পোশাক শিল্পে আর কত লাশের মিছিল! by শাহজাহান মিয়া
ভয়াবহ। ভয়ংকর। মর্মস্পর্শী না হৃদয়বিদারক- আশুলিয়া এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় সংঘটিত স্মরণকালের ভয়াবহ আগুনে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দেওয়ার জন্য কোনো শব্দকেই যথাযথ, যথার্থ বা যথেষ্ট বলে কারো মনে হবে না। বিবেকের তাড়নায় শুধু লেখা বা কলম হাতে তুলে নেওয়া।
দেশের সর্বত্র আপামর জনসাধারণের মনে একটি কথাই ভেসে উঠছে, গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে প্রায়ই সংঘটিত জীবনসংহারী অগ্নিকাণ্ড আর কত দিন চলবে? হতভাগ্য শ্রমিকদের লাশের মিছিল আর কত দীর্ঘ হবে? সর্বগ্রাসী আগুনে জ্বলে-পুড়ে আর কতকাল এই দুর্ভাগা শ্রমিকদের অঙ্গার হতে হবে? গ্রাম্য সরলতায় উদ্ভাসিত শ্রমিকরা, বিশেষ করে মেয়েরা, প্রাণ উজাড় করে মাথা নিচু করে কাজ করে দেশের জন্য আনছে মহামূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এরাই আগুনে পুড়ে বা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে হয়ে যাচ্ছে মুর্দা বা লাশ। গত ২৪ সেপ্টেম্বর শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তুবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনস নামের একটি পোশাক কারখানায় স্মরণকালের ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন কমপক্ষে ১১১ জন শ্রমিক। আগের দিন সন্ধ্যায় আগুন লাগার পর পর দিন ভোর পর্যন্ত আটতলা পোশাক কারখানটিতে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভবনটির নিচতলায় আগুন লাগে। নিচতলার গেট বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা দিশেহারা হয়ে সিঁড়ি দিয়ে ভবনের ওপরে ওঠার সময় ফাঁকা সিঁড়ি দিয়ে আগুন সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে অভাগা শ্রমিকদের পিছু পিছু ছোটে এবং অনেকেই পুড়ে মারা যান। অনেকে ওপরে উঠতে পারলেও সেখানেই আটকা পড়েন। অনেক চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর রবিবার ভোর থেকেই কারখানাটির তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চমতলা থেকে উদ্ধার হতে থাকে হতভাগ্য শ্রমিকদের একের পর এক- এক শ লাশ। এর মধ্যে তৃতীয়তলার সিঁড়ির ধাপগুলোতেই পাওয়া যায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ৬৮ জনের লাশ। ওই লাশগুলোর প্রায় সবই ছিল মেয়েদের। অনেকে আরো ওপরের তলায় উঠতে পারলেও তাঁরা জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়েন। প্রায় হাজার শ্রমিক লাফিয়ে পড়ে কোনোমতে জীবন বাঁচাতে পারলেও প্রায় অর্ধেকই বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের বেশির ভাগের বাড়িই উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত রংপুর ও দিনাজপুরে। গরিব মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের দুমুঠো ভাতের জোগান নিশ্চিত করতে ওই দুর্ভাগারা এসেছিলেন নিশ্চিন্তপুরে। অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়ে তাঁরা শুধু নিশ্চল-নিশ্চুপ হয়ে যাননি, আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছেন। গত ২৫ নভেম্বর ছিল মহররম মাসের ১০ তারিখ। আশুরা। আশুলিয়ার পোশাক কারখানার অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের মর্মবিদারী আর্তনাদ-আহাজারি শেষ না হতেই ২৬ নভেম্বর সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় উত্তরার দক্ষিণখানের মোল্লারটেকের একটি ১০ তলা ভবনে অবস্থিত তিনটি গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লাগে। আগুন নেভানোয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের তৎপরতা ও ভবন থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ভালো থাকায় হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
গ্রাম থেকে আসা এই শ্রমিকরাই মুখ বুজে, মাথা নিচু করে দিবানিশি কাজ করে মালিকের কারখানা অবিরাম সচল রাখেন। পূর্বাকাশে লাল সূর্য রুদ্রমূর্তি ধারণ করে পিচঢালা পথে তাপ ছড়িয়ে তপ্ত করার আগেই নগরীর বিভিন্ন বস্তি এলাকায় বসবাসরত গার্মেন্টের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কর্মী বেরিয়ে পড়েন তাঁদের কর্মস্থলে পেঁৗছার জন্য। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ, বর্ষার মুষলধারার বৃষ্টি বা কোনো হাড়কাঁপানো শীতের সকাল- এ রকম কোনো বৈরী আবহাওয়াকে কোনো তোয়াক্কা না করে তাঁরা সময়মতো কর্মস্থলে পেঁৗছাতে যানজটে ঠাসা রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তার জনাকীর্ণ ফুটপাতের ভিড় ঠেলে ছুটে চলে দ্রুতপদে। রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে এটা প্রাত্যহিক সাধারণ দৃশ্য। রুটি-রুজির অন্বেষণে সাধারণত গ্রাম থেকে আসা এসব সহজ-সরল মনের ছেলেমেয়েরা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে তাদের রক্ত পানি করে ঘাম ঝরিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে দিনে কমপক্ষে ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করছে। তাদের হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে মালিকরা যেমন অর্থ ও মুনাফা উপার্জন করছেন, তেমনি দেশ অর্জন করছে অতি কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু তারা পায় বেঁচে থাকার জন্য নামমাত্র কিছু বেতন-ভাতা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরিও কম।
গত ২০ বছরে দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ২১২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এসব দুর্ঘটনায় প্রায় ৭০০ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু মালিকরা বলছেন, মৃতের সংখ্যা ২৭৫ জন। দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রথম ঘটে ঢাকার মিরপুরে ১৯৯০ সালে সারিকা গার্মেন্টসে। মোট ২৭ জন মারা যান ওই অগ্নিকাণ্ডে। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের খান নিমির পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২৮ জনের মৃত্যু ঘটে। ওই বছর ২০ এপ্রিল সাভারে স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের ভবনধসে ৭৯ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে এরিনা কে টি এস টেঙ্টাইলে অগ্নিকাণ্ডে ৬৪ জন প্রাণ হারান। একই বছরের দুদিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার মহাখালীতে ফিনিক্স ভবনধসে মারা যান ২২ জন। ২০১০ সালে গরিব অ্যান্ড গরিব নামে একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ২১ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার প্রকাশক, এফবিসিসিআইর সভাপতি এ কে আজাদের মালিকানাধীন হা-মীম গ্রুপের একটি বিরাট গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ৩০ জন নিহত ও দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হন। প্রায় প্রতিটি ঘটনার পরই যথারীতি মামলা হয়। মামলায় কারো সাজা হয়েছে বলে জানা যায়নি। কারণ সবাই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে হা-মীম গ্রুপের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটিকে অনেকেই স্বাভাবিক বলে মনে করেননি। বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টে তার প্রকাশও ঘটেছিল। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও তখন নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি। ফ্যাক্টরির মালিক কর্তৃপক্ষও ঘটনাটি স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারেনি। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে দেশের দুটি বড় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে নাশকতার বিষয়টি জোরেশোরে বলছেন। কারণ এ সময়ই বিদেশ থেকে বড় অর্ডারগুলো পাওয়া যায়। তাই স্বার্থান্বেষী মহল অনেক কিছুই করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালিকপক্ষের উদাসীনতাও কম দায়ী নয়। সরকারকেও বেশ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে আশুলিয়ায় মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে সুমি বেগম নামে এক পোশাককর্মী নিজ কর্মক্ষেত্র ডেবনিয়া নামক একটি পোশাক কারখানায় আগুন লাগিয়েছিল। ঘটনাটি সে কোর্টে স্বীকারও করেছে। সুমি বলেছে, জাকির নামে কারখানার এক কর্মকর্তা তাকে টাকা দিয়ে কারখানায় আগুন লাগাতে বলে। আগুনের ঘটনা টের পেয়ে কারখানার অন্য কর্মীরা দ্রুত আগুন নেভাতে সক্ষম হলে আরো একটি বিপদ থেকে একটি প্রতিষ্ঠান বেঁচে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সুমি ও জাকির- দুজনকেই রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গত ২৭ নভেম্বর আশুলিয়ার বাইপাইলে গ্রিল্ডেন শাহরিয়র নামক একটি পোশাক কারখানায় সন্ধ্যা ৭টার দিকে আগুন লাগে। আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টের প্রাণহানি ও চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার থেকে গার্ডার পড়ে ১৫ জন লোক নিহত হওয়ার ঘটনায় জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য কারখানাটিতে কোনো শ্রমিক ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে আধঘণ্টার মধ্যেই আগুন নেভাতে সক্ষম হয়।
গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে মালিক বা তাদের পক্ষের কোনো কর্মকর্তার অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট হলেও তাদের কোনো শাস্তি হয় না। শাস্তি হলে তারা অবশ্যই সতর্ক হতো। অনেক কারখানায় আগুন নেভানোর ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। জলাধার নেই। দুর্ঘটনার সময় শ্রমিকদের বের হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা নেই। প্রশিক্ষিত লোকজন নেই। ফ্যাক্টরির পাশের রাস্তা সরু। আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসা-যাওয়ায়ও অসুবিধা হয়।
শ্রমিক অসন্তোষ, দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও নিরাপত্তাহীনতার সুযোগে গার্মেন্ট কারখানায় পরিকল্পিতভাবে নাশকতা চালানোর কথাও অনেকে বলছেন। বিশ্বব্যাপী মহামন্দার সময়ও বাংলাদেশের সস্তা শ্রমবাজারের পোশাক খাত অনেক সম্ভাবনার সোনালি আভায় দীপ্ত হওয়ার আশা জাগিয়েছিল। সস্তা পণ্য তৈরিতে পটু চীনও ঝুঁকছে বাংলাদেশের দিকে। সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচনকারী বাংলাদেশের সেই গার্মেন্ট সেক্টরই আজ মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রের শিকার। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে এবং লাখ লাখ গার্মেন্টকর্মীর পরিবারের স্বার্থে তৈরি পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো বিকল্প নেই। সবাই মিলিতভাবে সংকটের মোকাবিলা করে একযোগে কাজ করলে গার্মেন্ট শিল্পের অশনিসংকেত সাফল্যের সোনালি আভায় রূপান্তর অবশ্যই সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
গ্রাম থেকে আসা এই শ্রমিকরাই মুখ বুজে, মাথা নিচু করে দিবানিশি কাজ করে মালিকের কারখানা অবিরাম সচল রাখেন। পূর্বাকাশে লাল সূর্য রুদ্রমূর্তি ধারণ করে পিচঢালা পথে তাপ ছড়িয়ে তপ্ত করার আগেই নগরীর বিভিন্ন বস্তি এলাকায় বসবাসরত গার্মেন্টের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কর্মী বেরিয়ে পড়েন তাঁদের কর্মস্থলে পেঁৗছার জন্য। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ, বর্ষার মুষলধারার বৃষ্টি বা কোনো হাড়কাঁপানো শীতের সকাল- এ রকম কোনো বৈরী আবহাওয়াকে কোনো তোয়াক্কা না করে তাঁরা সময়মতো কর্মস্থলে পেঁৗছাতে যানজটে ঠাসা রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তার জনাকীর্ণ ফুটপাতের ভিড় ঠেলে ছুটে চলে দ্রুতপদে। রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে এটা প্রাত্যহিক সাধারণ দৃশ্য। রুটি-রুজির অন্বেষণে সাধারণত গ্রাম থেকে আসা এসব সহজ-সরল মনের ছেলেমেয়েরা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে তাদের রক্ত পানি করে ঘাম ঝরিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে দিনে কমপক্ষে ৮-১০ ঘণ্টা কাজ করছে। তাদের হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে মালিকরা যেমন অর্থ ও মুনাফা উপার্জন করছেন, তেমনি দেশ অর্জন করছে অতি কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু তারা পায় বেঁচে থাকার জন্য নামমাত্র কিছু বেতন-ভাতা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরিও কম।
গত ২০ বছরে দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ২১২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এসব দুর্ঘটনায় প্রায় ৭০০ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু মালিকরা বলছেন, মৃতের সংখ্যা ২৭৫ জন। দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রথম ঘটে ঢাকার মিরপুরে ১৯৯০ সালে সারিকা গার্মেন্টসে। মোট ২৭ জন মারা যান ওই অগ্নিকাণ্ডে। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের খান নিমির পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ২৮ জনের মৃত্যু ঘটে। ওই বছর ২০ এপ্রিল সাভারে স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের ভবনধসে ৭৯ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে এরিনা কে টি এস টেঙ্টাইলে অগ্নিকাণ্ডে ৬৪ জন প্রাণ হারান। একই বছরের দুদিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার মহাখালীতে ফিনিক্স ভবনধসে মারা যান ২২ জন। ২০১০ সালে গরিব অ্যান্ড গরিব নামে একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ২১ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার প্রকাশক, এফবিসিসিআইর সভাপতি এ কে আজাদের মালিকানাধীন হা-মীম গ্রুপের একটি বিরাট গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ৩০ জন নিহত ও দুই শতাধিক শ্রমিক আহত হন। প্রায় প্রতিটি ঘটনার পরই যথারীতি মামলা হয়। মামলায় কারো সাজা হয়েছে বলে জানা যায়নি। কারণ সবাই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে হা-মীম গ্রুপের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটিকে অনেকেই স্বাভাবিক বলে মনে করেননি। বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টে তার প্রকাশও ঘটেছিল। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও তখন নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি। ফ্যাক্টরির মালিক কর্তৃপক্ষও ঘটনাটি স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারেনি। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে দেশের দুটি বড় গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে নাশকতার বিষয়টি জোরেশোরে বলছেন। কারণ এ সময়ই বিদেশ থেকে বড় অর্ডারগুলো পাওয়া যায়। তাই স্বার্থান্বেষী মহল অনেক কিছুই করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালিকপক্ষের উদাসীনতাও কম দায়ী নয়। সরকারকেও বেশ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে আশুলিয়ায় মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে সুমি বেগম নামে এক পোশাককর্মী নিজ কর্মক্ষেত্র ডেবনিয়া নামক একটি পোশাক কারখানায় আগুন লাগিয়েছিল। ঘটনাটি সে কোর্টে স্বীকারও করেছে। সুমি বলেছে, জাকির নামে কারখানার এক কর্মকর্তা তাকে টাকা দিয়ে কারখানায় আগুন লাগাতে বলে। আগুনের ঘটনা টের পেয়ে কারখানার অন্য কর্মীরা দ্রুত আগুন নেভাতে সক্ষম হলে আরো একটি বিপদ থেকে একটি প্রতিষ্ঠান বেঁচে যায়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সুমি ও জাকির- দুজনকেই রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গত ২৭ নভেম্বর আশুলিয়ার বাইপাইলে গ্রিল্ডেন শাহরিয়র নামক একটি পোশাক কারখানায় সন্ধ্যা ৭টার দিকে আগুন লাগে। আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টের প্রাণহানি ও চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার থেকে গার্ডার পড়ে ১৫ জন লোক নিহত হওয়ার ঘটনায় জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য কারখানাটিতে কোনো শ্রমিক ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে আধঘণ্টার মধ্যেই আগুন নেভাতে সক্ষম হয়।
গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে মালিক বা তাদের পক্ষের কোনো কর্মকর্তার অবহেলার বিষয়টি স্পষ্ট হলেও তাদের কোনো শাস্তি হয় না। শাস্তি হলে তারা অবশ্যই সতর্ক হতো। অনেক কারখানায় আগুন নেভানোর ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। জলাধার নেই। দুর্ঘটনার সময় শ্রমিকদের বের হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা নেই। প্রশিক্ষিত লোকজন নেই। ফ্যাক্টরির পাশের রাস্তা সরু। আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসা-যাওয়ায়ও অসুবিধা হয়।
শ্রমিক অসন্তোষ, দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও নিরাপত্তাহীনতার সুযোগে গার্মেন্ট কারখানায় পরিকল্পিতভাবে নাশকতা চালানোর কথাও অনেকে বলছেন। বিশ্বব্যাপী মহামন্দার সময়ও বাংলাদেশের সস্তা শ্রমবাজারের পোশাক খাত অনেক সম্ভাবনার সোনালি আভায় দীপ্ত হওয়ার আশা জাগিয়েছিল। সস্তা পণ্য তৈরিতে পটু চীনও ঝুঁকছে বাংলাদেশের দিকে। সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচনকারী বাংলাদেশের সেই গার্মেন্ট সেক্টরই আজ মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রের শিকার। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে এবং লাখ লাখ গার্মেন্টকর্মীর পরিবারের স্বার্থে তৈরি পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো বিকল্প নেই। সবাই মিলিতভাবে সংকটের মোকাবিলা করে একযোগে কাজ করলে গার্মেন্ট শিল্পের অশনিসংকেত সাফল্যের সোনালি আভায় রূপান্তর অবশ্যই সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments