ক্ষুধার্ত মানুষের জীবনের দামও কম? by প্রভাষ আমিন
বাঙালি নাকি খুব ইমোশনাল জাতি। কিন্তু
এই প্রশংসাটি আর সত্য বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশ তো সকালে স্বাভাবিক
জীবন-যাপন শুরু করেছে; অফিস-আদালত-শেয়ারবাজার খুলেছে; আমরা সবাই খেয়েদেয়ে,
শেভ করে, সেজেগুজে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।
যে দেশে একই সময়ে আগুনে পুড়ে ১১১ জন মানুষ কয়লা হয়ে যায় আর ফ্লাইওভারের
গার্ডার চাপা পড়ে ১৫ জন চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে যায়- সে দেশ স্বাভাবিক থাকে কী
করে; সে দেশে তো কান্নার রোল পড়ে যাওয়ার কথা। মিডিয়া আর টক শোর হৈচৈ ছাড়া
আর তো সব যেমন ছিল তেমনই আছে। শুধু ১২৬ জন মানুষ বিনা অপরাধে, বিনা দোষে
অপঘাতে মরে গেছে। এই ১২৬টি পরিবারের কান্না তো ছুঁয়ে যায়নি বাকি ১৬ কোটি
মানুষের হৃদয়।
আমরা লিখছি-বলছি আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর আর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে দুর্ঘটনা হয়েছে। দুর্ঘটনা বললেই মনে হয়, দুর্ঘটনা তো হতেই পারে, দুর্ঘটনার ওপর তো কারো হাত নেই। কিন্তু নিশ্চিন্তপুর আর বহদ্দারহাটে আসলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, যা ঘটেছে তা নির্মম হত্যাকাণ্ড। কিছু লোভী, অসৎ মানুষের বানানো মৃত্যুফাঁদে আটকে পড়ে মরে গেছে মানুষগুলো। নিশ্চিন্তপুর! নিশ্চিন্তপুরেই লোভী গার্মেন্টমালিক এমন একটি মৃত্যুফাঁদ বানিয়ে রেখেছেন! সেখানেই প্রতি দিন হাজার হাজার সস্তা শ্রমিক কাজ করে। নিশ্চিন্তপুরের অগ্নিকাণ্ডকে কেন আমি দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলছি? ৯ তলা এই ভবনটি কে বানিয়েছে, কে অনুমোদন দিয়েছে, আমরা জানি না। এই ভবনে যে বেরোনোর জন্য জরুরি পথ নেই, সেটা নিশ্চয়ই যারা বানিয়েছে, তারা জানে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী। এই ভবনটি যেখানে বানানো হয়েছে, সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার মতো প্রশস্ত পথ নেই। যা-ও কোনো রকমে যেতে পারে, তা-ও শুধু সামনের দিকে যেতে পারে। তাই ফায়ার সার্ভিস-কর্মীদের প্রাণান্ত চেষ্টার পরও ১৫ ঘণ্টা ধরে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে ১১১টি মানবদেহ। এমন জায়গায় যারা এমন একটি ভবন বানিয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী। আগুন লাগার পরপর অনেকে নামতে চেয়েছিল। কিন্তু গার্মেন্টের লোকজন বলেছে, তেমন কিছু হয়নি, যার যার কাজ করো। যাতে কেউ বেরোতে না পারে সে জন্য নাকি নিচতলার গেটও আটকে দেওয়া হয়েছিল। সময়মতো অর্ডার সাপ্লাই দেওয়ার জন্য যারা আগুন লাগার পরও মানুষকে বেরোতে দেয়নি, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী। পুড়ে যাওয়া ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরে ছোট ছোট ফায়ার এঙ্টিংগুইশার লাগানো ছিল, এত বড় ভবনের জন্য যা একদমই যথেষ্ট নয়। তার চেয়ে বড় কথা হলো, সব ফায়ার এঙ্টিংগুইশারই অক্ষত ছিল। কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। আসলে কেউ জানতই না কিভাবে সেগুলো ব্যবহার করা হয়; তাদের তা শেখানো হয়নি। আসলে সেই ফায়ার এঙ্টিংগুইশার লাগানো হয়েছিল বিদেশি বায়ারদের সন্তুষ্ট করার জন্য, শ্রমিকদের জীবন বাঁচানোর জন্য নয়। কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়া, আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছাড়া যারা শ্রমিকদের এই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাজে লাগিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী। তাজরিন ফ্যাশনের মালিক স্বীকার করেছেন, নতুন অর্ডার পেয়েছেন বলে তাঁর কারখানায় ৫০০ টন সুতা ছিল। গার্মেন্ট কারখানায় সুতা থাকবে, কাপড় থাকবে, পোশাক থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিয়ম হলো, কারখানার গোডাউন থাকবে টপ ফ্লোরে। কিন্তু তাজরিন ফ্যাশনে গোডাউন ছিল নিচতলায়। শুধু ৫০০ টন সুতা ৯ তলায় তোলার খরচ আর সময় বাঁচানোর জন্যই নিচতলায় গোডাউন রাখা হয়েছে। যারা নিচতলাকে গোডাউন বানিয়েছিলে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী।
চট্টগ্রামের ফ্লাইওভার ধসের ঘটনাটি অবশ্যই কোনো দুর্ঘটনা নয়। কারণ গত ২৯ জুন এই ফ্লাইওভারে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। প্রথম বলে তর্কের খাতিরে সেটিকে দুর্ঘটনা বলে মানতে রাজি আছি আমি। কিন্তু সেদিন শুক্রবার ও জুমার নামাজের সময় ছিল বলে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সে ঘটনায় তদন্ত হয়েছে। তাতে বাড়তি সতর্কতার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু কিছুই কেউ কানে তোলেনি। ভরা বাজারের ওপর নড়বড়ে ফ্লাইওভার। বাজার করতে বা বিকেলবেলায় ঘুরতে আসা মানুষের মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। পাঁচ মাসের মধ্যে যখন একই স্থানে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, এটা অবশ্যই হত্যাকাণ্ড। উদ্বোধনের পর ২০-৩০ বছর এই ফ্লাইওভারে লাখ লাখ গাড়ি চলার কথা। সেই ফ্লাইওভার যখন উদ্বোধনের দুই মাস আগে ধসে পড়ে, তখন তাকে দুর্ঘটনা বলা অন্যায়।
আমরা জানি, নিশ্চিন্তপুর আর বহদ্দারহাটের ঘটনায় মামলা হবে, তদন্ত হবে। এসবই হবে আসলে মানুষের দৃষ্টি অন্য খাতে সরাতে, মরে যাওয়া মানুষের স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে। এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। সেই মামলায় কি কেউ সাজা পেয়েছে? সেই সব তদন্তে কী হয়েছে? কেউ কি জানেন? ২৯ জুন ফ্লাইওভার ধসের ঘটনায় যদি কেউ সাজা পেত তাহলে হয়তো এবারের বিপর্যয় ঘটত না। আমরা বারবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। কিন্তু কখনোই সে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় না। হয় না বলেই লোভী আর অসৎ মানুষগুলো বারবার মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।
তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এই সাফল্যের পেছনে আছে আমাদের মানুষ, সস্তা মানুষ, অঢেল মানুষ, বোকা মানুষ, গরিব মানুষ। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য আমাদের দেশের গরিব মানুষগুলো, বিশেষ করে মহিলারা ঝাঁকে ঝাঁকে লোভী গার্মেন্টমালিকদের বানানো কারখানা নামের কারাগারে কাজে যায়। আমরা জানি, কাজের ক্ষেত্রটি সবার জন্যই হওয়া উচিত আনন্দের। কিন্তু আমাদের দেশে গার্মেন্ট মানেই কারাগার, গার্মেন্ট মানেই মৃত্যুফাঁদ। সেখানে সস্তা শ্রমিকদের শ্রমে-ঘামে-রক্তে বানানো পোশাক ইউরোপ-আমেরিকায় বিকোয় চড়া দামে। গাড়ির মডেল বদলায় গার্মেন্ট মালিকদের, প্রবৃদ্ধি হয় দেশের অর্থনীতির। কিন্তু বদলায় না সখিনাদের ভাগ্য। দুর্ঘটনার পরপর বিজিএমইএ ঘোষণা দিল, যারা মারা গেছে তাদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। আহা কী দয়ার শরীর মালিকদের! এক লাখ টাকা অনেক গার্মেন্টমালিকের এক সন্ধ্যার পার্টির বিল। আমাদের বোকা ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর শ্রমের দাম কম, তাই বলে জীবনের দামও? আমাদের দেশে মানুষ অনেক বেশি, তাই বলে তো যেভাবে-সেভাবে তাদের জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। আমাদের দেশে প্রায়ই নানা দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়, শয়ে শয়ে মারা যায়। একবার লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মানুষের জন্য মাথাপিছু ছাগল দেওয়ার ঘোষণাও এসেছিল। হায়রে! যারা এই এক লাখ টাকা দাম ধরল, তারা কি কখনো বুঝবে পুড়ে যাওয়া সখিনার সন্তানের কষ্ট? যে সন্তান তার মাকে ফোন করে বলল, মা, আমাকে বাঁচাও, আমি মরে যাচ্ছি। সেই মায়ের বুকের কষ্ট কি এক লাখ টাকায় লাঘব হবে? ঘটনার দিন তাজরিন ফ্যাশনের এক পরিচালক পোড়া ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, আমাদের এত কোটি টাকার সুতা পুড়ে গেছে, এত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মানুষ যেন তাঁর কাছে কিছু নয়। তাঁর যত ক্ষতি হয়েছে, সেই মায়ের ক্ষতি তো তার চেয়ে কম নয়। সন্তানের বাঁচার আকুতি সারা জীবন তার কানে বাজবে। মালিক তো তাঁর টাকা পেয়ে যাবেন ইনস্যুরেন্সের কাছ থেকে। সন্তান ছাড়া আর কিছুই তো সেই মায়ের ক্ষতি পূরণ করতে পারবে না। যাদের কাছে জীবনের চেয়ে সুতার দাম বেশি, বিল্ডিংয়ের দাম বেশি, তাদের রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। বসে বসে মধ্যবিত্তসুলভ আহা-উহু করলে আমাদের ভাই, আমাদের বোন, আমাদের সন্তানরা এভাবেই পুড়ে মরতে থাকবে।
২৬.১১.২০১২
probhash2000@gmail.com
আমরা লিখছি-বলছি আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর আর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে দুর্ঘটনা হয়েছে। দুর্ঘটনা বললেই মনে হয়, দুর্ঘটনা তো হতেই পারে, দুর্ঘটনার ওপর তো কারো হাত নেই। কিন্তু নিশ্চিন্তপুর আর বহদ্দারহাটে আসলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, যা ঘটেছে তা নির্মম হত্যাকাণ্ড। কিছু লোভী, অসৎ মানুষের বানানো মৃত্যুফাঁদে আটকে পড়ে মরে গেছে মানুষগুলো। নিশ্চিন্তপুর! নিশ্চিন্তপুরেই লোভী গার্মেন্টমালিক এমন একটি মৃত্যুফাঁদ বানিয়ে রেখেছেন! সেখানেই প্রতি দিন হাজার হাজার সস্তা শ্রমিক কাজ করে। নিশ্চিন্তপুরের অগ্নিকাণ্ডকে কেন আমি দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলছি? ৯ তলা এই ভবনটি কে বানিয়েছে, কে অনুমোদন দিয়েছে, আমরা জানি না। এই ভবনে যে বেরোনোর জন্য জরুরি পথ নেই, সেটা নিশ্চয়ই যারা বানিয়েছে, তারা জানে। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী। এই ভবনটি যেখানে বানানো হয়েছে, সেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার মতো প্রশস্ত পথ নেই। যা-ও কোনো রকমে যেতে পারে, তা-ও শুধু সামনের দিকে যেতে পারে। তাই ফায়ার সার্ভিস-কর্মীদের প্রাণান্ত চেষ্টার পরও ১৫ ঘণ্টা ধরে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে ১১১টি মানবদেহ। এমন জায়গায় যারা এমন একটি ভবন বানিয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী। আগুন লাগার পরপর অনেকে নামতে চেয়েছিল। কিন্তু গার্মেন্টের লোকজন বলেছে, তেমন কিছু হয়নি, যার যার কাজ করো। যাতে কেউ বেরোতে না পারে সে জন্য নাকি নিচতলার গেটও আটকে দেওয়া হয়েছিল। সময়মতো অর্ডার সাপ্লাই দেওয়ার জন্য যারা আগুন লাগার পরও মানুষকে বেরোতে দেয়নি, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী। পুড়ে যাওয়া ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরে ছোট ছোট ফায়ার এঙ্টিংগুইশার লাগানো ছিল, এত বড় ভবনের জন্য যা একদমই যথেষ্ট নয়। তার চেয়ে বড় কথা হলো, সব ফায়ার এঙ্টিংগুইশারই অক্ষত ছিল। কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। আসলে কেউ জানতই না কিভাবে সেগুলো ব্যবহার করা হয়; তাদের তা শেখানো হয়নি। আসলে সেই ফায়ার এঙ্টিংগুইশার লাগানো হয়েছিল বিদেশি বায়ারদের সন্তুষ্ট করার জন্য, শ্রমিকদের জীবন বাঁচানোর জন্য নয়। কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়া, আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছাড়া যারা শ্রমিকদের এই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাজে লাগিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী। তাজরিন ফ্যাশনের মালিক স্বীকার করেছেন, নতুন অর্ডার পেয়েছেন বলে তাঁর কারখানায় ৫০০ টন সুতা ছিল। গার্মেন্ট কারখানায় সুতা থাকবে, কাপড় থাকবে, পোশাক থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিয়ম হলো, কারখানার গোডাউন থাকবে টপ ফ্লোরে। কিন্তু তাজরিন ফ্যাশনে গোডাউন ছিল নিচতলায়। শুধু ৫০০ টন সুতা ৯ তলায় তোলার খরচ আর সময় বাঁচানোর জন্যই নিচতলায় গোডাউন রাখা হয়েছে। যারা নিচতলাকে গোডাউন বানিয়েছিলে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অবশ্যই তারা দায়ী।
চট্টগ্রামের ফ্লাইওভার ধসের ঘটনাটি অবশ্যই কোনো দুর্ঘটনা নয়। কারণ গত ২৯ জুন এই ফ্লাইওভারে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। প্রথম বলে তর্কের খাতিরে সেটিকে দুর্ঘটনা বলে মানতে রাজি আছি আমি। কিন্তু সেদিন শুক্রবার ও জুমার নামাজের সময় ছিল বলে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সে ঘটনায় তদন্ত হয়েছে। তাতে বাড়তি সতর্কতার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু কিছুই কেউ কানে তোলেনি। ভরা বাজারের ওপর নড়বড়ে ফ্লাইওভার। বাজার করতে বা বিকেলবেলায় ঘুরতে আসা মানুষের মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। পাঁচ মাসের মধ্যে যখন একই স্থানে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, এটা অবশ্যই হত্যাকাণ্ড। উদ্বোধনের পর ২০-৩০ বছর এই ফ্লাইওভারে লাখ লাখ গাড়ি চলার কথা। সেই ফ্লাইওভার যখন উদ্বোধনের দুই মাস আগে ধসে পড়ে, তখন তাকে দুর্ঘটনা বলা অন্যায়।
আমরা জানি, নিশ্চিন্তপুর আর বহদ্দারহাটের ঘটনায় মামলা হবে, তদন্ত হবে। এসবই হবে আসলে মানুষের দৃষ্টি অন্য খাতে সরাতে, মরে যাওয়া মানুষের স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে। এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। সেই মামলায় কি কেউ সাজা পেয়েছে? সেই সব তদন্তে কী হয়েছে? কেউ কি জানেন? ২৯ জুন ফ্লাইওভার ধসের ঘটনায় যদি কেউ সাজা পেত তাহলে হয়তো এবারের বিপর্যয় ঘটত না। আমরা বারবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। কিন্তু কখনোই সে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় না। হয় না বলেই লোভী আর অসৎ মানুষগুলো বারবার মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।
তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এই সাফল্যের পেছনে আছে আমাদের মানুষ, সস্তা মানুষ, অঢেল মানুষ, বোকা মানুষ, গরিব মানুষ। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য আমাদের দেশের গরিব মানুষগুলো, বিশেষ করে মহিলারা ঝাঁকে ঝাঁকে লোভী গার্মেন্টমালিকদের বানানো কারখানা নামের কারাগারে কাজে যায়। আমরা জানি, কাজের ক্ষেত্রটি সবার জন্যই হওয়া উচিত আনন্দের। কিন্তু আমাদের দেশে গার্মেন্ট মানেই কারাগার, গার্মেন্ট মানেই মৃত্যুফাঁদ। সেখানে সস্তা শ্রমিকদের শ্রমে-ঘামে-রক্তে বানানো পোশাক ইউরোপ-আমেরিকায় বিকোয় চড়া দামে। গাড়ির মডেল বদলায় গার্মেন্ট মালিকদের, প্রবৃদ্ধি হয় দেশের অর্থনীতির। কিন্তু বদলায় না সখিনাদের ভাগ্য। দুর্ঘটনার পরপর বিজিএমইএ ঘোষণা দিল, যারা মারা গেছে তাদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। আহা কী দয়ার শরীর মালিকদের! এক লাখ টাকা অনেক গার্মেন্টমালিকের এক সন্ধ্যার পার্টির বিল। আমাদের বোকা ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর শ্রমের দাম কম, তাই বলে জীবনের দামও? আমাদের দেশে মানুষ অনেক বেশি, তাই বলে তো যেভাবে-সেভাবে তাদের জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। আমাদের দেশে প্রায়ই নানা দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়, শয়ে শয়ে মারা যায়। একবার লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া মানুষের জন্য মাথাপিছু ছাগল দেওয়ার ঘোষণাও এসেছিল। হায়রে! যারা এই এক লাখ টাকা দাম ধরল, তারা কি কখনো বুঝবে পুড়ে যাওয়া সখিনার সন্তানের কষ্ট? যে সন্তান তার মাকে ফোন করে বলল, মা, আমাকে বাঁচাও, আমি মরে যাচ্ছি। সেই মায়ের বুকের কষ্ট কি এক লাখ টাকায় লাঘব হবে? ঘটনার দিন তাজরিন ফ্যাশনের এক পরিচালক পোড়া ভবনের পাশে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, আমাদের এত কোটি টাকার সুতা পুড়ে গেছে, এত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মানুষ যেন তাঁর কাছে কিছু নয়। তাঁর যত ক্ষতি হয়েছে, সেই মায়ের ক্ষতি তো তার চেয়ে কম নয়। সন্তানের বাঁচার আকুতি সারা জীবন তার কানে বাজবে। মালিক তো তাঁর টাকা পেয়ে যাবেন ইনস্যুরেন্সের কাছ থেকে। সন্তান ছাড়া আর কিছুই তো সেই মায়ের ক্ষতি পূরণ করতে পারবে না। যাদের কাছে জীবনের চেয়ে সুতার দাম বেশি, বিল্ডিংয়ের দাম বেশি, তাদের রুখে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। বসে বসে মধ্যবিত্তসুলভ আহা-উহু করলে আমাদের ভাই, আমাদের বোন, আমাদের সন্তানরা এভাবেই পুড়ে মরতে থাকবে।
২৬.১১.২০১২
probhash2000@gmail.com
No comments