টিআইবির রিপোর্ট, বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া by ওয়াহিদ নবি
সংসদ সদস্যদের সম্বন্ধে টিআইবি যে জরিপকাজটি প্রকাশ করেছে এবং তার প্রতিক্রিয়া যেভাবে বিভিন্ন মহল ব্যক্ত করেছে তাতে করে দুটি সন্তোষজনক ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয়। প্রথমটি হচ্ছে, তথ্যমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা টিআইবির জরিপকাজটির পদ্ধতি জানতে চেয়েছেন।
আমার জানামতে এর আগে কোনো দিন কোনো রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক গবেষণার পদ্ধতি জানতে চাননি। দ্বিতীয় সন্তোষজনক জিনিসটি হচ্ছে আমার জানামতে, এই প্রথম একটি দৈনিক পত্রিকায় একটি রাজনৈতিক গবেষণার পদ্ধতি সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে (কালের কণ্ঠ, অক্টোবর ২৪)। একটি গণতান্ত্রিক দেশে মতামত জানার অধিকার সবার রয়েছে। বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু গবেষণার ফল হিসেবে কিছু প্রকাশিত হলে আবেগময় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে গবেষণাটির পদ্ধতিসহ অন্যান্য বিষয় বস্তুনিষ্ঠভাবে আলোচনা করলে ভালো হয়।
১৪ অক্টোবর টিআইবির রিপোর্টটি প্রকাশিত হলে পরের দিন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, ২০০১ সালেও টিআইবি অনুরূপ একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের অর্থ এভাবে করা যেতে পারে যে নির্বাচনের ঠিক আগে এ ধরনের জরিপকাজের ফলাফল প্রকাশ করে তখনকার সরকারি দলের ক্ষতি করা হয়েছিল। এটা ঠিক যে এবারও নির্বাচনের এক বছর আগে টিআইবির জরিপকাজটির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মনে হয় বিএনপি সরকারের দেশ পরিচালনার শেষ দিকে টিআইবি এ ধরনের জরিপকাজের ফলাফল প্রকাশ করেনি। টিআইবির এ ধরনের কাজকে প্রধানমন্ত্রী যদি সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন তবে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। সংসদের স্পিকার টিআইবির জরিপকাজটিকে 'ভ্রমাত্মক' বলে অভিহিত করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এই বলে মন্তব্য করেন যে জরিপকাজটির ফলাফল সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে শুধু প্রযোজ্য। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক অবশ্য বলেছেন, বিএনপির ১৩ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ১২ জন সম্পর্কেই তাঁদের ফলাফল প্রযোজ্য। এ ছাড়া বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশ পরপর চারবার পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয় টিআইবির তথ্য অনুযায়ী। সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টটি গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। এই সময় কেউ পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেননি। একটি 'টক শো'তে একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক টিআইবি ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, 'এটি একটি র্যান্ডম রিসার্চ'। তিনি মন্তব্য করেন, অনেকেই 'র্যান্ডম রিসার্চ' কী তা জানেন না। আসলে র্যান্ডম রিসার্চ বলে কিছু নেই। আছে র্যান্ডম স্যাম্পল, যা এই জরিপকাজটিতে ব্যবহার করা হয়নি। তিনি আরো মন্তব্য করেন, 'একটি ভাত টিপলেই হাঁড়ির সব ভাত কেমন হয়েছে বোঝা যায়। এই ধারণা হয়তো ঠিক ভাত সম্পর্কে, কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন মানুষের মনোভাব ভিন্ন, তাই ভাতের উপমাটি মানুষের মনোভাব সম্পর্কে গবেষণার উপযোগী নয়।
এরপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সরকার জরিপকাজটির পদ্ধতিসহ অন্যান্য বিষয় জানার জন্য টিআইবিতে যোগাযোগ করে। সরকার ৩১টি বিষয় জানতে চায়। টিআইবি বিষয়গুলো জানালে ২৮ নভেম্বর সরকার একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সরকারের পক্ষে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন, প্রতিবেদনটির পদ্ধতি সঠিক নয় এবং প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ। সংবাদমাধ্যমে যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে বলা সম্ভব নয় যে তিনি কী কী যুক্তি দেখিয়েছেন পদ্ধতিটি যে সঠিক নয় তা প্রমাণ করার জন্য। ইনু সাহেব আরো জানিয়েছেন, পূর্বনির্ধারিত ধারণা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে টিআইবি। তিনি বলেছেন, টিআইবির একটি অঙ্গসংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) টিআইবি আয়োজিত বৈঠকগুলো সঞ্চালন করেছে। তথ্যমন্ত্রী জানান, সরকার টিআইবির বিরুদ্ধে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেবে না। তবে সরকার যে টিআইবির প্রতিবেদনের তথ্য প্রত্যাখ্যান করেছে এ কথা টিআইবির প্রধান কার্যালয়ে জানিয়ে দেবে। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে জরিপকাজ করার জন্য টিআইবির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী।
সংসদে আবেগের সঙ্গে বক্তব্য দেন কয়েকজন সংসদ সদস্য। তাঁদের কেউ কেউ টিআইবি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি করেন। সংসদ সদস্যদের এ আবেগময় বক্তব্য কারো কারো সমালোচনার শিকার হয়েছে। সংসদ সদস্যদের আবেগময় হওয়ার কারণ থাকলেও আবেগবর্জিত ভাষণ অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বেশি এ কথা বোধ হয় আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে। ছাত্রদের বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও দেখি প্রতিযোগীরা ভীষণ উত্তেজিতভাবে বক্তৃতা দেন। স্পিকার জানান, অভিজ্ঞ সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন তিনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক জানান, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করাই তাঁদের উদ্দেশ্য। গণবিরোধী শক্তি বা বিরোধী দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। তিনি আরো বলেন, টিআইবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আগে তাঁদের নিজ পক্ষ সমর্থন করার অধিকার দেওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, সংসদে যেসব কথা হয়েছে সেগুলোর কারণে প্রতিবেদন তৈরি করার ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের জ্ঞানের অভাব। এই জাতীয় ভাষা সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করে না। এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয় যে যাঁরা কলা বিভাগে পড়েছেন তাঁরা পরিসংখ্যান বা গবেষণা পদ্ধতি জানবেন না।
এবারে সংক্ষেপে গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। প্রথমে দেখি এটি কী ধরনের গবেষণা? এখন টিআইবি বলছে, এটি জরিপকাজ নয়। তারা বলছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল সংসদ সদস্যদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সবিস্তারে জানা। এ জন্য তারা জরিপের অন্তর্ভুক্ত করেছে তাঁদের যাঁরা সংসদ সদস্যদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই করতে গিয়ে তারা স্যাম্পলটিকে (নমুনা) 'বায়াসড; (পক্ষপাতিত্বমূলক) করে ফেলেছে। অর্থাৎ যে উত্তরগুলো তারা শুনতে চেয়েছে সেগুলো যাঁরা বলতে চেয়েছেন তাঁদেরই শুধু জরিপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর পরের কথাটি হচ্ছে, মনে করা যাক একজন 'অভিহিত ব্যক্তি' বললেন, তিনি জানেন একজন সংসদ সদস্য মানুষ খুন করেছেন। এরপর কি জানার কথা নয় যে কথাটি কি ঠিক? জানতে কি চেষ্টা করা উচিত নয় যে তিনি কী করে জানলেন? টিআইবি বলছে, এটি কোয়ালিটেটিভ গবেষণা। এই জাতীয় গবেষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো একটি বিষয় (যেমন মনোভাব) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা ও বিস্তারিত জানা। কিন্তু টিআইবি সেটি না করে উত্তরদানকারীর উত্তর শুনেই সেটি সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর না নিয়েই সত্য বলে ধরে নিয়ে ফলাফলের অংশের অন্তর্ভুক্ত করল।
কোয়ালিটেটিভ গবেষণার উদ্দেশ্য 'ইনসিডেনস বা প্রিভিলেনস; নির্ণয় করা নয়। এই জরিপে তাই করা হয়েছে। শতকরা কতজন কী করেছেন সেটিই বড় করে দেখানো হয়েছে। এসব করা হয় 'সার্ভে জাতীয়' গবেষণায়। এখানে মানুষের মতামত জরিপ করা হয়েছে। এখানে 'র্যান্ডম স্যাম্পল' নিতে হবে। সমাজে বিভিন্ন ধরনের মানুষ থাকে। যেমন পুরুষ ও মহিলা, যুবক ও বৃদ্ধ, শ্রমজীবী ও বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকের সম্ভাবনা থাকবে স্যাম্পলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার। ফোকাস গ্রুপের সদস্য-সদস্যা জরিপের অংশ হতে পারেন না। স্যাম্পল যদি পপুলেশনের প্রতিনিধিত্বশীল না হয় তবে সে স্যাম্পলের কোনো মূল্য নেই (কোয়ালিটেটিভ গবেষণায় প্রযোজ্য নয়) গবেষণায়।
বৈঠকগুলো পরিচালনা করেছেন সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্যরা। তাঁরা টিআইবির অংশ। সচেতন বা অচেতনভাবে আলোচকরা টিআইবির মতামতকেই অনুসরণ করেছেন। এমনটিই যে হয় দেশ-বিদেশের বহু গবেষণায় তা দেখা গেছে।
কয়জন আলোচক, কয়জন সংসদ সদস্যের নেতিবাচক কর্মের কথা বলেছেন তা স্পষ্ট নয়। হতে পারে যে সক্রিয় আলোচকরা মাত্র কয়েকজন হলেও বহুজন সংসদ সদস্যের কথা বলেছেন (যাঁরা অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় তাঁরা হয়তো তেমন কিছু বলেননি) সেগুলোকে যোগ দিয়ে বলা হয়েছে এগুলো সব আলোচকের মত।
মনে হয় সংগঠন হিসেবে টিআইবির উদ্দেশ্য কী সেটি টিআইবির কর্মকর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। যদি তাঁদের জরিপে ইতিবাচক কাজ উঠে আসে তবে কি টিআইবির কোনো গুরুত্ব থাকবে? যদিও তাঁরা মুখে স্বীকার করবেন না এই সমস্যার কথা; কিন্তু বাস্তব সত্যটি কী সেটি ভেবে দেখলে তাঁদের কর্তব্যের চরিত্রটি বুঝতে সুবিধা হবে।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী চিকিৎসক
১৪ অক্টোবর টিআইবির রিপোর্টটি প্রকাশিত হলে পরের দিন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, ২০০১ সালেও টিআইবি অনুরূপ একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের অর্থ এভাবে করা যেতে পারে যে নির্বাচনের ঠিক আগে এ ধরনের জরিপকাজের ফলাফল প্রকাশ করে তখনকার সরকারি দলের ক্ষতি করা হয়েছিল। এটা ঠিক যে এবারও নির্বাচনের এক বছর আগে টিআইবির জরিপকাজটির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মনে হয় বিএনপি সরকারের দেশ পরিচালনার শেষ দিকে টিআইবি এ ধরনের জরিপকাজের ফলাফল প্রকাশ করেনি। টিআইবির এ ধরনের কাজকে প্রধানমন্ত্রী যদি সন্দেহের চোখে দেখে থাকেন তবে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। সংসদের স্পিকার টিআইবির জরিপকাজটিকে 'ভ্রমাত্মক' বলে অভিহিত করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এই বলে মন্তব্য করেন যে জরিপকাজটির ফলাফল সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে শুধু প্রযোজ্য। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক অবশ্য বলেছেন, বিএনপির ১৩ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ১২ জন সম্পর্কেই তাঁদের ফলাফল প্রযোজ্য। এ ছাড়া বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশ পরপর চারবার পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয় টিআইবির তথ্য অনুযায়ী। সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টটি গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। এই সময় কেউ পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেননি। একটি 'টক শো'তে একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক টিআইবি ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, 'এটি একটি র্যান্ডম রিসার্চ'। তিনি মন্তব্য করেন, অনেকেই 'র্যান্ডম রিসার্চ' কী তা জানেন না। আসলে র্যান্ডম রিসার্চ বলে কিছু নেই। আছে র্যান্ডম স্যাম্পল, যা এই জরিপকাজটিতে ব্যবহার করা হয়নি। তিনি আরো মন্তব্য করেন, 'একটি ভাত টিপলেই হাঁড়ির সব ভাত কেমন হয়েছে বোঝা যায়। এই ধারণা হয়তো ঠিক ভাত সম্পর্কে, কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন মানুষের মনোভাব ভিন্ন, তাই ভাতের উপমাটি মানুষের মনোভাব সম্পর্কে গবেষণার উপযোগী নয়।
এরপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সরকার জরিপকাজটির পদ্ধতিসহ অন্যান্য বিষয় জানার জন্য টিআইবিতে যোগাযোগ করে। সরকার ৩১টি বিষয় জানতে চায়। টিআইবি বিষয়গুলো জানালে ২৮ নভেম্বর সরকার একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সরকারের পক্ষে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন, প্রতিবেদনটির পদ্ধতি সঠিক নয় এবং প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ। সংবাদমাধ্যমে যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে বলা সম্ভব নয় যে তিনি কী কী যুক্তি দেখিয়েছেন পদ্ধতিটি যে সঠিক নয় তা প্রমাণ করার জন্য। ইনু সাহেব আরো জানিয়েছেন, পূর্বনির্ধারিত ধারণা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে টিআইবি। তিনি বলেছেন, টিআইবির একটি অঙ্গসংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) টিআইবি আয়োজিত বৈঠকগুলো সঞ্চালন করেছে। তথ্যমন্ত্রী জানান, সরকার টিআইবির বিরুদ্ধে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেবে না। তবে সরকার যে টিআইবির প্রতিবেদনের তথ্য প্রত্যাখ্যান করেছে এ কথা টিআইবির প্রধান কার্যালয়ে জানিয়ে দেবে। সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে জরিপকাজ করার জন্য টিআইবির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী।
সংসদে আবেগের সঙ্গে বক্তব্য দেন কয়েকজন সংসদ সদস্য। তাঁদের কেউ কেউ টিআইবি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি করেন। সংসদ সদস্যদের এ আবেগময় বক্তব্য কারো কারো সমালোচনার শিকার হয়েছে। সংসদ সদস্যদের আবেগময় হওয়ার কারণ থাকলেও আবেগবর্জিত ভাষণ অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বেশি এ কথা বোধ হয় আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে। ছাত্রদের বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও দেখি প্রতিযোগীরা ভীষণ উত্তেজিতভাবে বক্তৃতা দেন। স্পিকার জানান, অভিজ্ঞ সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন তিনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক জানান, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করাই তাঁদের উদ্দেশ্য। গণবিরোধী শক্তি বা বিরোধী দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। তিনি আরো বলেন, টিআইবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আগে তাঁদের নিজ পক্ষ সমর্থন করার অধিকার দেওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, সংসদে যেসব কথা হয়েছে সেগুলোর কারণে প্রতিবেদন তৈরি করার ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের জ্ঞানের অভাব। এই জাতীয় ভাষা সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করে না। এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয় যে যাঁরা কলা বিভাগে পড়েছেন তাঁরা পরিসংখ্যান বা গবেষণা পদ্ধতি জানবেন না।
এবারে সংক্ষেপে গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। প্রথমে দেখি এটি কী ধরনের গবেষণা? এখন টিআইবি বলছে, এটি জরিপকাজ নয়। তারা বলছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল সংসদ সদস্যদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সবিস্তারে জানা। এ জন্য তারা জরিপের অন্তর্ভুক্ত করেছে তাঁদের যাঁরা সংসদ সদস্যদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই করতে গিয়ে তারা স্যাম্পলটিকে (নমুনা) 'বায়াসড; (পক্ষপাতিত্বমূলক) করে ফেলেছে। অর্থাৎ যে উত্তরগুলো তারা শুনতে চেয়েছে সেগুলো যাঁরা বলতে চেয়েছেন তাঁদেরই শুধু জরিপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর পরের কথাটি হচ্ছে, মনে করা যাক একজন 'অভিহিত ব্যক্তি' বললেন, তিনি জানেন একজন সংসদ সদস্য মানুষ খুন করেছেন। এরপর কি জানার কথা নয় যে কথাটি কি ঠিক? জানতে কি চেষ্টা করা উচিত নয় যে তিনি কী করে জানলেন? টিআইবি বলছে, এটি কোয়ালিটেটিভ গবেষণা। এই জাতীয় গবেষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো একটি বিষয় (যেমন মনোভাব) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা ও বিস্তারিত জানা। কিন্তু টিআইবি সেটি না করে উত্তরদানকারীর উত্তর শুনেই সেটি সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর না নিয়েই সত্য বলে ধরে নিয়ে ফলাফলের অংশের অন্তর্ভুক্ত করল।
কোয়ালিটেটিভ গবেষণার উদ্দেশ্য 'ইনসিডেনস বা প্রিভিলেনস; নির্ণয় করা নয়। এই জরিপে তাই করা হয়েছে। শতকরা কতজন কী করেছেন সেটিই বড় করে দেখানো হয়েছে। এসব করা হয় 'সার্ভে জাতীয়' গবেষণায়। এখানে মানুষের মতামত জরিপ করা হয়েছে। এখানে 'র্যান্ডম স্যাম্পল' নিতে হবে। সমাজে বিভিন্ন ধরনের মানুষ থাকে। যেমন পুরুষ ও মহিলা, যুবক ও বৃদ্ধ, শ্রমজীবী ও বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকের সম্ভাবনা থাকবে স্যাম্পলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার। ফোকাস গ্রুপের সদস্য-সদস্যা জরিপের অংশ হতে পারেন না। স্যাম্পল যদি পপুলেশনের প্রতিনিধিত্বশীল না হয় তবে সে স্যাম্পলের কোনো মূল্য নেই (কোয়ালিটেটিভ গবেষণায় প্রযোজ্য নয়) গবেষণায়।
বৈঠকগুলো পরিচালনা করেছেন সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্যরা। তাঁরা টিআইবির অংশ। সচেতন বা অচেতনভাবে আলোচকরা টিআইবির মতামতকেই অনুসরণ করেছেন। এমনটিই যে হয় দেশ-বিদেশের বহু গবেষণায় তা দেখা গেছে।
কয়জন আলোচক, কয়জন সংসদ সদস্যের নেতিবাচক কর্মের কথা বলেছেন তা স্পষ্ট নয়। হতে পারে যে সক্রিয় আলোচকরা মাত্র কয়েকজন হলেও বহুজন সংসদ সদস্যের কথা বলেছেন (যাঁরা অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় তাঁরা হয়তো তেমন কিছু বলেননি) সেগুলোকে যোগ দিয়ে বলা হয়েছে এগুলো সব আলোচকের মত।
মনে হয় সংগঠন হিসেবে টিআইবির উদ্দেশ্য কী সেটি টিআইবির কর্মকর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। যদি তাঁদের জরিপে ইতিবাচক কাজ উঠে আসে তবে কি টিআইবির কোনো গুরুত্ব থাকবে? যদিও তাঁরা মুখে স্বীকার করবেন না এই সমস্যার কথা; কিন্তু বাস্তব সত্যটি কী সেটি ভেবে দেখলে তাঁদের কর্তব্যের চরিত্রটি বুঝতে সুবিধা হবে।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী চিকিৎসক
No comments