আশুলিয়া ট্র্যাজেডি- ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নয়, হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই by কাবেরী গায়েন
২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছেন ১৭০, ১৪৬, ১২৬ কিংবা ১১১ জন শ্রমিক। ১১১ জন পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া শ্রমিকের মৃত্যুতে সরকারিভাবে নির্ধারিত জাতীয় শোক দিবস পালন করেছি আমরা। সব উপাসনালয়ে প্রার্থনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
আর জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে রাখা হয়েছিল। সারা জাতি যখন গভীর বেদনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এমনকি ক্রোধ-ক্ষোভ প্রকাশেরও উপযুক্ত ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, গভীর প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে কাঠামোগত শ্রমিক হত্যার খুনিদের বিচারের দিকে, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৬ নভেম্বর একটি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব উপস্থিত করলেন জাতীয় সংসদে। তিনি বললেন, ‘এটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথমে পুলিশ, তারপর গার্মেন্টস। এরপর কিসের ওপর হামলা হবে, সেটা দেখতে হবে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সরকারপ্রধানের কাজ নয় রাষ্ট্রের কার ওপর পরবর্তী হামলা হয়, তা দেখা। বরং সরকারপ্রধানের কাজ হলো কারও ওপরই যেন কেউ হামলা না করতে পারে, সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আর যদি হামলা হয়েও যায়, সেই হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বের করে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা এবং কারণকে খুঁজে কারণ নির্মূল করার ব্যবস্থা করা।
এরপর তিনি বললেন, ‘রোববার ডেবোনেয়ার গার্মেন্টসে আগুন লাগানোর চেষ্টা করেছে চক্রান্তকারীরা। সুমি বেগম নামের এক নারী শ্রমিক কারখানায় আগুন দেন। এ জন্য পুলিশ সুমি ও জাকির নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।...সুমি স্বীকার করেছেন, মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি এ কাজটি করেছেন। এর পেছনে কারা জড়িত, তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে। যখন বায়াররা আসেন, কন্ট্রাক্ট সই হয়, তখনই এ ঘটনা ঘটানো হলো।’
কেন সুমি বেগমকে ২০ হাজার টাকায় আগুন লাগানোর কাজ দিয়ে জাকিরই সেই কাজটি সিসিটিভিতে ধরে রাখবেন? অতি যৌক্তিক এই প্রশ্নটি করে আমি শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যা অনুপস্থিত, সেই জায়গায় একটু দৃষ্টি দিতে চাই। অনুপস্থিত প্রসঙ্গটি হলো, মালিকপক্ষকে তিনি এই দুর্ঘটনার জন্য একটিবারের জন্য দায়ী করলেন না। রেপ্রিজেন্টেশন তত্ত্বে স্টুয়ার্ট হল বলেছেন, যা উপস্থাপিত হয় তা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট কথা বলে, যা অনুপস্থিত থাকে তার বিশ্লেষণও গুরুত্বপূর্ণ। তদন্তের আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাকে সত্য বলে ধরে নিলেও বলতেই হয়, আগুন যেভাবেই লাগুক না কেন, এত প্রাণ গেল কেন? আমরা গণমাধ্যমে দেখলাম এবং পড়লাম এই তাজরীন ফ্যাশনসের সরু সিঁড়ির কথা, তালাবদ্ধ গেটের কথা, এক্সিট মার্কিং না থাকার কথা এবং অন্ধকারের কথা। তিনি কেন এই না থাকাকে একবারও দায়ী করলেন না? কেন বললেন না কোম্পানি আইনের ব্যত্যয় থাকার জন্য এই পোশাক কারখানার মালিক এবং ব্যবস্থাপনাকে শাস্তি পেতেই হবে? অথচ এই অগ্নিকাণ্ডের ভেতর থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের বয়ানে যা বেরিয়ে এসেছে, তা মারাত্মক, আগুন লাগা আঁচ করতে পেরেই শ্রমিকেরা কারখানার ভেতর ছোটাছুটি করতে থাকেন। তাঁরা নিচে নেমে যেতে চাইলে কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার শ্রমিকদের বলেন, ‘নিচে আগুনের মহড়া হচ্ছে। ভয়ের কিছুই নেই।’ তারপরও শ্রমিকদের কেউ কেউ বের হয়ে যান। ‘একপর্যায়ে গেট বন্ধ করে উচ্চ স্বরে সাউন্ডবক্সে গান ছাড়েন। প্রোডাকশন ম্যানেজাররা শ্রমিকদের বের হওয়ার পথ তালাবদ্ধ করে বের হয়ে যান।’
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪ নম্বর ধারায় কারখানায় কর্মরত অবস্থায় অবহেলাজনিত মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না। আমরা দেখেছি, কাঠামোগত এই অবহেলার জন্য মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতরই হচ্ছে। ২০০০ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৫ জন, ২০০৪ সালে ২৬ জন, ২০০৫ সালে ৭৮ জন, ২০০৬ সালে ৯১ জন, ২০১১ সালে ২১ জন এবং ২০১২ সালে ২৬ জন। এগুলো হত্যাকাণ্ড। মালিকপক্ষের দায় তো আছেই, সব সরকারেরই দায় থাকে ফ্যাক্টরি কমপ্লায়েন্সের বিষয়ে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ীই যেকোনো আরএমজি ফ্যাক্টরির অনুমোদন পেতে হলে অন্তত তিনটি নির্গমন সিঁড়ি থাকতে হবে, যার প্রস্থ হবে ৪৫ ইঞ্চির বেশি। প্রতি এক হাজার বর্গফুটের জন্য থাকতে হবে কার্বন ডাই-অক্সাইড বা ড্রাই পাউডারের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। থাকতে হবে ধোঁয়া শনাক্তকারী এবং সক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম। প্রতিটি লাইনে থাকতে হবে ৩২ ইঞ্চির একটি আইল। প্রতিটি বের হওয়ার দরজায় থাকবে আলো। শ্রমিকদের মধ্য থেকে ফায়ার ফাইট এবং ফার্স্ট এইড দেওয়ার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুটি দল থাকবে। বছরের পর বছর দেশীয় আইনে নির্ধারিত এসবের কোনোটি না থাকা সত্ত্বেও অনেক ফ্যাক্টরি চলছে এবং শ্রমিকেরা পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ার পর আমরা বলছি, এগুলো দুর্ঘটনা। আর যেসব ফ্যাক্টরিতে অনুমোদন নেওয়ার সময় এগুলো দেখানো হয় অথচ কর্মরত শ্রমিকদের জন্য এসব মোটেই ব্যবহার করা হয় না, তাদের দায় কে নেবে? অবশ্যই সরকারের মনিটরিং সেল থাকতে হবে এই দুই ক্ষেত্রেই। তা যে থাকেনি, তার প্রমাণ এই মৃত্যুগুলো। তাই এই মৃত্যু কিছুতেই দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড।
এই সরকারি শোক দিবসেই বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী, শিক্ষক, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মী এবং নাগরিকেরা যখন শাহবাগের মোড়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন ২৭ নভেম্বর, তখন চাঁদপুর থেকে এক নারী ছুটে এসেছেন শাহবাগে ২৪ তারিখের পর থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া তাঁর বোন, ভগ্নিপতি ও মেয়ের খোঁজে। তিনি কিছু চেনেন না, পিজি হাসপাতালের সামনে এসেছিলেন কিন্তু সেখানে কীভাবে ঢুকতে হয় তিনি জানেন না, তাই এত মানুষের সমাবেশ দেখে ভেবেছেন, হয়তো এখানে কোনো খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। জানি না, তিনি এই খোঁজ পেয়েছেন কি না, কিংবা আর কোনো দিন পাবেন কি না, তড়িঘড়ি করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে দিয়ে দেওয়া ৫৯টি শনাক্তহীন মানুষের কয়লা হয়ে যাওয়া দেহের মধ্যে তাঁরাও আছেন কি না।
যে বস্ত্র শ্রমিকেরা বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে আমাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই বস্ত্র শ্রমিকদের শনাক্ত-অযোগ্যভাবে পুড়িয়ে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে তুলে দেওয়ার মানে কি আমরা বুঝি? কেউ এসএমএস করেছেন তাঁর মায়ের কাছে, ‘কোমরে বাঁধা শার্ট দেখে লাশ চিনে নিয়ো’, কেউ বলেছেন, নাকফুলের কথা। এভাবে জলজ্যান্ত সবচেয়ে কর্মব্যস্ত মানুষগুলো মালিকদের লোভের আর রাষ্ট্রের উদাসীনতার শিকার হয়ে পরিচয়হীন হয়ে গেল, অথচ রাষ্ট্রই তো মানুষকে পরিচয় দেয়। এই শনাক্ত-অযোগ্য লাশের দায় কেন রাষ্ট্র নেবে না?
এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের আরেকটি দিক সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন কি না জানি না, পত্রিকান্তরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন একজন কথিত ঋণখেলাপি। কেবল তাজরীন ফ্যাশনসের নামেই তিনি ব্যাংকঋণ নিয়েছেন ৫০ কোটি টাকা। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ছিল খুবই অনিয়মিত এবং বেতন-ভাতার দাবিতে মাঝেমধ্যেই শ্রমিক বিক্ষোভ হতো। রক্ষা পাওয়া এক নারী শ্রমিক জানিয়েছেন, ঘটনার দিন কয়েক আগেই প্রোডাকশন ম্যানেজার তাঁদের বলেছিলেন, ‘অগ্নিনির্বাপণ মহড়া চলবে। তোমরা ভয় পাবা না এবং নিচেও নামবা না।’ এই দিকটি কি খতিয়ে দেখা হবে না?
২০১১ সালে গ্লোবাল রেসপনসিবিলিটি রিপোর্টে ওয়ালমার্ট এই অগ্নি-নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রসঙ্গেই বাংলাদেশের ৪৯টি কারখানায় কাজ করা বন্ধ করেছে। ২০১১ সালের মে মাসের তদন্ত শেষে তাজরীন ফ্যাশনসকে ‘হাই রিস্ক’ এবং আগস্ট মাসে ‘মিডিয়াম রিস্ক’ ক্যাটাগরিতে ফেলেছে ওয়ালমার্ট। বাংলাদেশে জ্বালানির মতোই আছে সস্তা শ্রমের জোগান। যদিও ওয়ালমার্টসহ অনেক সংস্থাই এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, কিন্তু ধরে নিতে পারি, সস্তা শ্রমের এই অফুরান বাজারে তারা ফের আসবে। আমরা কি ভুলে যাব এই ১১১টি দগ্ধ জীবনের স্মৃতি?
বাংলাদেশ সরকার তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করবে আর শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই করবে না, এ হয় না। যদি মালিকপক্ষকে এই মৃত্যুকূপগুলোকে কার্যোপযোগী ব্যবস্থায় উন্নীত করার ব্যাপারে বাধ্য করা না যায়, তবে শ্রমিকদের এই মৃত্যু কেবল শোক দিবস করে বা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। সয়ে যেতে যেতে জাতিগত চূড়ান্ত বোধ নষ্ট হওয়ার আগেই কাঠামোগত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছি। আমরা যেন পুড়ে যাওয়া শ্রমিকদের দিকেই তাঁদের হত্যার দায় তুলে না দিই, এইটুকু মানবিকতা আশা করা কি খুব বেশি?
ড. কাবেরী গায়েন: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এরপর তিনি বললেন, ‘রোববার ডেবোনেয়ার গার্মেন্টসে আগুন লাগানোর চেষ্টা করেছে চক্রান্তকারীরা। সুমি বেগম নামের এক নারী শ্রমিক কারখানায় আগুন দেন। এ জন্য পুলিশ সুমি ও জাকির নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।...সুমি স্বীকার করেছেন, মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি এ কাজটি করেছেন। এর পেছনে কারা জড়িত, তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে। যখন বায়াররা আসেন, কন্ট্রাক্ট সই হয়, তখনই এ ঘটনা ঘটানো হলো।’
কেন সুমি বেগমকে ২০ হাজার টাকায় আগুন লাগানোর কাজ দিয়ে জাকিরই সেই কাজটি সিসিটিভিতে ধরে রাখবেন? অতি যৌক্তিক এই প্রশ্নটি করে আমি শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যা অনুপস্থিত, সেই জায়গায় একটু দৃষ্টি দিতে চাই। অনুপস্থিত প্রসঙ্গটি হলো, মালিকপক্ষকে তিনি এই দুর্ঘটনার জন্য একটিবারের জন্য দায়ী করলেন না। রেপ্রিজেন্টেশন তত্ত্বে স্টুয়ার্ট হল বলেছেন, যা উপস্থাপিত হয় তা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট কথা বলে, যা অনুপস্থিত থাকে তার বিশ্লেষণও গুরুত্বপূর্ণ। তদন্তের আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাকে সত্য বলে ধরে নিলেও বলতেই হয়, আগুন যেভাবেই লাগুক না কেন, এত প্রাণ গেল কেন? আমরা গণমাধ্যমে দেখলাম এবং পড়লাম এই তাজরীন ফ্যাশনসের সরু সিঁড়ির কথা, তালাবদ্ধ গেটের কথা, এক্সিট মার্কিং না থাকার কথা এবং অন্ধকারের কথা। তিনি কেন এই না থাকাকে একবারও দায়ী করলেন না? কেন বললেন না কোম্পানি আইনের ব্যত্যয় থাকার জন্য এই পোশাক কারখানার মালিক এবং ব্যবস্থাপনাকে শাস্তি পেতেই হবে? অথচ এই অগ্নিকাণ্ডের ভেতর থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের বয়ানে যা বেরিয়ে এসেছে, তা মারাত্মক, আগুন লাগা আঁচ করতে পেরেই শ্রমিকেরা কারখানার ভেতর ছোটাছুটি করতে থাকেন। তাঁরা নিচে নেমে যেতে চাইলে কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার শ্রমিকদের বলেন, ‘নিচে আগুনের মহড়া হচ্ছে। ভয়ের কিছুই নেই।’ তারপরও শ্রমিকদের কেউ কেউ বের হয়ে যান। ‘একপর্যায়ে গেট বন্ধ করে উচ্চ স্বরে সাউন্ডবক্সে গান ছাড়েন। প্রোডাকশন ম্যানেজাররা শ্রমিকদের বের হওয়ার পথ তালাবদ্ধ করে বের হয়ে যান।’
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৪ নম্বর ধারায় কারখানায় কর্মরত অবস্থায় অবহেলাজনিত মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না। আমরা দেখেছি, কাঠামোগত এই অবহেলার জন্য মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতরই হচ্ছে। ২০০০ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৫ জন, ২০০৪ সালে ২৬ জন, ২০০৫ সালে ৭৮ জন, ২০০৬ সালে ৯১ জন, ২০১১ সালে ২১ জন এবং ২০১২ সালে ২৬ জন। এগুলো হত্যাকাণ্ড। মালিকপক্ষের দায় তো আছেই, সব সরকারেরই দায় থাকে ফ্যাক্টরি কমপ্লায়েন্সের বিষয়ে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ীই যেকোনো আরএমজি ফ্যাক্টরির অনুমোদন পেতে হলে অন্তত তিনটি নির্গমন সিঁড়ি থাকতে হবে, যার প্রস্থ হবে ৪৫ ইঞ্চির বেশি। প্রতি এক হাজার বর্গফুটের জন্য থাকতে হবে কার্বন ডাই-অক্সাইড বা ড্রাই পাউডারের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। থাকতে হবে ধোঁয়া শনাক্তকারী এবং সক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম। প্রতিটি লাইনে থাকতে হবে ৩২ ইঞ্চির একটি আইল। প্রতিটি বের হওয়ার দরজায় থাকবে আলো। শ্রমিকদের মধ্য থেকে ফায়ার ফাইট এবং ফার্স্ট এইড দেওয়ার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুটি দল থাকবে। বছরের পর বছর দেশীয় আইনে নির্ধারিত এসবের কোনোটি না থাকা সত্ত্বেও অনেক ফ্যাক্টরি চলছে এবং শ্রমিকেরা পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়ার পর আমরা বলছি, এগুলো দুর্ঘটনা। আর যেসব ফ্যাক্টরিতে অনুমোদন নেওয়ার সময় এগুলো দেখানো হয় অথচ কর্মরত শ্রমিকদের জন্য এসব মোটেই ব্যবহার করা হয় না, তাদের দায় কে নেবে? অবশ্যই সরকারের মনিটরিং সেল থাকতে হবে এই দুই ক্ষেত্রেই। তা যে থাকেনি, তার প্রমাণ এই মৃত্যুগুলো। তাই এই মৃত্যু কিছুতেই দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড।
এই সরকারি শোক দিবসেই বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী, শিক্ষক, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মী এবং নাগরিকেরা যখন শাহবাগের মোড়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন ২৭ নভেম্বর, তখন চাঁদপুর থেকে এক নারী ছুটে এসেছেন শাহবাগে ২৪ তারিখের পর থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া তাঁর বোন, ভগ্নিপতি ও মেয়ের খোঁজে। তিনি কিছু চেনেন না, পিজি হাসপাতালের সামনে এসেছিলেন কিন্তু সেখানে কীভাবে ঢুকতে হয় তিনি জানেন না, তাই এত মানুষের সমাবেশ দেখে ভেবেছেন, হয়তো এখানে কোনো খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। জানি না, তিনি এই খোঁজ পেয়েছেন কি না, কিংবা আর কোনো দিন পাবেন কি না, তড়িঘড়ি করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে দিয়ে দেওয়া ৫৯টি শনাক্তহীন মানুষের কয়লা হয়ে যাওয়া দেহের মধ্যে তাঁরাও আছেন কি না।
যে বস্ত্র শ্রমিকেরা বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে আমাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই বস্ত্র শ্রমিকদের শনাক্ত-অযোগ্যভাবে পুড়িয়ে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে তুলে দেওয়ার মানে কি আমরা বুঝি? কেউ এসএমএস করেছেন তাঁর মায়ের কাছে, ‘কোমরে বাঁধা শার্ট দেখে লাশ চিনে নিয়ো’, কেউ বলেছেন, নাকফুলের কথা। এভাবে জলজ্যান্ত সবচেয়ে কর্মব্যস্ত মানুষগুলো মালিকদের লোভের আর রাষ্ট্রের উদাসীনতার শিকার হয়ে পরিচয়হীন হয়ে গেল, অথচ রাষ্ট্রই তো মানুষকে পরিচয় দেয়। এই শনাক্ত-অযোগ্য লাশের দায় কেন রাষ্ট্র নেবে না?
এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের আরেকটি দিক সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন কি না জানি না, পত্রিকান্তরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেন একজন কথিত ঋণখেলাপি। কেবল তাজরীন ফ্যাশনসের নামেই তিনি ব্যাংকঋণ নিয়েছেন ৫০ কোটি টাকা। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ছিল খুবই অনিয়মিত এবং বেতন-ভাতার দাবিতে মাঝেমধ্যেই শ্রমিক বিক্ষোভ হতো। রক্ষা পাওয়া এক নারী শ্রমিক জানিয়েছেন, ঘটনার দিন কয়েক আগেই প্রোডাকশন ম্যানেজার তাঁদের বলেছিলেন, ‘অগ্নিনির্বাপণ মহড়া চলবে। তোমরা ভয় পাবা না এবং নিচেও নামবা না।’ এই দিকটি কি খতিয়ে দেখা হবে না?
২০১১ সালে গ্লোবাল রেসপনসিবিলিটি রিপোর্টে ওয়ালমার্ট এই অগ্নি-নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রসঙ্গেই বাংলাদেশের ৪৯টি কারখানায় কাজ করা বন্ধ করেছে। ২০১১ সালের মে মাসের তদন্ত শেষে তাজরীন ফ্যাশনসকে ‘হাই রিস্ক’ এবং আগস্ট মাসে ‘মিডিয়াম রিস্ক’ ক্যাটাগরিতে ফেলেছে ওয়ালমার্ট। বাংলাদেশে জ্বালানির মতোই আছে সস্তা শ্রমের জোগান। যদিও ওয়ালমার্টসহ অনেক সংস্থাই এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, কিন্তু ধরে নিতে পারি, সস্তা শ্রমের এই অফুরান বাজারে তারা ফের আসবে। আমরা কি ভুলে যাব এই ১১১টি দগ্ধ জীবনের স্মৃতি?
বাংলাদেশ সরকার তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার আয় করবে আর শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য কিছুই করবে না, এ হয় না। যদি মালিকপক্ষকে এই মৃত্যুকূপগুলোকে কার্যোপযোগী ব্যবস্থায় উন্নীত করার ব্যাপারে বাধ্য করা না যায়, তবে শ্রমিকদের এই মৃত্যু কেবল শোক দিবস করে বা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। সয়ে যেতে যেতে জাতিগত চূড়ান্ত বোধ নষ্ট হওয়ার আগেই কাঠামোগত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছি। আমরা যেন পুড়ে যাওয়া শ্রমিকদের দিকেই তাঁদের হত্যার দায় তুলে না দিই, এইটুকু মানবিকতা আশা করা কি খুব বেশি?
ড. কাবেরী গায়েন: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments