বাংলাদেশ-মিয়ানমার-ঘরের বাইরে যেতেই হবে by শেখ রোকন
মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সংকট নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ সর্বশেষ (১২ নভেম্বর ২০১২) যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তার বাংলা ভাবার্থ রবীন্দ্রনাথ থেকে ধার করা যায়। মিয়ানমার :স্টর্ম ক্লাউডস অন দ্য হোরাইজন_ 'কালি-মাখা মেঘে ওপারে অঁাঁধার'।
বলাবাহুল্য, ক্রাইসিস গ্রুপ যেখানে দাঁড়িয়ে, যে ধরনের বিশ্লেষণ করে থাকে, সেখান থেকে মিয়ানমার 'দিগন্ত' বটে। কিন্তু আমাদের দিক থেকে সেটা নেহাত 'ওপার'। নাফ নদীর এপারে আমাদের ঘর, ওপারে মিয়ানমারের। আমরা চাই বা না চাই; সীমান্তের ওপাশের যে কোনো ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া এপাশে পড়তে যে বাধ্য, গত কয়েক মাসে দফায় দফায় প্রমাণ হয়েছে।
ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষণ হচ্ছে_ মিয়ানমারের নেতৃত্ব যদিও একনায়কতান্ত্রিক অতীত ঝেড়ে ফেলে দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছেন, গণতন্ত্রমুখী সেই সড়ক দুর্গমই মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ব্যক্তিগতভাবে বিরোধী দলের সঙ্গে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠাসহ গণতন্ত্রের পথে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। যেমন দফায় দফায় রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান, কালো তালিকার দৈর্ঘ্য কমিয়ে ফেলা, সংবাদমাধ্যমের সেন্সরশিপ তুলে দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংস্কার প্রক্রিয়ার আকাশে কালো মেঘ জমেছে। কারণ দীর্ঘ কেন্দ্রীয় সামরিক শাসনের পর যখন বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলে স্থানীয় পক্ষগুলো প্রশাসন ও উন্নয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তখন পুরনো বিভাজন নতুনরূপে হাজির হচ্ছে। কাচিনসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও সরকারের 'দুর্বলতা' আঁচ করে পরিস্থিতি নিজেদের দিকে নিতে চাইছে। দায়িত্ব ও ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যাপারেও রাজনৈতিক নেতারা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে কালো মেঘ জমার প্রধান কারণ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতা। এর ফলে মিয়ানমারের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারণ সরকার যদিও গত জুন থেকে থেমে থেমে চলা অঘটনগুলোকে 'অভ্যন্তরীণ সমস্যা' বলে মনে করে, এর একটি স্পষ্ট আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত রয়েছে। নাগরিকত্বের প্রশ্নটি সেক্ষেত্রে সবার আগে আসবে। যেমন মিয়ানমার অফিসিয়ালি যেসব অ-বার্মিজ নৃগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তার মধ্যে রোহিঙ্গা নেই। সরকার ও মূলধারার প্রচারমাধ্যমে তারা বরং 'বাঙালি' বলে চিহ্নিত। বাংলাদেশ সঙ্গত কারণেই এই অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে আসছে।
আসিয়ানের মহাসচিব সম্প্রতি বলেছেন_ 'মিয়ানমার আজ বিশ্বাস করে বটে এটা তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট; কিন্তু সতর্ক না হলে আগামীকাল তাদের সংকট আমাদের সবার সংকটে পরিণত হতে পারে।' মিয়ানমার সফরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে গেছেন। আর মুসলিম বিশ্ব তো বরাবরই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক সহিংসতায় ইরান, মিসর, সৌদি আরব, পাকিস্তান যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, মুসলিম বিশ্বের আর পাঁচটা সংকটেও তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে সেটাকে আলাদা করা কঠিন। ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার উদ্বেগের নেপথ্যে নিছক 'ভ্রাতৃত্ব' নয়। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার জের ধরে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। মিয়ানমার ইতিমধ্যেই তা প্রত্যক্ষও করেছে। রাখাইন স্টেটের জের ধরে দূরবর্তী কারেন স্টেটেও বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘাত দেখা দিয়েছে। অথচ সেখানকার মুসলিমরা রোহিঙ্গা নয়; চেহারা ও গায়ের রঙে সাধারণ বার্মিজদের মতোই। সরকারিভাবেও তারা মিয়ানমারের স্বীকৃত নৃগোষ্ঠী। এই ধরনের সহিংসতা যে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতে ছড়িয়ে পড়বে না, কে নিশ্চয়তা দেবে? ইন্দোনেশিয়ার জেলে আটক চরমপন্থি নেতা আবু বাকার বশীর ইতিমধ্যে খোলা চিঠি লিখে হুমকি দিয়েছেন, যদি রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতা বন্ধ না হয়, জিহাদ ঘোষণা করবে তার দল।
এই পরিস্থিতিতে ক্রাইসিস গ্রুপ পরামর্শ দিয়েছে_ মিয়ানমারকে তার তিক্ত অতীত ও সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িকতা মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে রাখাইন স্টেটের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ও বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চিকে 'নৈতিক নেতৃত্ব' দিতে হবে। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক যাত্রা সংহত করতে আরও কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যেমন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, সামাজিক সেতুবন্ধ তৈরি করা, রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, ঘরের পাশে এমন সংকটে বাংলাদেশের কী কর্তব্য সেটা ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।
ক্রাইসিস গ্রুপ না হলেও গত এক বছরে অবশ্য বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী পক্ষ ঢাকাকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নানা 'পরামর্শ' দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা সংকটে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করেছে। গত জুনে রাখাইন স্টেটে সহিংসতা শুরুর পর থেকে নৌ ও স্থলপথে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করেছে; কিন্তু তারা আগের বছরগুলোর মতো আশ্রয় পায়নি। সীমান্ত রক্ষীরা ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে খাবার, ওষুধ, বিশ্রাম দিয়েছে; কিন্তু আশ্রয় দেয়নি। এমন 'অমানবিক' অবস্থান নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে; কিন্তু সরকার চোখ-মুখ শক্ত করে সয়ে গেছে। কারণ, বৈধ ও অবৈধ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর উপস্থিতির কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতাই কেবল নয়; বহির্বিশ্বের বাংলাদেশি শ্রমবাজারেও যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকার আগে থেকেই সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল। ফলে রবীন্দ্রনাথের 'আষাঢ়' কবিতা মেনেই যেন ঘরের বাইরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, জানালা দিয়ে বর্ষার জীবন ও প্রকৃতি দেখার মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক সংকটে তাকিয়ে থাকা কূটনৈতিক দিক থেকে কতখানি সঙ্গত? ঔচিত্যবোধ না হয় উহ্যই থাকল! আর পিঠ ফিরিয়ে থাকলেও কি কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হবে? মনে হয় না। বরং দেখা গেছে, ওই ইস্যুতে নির্লিপ্ত থাকার পরও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের নির্ধারিত ঢাকা সফর গত জুলাইয়ে বাতিল হয়ে গেছে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ছাড়াই। অন্তত জাতিসংঘ শরণার্থী শিবিরে রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সূচিত উদ্যোগ এখন হিমাগারে। মিয়ানমার হয়ে এশিয়ান হাইওয়ে কিংবা ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়েতে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিইয়ে গেছে। গত বছরের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরের পর ঢাকা-রেঙ্গুন সরাসরি বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখতে পারছে না।
এসব দূরত্ব সত্ত্বেও গত এক দশকে সেখানে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের আকার ও সংযুক্তি অনেক বেড়েছে। শুধু দূতাবাস সংশ্লিষ্ট লোকজন নয়, এখন ব্যবসায়ীদেরও যাতায়াত বেড়েছে। মাছ ও কৃষিপণ্য বাণিজ্য কেবল নয়, বাংলাদেশে অন্তত ২০টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মিয়ানমারে রফতানি করছে। বেড়েছে সেখানে তৎপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা। তাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথা ভেবেও কিন্তু আমরা মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারি না।
বড় কথা, গত জুনের রাখাইন সহিংসতার পর থেকে বরং ইয়াঙ্গুনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা পুড়ছে তুষের আগুনে। চার-পাঁচ বছর ধরে সেখানে আছেন, এমন একজন বাংলাদেশি জানালেন, হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন যেন বৈরী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা আর আগের মতো আন্তরিক নয়। বাড়ি ভাড়া পেতেও তৈরি হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধক। এই অবস্থায় মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে কথা বলতেই হবে। আর সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যু পাশ কাটিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? আমরা পছন্দ করি বা না করি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের কূটনৈতিক কপাল জড়িয়ে গেছে। ইস্যুটি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু অস্বস্তি রয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমলে না নিলে অস্বস্তি অসুবিধায় পরিণত হতে পারে। যেমন বাড়বে রোহিঙ্গা সংকট, তেমনই মিয়ানমারের সঙ্গে দূরত্ব।
হতে পারে সম্পর্কের এমন শীতলতার পেছনে মিয়ানমারের দায়ই বারো আনা। কিন্তু কূটনীতি মানে ব্লেম গেইম নয়, নয় মুখ ফিরিয়ে থাকা। প্রতিবেশী যদি তার ঘর থেকে বের হতে না চায়, কথা বলার জন্য আমাদেরই পা বাড়াতে হবে।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষণ হচ্ছে_ মিয়ানমারের নেতৃত্ব যদিও একনায়কতান্ত্রিক অতীত ঝেড়ে ফেলে দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছেন, গণতন্ত্রমুখী সেই সড়ক দুর্গমই মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ব্যক্তিগতভাবে বিরোধী দলের সঙ্গে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠাসহ গণতন্ত্রের পথে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। যেমন দফায় দফায় রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান, কালো তালিকার দৈর্ঘ্য কমিয়ে ফেলা, সংবাদমাধ্যমের সেন্সরশিপ তুলে দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংস্কার প্রক্রিয়ার আকাশে কালো মেঘ জমেছে। কারণ দীর্ঘ কেন্দ্রীয় সামরিক শাসনের পর যখন বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলে স্থানীয় পক্ষগুলো প্রশাসন ও উন্নয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তখন পুরনো বিভাজন নতুনরূপে হাজির হচ্ছে। কাচিনসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও সরকারের 'দুর্বলতা' আঁচ করে পরিস্থিতি নিজেদের দিকে নিতে চাইছে। দায়িত্ব ও ক্ষমতা ভাগাভাগির ব্যাপারেও রাজনৈতিক নেতারা পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন। তবে কালো মেঘ জমার প্রধান কারণ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতা। এর ফলে মিয়ানমারের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। কারণ সরকার যদিও গত জুন থেকে থেমে থেমে চলা অঘটনগুলোকে 'অভ্যন্তরীণ সমস্যা' বলে মনে করে, এর একটি স্পষ্ট আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত রয়েছে। নাগরিকত্বের প্রশ্নটি সেক্ষেত্রে সবার আগে আসবে। যেমন মিয়ানমার অফিসিয়ালি যেসব অ-বার্মিজ নৃগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তার মধ্যে রোহিঙ্গা নেই। সরকার ও মূলধারার প্রচারমাধ্যমে তারা বরং 'বাঙালি' বলে চিহ্নিত। বাংলাদেশ সঙ্গত কারণেই এই অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করে আসছে।
আসিয়ানের মহাসচিব সম্প্রতি বলেছেন_ 'মিয়ানমার আজ বিশ্বাস করে বটে এটা তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট; কিন্তু সতর্ক না হলে আগামীকাল তাদের সংকট আমাদের সবার সংকটে পরিণত হতে পারে।' মিয়ানমার সফরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে গেছেন। আর মুসলিম বিশ্ব তো বরাবরই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক সহিংসতায় ইরান, মিসর, সৌদি আরব, পাকিস্তান যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, মুসলিম বিশ্বের আর পাঁচটা সংকটেও তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে সেটাকে আলাদা করা কঠিন। ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার উদ্বেগের নেপথ্যে নিছক 'ভ্রাতৃত্ব' নয়। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার জের ধরে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। মিয়ানমার ইতিমধ্যেই তা প্রত্যক্ষও করেছে। রাখাইন স্টেটের জের ধরে দূরবর্তী কারেন স্টেটেও বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘাত দেখা দিয়েছে। অথচ সেখানকার মুসলিমরা রোহিঙ্গা নয়; চেহারা ও গায়ের রঙে সাধারণ বার্মিজদের মতোই। সরকারিভাবেও তারা মিয়ানমারের স্বীকৃত নৃগোষ্ঠী। এই ধরনের সহিংসতা যে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতে ছড়িয়ে পড়বে না, কে নিশ্চয়তা দেবে? ইন্দোনেশিয়ার জেলে আটক চরমপন্থি নেতা আবু বাকার বশীর ইতিমধ্যে খোলা চিঠি লিখে হুমকি দিয়েছেন, যদি রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতা বন্ধ না হয়, জিহাদ ঘোষণা করবে তার দল।
এই পরিস্থিতিতে ক্রাইসিস গ্রুপ পরামর্শ দিয়েছে_ মিয়ানমারকে তার তিক্ত অতীত ও সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িকতা মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে রাখাইন স্টেটের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ও বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চিকে 'নৈতিক নেতৃত্ব' দিতে হবে। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক যাত্রা সংহত করতে আরও কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যেমন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, সামাজিক সেতুবন্ধ তৈরি করা, রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, ঘরের পাশে এমন সংকটে বাংলাদেশের কী কর্তব্য সেটা ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।
ক্রাইসিস গ্রুপ না হলেও গত এক বছরে অবশ্য বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী পক্ষ ঢাকাকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নানা 'পরামর্শ' দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা সংকটে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করেছে। গত জুনে রাখাইন স্টেটে সহিংসতা শুরুর পর থেকে নৌ ও স্থলপথে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করেছে; কিন্তু তারা আগের বছরগুলোর মতো আশ্রয় পায়নি। সীমান্ত রক্ষীরা ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে খাবার, ওষুধ, বিশ্রাম দিয়েছে; কিন্তু আশ্রয় দেয়নি। এমন 'অমানবিক' অবস্থান নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে; কিন্তু সরকার চোখ-মুখ শক্ত করে সয়ে গেছে। কারণ, বৈধ ও অবৈধ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর উপস্থিতির কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতাই কেবল নয়; বহির্বিশ্বের বাংলাদেশি শ্রমবাজারেও যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকার আগে থেকেই সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল। ফলে রবীন্দ্রনাথের 'আষাঢ়' কবিতা মেনেই যেন ঘরের বাইরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে, জানালা দিয়ে বর্ষার জীবন ও প্রকৃতি দেখার মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক সংকটে তাকিয়ে থাকা কূটনৈতিক দিক থেকে কতখানি সঙ্গত? ঔচিত্যবোধ না হয় উহ্যই থাকল! আর পিঠ ফিরিয়ে থাকলেও কি কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হবে? মনে হয় না। বরং দেখা গেছে, ওই ইস্যুতে নির্লিপ্ত থাকার পরও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের নির্ধারিত ঢাকা সফর গত জুলাইয়ে বাতিল হয়ে গেছে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা ছাড়াই। অন্তত জাতিসংঘ শরণার্থী শিবিরে রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সূচিত উদ্যোগ এখন হিমাগারে। মিয়ানমার হয়ে এশিয়ান হাইওয়ে কিংবা ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়েতে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা যেন হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিইয়ে গেছে। গত বছরের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরের পর ঢাকা-রেঙ্গুন সরাসরি বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখতে পারছে না।
এসব দূরত্ব সত্ত্বেও গত এক দশকে সেখানে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের আকার ও সংযুক্তি অনেক বেড়েছে। শুধু দূতাবাস সংশ্লিষ্ট লোকজন নয়, এখন ব্যবসায়ীদেরও যাতায়াত বেড়েছে। মাছ ও কৃষিপণ্য বাণিজ্য কেবল নয়, বাংলাদেশে অন্তত ২০টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মিয়ানমারে রফতানি করছে। বেড়েছে সেখানে তৎপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা। তাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথা ভেবেও কিন্তু আমরা মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারি না।
বড় কথা, গত জুনের রাখাইন সহিংসতার পর থেকে বরং ইয়াঙ্গুনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা পুড়ছে তুষের আগুনে। চার-পাঁচ বছর ধরে সেখানে আছেন, এমন একজন বাংলাদেশি জানালেন, হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন যেন বৈরী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা আর আগের মতো আন্তরিক নয়। বাড়ি ভাড়া পেতেও তৈরি হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধক। এই অবস্থায় মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশকে কথা বলতেই হবে। আর সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যু পাশ কাটিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? আমরা পছন্দ করি বা না করি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের কূটনৈতিক কপাল জড়িয়ে গেছে। ইস্যুটি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু অস্বস্তি রয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমলে না নিলে অস্বস্তি অসুবিধায় পরিণত হতে পারে। যেমন বাড়বে রোহিঙ্গা সংকট, তেমনই মিয়ানমারের সঙ্গে দূরত্ব।
হতে পারে সম্পর্কের এমন শীতলতার পেছনে মিয়ানমারের দায়ই বারো আনা। কিন্তু কূটনীতি মানে ব্লেম গেইম নয়, নয় মুখ ফিরিয়ে থাকা। প্রতিবেশী যদি তার ঘর থেকে বের হতে না চায়, কথা বলার জন্য আমাদেরই পা বাড়াতে হবে।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
No comments