শিক্ষা-আমাদের শিশুরা কী বই পড়ছে by নূর কামরুন নাহার
শিশুদের হাতে যেমন তুলে দিতে হবে ভালো বই তেমনি যে কোনো বই যাতে বাজারে চলে না আসে এবং শিশুদের মেধা ও মননের ক্ষতি করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল দিতে হবে। ভালো ও সুন্দরের দিকে আমাদের শিশুদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের
গত কয়েক বছর ধরেই বইমেলায় শিশুদের উপস্থিতি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ব্যাপকসংখ্যক শিশু আসছে বইমেলায়। শিশুদের এই আগমনকে কেন্দ্র করে মেলায় শিশু কর্নার, শিশুপ্রহর_ এ ধরনের বাড়তি কিছু ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে।
শিশুরা মেলায় আসছে এবং শুধু শিশুদের মেলায় নিয়ে আসার জন্যই অনেক অভিভাবকও মেলায় আসছেন। আমার এমন অনেক পরিচিত, বল্পুব্দ ও সহকর্মীর সঙ্গে মেলায় দেখা হয়েছে, যাদের প্রায় সবাই কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, বাচ্চার জন্যই তারা মেলায় এসেছেন। তাদের বাচ্চারা বই কিনতে খুবই আগ্রহী কিন্তু বাচ্চার জন্য কোন বই কিনবেন বুঝতে পারছেন না। ভালো বই খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের অনেকেই আমার কাছে ভালো বইয়ের সন্ধান চেয়েছেন, পরামর্শ চেয়েছেন কোন বই কেনা যায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমিও তাদের খুব একটা সাহায্য করতে পারিনি।
বইমেলায় আসা শিশুদের সঙ্গেও আমার বিভিন্ন সময় কথা হয়েছে, দেখেছি কী অপরিসীম আগ্রহ তাদের বইয়ের প্রতি। দেখেছি কী আগ্রহ আর আনন্দে তারা দু'হাতে ধরে রেখেছে নতুন কেনা বই। তাদের বুদ্ধিদীপ্ত চোখগুলো কেমন চকচক করে উঠেছে খুশি আর উত্তেজনায়। তাদের হাতের রঙবেরঙের বাহারি প্রচ্ছদ ও ছবি সংবলিত আকর্ষণীয় ওইসব বই ইচ্ছা করেই নেড়েচেড়ে দেখেছি। কী বই কিনছে আমাদের শিশুরা, আর কী পাঠ করছে? রঙচঙে ওসব বইয়ের প্রচ্ছদ আর ছবি যতটা আকর্ষণীয়, ঠিক ততটাই অনাকর্ষণীয় বইয়ের বিষয়বস্তু ও লেখার মান। শিশুদের বই কেনার প্রবল আগ্রহ এবং শিশুদের বইয়ের ব্যাপক কাটতিকে পুঁজি করে একশ্রেণীর লেখক ও প্রকাশকের সমন্বয়ে বের করা হচ্ছে এসব নিম্নমানের বই। এসব বইয়ের চেহারা খুবই মনোগ্রাহী। বইয়ের নামেও রয়েছে চমক। অধিকাংশ বইয়ের নামই আবার ভূত, পেত্নী ও পরী সংক্রান্ত। ভূত, পেত্নী, পরী_ এসব অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি কৌতূহল এবং ভূত সম্পর্কে এক ধরনের ভয় ও সাধারণ উৎসাহ থাকার কারণেই এ ধরনের নামের বই সর্বাধিক, এসব বইয়ের কাটতিও অবিশ্বাস্য। তাই কোনো রকম একটা কিছু লিখে, কিছু ছবি আর ভূত-পেত্নীর নাম জুড়ে দিলেই হলো। দ্রুত বিক্রি হয়ে যায় নিম্নমানের এসব বই।
নাম এবং ছবিসর্বস্ব এসব বইয়ে মূলত কিছুই নেই। কাহিনীর চমৎকারিত্ব, বর্ণনার মুনশিয়ানার তো প্রশ্নই ওঠে না, অনেক বাক্যই শুদ্ধ নয়। অসংখ্য বানান ভুল আর অশুদ্ধ বাক্যের এ বইগুলো শিশুদের ভাষাজ্ঞান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা তো রাখছেই না, বরং তাদের মেধা ও জানার জগৎকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
চলতি সময়ে শিশুদের জন্য লিখিত অধিকাংশ বইয়ের বিষয়ই হচ্ছে ভূত-প্রেত এবং কাল্পনিক গাঁজাখুরি কাহিনীভিত্তিক। যার ভেতরে বাস্তব জীবনের কোনো প্রতিফলন নেই, নেই সমাজের কোনো চিত্র, এমনকি শিশুদের নির্মল আনন্দ দান করতে পারে এমন কিছুও নেই। অধিকাংশ বইয়ের আকারও বেশ ছোট, ছবি দিয়েই আবার অধিকাংশ জায়গা ভরা, ফলে পাঠের বিষয়বস্তুও নিতান্তই কম।
শিশু বয়সে থাকে নানা কৌতূহল, চারপাশের জগৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন। মনোজগতের বিকাশ, সমাজ এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠারও প্রথম স্তর বা ধাপ হচ্ছে শিশুকাল। শিশুর প্রাথমিক পাঠ যদি সঠিক না হয়, গড়ে ওঠার সময়ই যদি সত্য, সুন্দর আর প্রকৃত জীবনভিত্তিক বিষয়ের সঙ্গে তার পরিচিতি না ঘটে, তবে পরবর্তী জীবনে সে সঠিক ও সুন্দরকে চিনতে ব্যর্থ হবে। তার মানসিক জগতের বিকাশ হবে রাহুগ্রস্ত এবং বিকৃত মানসিকতার। প্রকৃত জীবনবোধ গঠনে থেকে যাবে ঘাটতি এবং এ ঘাটতি কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব হবে না। শিশু যদি বেড়ে ওঠে এক কাল্পনিক জগৎকে কেন্দ্র করে তবে কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খেতে তাকে প্রতি মুহূর্তেই হোঁচট খেতে হবে, আর তার শিক্ষায় যদি নৈতিক শিক্ষা না থাকে, সুস্থ আনন্দ না থাকে তবে সে অন্যায় আচরণে দ্বিধা করবে না এবং বিকৃত বিষয়ে আনন্দ নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।
মননের দৈন্য এখন আমাদের এক গভীর সংকটের মুখে পতিত করেছে। সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার চর্চায় এক অশুভ অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে। ফলে আমাদের সাহিত্য-শিল্প এক মন্দাকাল অতিক্রম করছে। বলা হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম অস্থির। তাদের মধ্যে সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি প্রেম দেখা যাচ্ছে না। তারা বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত। আকাশ সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেছে। এ সময় যদি আমরা শিশুদের সঠিক শিক্ষা দিতে না পারি, তাদের হাতে যদি সঠিক বই তুলে দিতে না পারি, শিশুদের মধ্যে যদি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মমত্ববোধ জাগরিত করতে না পারি, তাদের হাতে যদি ভুল বানান আর অশুদ্ধ বাক্যের বই তুলে দিই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে আরও দূরে সরে যাবে এবং আরও অধিক মাত্রায় অস্থির হয়ে উঠবে, তাতে আর সন্দেহ কি!
ভাষাকে জানতে হলে, ভাষার সুন্দর ব্যবহার শিখতে হলে, মনকে অনির্বচনীয় আনন্দে পূর্ণ করতে হলে ভালো বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। মানসিক জগতের বিকাশ, চিন্তার খোরাক সৃষ্টি এবং সুস্থ আনন্দের জন্যও ভালো বইয়ের ভূমিকার কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। শিশুদের মানসিক জগতের উৎকর্ষ সাধন, দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধ গঠন, নিজের সংস্কৃতিকে চেনা ও ভাষাকে জানার জন্য শিশুদের উপযোগী ভালো বই প্রয়োজন_ যে বই একই সঙ্গে শিশুকে আনন্দ দেবে, শিক্ষা দেবে এবং আমাদের শিকড়ের কথা বলবে।
শিশুসাহিত্য খুব সহজ বিষয় নয়। শিশুদের উপযোগী করে বই লেখা সত্যিকার অর্থেই একটি কঠিন ও পরিশ্রমী কাজ। শিশুদের সাহিত্য রচনায় যেমন বিষয়বস্তু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনি বিষয়ের উপস্থাপনা এবং বর্ণনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কোন বিষয়গুলো পড়লে আমাদের শিশুদের মনোজগৎ আলোকিত ও সমৃদ্ধ হবে, শিশুরা পড়তে আকৃষ্ট হবে, নির্মল আনন্দ পাবে তা খুব চিন্তা করে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। মনে হলো আর রাতারাতি বই লিখে ফেললাম, বাণিজ্য হবে তাই রঙচঙ মেখে ছাপিয়ে দিলাম, এরপর হয়ে গেলাম লেখক_ শিশুসাহিত্যিক বিষয়টি এত সোজা নয়।
শিশুরা বই পড়তে চাইছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এ যুগেও বাবা-মাকে জোর করে বইমেলায় নিয়ে আসছে_ এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। কিন্তু এই যে আমাদের নতুন প্রজন্ম, যারা বই পড়তে আগ্রহী, তাদের হাতে আমরা কোন বই তুলে দেব? বাংলা সাহিত্যের প্রথম পাঠ কেমন হবে, কেমন হবে তাদের জীবনের প্রাথমিক পাঠ_ আমাদের এখনই দেখতে হবে, ভাবতে হবে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে যেনতেন বই কিছু রঙ লাগিয়ে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হলো আর বিকল্প কিছু না থাকায় আমাদের শিশুরা তা কিনতে বাধ্য হলো_ এমন হলে চলবে না। বিষয়টিকে আমাদের অবশ্যই নজরদারিতে আনতে হবে। আমাদের আগামী প্রজন্ম, যাদের কাছে রয়েছে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার, তাদের প্রাথমিক পাঠ নিয়ে এত খামখেয়ালিপনায় ডুবে থাকলে চলবে না। সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার পর আফসোস করে লাভ হবে না, তাই এখনই এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশুদের হাতে যেমন তুলে দিতে হবে ভালো বই তেমনি যে কোনো বই যাতে বাজারে চলে না আসে এবং শিশুদের মেধা ও মননের ক্ষতি করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল দিতে হবে। ভালো ও সুন্দরের দিকে আমাদের শিশুদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। এ কাজ যত কঠিন আর পরিশ্রমসাধ্যই হোক না কেন আমাদের করতেই হবে, না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে, তখন কোনো অজুহাতই খাটবে না।
নূর কামরুন নাহার : কলাম লেখক
nurquamrunnaher@yahoo.com
শিশুরা মেলায় আসছে এবং শুধু শিশুদের মেলায় নিয়ে আসার জন্যই অনেক অভিভাবকও মেলায় আসছেন। আমার এমন অনেক পরিচিত, বল্পুব্দ ও সহকর্মীর সঙ্গে মেলায় দেখা হয়েছে, যাদের প্রায় সবাই কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, বাচ্চার জন্যই তারা মেলায় এসেছেন। তাদের বাচ্চারা বই কিনতে খুবই আগ্রহী কিন্তু বাচ্চার জন্য কোন বই কিনবেন বুঝতে পারছেন না। ভালো বই খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের অনেকেই আমার কাছে ভালো বইয়ের সন্ধান চেয়েছেন, পরামর্শ চেয়েছেন কোন বই কেনা যায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমিও তাদের খুব একটা সাহায্য করতে পারিনি।
বইমেলায় আসা শিশুদের সঙ্গেও আমার বিভিন্ন সময় কথা হয়েছে, দেখেছি কী অপরিসীম আগ্রহ তাদের বইয়ের প্রতি। দেখেছি কী আগ্রহ আর আনন্দে তারা দু'হাতে ধরে রেখেছে নতুন কেনা বই। তাদের বুদ্ধিদীপ্ত চোখগুলো কেমন চকচক করে উঠেছে খুশি আর উত্তেজনায়। তাদের হাতের রঙবেরঙের বাহারি প্রচ্ছদ ও ছবি সংবলিত আকর্ষণীয় ওইসব বই ইচ্ছা করেই নেড়েচেড়ে দেখেছি। কী বই কিনছে আমাদের শিশুরা, আর কী পাঠ করছে? রঙচঙে ওসব বইয়ের প্রচ্ছদ আর ছবি যতটা আকর্ষণীয়, ঠিক ততটাই অনাকর্ষণীয় বইয়ের বিষয়বস্তু ও লেখার মান। শিশুদের বই কেনার প্রবল আগ্রহ এবং শিশুদের বইয়ের ব্যাপক কাটতিকে পুঁজি করে একশ্রেণীর লেখক ও প্রকাশকের সমন্বয়ে বের করা হচ্ছে এসব নিম্নমানের বই। এসব বইয়ের চেহারা খুবই মনোগ্রাহী। বইয়ের নামেও রয়েছে চমক। অধিকাংশ বইয়ের নামই আবার ভূত, পেত্নী ও পরী সংক্রান্ত। ভূত, পেত্নী, পরী_ এসব অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি কৌতূহল এবং ভূত সম্পর্কে এক ধরনের ভয় ও সাধারণ উৎসাহ থাকার কারণেই এ ধরনের নামের বই সর্বাধিক, এসব বইয়ের কাটতিও অবিশ্বাস্য। তাই কোনো রকম একটা কিছু লিখে, কিছু ছবি আর ভূত-পেত্নীর নাম জুড়ে দিলেই হলো। দ্রুত বিক্রি হয়ে যায় নিম্নমানের এসব বই।
নাম এবং ছবিসর্বস্ব এসব বইয়ে মূলত কিছুই নেই। কাহিনীর চমৎকারিত্ব, বর্ণনার মুনশিয়ানার তো প্রশ্নই ওঠে না, অনেক বাক্যই শুদ্ধ নয়। অসংখ্য বানান ভুল আর অশুদ্ধ বাক্যের এ বইগুলো শিশুদের ভাষাজ্ঞান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা তো রাখছেই না, বরং তাদের মেধা ও জানার জগৎকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
চলতি সময়ে শিশুদের জন্য লিখিত অধিকাংশ বইয়ের বিষয়ই হচ্ছে ভূত-প্রেত এবং কাল্পনিক গাঁজাখুরি কাহিনীভিত্তিক। যার ভেতরে বাস্তব জীবনের কোনো প্রতিফলন নেই, নেই সমাজের কোনো চিত্র, এমনকি শিশুদের নির্মল আনন্দ দান করতে পারে এমন কিছুও নেই। অধিকাংশ বইয়ের আকারও বেশ ছোট, ছবি দিয়েই আবার অধিকাংশ জায়গা ভরা, ফলে পাঠের বিষয়বস্তুও নিতান্তই কম।
শিশু বয়সে থাকে নানা কৌতূহল, চারপাশের জগৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন। মনোজগতের বিকাশ, সমাজ এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠারও প্রথম স্তর বা ধাপ হচ্ছে শিশুকাল। শিশুর প্রাথমিক পাঠ যদি সঠিক না হয়, গড়ে ওঠার সময়ই যদি সত্য, সুন্দর আর প্রকৃত জীবনভিত্তিক বিষয়ের সঙ্গে তার পরিচিতি না ঘটে, তবে পরবর্তী জীবনে সে সঠিক ও সুন্দরকে চিনতে ব্যর্থ হবে। তার মানসিক জগতের বিকাশ হবে রাহুগ্রস্ত এবং বিকৃত মানসিকতার। প্রকৃত জীবনবোধ গঠনে থেকে যাবে ঘাটতি এবং এ ঘাটতি কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব হবে না। শিশু যদি বেড়ে ওঠে এক কাল্পনিক জগৎকে কেন্দ্র করে তবে কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খেতে তাকে প্রতি মুহূর্তেই হোঁচট খেতে হবে, আর তার শিক্ষায় যদি নৈতিক শিক্ষা না থাকে, সুস্থ আনন্দ না থাকে তবে সে অন্যায় আচরণে দ্বিধা করবে না এবং বিকৃত বিষয়ে আনন্দ নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।
মননের দৈন্য এখন আমাদের এক গভীর সংকটের মুখে পতিত করেছে। সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার চর্চায় এক অশুভ অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে। ফলে আমাদের সাহিত্য-শিল্প এক মন্দাকাল অতিক্রম করছে। বলা হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম অস্থির। তাদের মধ্যে সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি প্রেম দেখা যাচ্ছে না। তারা বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত। আকাশ সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেছে। এ সময় যদি আমরা শিশুদের সঠিক শিক্ষা দিতে না পারি, তাদের হাতে যদি সঠিক বই তুলে দিতে না পারি, শিশুদের মধ্যে যদি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মমত্ববোধ জাগরিত করতে না পারি, তাদের হাতে যদি ভুল বানান আর অশুদ্ধ বাক্যের বই তুলে দিই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে আরও দূরে সরে যাবে এবং আরও অধিক মাত্রায় অস্থির হয়ে উঠবে, তাতে আর সন্দেহ কি!
ভাষাকে জানতে হলে, ভাষার সুন্দর ব্যবহার শিখতে হলে, মনকে অনির্বচনীয় আনন্দে পূর্ণ করতে হলে ভালো বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। মানসিক জগতের বিকাশ, চিন্তার খোরাক সৃষ্টি এবং সুস্থ আনন্দের জন্যও ভালো বইয়ের ভূমিকার কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। শিশুদের মানসিক জগতের উৎকর্ষ সাধন, দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধ গঠন, নিজের সংস্কৃতিকে চেনা ও ভাষাকে জানার জন্য শিশুদের উপযোগী ভালো বই প্রয়োজন_ যে বই একই সঙ্গে শিশুকে আনন্দ দেবে, শিক্ষা দেবে এবং আমাদের শিকড়ের কথা বলবে।
শিশুসাহিত্য খুব সহজ বিষয় নয়। শিশুদের উপযোগী করে বই লেখা সত্যিকার অর্থেই একটি কঠিন ও পরিশ্রমী কাজ। শিশুদের সাহিত্য রচনায় যেমন বিষয়বস্তু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনি বিষয়ের উপস্থাপনা এবং বর্ণনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কোন বিষয়গুলো পড়লে আমাদের শিশুদের মনোজগৎ আলোকিত ও সমৃদ্ধ হবে, শিশুরা পড়তে আকৃষ্ট হবে, নির্মল আনন্দ পাবে তা খুব চিন্তা করে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। মনে হলো আর রাতারাতি বই লিখে ফেললাম, বাণিজ্য হবে তাই রঙচঙ মেখে ছাপিয়ে দিলাম, এরপর হয়ে গেলাম লেখক_ শিশুসাহিত্যিক বিষয়টি এত সোজা নয়।
শিশুরা বই পড়তে চাইছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এ যুগেও বাবা-মাকে জোর করে বইমেলায় নিয়ে আসছে_ এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। কিন্তু এই যে আমাদের নতুন প্রজন্ম, যারা বই পড়তে আগ্রহী, তাদের হাতে আমরা কোন বই তুলে দেব? বাংলা সাহিত্যের প্রথম পাঠ কেমন হবে, কেমন হবে তাদের জীবনের প্রাথমিক পাঠ_ আমাদের এখনই দেখতে হবে, ভাবতে হবে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে যেনতেন বই কিছু রঙ লাগিয়ে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হলো আর বিকল্প কিছু না থাকায় আমাদের শিশুরা তা কিনতে বাধ্য হলো_ এমন হলে চলবে না। বিষয়টিকে আমাদের অবশ্যই নজরদারিতে আনতে হবে। আমাদের আগামী প্রজন্ম, যাদের কাছে রয়েছে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার, তাদের প্রাথমিক পাঠ নিয়ে এত খামখেয়ালিপনায় ডুবে থাকলে চলবে না। সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার পর আফসোস করে লাভ হবে না, তাই এখনই এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশুদের হাতে যেমন তুলে দিতে হবে ভালো বই তেমনি যে কোনো বই যাতে বাজারে চলে না আসে এবং শিশুদের মেধা ও মননের ক্ষতি করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল দিতে হবে। ভালো ও সুন্দরের দিকে আমাদের শিশুদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। এ কাজ যত কঠিন আর পরিশ্রমসাধ্যই হোক না কেন আমাদের করতেই হবে, না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে, তখন কোনো অজুহাতই খাটবে না।
নূর কামরুন নাহার : কলাম লেখক
nurquamrunnaher@yahoo.com
No comments