আবার গার্মেন্ট কারখানায় আগুন-জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
জীবনের নিশ্চয়তা নেই নিশ্চিন্তপুরে। জীবন ও জীবিকার দায়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা প্রান্তিক মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি তার কর্মস্থল। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে গেছে অনেকের স্বপ্ন। সরকারি হিসাবেই মৃতের সংখ্যা ১১১।
আগুন শুধু যে ১১১ জন কর্মীর জীবন কেড়ে নিয়েছে তা-ই নয়, এই অগ্নিকাণ্ডের ভেতর দিয়ে গার্মেন্ট মালিকদের লোভের আগুন কত ভয়াবহ হতে পারে, সেটাও নতুন করে আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। গার্মেন্ট কারখানার আগুন নেভাতে দমকল বাহিনী সব চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার আগেই মালিকপক্ষের লোভের আগুনে ভর করে আগুন ছড়িয়ে গেছে। কতটা নিষ্ঠুর ও বর্বর হলে আগুন লাগা কারখানার গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া যায়, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। বিকশিত পুঁজি কিংবা মুনাফার লোভ কি মানুষের জীবনকেও তুচ্ছ করে দেয়? এখনো কি শ্রমিককে মানুষ বিবেচনা করা সম্ভব হচ্ছে না কিছু মানুষের পক্ষে? তা যদি না-ই হবে, তাহলে কেন আগুন লেগে যাওয়ার পরও তাজরিন গার্মেন্টের শ্রমিকদের বের হতে দেওয়া হয়নি? কেন তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল ভেতরে ও বাইরে? সোমবার ঢাকার দক্ষিণখানেও গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লেগেছে। পোশাক শিল্পে এই অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্য কারণ কি শুধুই দুর্ঘটনা, না অন্য কিছু?বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। গার্মেন্ট খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তার সংগত কারণও রয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্ববাজারে পরিচিতি পেয়েছে। সৃষ্টি করেছে চাহিদা। এ ছাড়া শ্রমমূল্য কম হওয়ার কারণে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী। ফলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প অল্পদিনেই বিশ্ববাজারে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। কিছু দিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূতও বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের প্রশংসা করেছেন। শনিবার সন্ধ্যায় নিশ্চিন্তপুরে গার্মেন্ট কারখানা ও চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার ভেঙে প্রাণহানির ঘটনায় আজ পালন করা হচ্ছে জাতীয় শোক। আজ অর্ধনমিত থাকবে জাতীয় পতাকা। সব ধর্মের উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা করা হবে।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক শোষণের অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। অনেক দেন-দরবার ও আন্দোলনের পর গার্মেন্ট শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। সেই মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করার কাজটাও ছিল কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশে গার্মেন্টকর্মীদের জন্য স্বতন্ত্র মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করা হলেও জীবনের নিরাপত্তা যে নিশ্চিত করা যায়নি, তা প্রমাণিত হয়েছে গত শনিবারের অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনার ভেতর দিয়ে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির অকালপ্রয়াণে একটি পরিবার যে অসহায় অবস্থার ভেতর পড়ে গেল, তা থেকে উত্তরণের উপায় কী? পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নিহতদের পরিবারের জন্য অর্থ সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে। মাত্র এক লাখ টাকা কিংবা পরিবারের অন্য একজনের চাকরি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা কি কোনো সন্তানের পিতৃ বা মাতৃস্নেহের বিকল্প হতে পারে?
বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশ বিদেশি ক্রেতাদের ওপর ভর করে। বিদেশি ক্রেতারাও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ব্যাপারে আগ্রহী। তবে কয়েকটি বিষয়ে তাঁরা নিশ্চয়তা চান। এই শিল্পের নেতিবাচক কয়েকটি দিক নিয়ে দেশের পোশাক কারখানার মালিকদের বারবার সতর্ক করা হয়েছে। বিদেশি ক্রেতারা চান পোশাক শিল্পে নিয়োজিত কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করবে। সেই নিরাপত্তা কি নিশ্চিত করা হয়েছে? নিশ্চিন্তপুরের ঘটনায় বিবিসি অভিযোগ তুলেছে পোশাক কারখানার মালিক, তদন্ত কর্মকর্তা ও দেশের ফায়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানকার অনেক শিল্প মালিক ও তদন্ত কর্মকর্তা অসৎ। ফায়ার সার্ভিস অদক্ষ। যে কারণে বারবার দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো শিল্প মালিকের সাজা হয়নি।
নিশ্চিন্তপুর ও চট্টগ্রামের দুর্ঘটনা দুটি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, উভয় স্থানেই মানবিকতার পরাজয় ঘটেছে। তাজরিন গার্মেন্টের মালিক পক্ষ মানবিক হলে অনেক জীবন রক্ষা করা যেত। চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারের ঠিকাদার মানবিক হলে এড়ানো যেত দুর্ঘটনা। আমাদের পুঁজির পৃষ্ঠপোষকরা কেন মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলেন? নিশ্চিন্তপুর ও চট্টগ্রামের দুর্ঘটনায় নিহতদের শোক জানানোর ভাষা আমাদের নেই। আমরা চাই দুটি ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত হোক। নিশ্চিত করা হোক প্রকৃত দোষীদের শাস্তি। নিহতদের পুনর্বাসনে সরকারের চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না- এটাই আমাদের চাওয়া।
No comments