অবহেলার শাস্তি হয় না মালিকদের-পার পাওয়া যায় ক্ষতিপূরণ দিয়েই
১৯৯০ সালের পর থেকে তাজরীন ফ্যাশনে আগুন লাগার আগ পর্যন্ত পোশাক কারখানায় ২১২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৭৫ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ হিসাব পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর। অন্যদিকে শ্রমিকরা বলছেন, মৃত্যুর এ সংখ্যা ৭০০।
মৃত্যু সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, ওই সব ঘটনায় কোনো মালিকের শাস্তি হয়নি। এমনকি মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা কর্মীদেরও সাজা হয়নি। এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে পাঁচটি, যেগুলোর বিচার শেষ হয়নি বলে জানা গেছে।এদিকে পোশাক কারখানায় আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকা, ব্যবস্থা থাকলেও ট্যাংকিতে পানি না থাকা, শ্রমিকদের বের হওয়ার দরজা আটকে রাখা, মূল ফটকে তালা মেরে রাখার মতো অনেক অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ তাজরীন গার্মেন্টে আগুন লাগার ঘটনায় অভিযোগ উঠেছে, শ্রমিকদের এক ঘণ্টা দেরি করে জানানো হয় বিষয়টি। এ ছাড়া মূল ফটকে তালা মেরে রাখা হয় এবং বাইরের হৈহুল্লোড় শ্রমিকদের কানে যাওয়া ঠেকাতে উচ্চ স্বরে গান বাজানো হয়।
আগুন বা দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা মারা গেলে আইনত তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয় মাত্র এক লাখ টাকা। আর কর্মক্ষমতা হারিয়ে গেলে শ্রমিক পান এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। শ্রমিক নেতারা বলছেন, মালিকদের কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং শ্রমিকদের মৃত্যু হয়।
অভিযোগ রয়েছে পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য এ পর্যন্ত যা কিছু করা হয়েছে, তা কোনো মালিক নিজের ইচ্ছায় করতে চাননি। তাঁরা যা কিছু করেছেন, তা বিদেশি ক্রেতাদের চাপে। ঢাকায় কার্যালয় নিয়ে নিয়মিত তদারক করে ক্রেতারা কারখানায় শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালিকদের বাধ্য করেছেন। অভিযোগ আছে, ক্রেতাদের চোখও ফাঁকি দিচ্ছেন কোনো কোনো মালিক।
২০১০ সালে গরিব অ্যান্ড গরিব নামের একটি কারখানায় আগুন লেগে ২১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ওই বছর হামীম গ্রুপের একটি কারখানায় আগুন লেগে মৃত্যু হয় ২৯ জনের। ওই দুটি কারখানা ছিল কমপ্লায়েন্ট। আগুন নেভানোর ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু অভিযোগ আছে, আগুন লাগার পর দেখা যায় তাদের আগুন নেভানোর জলাধারে পানি নেই। ফলে দূর থেকে পানি এনে আগুন নেভাতে হয়। ততক্ষণে মৃত্যু হয় শ্রমিকদের। কারখানার মালিকরা ক্ষতিপূরণ দিয়ে রক্ষা পেয়ে যান।
এর আগে ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে এরিনা কে টি এস টেক্সটাইলে অগ্নিকাণ্ডে ৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। সে বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মহাখালীতে ফিনিঙ্ ভবন ধসে মারা যায় ২২ জন। ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল সাভারে স্পেকট্রাম গার্মেন্টের ভবন ধসে ৭৯ শ্রমিকের এবং সে বছর ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের খান নিমির গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ২৮ জনের মৃত্যু হয়। এসব ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। কিন্তু মামলায় কারো শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। অভিযোগ আছে, আইনের ফাঁক দিয়ে আর প্রশাসনকে হাত করে মাফ পেয়ে গেছে সংশ্লিষ্টরা। এ কারণেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা না হলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব নয়। জানা যায়, আগুন লাগার পর সাধারণত রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করে। কিন্তু
সে মামলা আর এগোয় না। বিচারও শেষ হয় না। শুধু স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধ্বসের ঘটনায় মালিক কিছুদিন কারাগারে ছিলেন। পরে তিনি জামিন পেয়ে যান বলে শ্রমিক সংগঠনগুলো জানিয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পোশাক কারখানায় আগুন লেগে শ্রমিকের মৃত্যু হলে মালিকদের অথবা মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার কর্মীদের অবহেলার কোনো শাস্তি হয় না। শাস্তি হলে তাঁরা আরো সতর্ক হতেন। তাতে এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটত না।'
অভিযোগ আছে, কমপ্লায়েন্ট কারখানার বাইরে বহু কারখানা আছে, যেখানে আগুন প্রতিরোধের ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। দু-একটি এঙ্টিংগুইশার কিনে রেখেই তারা খালাস। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সেগুলো পাল্টানো হয় না। পানি রাখার জলাধার নেই। শ্রমিকদের বের হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তাও নেই। সব কিছু থাকলেও সেগুলো ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ নেই অনেক কারখানায়। ওই সব কারখানা বড় কোনো ক্রেতার কাজ পায় না। অনেকে সাব-কন্ট্রাক্টের ভিত্তিতে কাজ করে। ফলে তাদের ওপর ক্রেতাদের কোনো চাপ থাকে না। অনেক বড় গ্রুপ তাদের একটি কারখানার জন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে আদেশ নিয়ে নিজেরই অন্য কারখানায় কাজ করায়। এ ক্ষেত্রে একটি কারখানাকে তারা শত ভাগ কমপ্লায়েন্ট হিসেবে দেখায়, বাকিগুলোতে শ্রমিকের নিরপত্তার বিষয়টি থাকে গৌণ।
বিজিএমইএর সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান অবশ্য বলেন, 'আগুন লাগা নিয়ে পোশাক কারখানার মালিকদের কোনো অবহেলা নেই। একটি কারখানা অনেক বড়। এর সব কিছু মালিকের সশরীরে তদারক করা কঠিন। তাঁকে বিদেশ থেকে কাজের আদেশও আনতে হয়। কিন্তু কারখানায় আগুন লাগলে দায়-দায়িত্ব মালিকের ওপরই বর্তায়। কোনো মালিক ইচ্ছা করে কোনো অবহেলা করেন না।'
সিদ্দিকুর রহমান আরো বলেন, 'বাংলাদেশে পোশাক কারখানায় যে সম্মান শ্রমিকদের করা হয়, তা অন্য কোথাও করা হয় না। আমাদের দেশের কারখানাগুলো অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। একসময় বাথরুমেও মালিকরা মেশিন বসাতেন। এখন আমরা ধীরে ধীরে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। কিন্তু জমির দাম অনেক বেশি হওয়ায় অনেক সময় মালিকরা মূল রাস্তা থেকে অনেক ভেতরে কারখানা নির্মাণ করেন।'
No comments