প্রান্তজেলার পান্থজন by প্রবীর চন্দ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে অপরাহ্ন ৩টার দিকে বসে আছেন বাচ্চু ভাই। দেখে মোটামুটি চমকেই উঠলাম। একজন আলোকিত মানুষ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও শিক্ষক, উত্তর জনপদের সাংস্কৃতিক নক্ষত্র বাচ্চু ভাই আমার ঘরের ভেতর!
বাচ্চু ভাইকে বললাম, আপনি কোথা থেকে এলেন এখানে? তিনি বললেন, 'সারদা থেকে। ওখানেই এখন শিক্ষকতা করি। বেশ কিছুদিন থেকে ভাবছি কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু সময় হয়ে উঠছে না। তোমার কি তার কোয়ার্টার চেনা আছে?' আমি বললাম, 'পশ্চিম ব্লকে, তবে বাড়ির নম্বর জানা নেই। তা ছাড়া আমি তো তার সরাসরি একজন ছাত্র। আজকেও তার সঙ্গে আমাদের ক্লাস ছিল।' এ কথা শুনে বাচ্চু ভাই, যার পুরো নাম হাসিম আকতার করিমদাদ, আমার কাঁধটা ধরে একটু আদর করে বললেন, তুমি কত বড় লেখকের ছাত্র, তা জান? 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'-এর লেখকের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। সেই বাচ্চু ভাই দীর্ঘদিন রোগশয্যায় থাকার পর চলে গেলেন না-ফেরার দেশে গত ২৯ অক্টোবর; পঞ্চগড় জেলার সব মানুষকে কাঁদিয়ে!
সাহিত্য ও বিজ্ঞান চেতনা মঞ্চ, বোদার পক্ষ থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বের্ট্রল্ড ব্রেখটের দুই দিনব্যাপী 'জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি' আয়োজন করা হয় ৯ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে। কবি শামসুর রাহমান সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি। এ ছাড়া কবি পাথরাজ মহাবিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন উত্তরবঙ্গের এ সফরে। কবির বক্তব্যানুযায়ী, জীবনে প্রথমবার কোনো শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে তিনি বেশ আবেগে আপ্লুত। এমনই আপ্লুত কণ্ঠে তিনি হাসিম আকতার করিমদাদের প্রশংসা করেছিলেন। সেই জন্মশতবর্ষের প্রবন্ধপাঠ আয়োজনে করিমদাদ জীবনানন্দ দাশের ওপর পঠিত প্রবন্ধ সম্পর্কে মূল আলোচনা হাজির করেন। আলোচনা শুনে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, 'ভদ্রলোক কী করেন? আমরা কি আরেকজন জীবনানন্দকে দেখছি! একাধারে কবি ও সমালোচক। এমন দ্বৈত সত্তা মফস্বল শহরে থাকে, এটা খুব বিরল।' মননের সঙ্গে সাহিত্যের বিষয়বস্তুর সংহতি না থাকলে অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়_ সেদিনের আলোচনায় করিমদাদের এমন সাহিত্য-দর্শন শুধু দেশের প্রধান কবি নয়, সবাইকেই মুগ্ধ করেছিল।
তিনি সাহিত্যের শুধু শুদ্ধ পাঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রকৃত গবেষক। সবকিছুর গভীরে যেতে পারতেন তিনি অনায়াসেই। ছিলেন দুর্দান্ত গ্রন্থকীট। পত্রিকার সিরিয়াস পাঠক কাকে বলে তার কাছে গেলেই তা বোঝা যেত। আমরা যখনই কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির দুর্বলতা ও সংকটে ভুগেছি তখনই দৌড়ে গিয়েছি তার কাছে। পঞ্চগড় নজরুল পাঠাগার মানেই তিনি। পঞ্চগড় জেলার পান্থজন যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন পান্থজনের সখাও।
২০০৬ সালে আমাদের এখানে গান গাইতে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও রবীন্দ্রসঙ্গীত গবেষক অধ্যাপক আনিসুর রহমান। খালি গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন তিনি। আর বাচ্চু ভাই রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো কবিতার মতো পড়ে গেলেন। সুর তাতে ছোঁয়ালেন না। সুর না দিয়েও যে রবীন্দ্রসঙ্গীত আবৃত্তি করা যায়, তা তিনি শুনিয়ে মুগ্ধ করলেন। আমরা বিস্মিতও হলাম। অর্থাৎ রবিঠাকুরের গান যে সুরপ্রধান নয়, কথাপ্রধান তা তিনি অভিনব প্রয়াসে যেন বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আর অতিথি শিল্পী অধ্যাপক আনিসুর রহমানও খুঁজে পেলেন তার এক সঙ্গী।
জীবনের শেষ সময়ে কিডনিজনিত কারণে ভীষণভাবে অসুস্থ ছিলেন তিনি। পঞ্চগড় সরকারি বিষ্ণু প্রসাদ স্কুল থেকে রিটায়ার করেছিলেন আরও আগে। বলা যায়, তার প্রিয় অঙ্গন থেকে একা হয়ে গিয়েছিলেন জ্ঞানভিত্তিক পঞ্চগড় গড়ার পথিকৃৎ এই মানুষটি। হাসান আজিজুল হকের সেই কলাগাছ, যে মৃদুমন্দ বাতাসে একবার পিঠ দেখায়, একবার বুক দেখায়_ সে রকমই করিমদাদ আমাদের চিরদিনই ভালোবাসার বুক দেখিয়েছেন। আর পিঠ দেখিয়েছেন সব অপকর্ম-অসত্যের দিকে। সজ্জন মানুষটি স্মরণীয় হয়ে রইবেন।
pkchanda1960@gmail.com
সাহিত্য ও বিজ্ঞান চেতনা মঞ্চ, বোদার পক্ষ থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বের্ট্রল্ড ব্রেখটের দুই দিনব্যাপী 'জন্মশতবর্ষ শ্রদ্ধাঞ্জলি' আয়োজন করা হয় ৯ নভেম্বর ১৯৯৮ সালে। কবি শামসুর রাহমান সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি। এ ছাড়া কবি পাথরাজ মহাবিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন উত্তরবঙ্গের এ সফরে। কবির বক্তব্যানুযায়ী, জীবনে প্রথমবার কোনো শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে তিনি বেশ আবেগে আপ্লুত। এমনই আপ্লুত কণ্ঠে তিনি হাসিম আকতার করিমদাদের প্রশংসা করেছিলেন। সেই জন্মশতবর্ষের প্রবন্ধপাঠ আয়োজনে করিমদাদ জীবনানন্দ দাশের ওপর পঠিত প্রবন্ধ সম্পর্কে মূল আলোচনা হাজির করেন। আলোচনা শুনে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, 'ভদ্রলোক কী করেন? আমরা কি আরেকজন জীবনানন্দকে দেখছি! একাধারে কবি ও সমালোচক। এমন দ্বৈত সত্তা মফস্বল শহরে থাকে, এটা খুব বিরল।' মননের সঙ্গে সাহিত্যের বিষয়বস্তুর সংহতি না থাকলে অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়_ সেদিনের আলোচনায় করিমদাদের এমন সাহিত্য-দর্শন শুধু দেশের প্রধান কবি নয়, সবাইকেই মুগ্ধ করেছিল।
তিনি সাহিত্যের শুধু শুদ্ধ পাঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রকৃত গবেষক। সবকিছুর গভীরে যেতে পারতেন তিনি অনায়াসেই। ছিলেন দুর্দান্ত গ্রন্থকীট। পত্রিকার সিরিয়াস পাঠক কাকে বলে তার কাছে গেলেই তা বোঝা যেত। আমরা যখনই কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির দুর্বলতা ও সংকটে ভুগেছি তখনই দৌড়ে গিয়েছি তার কাছে। পঞ্চগড় নজরুল পাঠাগার মানেই তিনি। পঞ্চগড় জেলার পান্থজন যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন পান্থজনের সখাও।
২০০৬ সালে আমাদের এখানে গান গাইতে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও রবীন্দ্রসঙ্গীত গবেষক অধ্যাপক আনিসুর রহমান। খালি গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন তিনি। আর বাচ্চু ভাই রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো কবিতার মতো পড়ে গেলেন। সুর তাতে ছোঁয়ালেন না। সুর না দিয়েও যে রবীন্দ্রসঙ্গীত আবৃত্তি করা যায়, তা তিনি শুনিয়ে মুগ্ধ করলেন। আমরা বিস্মিতও হলাম। অর্থাৎ রবিঠাকুরের গান যে সুরপ্রধান নয়, কথাপ্রধান তা তিনি অভিনব প্রয়াসে যেন বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আর অতিথি শিল্পী অধ্যাপক আনিসুর রহমানও খুঁজে পেলেন তার এক সঙ্গী।
জীবনের শেষ সময়ে কিডনিজনিত কারণে ভীষণভাবে অসুস্থ ছিলেন তিনি। পঞ্চগড় সরকারি বিষ্ণু প্রসাদ স্কুল থেকে রিটায়ার করেছিলেন আরও আগে। বলা যায়, তার প্রিয় অঙ্গন থেকে একা হয়ে গিয়েছিলেন জ্ঞানভিত্তিক পঞ্চগড় গড়ার পথিকৃৎ এই মানুষটি। হাসান আজিজুল হকের সেই কলাগাছ, যে মৃদুমন্দ বাতাসে একবার পিঠ দেখায়, একবার বুক দেখায়_ সে রকমই করিমদাদ আমাদের চিরদিনই ভালোবাসার বুক দেখিয়েছেন। আর পিঠ দেখিয়েছেন সব অপকর্ম-অসত্যের দিকে। সজ্জন মানুষটি স্মরণীয় হয়ে রইবেন।
pkchanda1960@gmail.com
No comments