আলোর ইশারা-দোহা জলবায়ু সম্মেলন :অতি আশাবাদী না হওয়াই ভালো by আইনুন নিশাত
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের আবহাওয়া ও জলবায়ুতে যে পরিবর্তন আসছে, সে বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন বা আইন তৈরি হয়েছিল ১৯৯২ সালে। তখনও বিজ্ঞানীদের মনে কিছুটা দ্বিধা ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা নিয়ে।
তবুও প্রিকশনারি প্রিন্সিপলের অধীনে অর্থাৎ সতর্কতামূলক নীতির অধীনে দুটি ধারা সংযোজনের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ে কাজকর্ম শুরু হয়। এর একটি ধারা হচ্ছে আইপিসিসি_ ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ। সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে আইপিসিসির প্রতিবেদন প্রণীত হয়। পাঁচ-সাত বছর পরপর। চতুর্থ প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে ২০০৭ সালে। মনুষ্যসৃষ্ট কয়েকটি গ্যাস উদ্গিরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণেই যে এ ঘটনা, ওই প্রতিবেদনে তা নিশ্চিত করা হয়।
২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের পর জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত অগ্রগতি হতে থাকে। 'দ্রুত' শব্দটা অনেকের অপছন্দ হতে পারে। কারণ অনুন্নত বিশ্বের কাছে মনে হচ্ছে যে, এ বিষয়ে অগ্রগতি খুবই ধীরমাত্রা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। ১৯৫টি দেশ জড়িত এবং এই আলোচনায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। আইপিসিসির পরের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবে ২০১৪ সালে। আমাদের আশঙ্কা, পৃথিবী যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ পঞ্চম প্রতিবেদনে প্রকাশিত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ১৯৯২ সালে প্রণীত দ্বিতীয় ধারাটি রাজনৈতিক। ইউএনএফসিসিসি এই ধারাটির বাহক। এর অধীনে আবার প্রথমে দুই ধরনের আলোচনা শুরু হয়। একটি হচ্ছে মিটিগেশন বা প্রশমন অর্থাৎ যে কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি। অপরটি হচ্ছে অভিযোজন বা এডাপ্টেশন। অর্থাৎ যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে, তা মোকাবেলার পদ্ধতি।
প্রথমে নজর দেওয়া হয় মিটিগেশনের দিকে। এ উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে প্রণীত হয় কিয়োটো প্রটোকল। ওই প্রটোকলের মধ্য দিয়ে উন্নত বিশ্বের ওপর দায়িত্ব বর্তায় গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে যায় তাদের দায়িত্ব থেকে। তারা কিয়োটো প্রটোকলে অংশ নেয়নি। আরও কয়েকটি উন্নত দেশ গড়িমসি শুরু করে।
তবে ২০০৭ সালে আইপিসিসি প্রতিবেদন প্রকাশের পর জলবায়ু পরিবর্তন আলোচনায় নতুন জোয়ার আসে। এই ধারাতে ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন, ২০১০ সালে মেক্সিকোর কানকুন, ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে বৈশ্বিক পর্যায়ে সম্মেলন হয়েছে। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ২০১২ সালের সম্মেলন, কাতারের রাজধানী দোহায়।
উপরোক্ত সম্মেলনগুলোতে আলোচনার ফলাফল নিয়ে আমি বিভিন্ন সময় সমকালে আমার কলাম 'আলোর ইশারা' লিখেছি। আজ লিখতে চেষ্টা করছি দোহায় কী হতে পারে তা নিয়ে। ইতিমধ্যেই ক্লাইমেট চেঞ্জের বিরূপ ফলাফল নিয়ে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ আরও বেশি সচেতন ও উদ্বিগ্ন হয়েছে। এবারকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্লাইমেট চেঞ্জ বিরাট প্রভাব ফেলেছে। হারিকেন স্যান্ডির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ তথা রাজনীতিকরা নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ে। ওবামার বিরোধী রিপাবলিকান দল বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে একেবারে সিরিয়াস নয়। যে কারণে কট্টর ওবামাবিরোধী নিউইয়র্ক গভর্নর তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। স্যান্ডিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নিউ জার্সির গভর্নর একইভাবে ওবামাবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বন্যা, ব্যাংককের বন্যা এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এ বছর স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। তারপরও বর্ষার প্রথম দিকে সিলেট অঞ্চলে তীব্র বন্যা হয়েছে। আর বর্ষার শেষ দিকে তীব্র বন্যা হয়েছে রংপুর অঞ্চলে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনায় আমরা লক্ষ্য করি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অবস্থান। তারা বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। তারা কিয়োটো প্রটোকলের প্রথম পর্যায়ে যেটি ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে, সেটির দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেছে। পিছিয়ে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের দিক থেকে। কয়েকদিন আগে তারাও তাদের দায়িত্ব পালনের কথা মেনে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও অবস্থান পরিবর্তন করেনি। পিছু হটছে জাপান, রাশিয়া ও কানাডা। কিয়োটো প্রটোকলে উন্নয়নশীল বিশ্ব তথা অনুন্নত বিশ্বের কোনো দায় অর্পিত হয়নি। সেই সুযোগে বর্তমানে প্রধান দূষণকারী দেশ চীন ও ভারত প্রশমনের ক্ষেত্রে কোনো দায় নিচ্ছে না। জাপান ও রাশিয়া এই বিষয়ে তাদের অসন্তোষের কথা প্রকাশ করে কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে সরে যাচ্ছে। তবে ডারবানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০১৭ সালের মধ্যে একটি নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণীত হবে এবং এটি ২০২০ সাল থেকে কার্যকর হবে। তখন থেকে দায়ভার পৃথিবীর সব দেশের ওপর বর্তাবে। তাহলে ২০২০ পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন বাড়তেই থাকবে? আমার ভয় হচ্ছে ঠিক সেটাই হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাঠে না নামা পর্যন্ত এই অনিশ্চয়তা কাটবে বলে মনে হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, তাদের আইন প্রণয়নকারী সংস্থা, সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের ওপর বর্তমান শাসক দল ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা। যে কারণে তারা ভালো ভালো কথা বললেও কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং একই সঙ্গে গোটা বিশ্বের জন্য রূঢ় বাস্তবতা। দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের কাছে কোনো নতুন এপ্রোচ আশা করব কি? উত্তর হচ্ছে, বোধহয় না। কারণ চটজলদি তাদের পক্ষে অবস্থান পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে প্রশমন ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে তাদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক কিছু মতামত আশা করতে পারি।
অভিযোজনের ক্ষেত্রে আলোচনার ধারায় তেমন অগ্রগতি আশা করছি না। কারণ সবকিছুই জড়িত অর্থায়নের সঙ্গে। অর্থ ছাড়া দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে অভিযোজনের রাস্তায় কোনো অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। প্রযুক্তির কথা বলা হয়ে থাকে, এর সঙ্গে প্রশমনের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। আমাদের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দাবিদার। প্রযুক্তির যে একেবারে ব্যবহার নেই তা নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস ব্যবস্থা উন্নীতকরণে অবশ্যই প্রযুক্তির উন্নতির দরকার আছে। তবে সেখানেও অর্থায়নের বিষয়টি ফেলে দেওয়া যাবে না।
বালিতে অভিযোজন ও প্রশমনের সঙ্গে যোগ হয়েছে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টি। এ বিষয় দুটিতে কিছুটা অগ্রগতি হলেও অনেক জটিলতা থেকে যাচ্ছে। মূল লড়াইগুলো হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিকানা বিষয়ে। উন্নত বিশ্বের এপ্রোচ হচ্ছে_ এসব কাজ বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। উন্নয়নশীল বিশ্বের ধারণা, কাজগুলো কোনো অবস্থাতেই কেবল বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তারা চান সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল মালিক হবে সরকারের প্রতিনিধিরা।
এ পরিস্থিতিতে দোহা আলোচনায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ আলোচনার ধারা কীভাবে চলবে। সহজ করে বলতে গেলে ডারবান প্লাটফর্ম নামে একটি ফোরাম তৈরি হয়েছে। ফোরামটির মাধ্যমে সাধারণ আলোচনা চলবে। এর কার্যপরিধি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এটি সমাধান হতেই হবে। কিয়োটো প্রটোকলের পরবর্তী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হতেই হবে এবং আমাদের ধারণা তা হবে। কিন্তু এটি তেমন সুদূরপ্রসারী হবে কি-না সন্দেহ থাকছে।
শেষ করি বাংলাদেশ দলের অংশগ্রহণ নিয়ে। প্রতিবারের মতো এবারও পরিবেশমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য অংশ নিচ্ছেন। থাকছেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। গবেষকদের মধ্যে থেকেও বেশ কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে দোহাযাত্রী দলে। এর বাইরে এনজিওগুলোর পক্ষে অনেক বিশেষজ্ঞ ও একটিভিস্ট যাচ্ছেন। আমার আশা থাকবে, তারা জলবায়ু সংক্রান্ত বৈশ্বিক আলোচনায় বাংলাদেশের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিতে সহায়তা করতে পারবেন এবং দেশে ফিরে এসে চলমান প্রক্রিয়ার বিষয়ে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগে দেশজুড়ে হৈচৈ ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আবার সম্মেলন শেষে আশাভঙ্গেরও আবহ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ডারবান কিংবা কানকুনের সময় কিছুটা হৈচৈ হয়েছে। ফিরে এসে কেউ কেউ নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন। সবাইকে মনে রাখতে হবে আলোচনার ধারাবাহিকতার বিষয় আছে। দোহায় অগ্রগতি হতে পারে, তবে কোনো কিছু চূড়ান্ত হবে না। ২০১৫ সালের সভাটি গুরুত্বপূর্ণ হবে। তার আগে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে আরও দুটি সভা হবে। তর মাঝে প্রতি বছর জুন মাসে একটি করে সভা হবে জার্মানির বন শহরে। প্রতি বছর আরও দুটি করে সভা হতে পারে বিশ্বের সব দেশকে একত্রে নিয়ে। ডিসেম্বর মাসের সভাটিকে বলা হয় কনফারেন্স অব পার্টিস। ১৭টি কনফারেন্স অব পার্টিস বা কপ হয়েছে। প্রতিটি কপে গৃহীত সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অনুসারে ১৭টি কপের দু'একটি ছাড়া সবক'টিতে ল্যান্ডমার্ক বা মাইলফলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৮ নম্বর কপকে স্মরণীয় করে রাখতে কাতারিদের চেষ্টার অভাব থাকবে না, আশা করা যায়। এই ভরসায় ভাবছি, কিছু চমক এলেও আসতে পারে।
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত :পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
২০০৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের পর জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত অগ্রগতি হতে থাকে। 'দ্রুত' শব্দটা অনেকের অপছন্দ হতে পারে। কারণ অনুন্নত বিশ্বের কাছে মনে হচ্ছে যে, এ বিষয়ে অগ্রগতি খুবই ধীরমাত্রা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। ১৯৫টি দেশ জড়িত এবং এই আলোচনায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। আইপিসিসির পরের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবে ২০১৪ সালে। আমাদের আশঙ্কা, পৃথিবী যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ পঞ্চম প্রতিবেদনে প্রকাশিত হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ১৯৯২ সালে প্রণীত দ্বিতীয় ধারাটি রাজনৈতিক। ইউএনএফসিসিসি এই ধারাটির বাহক। এর অধীনে আবার প্রথমে দুই ধরনের আলোচনা শুরু হয়। একটি হচ্ছে মিটিগেশন বা প্রশমন অর্থাৎ যে কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি। অপরটি হচ্ছে অভিযোজন বা এডাপ্টেশন। অর্থাৎ যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে, তা মোকাবেলার পদ্ধতি।
প্রথমে নজর দেওয়া হয় মিটিগেশনের দিকে। এ উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে প্রণীত হয় কিয়োটো প্রটোকল। ওই প্রটোকলের মধ্য দিয়ে উন্নত বিশ্বের ওপর দায়িত্ব বর্তায় গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে যায় তাদের দায়িত্ব থেকে। তারা কিয়োটো প্রটোকলে অংশ নেয়নি। আরও কয়েকটি উন্নত দেশ গড়িমসি শুরু করে।
তবে ২০০৭ সালে আইপিসিসি প্রতিবেদন প্রকাশের পর জলবায়ু পরিবর্তন আলোচনায় নতুন জোয়ার আসে। এই ধারাতে ২০০৯ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন, ২০১০ সালে মেক্সিকোর কানকুন, ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে বৈশ্বিক পর্যায়ে সম্মেলন হয়েছে। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ২০১২ সালের সম্মেলন, কাতারের রাজধানী দোহায়।
উপরোক্ত সম্মেলনগুলোতে আলোচনার ফলাফল নিয়ে আমি বিভিন্ন সময় সমকালে আমার কলাম 'আলোর ইশারা' লিখেছি। আজ লিখতে চেষ্টা করছি দোহায় কী হতে পারে তা নিয়ে। ইতিমধ্যেই ক্লাইমেট চেঞ্জের বিরূপ ফলাফল নিয়ে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ আরও বেশি সচেতন ও উদ্বিগ্ন হয়েছে। এবারকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্লাইমেট চেঞ্জ বিরাট প্রভাব ফেলেছে। হারিকেন স্যান্ডির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ তথা রাজনীতিকরা নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ে। ওবামার বিরোধী রিপাবলিকান দল বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে একেবারে সিরিয়াস নয়। যে কারণে কট্টর ওবামাবিরোধী নিউইয়র্ক গভর্নর তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। স্যান্ডিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নিউ জার্সির গভর্নর একইভাবে ওবামাবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বন্যা, ব্যাংককের বন্যা এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এ বছর স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। তারপরও বর্ষার প্রথম দিকে সিলেট অঞ্চলে তীব্র বন্যা হয়েছে। আর বর্ষার শেষ দিকে তীব্র বন্যা হয়েছে রংপুর অঞ্চলে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনায় আমরা লক্ষ্য করি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অবস্থান। তারা বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নিয়েছে। তারা কিয়োটো প্রটোকলের প্রথম পর্যায়ে যেটি ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে, সেটির দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেছে। পিছিয়ে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের দিক থেকে। কয়েকদিন আগে তারাও তাদের দায়িত্ব পালনের কথা মেনে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও অবস্থান পরিবর্তন করেনি। পিছু হটছে জাপান, রাশিয়া ও কানাডা। কিয়োটো প্রটোকলে উন্নয়নশীল বিশ্ব তথা অনুন্নত বিশ্বের কোনো দায় অর্পিত হয়নি। সেই সুযোগে বর্তমানে প্রধান দূষণকারী দেশ চীন ও ভারত প্রশমনের ক্ষেত্রে কোনো দায় নিচ্ছে না। জাপান ও রাশিয়া এই বিষয়ে তাদের অসন্তোষের কথা প্রকাশ করে কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে সরে যাচ্ছে। তবে ডারবানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০১৭ সালের মধ্যে একটি নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণীত হবে এবং এটি ২০২০ সাল থেকে কার্যকর হবে। তখন থেকে দায়ভার পৃথিবীর সব দেশের ওপর বর্তাবে। তাহলে ২০২০ পর্যন্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন বাড়তেই থাকবে? আমার ভয় হচ্ছে ঠিক সেটাই হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাঠে না নামা পর্যন্ত এই অনিশ্চয়তা কাটবে বলে মনে হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, তাদের আইন প্রণয়নকারী সংস্থা, সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের ওপর বর্তমান শাসক দল ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা। যে কারণে তারা ভালো ভালো কথা বললেও কোনো কিছু বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং একই সঙ্গে গোটা বিশ্বের জন্য রূঢ় বাস্তবতা। দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের কাছে কোনো নতুন এপ্রোচ আশা করব কি? উত্তর হচ্ছে, বোধহয় না। কারণ চটজলদি তাদের পক্ষে অবস্থান পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে প্রশমন ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে তাদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক কিছু মতামত আশা করতে পারি।
অভিযোজনের ক্ষেত্রে আলোচনার ধারায় তেমন অগ্রগতি আশা করছি না। কারণ সবকিছুই জড়িত অর্থায়নের সঙ্গে। অর্থ ছাড়া দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে অভিযোজনের রাস্তায় কোনো অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। প্রযুক্তির কথা বলা হয়ে থাকে, এর সঙ্গে প্রশমনের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। আমাদের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দাবিদার। প্রযুক্তির যে একেবারে ব্যবহার নেই তা নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস ব্যবস্থা উন্নীতকরণে অবশ্যই প্রযুক্তির উন্নতির দরকার আছে। তবে সেখানেও অর্থায়নের বিষয়টি ফেলে দেওয়া যাবে না।
বালিতে অভিযোজন ও প্রশমনের সঙ্গে যোগ হয়েছে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টি। এ বিষয় দুটিতে কিছুটা অগ্রগতি হলেও অনেক জটিলতা থেকে যাচ্ছে। মূল লড়াইগুলো হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিকানা বিষয়ে। উন্নত বিশ্বের এপ্রোচ হচ্ছে_ এসব কাজ বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। উন্নয়নশীল বিশ্বের ধারণা, কাজগুলো কোনো অবস্থাতেই কেবল বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তারা চান সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল মালিক হবে সরকারের প্রতিনিধিরা।
এ পরিস্থিতিতে দোহা আলোচনায় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ আলোচনার ধারা কীভাবে চলবে। সহজ করে বলতে গেলে ডারবান প্লাটফর্ম নামে একটি ফোরাম তৈরি হয়েছে। ফোরামটির মাধ্যমে সাধারণ আলোচনা চলবে। এর কার্যপরিধি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এটি সমাধান হতেই হবে। কিয়োটো প্রটোকলের পরবর্তী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হতেই হবে এবং আমাদের ধারণা তা হবে। কিন্তু এটি তেমন সুদূরপ্রসারী হবে কি-না সন্দেহ থাকছে।
শেষ করি বাংলাদেশ দলের অংশগ্রহণ নিয়ে। প্রতিবারের মতো এবারও পরিবেশমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য অংশ নিচ্ছেন। থাকছেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। গবেষকদের মধ্যে থেকেও বেশ কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে দোহাযাত্রী দলে। এর বাইরে এনজিওগুলোর পক্ষে অনেক বিশেষজ্ঞ ও একটিভিস্ট যাচ্ছেন। আমার আশা থাকবে, তারা জলবায়ু সংক্রান্ত বৈশ্বিক আলোচনায় বাংলাদেশের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দিতে সহায়তা করতে পারবেন এবং দেশে ফিরে এসে চলমান প্রক্রিয়ার বিষয়ে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন সম্মেলনের আগে দেশজুড়ে হৈচৈ ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আবার সম্মেলন শেষে আশাভঙ্গেরও আবহ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ডারবান কিংবা কানকুনের সময় কিছুটা হৈচৈ হয়েছে। ফিরে এসে কেউ কেউ নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন। সবাইকে মনে রাখতে হবে আলোচনার ধারাবাহিকতার বিষয় আছে। দোহায় অগ্রগতি হতে পারে, তবে কোনো কিছু চূড়ান্ত হবে না। ২০১৫ সালের সভাটি গুরুত্বপূর্ণ হবে। তার আগে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে আরও দুটি সভা হবে। তর মাঝে প্রতি বছর জুন মাসে একটি করে সভা হবে জার্মানির বন শহরে। প্রতি বছর আরও দুটি করে সভা হতে পারে বিশ্বের সব দেশকে একত্রে নিয়ে। ডিসেম্বর মাসের সভাটিকে বলা হয় কনফারেন্স অব পার্টিস। ১৭টি কনফারেন্স অব পার্টিস বা কপ হয়েছে। প্রতিটি কপে গৃহীত সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অনুসারে ১৭টি কপের দু'একটি ছাড়া সবক'টিতে ল্যান্ডমার্ক বা মাইলফলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৮ নম্বর কপকে স্মরণীয় করে রাখতে কাতারিদের চেষ্টার অভাব থাকবে না, আশা করা যায়। এই ভরসায় ভাবছি, কিছু চমক এলেও আসতে পারে।
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত :পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
No comments