি, অমন অধরা সুন্দরকে যেন ছুঁতে পারি। তাহলে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার সর্বোচ্চ আসনে বসে দায়িত্ব এড়িয়ে বড় অঘটনকে দায়িত্ববানরা 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে বালুতে মুখ লুকাবেন না।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মণ্ডল সাহেব রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত। গত রবিবার বিকেলে তাঁর চায়ের আড্ডায় রবীন্দ্রসংগীতের প্যারোডি করেই বললেন, 'স্যার, বিচ্ছিন্ন ঘটনা কারে কয়?' তিনি নিজে 'মণ্ডল' বলেই কি না কে জানে কেরানীগঞ্জের পরাগ মণ্ডল অপহরণ ও অতঃপর খুঁজে পাওয়াসংক্রান্ত ঘটনাবলি জুনায়েদ মণ্ডলকে বেশ ভাবিয়েছে। অবশ্য ঘটনাটি দেশের বিবেকবান সব মানুষকেই আতঙ্কিত করেছে। আমাদের ডাক্তার সাহেব বেশি চিন্তিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের অপহরণ ঘটনাকে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে মন্তব্য করায়! তিনি এখন জানতে চান, এই 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' কথাটির অর্থটি কী?
মণ্ডল সাহেবের প্রশ্নটি স্পষ্ট। যদি এ দেশে অপহরণ-সন্ত্রাসজাতীয় ঘটনা দৈবাৎ ঘটত আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত, তবে এক-দুটি অপহরণের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যেত। তাহলে দিবালোকে মা-বোন আর গাড়ির ড্রাইভারকে গুলি করে ছোট পরাগকে ছিনিয়ে নেওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে পারতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের মানুষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ছিনতাই, খুনের ঘটনা অহরহ পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকছে। রাজনৈতিক হানাহানি তো চলছেই। গুমের ঘটনা ও অজ্ঞাতপরিচয় লাশের অভাব হচ্ছে না। তেমন এক বাস্তবতায় পরাগ মণ্ডলের অপহরণ কোন বিচারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে যায়?
আসলে আমাদের মনে হয়, মন্ত্রীর চেয়ারটাই বোধ করি ওরকম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়ারে সাহারা খাতুন আসীন থাকুন বা মহীউদ্দীন খান আলমগীর অধিষ্ঠিত হোন সবার সীমাবদ্ধতা ও অসহায়ত্বই বোধ হয় এক। তাই ভাষায় ও ব্যাখ্যায় তেমন গুণগত পার্থক্য দেখা যায় না।
বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। পরাগ মণ্ডলের অপহরণ নিয়ে যে রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হলো, অপহরণকারীরা প্রধান সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্কিত। ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পর পথে ফেলে গেছে পরাগকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, তাকে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কৌশলী হতে হয়েছে। তাই ছোটখাটোরা ধরা পড়লেও পালের গোদা ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণ মানুষ দেখেছে পরাগ উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নেই। হয়তো মুক্তিপণের টাকা পেয়ে পরাগকে অপহরণকারীরা পথের পাশে ফেলে গেছে।
নাটক আরো রয়েছে। শুরু থেকে মুক্তিপণ দেওয়ার ব্যাপারটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বীকার করেনি। পরাগের বাবাও অস্বীকার করেছেন। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেনি। করেনি এ জন্য যে এত বড় ফিল্মি কায়দায় তিনজন মানুষকে গুলিতে আহত করে ছিনিয়ে নেওয়া কিশোরকে কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই মুক্ত করে দিল। তাও যদি হতো পুলিশি কঠিন চিরুনি অভিযানে দিশেহারা হয়ে বাধ্য হয়েছে মুক্তি দিতে। মূল নায়কদের নাম-পরিচয় যা পাওয়া যাচ্ছে, তারা তো বেশ সেয়ানা। 'মুরগি কলজের নয়'। নানা রকম কানেকশন থাকা এই রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীরা অনেক কঠিন মামলা ঘাড়ে রেখে সদম্ভে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন। এদিকে র্যাব ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেওয়ার কথা মেনে নিয়ে বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
এটিও খুব হতাশার কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক পক্ষ র্যাব স্বীকার করছে, পরাগের বাবা ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন। অন্য পক্ষ ডিবি নিজেদের কৃতিত্ব প্রকাশ করছে। জানাচ্ছে, কোনো মুক্তিপণ নয়। তারা কৌশল করে, ফাঁদ পেতে উদ্ধার করেছে পরাগকে (কালের কণ্ঠ, ১৭ নভেম্বর)। একই সূত্রে বলা হয়েছে, স্থানীয় মানুষ মনে করছে, 'ভয়ে' ও 'চাপে' পরাগের পরিবার মুখ খুলছে না। এ ভয়টা কি সন্ত্রাসীর আর চাপটা কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর?
এমন একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যান্ত্রিক ভাষায় যদি পরাগ মণ্ডলের অপহরণকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেন, তাহলে সাধারণ মানুষের হতাশা বাড়বে বৈ কমবে না। আমরা বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রাখতে চাই। বিপন্ন মানুষের সামনে যখন দায়িত্বশীল পদাধিকারীরা বাস্তবতাবর্জিত কথা বলেন, তখন মানুষ আরো বেশি বিপন্ন বোধ করে। গত বিএনপি সরকারের আমলে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে সাধারণ মানুষ যখন বিপর্যস্ত, তখন প্রায় প্রতি বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলে কণ্ঠশীলন করেছেন।
এ দেশের মানুষ নির্বোধ নয়। তারা জানে রাতারাতি জগদ্দল পাথর সরানো যাবে না। দেশের বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে নষ্ট-রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে সক্ষমতা থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও অনেক সময় হাত-পা বাঁধা থাকে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে দিন দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশের নৈতিক স্খলন ঘটানো হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, রাজনৈতিক দূরদর্শী নীতিনির্ধারণ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট আর অব্যবস্থা মোকাবিলা সম্ভব নয়। তাই রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন ছাড়া সমাজ দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না।
এসব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রকৃত সত্য আড়াল করার দরকার কী। বরং সংকটকে মেনেই তা মোকাবিলা করতে হবে। আমরা মনে করি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সম্ভব নয়। তার আগে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে যে দল বা দল সমন্বয় থাকবে, সেসব দলের নীতিনির্ধারকদের প্রথমে আত্মশুদ্ধি করে নিশ্চিত হতে হবে যে তাঁরা গণতান্ত্রিক চেতনাসমৃদ্ধ হয়েছেন। এখন বুকের ভেতর অনুভব করছেন দেশপ্রেম। তখনই ক্ষমতাপ্রেম ও এর অনুষঙ্গে অন্ধ দলপ্রেম প্রকট হবে না।
এমন স্বপি্নল অবস্থা সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক দলে যুক্ত থাকা বা দলের নাম ভাঙানো মাস্তানরা, জমি দখল, চাঁদবাজি, টেন্ডারবাজি ও অস্ত্রবাজি বুক ফুলিয়ে করতে পারবে না। তাদের গডফাদাররা সরকারের ভেতর বা আশপাশে বসে মদদ দিতে পারবে না। থানা আদালত সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ক্ষমতায় থাকার দাপটে দলে দলে অপরাধী রাজনৈতিক মামলার নামে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে মুক্ত হয়ে যাবে না। অপ্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির মহান পদটাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে তাঁকে দিয়ে দলীয় সন্ত্রাসী-খুনিদের মার্জনা করানো হবে না।
এমন একটি অবস্থা তৈরি করা খুব যে কঠিন তা নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক সততা ও দেশপ্রেম। প্রকৃত গণতান্ত্রিক বোধ ছাড়া তা সম্ভবও নয়। আমরা প্রতিদিনই প্রত্যাশা করি, অমন অধরা সুন্দরকে যেন ছুঁতে পারি। তাহলে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার সর্বোচ্চ আসনে বসে দায়িত্ব এড়িয়ে বড় অঘটনকে দায়িত্ববানরা 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে বালুতে মুখ লুকাবেন না।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments