ফরিদা বারি বীথি : রবীন্দ্রময় যার সত্তা by সৈয়দ ইকবাল

দেশ ভাগ হওয়ার পর, নব্য পূর্ব পাকিস্তানে এক বিপরীত স্রোতে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে প্রাণপণ চেষ্টা হচ্ছিল বধের, ঠিক তখন যারা যুদ্ধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান ধরে রাখার তাদের প্রথম সারিতে ফরিদা বারি মালিক বীথি ছিলেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীতেই রয়েছে বাঙালির সব অনুভূতি ছুঁয়ে যাওয়ার ক্ষমতা_ এ বিশ্বাসই ছিল তার আজীবন। ষাটের দশকের শুরু থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে প্রাণে ধারণ করে এগিয়েছেন তিনি। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান আসত অন্তঃপ্রাণ থেকে এক অন্যরূপে। যারা তার গুণমুগ্ধ ছিলেন, কণ্ঠ আর গায়কীতে তারা আজ স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। যেমন_ শিল্পী কলিম শরাফী, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান, জামিল চৌধুরী, ড. অনুপম সেন, সুরকার আজাদ রহমান, শিল্পী হাশেম খানসহ অনেকে।
হাশেম খান তার বইয়ে লিখেছেন ফরিদা বারি বীথির কথা। তিনি লিখেছেন, কী মমত্ববোধ থেকে বীথি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে ঢাকার বাইরে ছুটতেন শুধু ছোট শহর আর গ্রামে রবীন্দ্রনাথকে আরও ছড়িয়ে দিতে। বিস্তারিত করতে রবীন্দ্র বারতা।
হয়তো তার ছোটবেলা আর বালিকাবেলা কেটেছে শান্তিনিকেতনে। হয়তো মা ফিরোজা বারির শিক্ষাজীবন কেটেছে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ছাত্রী হিসেবে সে কারণে। বাবা মালিক আবদুল বারি রবীন্দ্রনাথের অনুসারী ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য ছিলেন। দেশ ভাগের পর যাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কলকাতা ছেড়ে চলে আসতে হয় চট্টগ্রামে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম পোর্ট ট্রাস্ট তার হাতেই গড়া। একই সঙ্গে চেয়ারম্যান ছিলেন রেলের আর পোর্ট ট্রাস্টের। হাতেগোনা দুই-চারজন পর্দানশিন ছাত্রীর মধ্যে তার মেয়ে ফরিদা বারি মালিক বীথি ছিলেন ব্যতিক্রম। পরতেন সাধারণ শাড়ি, কপালে থাকত কালো টিপ, রবীন্দ্রসঙ্গীত করতেন চট্টগ্রাম কলেজসহ অন্যান্য মঞ্চে।
১৯৬১ সালে আবদুল বারি মালিক তার কর্মস্থলের ডেপুটি আরএন বাগচীকে নিয়ে সরকারি বড় এক কর্মকর্তা হয়ে নিজের সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আয়োজন করেন চট্টগ্রাম সেন্ট প্লাসিড স্কুলের বিশাল হলে ৮ দিনব্যাপী 'রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উৎসব'। আজ ১৫০তম রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীলগ্নে এখনও মালিক আবদুল বারি এবং আরএন বাগচীর ৮ দিনব্যাপী সেই রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এমনতর বাবা-মায়ের মেয়ে ফরিদা বারি মালিক বীথি কীভাবে চুপ থাকতে পারেন নিজের প্রাণের ভাষা বাংলার ওপর উর্দুর আক্রমণ এলে!
ফরিদা বারি মালিক বীথি তখন চট্টগ্রাম কলেজের পর শান্তিনিকেতন থেকে অনার্স শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন। নারী ভাষাসংগ্রামী হিসেবে নিজের দায়িত্ব মনে করে নিজ খরচায় পোস্টার-ফেস্টুন তৈরি করে ছাত্রী সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাজপথে মিছিল বের করেন এবং রাস্তা থেকে পুলিশের হাতে অ্যারেস্ট হয়ে জেলে যান। একই কারণে জেলে তার সঙ্গী হয়েছিলেন। 'জীবনে আর এ কাজ করব না' মুচলেকা দিয়ে সেই সময় জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন সবাই। একমাত্র ফরিদা বারি মালিক গোঁ ধরে বসেছিলেন, পুলিশি খাতায় সাইন করে মুক্তি চাই না। জেদি এ নারীকর্মীকে পুলিশ শেষ পর্যন্ত মুচলেকা ছাড়াই সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিল।
ফরিদা বারি মালিক বীথি ও জহরত আরার নেতৃত্বে মিছিলের ছবিটি সেই সময় তুলেছিলেন ড. রফিকুল ইসলাম নিজের ক্যামেরায়। তা যুগ যুগ ধরে একুশে ফেব্রুয়ারি বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয়ে আসছে বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিকসহ অনেক প্রকাশনায়, অথচ শিরোনামহীনভাবে। এমনকি ২০১১ সালের বেঙ্গল ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ঢাউস আকারের পত্রিকা 'বেঙ্গল বারতা' ছবিটি দিয়ে বিরাট প্রচ্ছদ করেছে শিরোনামহীনভাবে। অবাক লাগে, যাদের সাহসিকতায় দেশ আজ অশুভ শক্তি পরাজিত করে নতুন প্রজন্মের জন্য এটুকু সুবাতাস এনে দিয়েছে তাদের নামটি পর্যন্ত খুঁজে নিতে আমরা ক্লান্তিবোধ করি। আজ রবীন্দ্র জন্ম সার্ধশতবর্ষ উদযাপনের আগে একবার স্মরণ করে না কেউ যে, ৫০ বছর আগে ধর্মঝড়ে চরের মতো ভেসে ওঠা এক দেশের অন্ধকার যুগে শুধু অন্তরে বরীন্দ্রশক্তির জোরেই ৮ দিনব্যাপী রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উৎসব করে দেখিয়েছিলেন মালিক আবদুল বারি, আরএন বাগচী আর সহযোগী ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ফরিদা বারি মালিক বীথি_ একমাত্র রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া যিনি জীবনে অন্য কোনো গান গাননি। ছায়ানটের প্রথম দিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। তার মেধাবী ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন সেলিনা মালেক, ইফফাত আরা দেওয়ান ও নাসরীন বাহার। তার কালে অন্যান্য স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন কলিম শরাফী, সন্জীদা খাতুন, আফসারী খানম, মালেকা আজিম, আতিকুল ইসলাম ও বিলকিস নাসিরুদ্দীন।
স্বাধীন বাংলাদেশে এক বিশাল রবীন্দ্র জগৎ তৈরি হয়েছে যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উঁচু হয়ে আকাশ ছুঁয়েছে। এতেই এ মহাপ্রাণদের আত্মার আনন্দ। তাদের স্মরণ করা যায়। তুচ্ছ নামের জালে আটকে আর কী হবে?
 

No comments

Powered by Blogger.