সাদাকালো-একটি অগ্নিকাণ্ড ও কয়েকটি প্রশ্ন by আহমদ রফিক

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দেশের রপ্তানি আয়ের খুব বড় একটি খাত। এর প্রাণকণা গ্রাম থেকে আসা গরিব তরুণীকুল, যারা কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানীর মতে শ্রেণীগত নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়, যাদের শ্রম, নিখুঁত কর্মদক্ষতায় দেশের বিশাল অর্থনৈতিক অর্জন, তাদের প্রাপ্তি কতটুকু।
শুরুতে তাদের বেতন-ভাতাদি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে; কিন্তু ফল ছিল শূন্য। নেহাত তাঁরা নারী শ্রমিক বলে।
কখনো ইজ্জত, কখনো প্রাণ দিয়ে তারা এই শিল্প খাতটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বিদেশি সংস্থা তাদের ভালো-মন্দ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ করে যেসব পরমার্শ বা উপদেশ তৈরি করেছিল, তার সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। বরং অমানবিক থেকে গেছে পোশাক শিল্পের মালিকদের আচরণ এবং দেওয়া-নেওয়ার প্রক্রিয়া। সংগত দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য শ্রম আইনের নিরিখে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনও তৈরি করতে পারেনি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা।
এর মূল কারণ মালিকদের লোভ-মুনাফাবাজি ও একচেটিয়া শোষণের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। নারী শ্রমিক, তরুণী শ্রমিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শনে কাবু করা প্রাথমিক পর্যায়ে সহজ ছিল। তাই বিপুল মুনাফায় ভর করে মালিকরা অতিদ্রুত একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি- এভাবে তাঁদের পোশাক কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই বিশেষ খাতে শিল্পের বিকাশ ঘটেছে অবিশ্বাস্য অনিয়ম-দ্রুততায় ও উচ্চতায়! বাংলাদেশের অন্য শিল্প খাত ও বৃহৎ পুঁজির ব্যবসা-বাণিজ্যেরও বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে, নিয়মনীতি-বহির্ভূত ধারায়।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো লিখছি। এর পেছনে রয়েছে শাসকশ্রেণীর অবাঞ্ছিত ও জবরদস্ত সমর্থন, যা এক অর্থে শ্রেণীস্বার্থের প্রকাশ। স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষিত বক্তব্য ও তার আদর্শগত বাস্তবায়নের মধ্যে থেকে গেছে বিরাট প্রভেদ, বৈষম্য। শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিদের হাতে শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটার কারণে তাঁদের স্বার্থই শাসকদের কাছে প্রধান বিবেচিত হয়েছে, দরিদ্র শ্রমজীবী শ্রেণীর নূ্যনতম স্বার্থের প্রতি নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি তাঁরা।
সমাজসেবী বীনু আপা তাই ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলতেই পারেন : 'নারী শ্রমিকদের অর্জিত সোনালি অর্থের ওপর দিয়ে অশেষ আনন্দে হেঁটে যাচ্ছেন পোশাক শিল্পের মালিক-শিল্পপতিরা।' সত্যিই রাতারাতি তাঁদের শ্রেণীগত পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু শ্রমিক কর্মীদের অবস্থার তেমন কোনো হেরফের নেই। ইদানীং আইনকানুনের কিছু পরিবর্তন ঘটায় কিছুটা আর্থিক সুবিধা জুটছে পোশাক শ্রমিকদের ভাগ্যে। তবু অনাচারের ভূত নামেনি তাদের কাঁধ থেকে।
এই যে কিছুদিন আগে পোশাক শিল্প খাতের এক শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম রহস্যজনকভাবে খুন হলেন, তার জট এখনো খোলেনি- বিচার তো দূরের কথা। আর এর সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ করে মার্কিন রাজনীতিক-কূটনীতিক মহলে কেন এত ক্ষোভ ও তৎপরতা, সে রহস্যও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। সব কিছু অন্ধকারে থেকে গেছে এবং থেকে যাচ্ছে। এ নিয়ে শ্রম সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন বা বাম শ্রমিক রাজনীতির অঙ্গনেও কোনো চঞ্চলতা বা তৎপরতা দেখা যায়নি। কিন্তু কেন?
এখানেও কি রয়েছে রাজনীতির বিশেষ কোনো খেলা- যে খেলার সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক শক্তির? আমাদের পোশাক শিল্পের ভালো-মন্দের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনীতির একটা সম্পর্ক তো রয়েছেই। তবু সেখানে কোথায় টান পড়লে কী ঘটে তা বুঝতে পারা সত্যি কঠিন হয়ে ওঠে। বিষয়টা নিয়ে মার্কিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অনেকের কাছে বাস্তবিক বিস্ময়কর মনে হয়েছে এবং এর বিপরীতে শাসনযন্ত্রে ও ট্রেড ইউনিয়ন অঙ্গনে নির্বিকার-শীতলতা। বোঝা গেল না ওই মৃত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা তথা শ্রমিক নেতা একজন নায়ক, না খলনায়ক? আর এই যে পোশাক কারখানাগুলোতে আগুন- সবই কী শর্টসার্কিট না অন্য কোনো কারসাজি এর পেছনে?

। দুই।
এই যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প খাতের ভালো-মন্দ বা সমস্যা নিয়ে কিছু ভূমিকা, তার আসল কারণ গত শনিবার ২৪ নভেম্বর (২০১২) আশুলিয়ায় পোশাক কারখানা 'তাজরীন ফ্যাশনে' ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও শতাধিক পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু। এ ঘটনায় আহতও হয়েছে শতাধিক শ্রমিক। হাসপাতালে ভর্তি আহতদের কতজন মারা যাবে, তা কেউ বলতে পারবে না। প্রচণ্ড ধোঁয়া ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির অভাবে আগুন নেভাতে দমকলকর্মীদের অনেক সময় লেগেছে। স্থানীয় ব্যবস্থা কোনো কাজে লাগেনি।
এ দুর্ঘটনা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং সেগুলোর সংশ্লিষ্ট অভিযোগের তীর বেশির ভাগ মালিকপক্ষের দিকে। অর্থাৎ স্বীকৃত মানসম্পন্ন একটি কারখানায় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তামূলক সুযোগ-সুবিধা ও ব্যবস্থা এবং তার প্রয়োগিক বাস্তবতা যতটা থাকা দরকার, তা নেই। অথবা থাকলেও তা নিষ্ক্রিয়। এ জন্য একের পর এক শিল্প-কারখানাগুলো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে মালিকের যত ক্ষতি হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হচ্ছে দেশের এবং তা সম্ভাব্য রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার কারণে।
সম্ভবত সর্বাধিক ক্ষতি শ্রমিক-কর্মীদের। কারণ এ-জাতীয় আগুনে দুর্ঘটনায় হতাহত হয় প্রধানত শ্রমিক-কর্মী, বিশেষ করে নারী শ্রমিক। একেকটি মৃত্যুর পারিবারিক ক্ষতি বহুমাত্রিক। কখনো এমনও দেখা যায়, একটি মৃত্যু একটি পরিবারকে নিঃস্ব, সহায়হীন করে পথে বসিয়ে দিয়েছে। আর মৃত্যুর ব্যক্তিক-পারিবারিক শোকের দিক তো রয়েছেই। কিন্তু মালিকপক্ষের ক্ষতির দিকটা বিচার করতে গেলে দেখা যায়, বীমা সুবিধার কারণে ক্ষতির পরিমাণ ততটা বড় হয়ে দাঁড়ায় না- যতটা হয় তা রপ্তানি সমস্যার কারণে।
এখন সুনির্দিষ্টভাবে 'তাজরীন ফ্যাশন' প্রসঙ্গ এলে বেশ কিছু অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন হই আমরা। ৯ তলার ওই বিশাল কারখানা ভবনটিতে কর্মরত কয়েক হাজার কর্মী। বলা হয়েছে, একেকটি তলা ১৬ হাজার বর্গফুটের। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের সংখ্যা ৩৬৫। কিন্তু বিস্ময়কর যে নিচতলায় সুতার গুদামে শর্টসার্কিট বা যেকোনো কারণে আগুন লাগার সংবাদ পাওয়ার পর অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো কি ব্যবহার করা হয়েছিল? যদি না করা হয়ে থাকে, তার কারণ কী? ওগুলো কি 'শোপিস' হিসেবে রাখা হয়েছে?
অন্যদিকে প্রশ্ন: ওগুলো ব্যবহার করার মতো প্রশিক্ষিত কর্মী কি ছিল? আগুন লাগলে কিভাবে মোকাবিলা করতে হয়, তেমন প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষামূলক মহড়ার ব্যবস্থা কি সেখানে চালু আছে? যদি থাকে, তাহলে এত বড় ক্ষয়ক্ষতি হবে কেন? সোমবার কয়েকটি টিভির খবর ও টক শোতে শোনা গেল, পুলিশ কর্তৃপক্ষের হিসাবমতে মৃতের সংখ্যা ১১১ এবং এর বাইরেও মৃত্যুর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যা সঠিক তদন্তে বেরিয়ে আসতে পারে।
ভাবতে অবাক লাগছে, তিন-তিনটি দৈনিকে উল্লিখিত মৃতের সংখ্যা ৯ এবং ৭। এটা কিভাবে সম্ভব? দ্বিতীয়ত, এমন কথাও টিভি আলোচনায় শোনা গেছে, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ভবনের ওপরতলাগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের সরিয়ে আনায় কর্তৃপক্ষকে তৎপর হতে দেখা যায়নি। এ অভিযোগ সত্য না হলেও ভবনের স্থাপত্যগত ত্রুটির দিকটি একাধিক সূত্রে উঠে এসেছে যে এ ভবনে 'জরুরি বহির্গমনের' (ইমার্জেন্সি এক্সিটের) যথাযথ নিরাপদ ব্যবস্থা নেই।
কারণ ওপর থেকে নেমে আসা তিনটি সিঁড়িই নিচে একবিন্দুতে, এক গেটে এসে মিলেছে। ফলে অনেক লোক একসঙ্গে নেমে আসতে পারছে না। আরো একটি বিষয় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় এবং তা হলো নিরাপত্তার কারণে গেট তালাবদ্ধ করে রাখা। তারপর বহির্গমনের পথ (গেট) যদি হয় মাত্র একটি এবং তা থাকে তালাবদ্ধ, তাহলে সংগত কারণে গেটরক্ষকের তৎপরতার ওপর নির্ভর করবে মৃতের সংখ্যা, নিরাপদে বেরিয়ে যেতে পারা মানুষের সংখ্যা। নিরাপত্তামূলক এসব সীমাবদ্ধতা বলা বাহুল্য মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এখন প্রশ্ন নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধা কি সব গার্মেন্ট কারখানায় যথাযথ বিচারে রয়েছে? যদি না থাকে, তাহলে কারখানা শ্রমিকের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে অবিলম্বে সেসব বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। একটি দুর্ঘটনা এবং মানুষের মৃত্যু, কারখানার ক্ষতি, দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি নিছক তদারকির অভাবে ঘটবে, ঘটতে থাকবে তা যেমন যুক্তিসংগত নয়, তেমনি তা মেনে নেওয়া যায় না।
যায় না এ কারণে যে জীবনের মূল্য যেকোনো ধরনের ক্ষতিপূরণের ঊর্ধ্বে এবং কথাটা এত সহজ-সরল যে তা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। এই যে অগ্রহণযোগ্য করুণ মৃত্যু যা প্রতিরোধযোগ্য এবং অবহেলায় ঘটে, তা আসলে সাধারণ মৃত্যু নয়, এগুলো হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য। যেমন যোগ্য যানবাহন চালকের অবহেলায় সংঘটিত মৃত্যুর ঘটনা। উভয় ক্ষেত্রেই দায়ী ব্যক্তিদের সে হিসাবেই শাস্তি হওয়া উচিত। প্রয়োজনে দেশে তেমন আইন প্রণীত হওয়া দরকার। তা না হলে মানুষের প্রাণ বড় সহজমূল্যে বিকিয়ে যাবে।
সবশেষে প্রশ্ন : মূল্যবান পোশাক শিল্প খাতে এসব অগ্নিকাণ্ড যা দুর্ঘটনা নামে অভিহিত এবং তজ্জনিত মৃত্যু, বিশেষ করে আলোচ্য ঘটনায় মৃতের সংখ্যা যেখানে শতাধিক, সেখানে এ ট্র্যাজিক মৃত্যুর দায় কার? এটাই প্রথম নির্ধারিত হওয়া দরকার। পরে অন্য হিসাব-নিকাশ। অবশ্য দ্বিতীয় প্রশ্নটিও যে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ। মূল্যবান পোশাক খাতে মাঝেমধ্যে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড কি স্বাভাবিক? এগুলোর বিশদ বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার এবং তা জাতীয় স্বার্থে ও মানবিক স্বার্থে। আর নয় এমন সাদামাটা তদন্ত, যেখানে মূল কারণ বেরিয়ে আসবে না।
এটা আরো দরকার দেশের পোশাক শিল্পগুলোর স্বার্থে এ-জাতীয় শোকাবহ মৃত্যুর দায় কার বা কাদের তা বুঝে নিতে। আমাদের জানা দরকার, পোশাক শিল্প কারখানাগুলোয় দুর্ঘটনা, বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ড রোধে যথাযথ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং ব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি রয়েছে কি না। না থাকলে এক্ষুনি দেশের পোশাক শিল্প কারখানাগুলোয় তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। সে জন্য দরকার অবিলম্বে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেশব্যাপী একটি জরিপ শুরু করা এবং তা একটি অভিজ্ঞ ও দক্ষ জরিপ কমিটির মাধ্যমে। এ কাজে অবহেলা ভবিষ্যতে আরো অনেক মৃত্যুর কারণ হতে পারে। নিশ্চিন্তপুর আর নিশ্চিন্ত থাকবে না। অবিলম্বে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দায়ী কে তা শনাক্ত করা হোক।
২৬.১১.২০১২

লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.