পরিবেশ-হাওরের নিরুদ্দেশ পরিসংখ্যান by পাভেল পার্থ
চার বছর ধরে চেষ্টা করছি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরপাড়ের হাজং গ্রামগুলোতে কার্তিক মাসে চরমাগা গান শুনব। কিন্তু কয়েক বছর ধরে এ সময়টাতে সীমান্তবর্তী হাজং গ্রামের পুরুষদের অনেককেই পাচ্ছি না।
হেমন্তের দিন আসতে না আসতেই হাওর শূন্য করে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় হাজং, মান্দি, লেঙ্গাম কি বাঙালি পুরুষরা। বর্ষার দিনে আবার ফিরে আসে গ্রামে। হাজং গ্রামগুলোতে আগে শুকনো মৌসুমে ঘটা করে চরমাগা, দেওয়ালি, নবান ও বাস্তপূজা হতো। এখন হয় না। পরিবারের অধিকাংশই নিরুদ্দেশ থাকলে কি আর উৎসব জমে ওঠে? বাংলাদেশ কি ভারতের প্রবল সীমান্ত পাহারার ভেতর জীবনের যাবতীয় ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের হাওরের জনগণ আজ নিজের শরীর বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়লা ও পাথরখনিতে। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, ধরমপাশা, বিশ্বম্ভরপুর ও সদর এবং নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা অঞ্চলে হাওরবাসীর এই নিরুদ্দেশযাত্রা শুরু হয়েছে প্রায় হঠাৎ করেই; রাষ্ট্রের এক অন্যায় উন্নয়ন আঘাতের ফলাফল হিসেবে। কারণ, হাওরে এখন কোনো কাজ নেই। খাদ্য ফলানোর জমি নেই। মাছ ধরার জলপ্রবাহ নেই। বছর বছর মেঘালয় পাহাড়ের পাহাড়ি বালি আর আবর্জনায় খুন হয়ে যাচ্ছে হাওরের একরের পর একর জমি আর জলপ্রবাহ। হাওরের অধিকাংশ বিল-জলাশয় আজ ইজারা নিয়ে দখল করে রেখেছে ধনী আর প্রভাবশালীরা। যে হাওরাঞ্চলে এককালে ধান কাটতে মানিকগঞ্জ-নরসিংদী-ভৈরব কি দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসত মানুষ, সেই হাওরবাসীই আজ জীবিকার সন্ধানে হাওর থেকে প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরের পলাশ ইউনিয়নের প্রায় সব ঘর শূন্য করে সবাই চলে যেতে বাধ্য হয়েছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জের পাথর কোয়ারিতে। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাথর ও কয়লাখনিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। অনেকেই জীর্ণ জীবনটা নিয়ে কোনোমতে ফিরে আসে, অনেকেই চলে যায় কয়লা কি পাথরের স্তূপের তলায়। তারপর আর কেউ তাদের খবর জানে না। নিরুদ্দেশ মানুষের জন্য এক অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া হাওরবাসীর আর কী-ই বা করার আছে?
আমরা চলতি আলাপ শুরু করেছি দেশের সবচেয়ে বড় খাদ্য উৎপাদনকারী এলাকা হাওর নিয়ে, যেখানকার মানুষ আজ খাদ্যের সন্ধানে ভাটির দুনিয়া থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ নদীমাতৃক বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগজুড়েই হাওর জলাভূমি। বাংলাদেশে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড দেশে ৪১৪টি হাওর আছে বলে তাদের এক দলিলে উল্লেখ করে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪২৩টি হাওর রয়েছে। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৬০টি উপজেলার ৫৩৯টি ইউনিয়নে বিস্তৃত হাওরাঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। ধান আর মাছ দিয়ে হাওর বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের শরীর। হাওরের রাধারমণ, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, শীতালং শাহ, আরকুম শাহ, দূরবীন শাহ, জালালের মতো কারিগরদের জ্ঞান ও মূর্ছনায় নিরন্তর প্রাণ পায় বাংলাদেশ। কয়লা, পাথর, বালি, গ্যাস ও তেল সরবরাহ করে হাওর। এখানেই আছে দুনিয়ার দুর্লভ মিষ্টিপানির জলাবনের অবশেষ চিহ্নগুলো। দেশকে এত যে বিলায়, সেই হাওরের দুর্দশা আর কাটে না। রাষ্ট্র হাওরের জল-দানা আর সুরে বাঁচে, অথচ নির্দয়ের মতো হাওরকে বারবার বঞ্চিত করে রাখে।
হাওরবাসী জনগণ কৃষি, মৎস্যসহ হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহারের ভেতর দিয়েই এককালে গড়ে তুলেছিল স্বনির্ভর হাওরজীবন। হাওর জনপদের মানুষের সেই সার্বভৌমত্বের হাওরজীবন আজ বিপন্ন ও বিলীন। জলাভূমির অন্যায় ইজারা, ভূপ্রাকৃতিক ও জলবায়ু বিপর্যয়, করপোরেট কৃষির বিস্তার, উজানে বাঁধ ও খনি প্রকল্প, বাণিজ্যিক আগ্রাসন, প্রতিবেশীয় নীতি ও সনদের লঙ্ঘন, হাওর প্রাণ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে বিবেচনা না করা_ সব মিলিয়ে হাওর আজ আর তার স্বপ্রতিবেশ এবং পরিবেশে বিরাজিত নেই। হাওরবাসী জনগণ হাওরের জন্য এক সমন্বিত হাওর নীতিমালা ও পরিকল্পনার কথা বলে আসছে সুদীর্ঘকাল। সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড হাওরের জন্য সেই আকাঙ্ক্ষিত 'মাস্টারপ্ল্যান'টি তৈরি করেছে। ২০১২ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত তিন খণ্ডের এই হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার কোথাও হাওরের দুর্ভোগের অন্যতম প্রধান আন্তঃরাষ্ট্রিক কারণটিকে কোনো ধরনের বিবেচনাই করা হয়নি। হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনায়ও দেখা যাচ্ছে, হাওরের সমস্যা ও জনজীবনের গণিতকে 'নিরুদ্দেশ' ও আড়াল করা হয়েছে দুর্ধর্ষ কায়দায়।
উত্তর-পূর্ব হাইড্রোলজিক্যাল রিজিয়নের ভোগাই, সুমেশ্বরী, উমিয়াম, নয়াগাং (খাসিয়ামারা), জালুখালি (চলতি), নিতাই, চিতল, যাদুকাটা-রক্তি, সুরমা, কুশিয়ারা, ধলা, সারী-গোয়াইন, পিআইন, সোনাই-বরদল, মনু, ধলাই, জুড়ী, লংলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, কোরাঙ্গী ভারতীয় এলাকা থেকে উৎপন্ন এই ২২টি নদী ও সীমান্তবর্তী পাহাড় থেকে নেমে আসা নানা পাহাড়ি ছড়ার জলধারাই আমাদের সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জ-সিলেট-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার এলাকার হাওর জলাভূমির জলের মূল উৎস। এককালে পাহাড়ি এলাকা থেকে বৃষ্টির পানি নেমে হাওর এলাকায় বর্ষায় তৈরি করত ঋতুভিত্তিক বন্যা; আর ওই বন্যার সঙ্গে মানুষের এক ধরনের অভিজ্ঞতার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু চলতি সময়ে এ নিয়মরীতি সব ভেঙে গেছে, এখন যখন-তখন যে কোনো জায়গা দিয়েই যে কোনো হাওরেই নামে পাহাড়ি ঢলের পানি। কারণ, মেঘালয় পাহাড়ে বৃষ্টির জলকে ধারণ করার মতো প্রাকৃতিক বনভূমির আচ্ছাদন নেই। পাশাপাশি কয়লা আর পাথরখনির জন্য এলোপাতাড়ি পাহাড় খননের ফলে এসব পাহাড় ভেঙে পাহাড়ি ছড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের একটির পর একটি হাওর নিরুদ্দেশ করে দিচ্ছে। নেত্রকোনার প্রধান নদী সোমেশ্বরী, মহাদেও, লেঙ্গুরা, কংশ, উবদাখালী শুকিয়ে চর পড়ে ভরাট হয়ে বছরে আট মাস নদীতে পানি না থাকায় এবং চর পড়ায় নদীগুলো সমানে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। সিমসাং বা সোমেশ্বরী নদীর প্রায় ২০ ভাগ বেদখল হয়ে গেছে। চোখের সামনে মেঘালয় পাহাড়ের বালির স্তূপে নিহত হয়েছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের অন্যতম পচাশোল হাওর ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পাথরচাওলীর হাওর। নিদারুণভাবে ২০০৮ সালের ২০ জুলাই মেঘালয় পাহাড় ভেঙে বালি আর পাথরের স্তূপে তলিয়ে গেছে তাহিরপুর সীমান্তের গ্রাম আর কৃষিজমি। দেশের দ্বিতীয় রামসার অঞ্চল টাঙ্গুয়ার হাওরের কাছাকাছি পাথর ও কয়লাখনির পাশাপাশি পশ্চিম খাসি পাহাড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম খনি প্রকল্প।
এভাবেই উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে অন্যায়ভাবে পাথর-কয়লা-ইউরেনিয়াম খনিসহ একটার পর একটা বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সরাসরি আঘাত হানছে বাংলাদেশের ভাটিতে, হাওরাঞ্চলে। তাই এখান থেকে মানুষ, হাওর, কৃষিজমি, গ্রাম, প্রাণবৈচিত্র্য কি হাওরের বহমান জীবনধারা নিরন্তর প্রশ্নহীন কায়দায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী বৈঠকের একটিতেও আমরা এসব অন্যায় আর দুর্ভোগ নিয়ে কোনো আলোচনা উত্থাপিত হতে দেখিনি। সার্ক কি ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃরাষ্ট্রিক সংলাপেও বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি কোনোকালে। যেন হাওরাঞ্চলের এই নিরুদ্দেশযাত্রা এক অবিরাম রাষ্ট্রীয় নিয়তি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য অঞ্চল হাওরের ও হাওরবাসী জনগণের শরীর ও মগজের সীমানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র বাধ্য। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে তথাকথিত উন্নয়ন বাহাদুরি বন্ধ না হলে হাওরের নিরুদ্দেশযাত্রা কোনোকালেই থামবে না। হাওরের এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও ব্যাখ্যাকে দাবিয়ে রেখে কোনোভাবেই হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাষ্ট্র কেন জানবে না তার হাওর, তার ভূগোল, তার কৃষিজমি, তার মহাশোল কি নানিদ মাছ, তার গভীর পানির ধান জাত কি তার মানুষজন কীভাবে আছে, কোথায় আছে, কেমন আছে? হাওরের নিরুদ্দেশ অভিযাত্রাকে বিবেচনা না করে রাষ্ট্র কোন হিসেবে হাওর মহাপরিকল্পনা করে? হাওরাঞ্চলের নির্দয় নিরুদ্দেশযাত্রাকে প্রশ্ন করে আসুন, আমরা সবাই মিলে হাওরের পাশে দাঁড়াই। কারণ, এই হাওরাঞ্চলই অন্যায় নানকার প্রথা কি টংক প্রথার বিরুদ্ধে, ভাসান পানিতে সবার প্রবেশাধিকারের দাবিতে বারবার গর্জে ওঠার সাহস জুগিয়েছে বাংলাদেশকে। হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে নিরুদ্দেশ হওয়া থেকে হাওরকে বাঁচানোর দায়িত্ব সবার। আমরা কি এখন থেকেই সেই আওয়াজ তুলতে পারি?
পাভেল পার্থ :গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
animistbangla@gmail..com
আমরা চলতি আলাপ শুরু করেছি দেশের সবচেয়ে বড় খাদ্য উৎপাদনকারী এলাকা হাওর নিয়ে, যেখানকার মানুষ আজ খাদ্যের সন্ধানে ভাটির দুনিয়া থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ নদীমাতৃক বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগজুড়েই হাওর জলাভূমি। বাংলাদেশে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড দেশে ৪১৪টি হাওর আছে বলে তাদের এক দলিলে উল্লেখ করে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪২৩টি হাওর রয়েছে। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৬০টি উপজেলার ৫৩৯টি ইউনিয়নে বিস্তৃত হাওরাঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। ধান আর মাছ দিয়ে হাওর বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের শরীর। হাওরের রাধারমণ, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, শীতালং শাহ, আরকুম শাহ, দূরবীন শাহ, জালালের মতো কারিগরদের জ্ঞান ও মূর্ছনায় নিরন্তর প্রাণ পায় বাংলাদেশ। কয়লা, পাথর, বালি, গ্যাস ও তেল সরবরাহ করে হাওর। এখানেই আছে দুনিয়ার দুর্লভ মিষ্টিপানির জলাবনের অবশেষ চিহ্নগুলো। দেশকে এত যে বিলায়, সেই হাওরের দুর্দশা আর কাটে না। রাষ্ট্র হাওরের জল-দানা আর সুরে বাঁচে, অথচ নির্দয়ের মতো হাওরকে বারবার বঞ্চিত করে রাখে।
হাওরবাসী জনগণ কৃষি, মৎস্যসহ হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবহারের ভেতর দিয়েই এককালে গড়ে তুলেছিল স্বনির্ভর হাওরজীবন। হাওর জনপদের মানুষের সেই সার্বভৌমত্বের হাওরজীবন আজ বিপন্ন ও বিলীন। জলাভূমির অন্যায় ইজারা, ভূপ্রাকৃতিক ও জলবায়ু বিপর্যয়, করপোরেট কৃষির বিস্তার, উজানে বাঁধ ও খনি প্রকল্প, বাণিজ্যিক আগ্রাসন, প্রতিবেশীয় নীতি ও সনদের লঙ্ঘন, হাওর প্রাণ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে বিবেচনা না করা_ সব মিলিয়ে হাওর আজ আর তার স্বপ্রতিবেশ এবং পরিবেশে বিরাজিত নেই। হাওরবাসী জনগণ হাওরের জন্য এক সমন্বিত হাওর নীতিমালা ও পরিকল্পনার কথা বলে আসছে সুদীর্ঘকাল। সম্প্রতি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড হাওরের জন্য সেই আকাঙ্ক্ষিত 'মাস্টারপ্ল্যান'টি তৈরি করেছে। ২০১২ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত তিন খণ্ডের এই হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার কোথাও হাওরের দুর্ভোগের অন্যতম প্রধান আন্তঃরাষ্ট্রিক কারণটিকে কোনো ধরনের বিবেচনাই করা হয়নি। হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনায়ও দেখা যাচ্ছে, হাওরের সমস্যা ও জনজীবনের গণিতকে 'নিরুদ্দেশ' ও আড়াল করা হয়েছে দুর্ধর্ষ কায়দায়।
উত্তর-পূর্ব হাইড্রোলজিক্যাল রিজিয়নের ভোগাই, সুমেশ্বরী, উমিয়াম, নয়াগাং (খাসিয়ামারা), জালুখালি (চলতি), নিতাই, চিতল, যাদুকাটা-রক্তি, সুরমা, কুশিয়ারা, ধলা, সারী-গোয়াইন, পিআইন, সোনাই-বরদল, মনু, ধলাই, জুড়ী, লংলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, কোরাঙ্গী ভারতীয় এলাকা থেকে উৎপন্ন এই ২২টি নদী ও সীমান্তবর্তী পাহাড় থেকে নেমে আসা নানা পাহাড়ি ছড়ার জলধারাই আমাদের সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জ-সিলেট-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার এলাকার হাওর জলাভূমির জলের মূল উৎস। এককালে পাহাড়ি এলাকা থেকে বৃষ্টির পানি নেমে হাওর এলাকায় বর্ষায় তৈরি করত ঋতুভিত্তিক বন্যা; আর ওই বন্যার সঙ্গে মানুষের এক ধরনের অভিজ্ঞতার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু চলতি সময়ে এ নিয়মরীতি সব ভেঙে গেছে, এখন যখন-তখন যে কোনো জায়গা দিয়েই যে কোনো হাওরেই নামে পাহাড়ি ঢলের পানি। কারণ, মেঘালয় পাহাড়ে বৃষ্টির জলকে ধারণ করার মতো প্রাকৃতিক বনভূমির আচ্ছাদন নেই। পাশাপাশি কয়লা আর পাথরখনির জন্য এলোপাতাড়ি পাহাড় খননের ফলে এসব পাহাড় ভেঙে পাহাড়ি ছড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের একটির পর একটি হাওর নিরুদ্দেশ করে দিচ্ছে। নেত্রকোনার প্রধান নদী সোমেশ্বরী, মহাদেও, লেঙ্গুরা, কংশ, উবদাখালী শুকিয়ে চর পড়ে ভরাট হয়ে বছরে আট মাস নদীতে পানি না থাকায় এবং চর পড়ায় নদীগুলো সমানে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। সিমসাং বা সোমেশ্বরী নদীর প্রায় ২০ ভাগ বেদখল হয়ে গেছে। চোখের সামনে মেঘালয় পাহাড়ের বালির স্তূপে নিহত হয়েছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের অন্যতম পচাশোল হাওর ও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের পাথরচাওলীর হাওর। নিদারুণভাবে ২০০৮ সালের ২০ জুলাই মেঘালয় পাহাড় ভেঙে বালি আর পাথরের স্তূপে তলিয়ে গেছে তাহিরপুর সীমান্তের গ্রাম আর কৃষিজমি। দেশের দ্বিতীয় রামসার অঞ্চল টাঙ্গুয়ার হাওরের কাছাকাছি পাথর ও কয়লাখনির পাশাপাশি পশ্চিম খাসি পাহাড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম খনি প্রকল্প।
এভাবেই উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে অন্যায়ভাবে পাথর-কয়লা-ইউরেনিয়াম খনিসহ একটার পর একটা বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সরাসরি আঘাত হানছে বাংলাদেশের ভাটিতে, হাওরাঞ্চলে। তাই এখান থেকে মানুষ, হাওর, কৃষিজমি, গ্রাম, প্রাণবৈচিত্র্য কি হাওরের বহমান জীবনধারা নিরন্তর প্রশ্নহীন কায়দায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী বৈঠকের একটিতেও আমরা এসব অন্যায় আর দুর্ভোগ নিয়ে কোনো আলোচনা উত্থাপিত হতে দেখিনি। সার্ক কি ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃরাষ্ট্রিক সংলাপেও বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি কোনোকালে। যেন হাওরাঞ্চলের এই নিরুদ্দেশযাত্রা এক অবিরাম রাষ্ট্রীয় নিয়তি। দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য অঞ্চল হাওরের ও হাওরবাসী জনগণের শরীর ও মগজের সীমানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র বাধ্য। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে তথাকথিত উন্নয়ন বাহাদুরি বন্ধ না হলে হাওরের নিরুদ্দেশযাত্রা কোনোকালেই থামবে না। হাওরের এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও ব্যাখ্যাকে দাবিয়ে রেখে কোনোভাবেই হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাষ্ট্র কেন জানবে না তার হাওর, তার ভূগোল, তার কৃষিজমি, তার মহাশোল কি নানিদ মাছ, তার গভীর পানির ধান জাত কি তার মানুষজন কীভাবে আছে, কোথায় আছে, কেমন আছে? হাওরের নিরুদ্দেশ অভিযাত্রাকে বিবেচনা না করে রাষ্ট্র কোন হিসেবে হাওর মহাপরিকল্পনা করে? হাওরাঞ্চলের নির্দয় নিরুদ্দেশযাত্রাকে প্রশ্ন করে আসুন, আমরা সবাই মিলে হাওরের পাশে দাঁড়াই। কারণ, এই হাওরাঞ্চলই অন্যায় নানকার প্রথা কি টংক প্রথার বিরুদ্ধে, ভাসান পানিতে সবার প্রবেশাধিকারের দাবিতে বারবার গর্জে ওঠার সাহস জুগিয়েছে বাংলাদেশকে। হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে নিরুদ্দেশ হওয়া থেকে হাওরকে বাঁচানোর দায়িত্ব সবার। আমরা কি এখন থেকেই সেই আওয়াজ তুলতে পারি?
পাভেল পার্থ :গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
animistbangla@gmail..com
No comments