নরেন বিশ্বাস :স্মৃতিতে অম্লান by নিমাই মণ্ডল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-জীবনের প্রথম ক্লাসে শিক্ষক হিসেবে যাকে পেয়েছিলাম তিনি আমার প্রিয়তম শিক্ষক খ্যাতিমান আবৃত্তি ও উচ্চারণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস। পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত, শ্মশ্রুমণ্ডিত এই মানুষটির বাকভঙ্গি, শব্দ চয়ন এবং শব্দ প্রক্ষেপণের জাদুতে ক্লাস কখন শেষ হয়েছিল বুঝতেই পারিনি।
দারুণ ভালো লাগা নিয়ে সেদিন হলে ফিরেছিলাম। এই মুগ্ধতা শুধু শ্রেণীকক্ষেই নয়; আবৃত্তি কর্মশালা, নাট্য কর্মশালা কিংবা উচ্চারণ শিক্ষার ক্লাস_ সবখানেই তাকে ঘিরে আবর্তিত হতো। যারা কখনও, কোথাও একবার তার বক্তৃতা বা আবৃত্তি শুনেছেন, তারা এর সত্যতা স্বীকার করবেন।
নরেন বিশ্বাস তার সারা জীবনের সমস্ত কর্মপ্রবাহ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেবায় উৎসর্গ করে গেছেন। কঠিন বিষয়কে সহজ, প্রাণবন্ত ও সরস উপস্থাপনে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাই অলঙ্কার, কাব্যতত্ত্ব, ব্যাকরণ কিংবা উচ্চারণের মতো নীরস বিষয়কেও তিনি শ্রোতাদের কাছে অনায়াস দক্ষতায় অসম্ভব প্রিয় করে তুলতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে তার কণ্ঠস্বর পালন করত সহযোগী ভূমিকা। শ্রেণীকক্ষে বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক আবৃত্তি ছিল তার পাঠদানের নিজস্ব ধরন। স্মৃতিশক্তিও ছিল প্রখর। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং অন্যান্য আধুনিক কবির কবিতা তো বটেই; 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর মতো গ্রন্থেরও সর্গের পর সর্গ ছিল তার মুখস্থ। তার আবৃত্তি পারঙ্গমতার সবচেয়ে উজ্জ্বল ও শেষ উদাহরণটি সম্ভবত ছিল ১৯৯৮ সালের ১৯ জুলাই তারিখের 'কথন ও প্রিয় পঙ্ক্তিমালা' শীর্ষক একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান। প্রায় দৃষ্টিহীন আবৃত্তিকার নরেন বিশ্বাস সম্পূর্ণ স্মৃতিনির্ভর হয়ে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদাবলি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কবিদের কবিতা শুনিয়েছিলেন দুই ঘণ্টাধিক কাল।
ঢাকা শহর তো বটেই; বিভাগীয় কিংবা জেলা শহর, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তিনি আবৃত্তি, নাটক, উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতা দিয়েছেন। 'অলঙ্কার অন্বেষা', 'কাব্যতত্ত্ব অন্বেষা', 'ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব'-এর মতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার অমর কীর্তি 'বাঙলা উচ্চারণ অভিধান'। সেখানে তিনি পরম মমতা ও দারুণ শ্রমে ত্রিশ হাজার বাংলা শব্দের প্রমিত উচ্চারণ নির্দেশ করে গেছেন। তার আরেকটি অবিস্মরণীয় কাজ 'ঐতিহ্যের অঙ্গীকার' ক্যাসেটমালা। বাংলা সাহিত্যের সুনির্বাচিত অংশ নিয়ে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালে মোট ১৩টি অডিও ক্যাসেট প্রকাশ করেছিলেন। এতে ধারণ করা হয়েছিল চর্যাপদ থেকে মেঘনাদবধ কাব্য পর্যন্ত হাজার বছরের কবিতা; চারশ' বছরের পুরনো বাংলা গদ্য; লেবেদেফ থেকে দীনবন্ধু মিত্র পর্যন্ত ৫টি নাটক; চর্যাগীতি থেকে লালনগীতি পর্যন্ত হাজার বছরের বাংলা গান; রবীন্দ্র নাট্যকাব্য, কবিতা; নজরুল কবিতা; কিশোর কবিতা; রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতা; মুক্তিযুদ্ধের কবিতা; গিরিশচন্দ্রের প্রফুল্ল ও দ্বিজেন্দ্রলালের সাজাহান নাটক। এ ছাড়াও তিনি স্বকণ্ঠে বাঙলা উচ্চারণ সূত্র, বাঙলা উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতামালা এবং প্রিয় পঙ্ক্তিমালা শীর্ষক একক আবৃত্তির ক্যাসেট প্রকাশ করে জাতিকে ঋণী করে গেছেন।
বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা ছিল নরেন বিশ্বাসের। নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল না করে এই মানুষটি জাতির উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন নিরন্তর। তাই অকালেই তার দেহে বাসা বেঁধেছিল ডায়াবেটিস। পরিণামে কিডনি রোগ এবং অন্ধত্ব বরণ করে ১৯৯৮ সালের ২৭ নভেম্বর মাত্র ৫৩ বছর বয়সে তার দেহাবসান ঘটে। শুধু জীবনেই নয়; মরণেও তিনি দেশের সেবা করে গেছেন জীবদ্দশায় তার মরদেহকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগে দান করে। অধ্যাপক নরেন বিশ্বাসের চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার গভীর শ্রদ্ধা।
nemaimondal@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.