আমরা কতটুকু এগিয়েছি by বীণা শিকদার

আমরা প্রতি বছর আজকের দিনে বিনম্র শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্মরণ করি শহীদ ডা. শামস উল আলম খান মিলনকে। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে জানা-অজানা অনেক শহীদের জীবনদানের মধ্য দিয়ে সামরিক জান্তার পতন হয়েছিল। এরপর কেটে গেছে বাইশটি বছর।
আমরা এখন কোন বাংলাদেশ দেখছি? এরশাদের সামরিক শাসনের বুলেটের সামনে অকাতরে জীবন দিয়েছে যারা, তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ কতটুকু পেয়েছি? '৯০-এর ৫ ডিসেম্বর থেকে মাসজুড়ে যে জনসাধারণ বিজয়োৎসব পালন করেছিল, তাদের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু পূরণ হয়েছে? যে চিকিৎসক সমাজ ছিল জনগণের অধিকারের প্রশ্নে টান টান সতর্ক, তার এখন কী অবস্থা? যে বিএমএ ছিল গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী, চিকিৎসকদের গর্বিত পরিচয়, তার এখন কী অবস্থা?
আন্দোলনের আশু লক্ষ্য যদিও ছিল সামরিক সরকারের পতন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন; চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল শোষণ-মুক্তির-আকাঙ্ক্ষা। শোষণমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণ। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখনও অধরাই রয়ে গেল। এমনকি পোশাকি অর্থের গণতান্ত্রিক সমাজে যে উদার মূল্যবোধ থাকার কথা তাও পেয়েছি কি? বরং রাষ্ট্রধর্ম এখনও আছে। আছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। সংখ্যালঘু জাতিসত্তার স্বাধীন বিকাশের স্বীকৃতি নেই; আছে শ্রমিক, কৃষক, নারী, আদিবাসী, শ্রেণী, লিঙ্গ, ধর্ম, পেশাভেদে বৈষম্য।
মিলন শোষণ-মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়েই ছাত্ররাজনীতিতে এবং পরবর্তী সময়ে জাসদ রাজনীতি ও পেশাজীবী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। মিলন দিবসে আজ আমরা কী অঙ্গীকার করব সহযোদ্ধা শহীদের কাছে? শহীদ জননীর কাছে? কী মূল্যায়ন করবে উত্তর প্রজন্ম? কেউ কি দেশের জন্য জীবন দিতে আসবে আবার?
পেশার অধিকারের লড়াই করতে গিয়ে মিলন রাষ্ট্র কাঠামোয় 'শাসক-প্রশাসক' বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। সমর্থন জুগিয়েছেন শ্রেণী-সংগ্রামকে। বিশ্বাস করতেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনতার ঐক্য এ দেশের ভবিষ্যৎ শোষণমুক্ত সমাজের চালিকাশক্তি তৈরি করবে। স্বৈরাচারের পতন শোষণমুক্ত সমাজের লক্ষ্যে জনতার অভিযাত্রার দুয়ার খুলে দেবে। শ্রমিক-মেহনতি জনতা রাজনীতির মূল মঞ্চ অধিকার করে নেবে।
মিলন তথা প্রগতির সৈনিকদের এ প্রস্তুতির কথা প্রতিক্রিয়ার দুর্গের পাহারাদারদের অজানা ছিল না। তাই তারা পদে পদে পেতেছে নানা ফাঁদ। ব্যক্তি এরশাদের পতন ঘটলেও তার লুটতরাজের বিধি ব্যবস্থা যেন টিকে থাকে, সে বিষয়েই সচেষ্ট থেকেছে তারা। প্রথমেই তারা রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছে, যেন ফাটলের ফাঁক দিয়ে এরশাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন ঘটে। হয়েছেও তাই। পাঁচ বছরের কম সময়ের মধ্যেই দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার ঘুঁটিতে পরিণত হলো এরশাদের দল। আর এরশাদের হাতে গড়া লুটপাটের রাজনীতি-প্রশাসনিক নীতি-অর্থনীতি বহাল থাকল। এরশাদের আমলে যারা লুটপাট শুরু করেছিল তারা পরবর্তী পাঁচ-দশ বছরে 'আঙুল ফুলে কলা গাছ', 'কলা গাছ থেকে বটগাছ'-এ পরিণত হয়েছে। রাজনীতিবিদদের নির্বাসন দিয়ে রাজনীতি লুটেরাদের দখলে যাওয়ার প্রক্রিয়া এভাবেই প্রাতিষ্ঠনিক ভিত্তি পেয়েছে, যা ক্ষমতাপ্রত্যাশী প্রায় সব রাজনৈতিক দলকে গ্রাস করেছে। জনগণের প্রগতিশীল রাজনীতি দিন দিন হয়েছে প্রান্তিক থেকে আরও প্রান্তিক। শুধু তাই নয়, যে অন্ধকারের শক্তিকে ভর করে এরশাদ দীর্ঘ নয় বছর এবং এর আগে জিয়াউর রহমান পাঁচ বছর জনগণকে দমিয়ে রেখেছেন, যাদের ৯০-এর ডিসেম্বরে পরাজিত করা গেছে বলে সবাই মনে করেছে সেই অন্ধকারের শক্তি ১৭ বছর পর ২০০৭ সালে আবার ঢুকে পড়ল রাষ্ট্রক্ষমতার দরবারে। তবে এবারও সংগ্রামী ছাত্র সমাজ আগস্ট বিদ্রোহের মাধ্যমে অপশক্তির দিবাস্বপ্নকে ধূলিস্মাৎ করে দিল। এ যেন '৯০-এর অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতা দেওয়ার প্রয়াস!
কিন্তু তা হলো না, লুটপাটের বিধি-ব্যবস্থার গায়ে কোনো আঁচড় পড়েনি। কচুরিপানা এক পাশ থেকে সরিয়ে দিলে যেমনভাবে কিছু দিন পর আবার পুরো পুকুরকে ঢেকে ফেলে, তেমনি আগস্টের ছাত্র বিদ্রোহ মনে হয় মুচকি হেসে আড়ালে সরে গেছে। নইলে শিক্ষাঙ্গন কীভাবে অপরাজনীতির দাপটে ম্রিয়মাণ থাকে?
নতুন সংগ্রামের আবাহন করছে অপশক্তি ও অপরাজনীতিতে নিষ্পিষ্ট জাতি ও জনতা। এ ধরনের গুমোট অবস্থাতেই বিস্টেম্ফারণ ঘটিয়েছিল ছাত্র জনতা ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৮২, ১৯৯০ সালে। বরকত-রফিক-মোস্তফা-বাবুল-আসাদ-মতিউর-জয়নালদের সর্বশেষ উত্তরসূরি মিলন আবার এসে দাঁড়িয়েছে নতুন প্রজন্মের সামনে।

ড. বীণা শিকদার : '৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের কর্মী, গবেষক
beenashikdar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.