মানুষ পুড়ে কয়লা-আশুলিয়ায় লাশের সংখ্যা ১১১ by মাসুদুল আলম তুষার
তাজরীন গার্মেন্টে দাউদাউ আগুনের দিকে
তাকিয়ে থেকে সারা রাত পার করে দেওয়া কয়েক হাজার মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্ক।
রবিবারের ভোরের আলোয় তখনো পুরোপুরি আলোকিত হয়নি আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর
গ্রাম। কারখানার বিভিন্ন ফ্লোর থেকে তখনো ধোঁয়া বের হচ্ছিল।
সকাল ৬টায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, কারখানার ভেতরে 'অনেক লাশ' পড়ে আছে। শতাধিক
কর্মী নিখোঁজের আলোচনা রাত থেকে থাকলেও জোরালো ছিল না সেটা। সকাল পৌনে
৭টার দিকে লোকজন বিশ্বাস করতে শুরু করল 'শতাধিক লাশের খবর'। উদ্ধারকাজে
নিয়োজিত রেড ক্রিসেন্ট ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আচরণও ইঙ্গিত দিচ্ছিল
খবরের সত্যতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বজনদের আশা-ভরসাকে শেষ করে দিয়ে উদ্ধার
হতে থাকে পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশ আর লাশ। সরকারি হিসাবের খাতায় নিশ্চিন্তপুর
ট্র্যাজেডির লাশের সংখ্যা এখন ১১১; যদিও স্থানীয় লোকজনের দাবি মৃতের সংখ্যা
আরো বেশি। রাতের আঁধারে বেশ কিছু লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে
তাদের।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তুবা গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি করলেও মধ্যরাতে ফের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তখন পর্যন্ত লাশের সংখ্যা ছিল ৯। এ ৯ জনের সবাই আগুন থেকে বাঁচতে ৯ তলা কারখানা থেকে লাফিয়ে পড়ে এবং ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। রবিবার সকালে সবাইকে শোকে স্তব্ধ করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানাতে থাকেন আরো লাশ উদ্ধারের সংবাদ। দুপুরে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার মুহূর্তে ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আবদুল মতিন জানান, কারখানার ভেতরে বিভিন্ন তলায় তাঁরা ভোরে ১০০টি লাশ পেয়েছেন।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় এর আগে বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও এত বেশি প্রাণহানি আর কখনো ঘটেনি। আর ভয়াবহ আগুনের ট্র্যাজেডিতে এ মৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করছে যে স্থানটি, সেখানেই রয়েছে দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পোশাক কারখানা। লাখ লাখ পোশাক শ্রমিকের বসবাস আশুলিয়া, নিশ্চিন্তপুর, নরসিংহপুর, জিরাবো, বেরন, ঘোষবাগ, বাইপাইল ও পলাশবাড়ী এলাকায়। তাই রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার আগেই নিশ্চিন্তপুরে ঘরে ঘরে শোকের ছায়া। স্বজন না হারিয়েও বিলাপ করছে অনেক মানুষ। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটছে ট্র্যাজেডির স্থানটি দেখতে।
রবিবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় লাখো মানুষের ভিড়। লাশ আর গার্মেন্টের কাপড় পোড়ার গন্ধ একাকার হয়ে নাকে লাগছে। নিশ্চিন্তপুর রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো করা হচ্ছে লাশগুলো। বেশির ভাগই পুড়ে কয়লা। শনাক্ত করতে ছুটে আসা স্বজনরা প্রায়ই ব্যর্থ হচ্ছে কাছের মানুষের দেহটি চিনতে। আশুরার দিনে লাশ উদ্ধার আর শনাক্ত করার ঘটনায় শোকের মাতম উঠেছে দফায় দফায়।
যেভাবে তৈরি হলো মৃত্যুফাঁদ
অনুসন্ধান ও আহত গার্মেন্টকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগুনের ঘটনার পর নানাভাবে বন্দি হয়ে পড়েন কর্মীরা। কারখানার কর্মকর্তাদের আচরণ আর আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন বেশির ভাগ কর্মী। গার্মেন্ট নিরাপত্তার নানা আয়োজনও কর্মীদের আগুন থেকে উদ্ধার পাওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি তলায় নিরাপত্তার জন্য লাগানো তালাগুলো আগুন লাগার পরও খুলে দেওয়া হয়নি। কিছু কর্মী বের হয়ে যেতে চাইলে তাঁদের উল্টো বের হতে বাধা দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একপর্যায় তালা খুলে দেওয়া হলেও ধোঁয়া আর আগুনের তাপে বের হতে পারেননি কর্মীরা। কর্তৃপক্ষের এমন আচরণের কারণেই তিনতলা, চারতলা, পাঁচতলা ও ছয়তলার শ্রমিকরা আটকে পড়ে নিহত হয়েছেন। বেশি শ্রমিক ছিলেন তিনতলা ও চারতলায়। ফায়ার সার্ভিসের হিসাব মতে, তিনতলা থেকেই ৬৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
আহতরা জানান, অগ্নিকাণ্ডের সংকেত যখন বাজে, তখন কারখানার ব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক তিনতলায় ছিলেন। তিনিই প্রথমে সবাইকে নামতে বাধা দেন। আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনতলার কোয়ালিটিম্যান শান্তনা (২২) জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে বেজে ওঠা ফায়ার অ্যালার্মটি অল্প সময় ধরে ছিল। তাঁরা বের হতে চাইলে কারখানার লোকজন তাঁদের বাধা দেয়। কারখানার দক্ষিণ দিকে পুরুষের সিঁড়ি ও উত্তর দিকে নারীদের জন্য দুটি সিঁড়ি আছে। তবে ধোঁয়ার কারণে ওই দুই সিঁড়ির কাছেও তাঁরা যেতে পারেননি। যখন গেটের তালা খুলে দেওয়া হয়, তখন বড় সিঁড়িও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল। তিনি জানান, তাঁর ফ্লোরে কোয়ালিটি বিভাগে কাজ করা ২২ নারীর মধ্যে মাত্র দুজন বেঁচে আছেন।
পঞ্চম তলা থেকে নিচে লাফিয়ে পরে বেঁচে যাওয়া আরেক কর্মী শামছুন্নাহার জানান, প্রথমে তাঁরা বের হতে চাইলেও সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরে তালা খুলে দিলেও তাঁরা বের হতে পারেননি, এমনকি ছাদের দিকেও যেতে পারেননি। তৃতীয় তলার সুইপিং অপারেটর মোরশেদাও (২৫) লাফিয়ে পরে জীবন রক্ষা করেছেন। তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান পাশের শারমিন গার্মেন্টের লোডার। মোরশেদা জানান, সহকর্মী আঞ্জুয়ারা ও আমেনার সঙ্গে বাঁচার লড়াই করেছেন তিনি, কিন্তু এখন তাঁদের আর খোঁজ নেই।
অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছেন তৃতীয় তলার সুপারভাইজার মমিরুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, অ্যালার্মটি বাজে পাঁচ থেকে ছয় সেকেন্ডের জন্য। সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিস এ কাজটি করে থাকেন। কিন্তু ওই সময় ওপর থেকে কাউকে না নামতেও বলে দেন কর্মকর্তারা। পাঁচ-ছয় মিনিট পর ওপরে ধোঁয়া যায়। ততক্ষণে নিচে আগুন ধরে গেছে। তৃতীয় তলার ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান দ্বিতীয় তলার কাটিং ম্যানেজার রিয়াজ, চতুর্থ তলার ইনচার্জ রঞ্জু, ফিনিশিং ইনচার্জ নূর মোহাম্মদসহ অনেক কর্মকর্তাই তখন উপস্থিত ছিলেন। এ কর্মকর্তারাই কর্মীদের বের হতে বাধা দেন বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা। ভবনে ঘটনার সময় নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের ১০ কর্মী কাজ করছিলেন।
পঞ্চম তলার আহত সুইং সুপারভাইজার মিরাজুল ইমলাম জানান, আগুনের তীব্রতা বাড়ার পর তাঁরা নামার অনুমতি পান। ওই সময় ছাদে যাওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না। সিঁড়িতে ধোঁয়ার কারণে কোনো দিকে যেতে পারছিলেন না তাঁরা। পরে সিনিয়র অপারেটর মারুফ ও মিরাজুল দড়ি ধরে লাফিয়ে পড়েন। মারুফ মারা গেছেন।
কর্মী আলেনুর বেগম জানান, অগ্নিকাণ্ডের সময় পাঁচতলায় কাজ করছিলেন তিনি। সন্ধ্যায় আগুন লাগার সময় অ্যালার্ম বাজলেও তখন অ্যালার্মকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি। তাঁর অভিযোগ, অ্যালার্মকে গুরুত্ব দেওয়া হলে এমন ঘটনা ঘটত না। আলেনুর জানান, নিরাপত্তারক্ষীরা বলেন, 'এটা কিছু না, এটা মহড়া। তোমরা কাজে ফিরে যাও। সাত দিনের মধ্যে মাল ডেলিভারি দিতে হবে।' এ কথা শুনে কাজে মনোনিবেশ করেন তিনি। পরে অন্ধকার হয়ে গেলে তিনি নামার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। একসময় তিনি দেখেন, তাঁর সহকর্মীরা জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে নামছেন। উপায়ান্তর না দেখে তিনিও পাঁচতলা থেকে লাফ দেন। পড়েন পার্শ্ববর্তী ভবনের দোতলায়। হাত-পায়ে ও কোমরে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন তিনি।
সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শাহনাজ পারভীন পাঁচতলায় অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তিনি জানান, কাজ করার সময় আগুনের 'হুইসেল' বাজে। ওই সময় বের হওয়ার চেষ্টা করলে নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁদের বলেন, 'ওপরে ওঠো, কিছু হয়নি।' কয়েকজন ছেলে সহকর্মী পাঁচতলার একটি জানালা ভাঙেন। ওই জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েন শাহনাজসহ কয়েকজন। শাহনাজের দুটি পা ও বাঁ হাত ভেঙে গেছে। তাঁর স্বামী উকিল রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি বলেন, গতকাল সকাল পর্যন্ত কেউ তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি।
আহত নিলুফা (৩৫) জানান, তিনি পঞ্চম তলায় অপারেটর হিসেবে কাজ করছিলেন। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে তিনি সবার সঙ্গে নিচে নামতে থাকেন। চারতলায় এলে দুই নিরাপত্তাকর্মী তাঁদের বলেন, 'এমনিতেই সাইরেন বাজানো হয়েছে। তোমরা ওপরে চলে যাও।' পরে কালো ধোঁয়ায় আর কিছু দেখতে পাননি তাঁরা। একপর্যায়ে চারতলার জানালা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়েন নিলুফা। নিলুফা ও শাহনাজের বর্ণনায় জানা গেছে, পাঁচতলায় কমপক্ষে দেড় শ শ্রমিক কাজ করছিলেন।
কারখানার ষষ্ঠ তলায় কাজ করেন ইউনুস এবং তৃতীয় তলায় কাজ করেন তাঁর স্ত্রী সাবিনা। অগ্নিকাণ্ডের সময় পঞ্চম তলায় এসে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়েন ইউনুস। আহত ইউনুস স্থানীয় নারী ও শিশু হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখন নিশ্চিন্তপুরের ভাড়া বাসায় আছেন। তাঁর স্ত্রী সাবিনাও বেঁচে গেছেন। তবে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন। কালের কণ্ঠকে তাঁরা বলেন, 'আমরা গরিব মানুষ, আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা কে করবে?'
এখনো স্বজনের খোঁজ
নিশ্চিন্তপুরের মেহেরের বাড়ির ভাড়াটিয়া বাবুল ও তাঁর স্ত্রী মরিয়ম চাকরি করেন তাজরীন ফ্যাশনসে। শনিবার অগ্নিকাণ্ডের সময় চারতলা থেকে বাঁশ বেয়ে নেমে বেঁচে গেছেন বাবুল। আর পাঁচতলায় কাজ করছিলেন মরিয়ম। ঘটনার পর থেকে স্ত্রীকে খুঁজে ফিরছেন বাবুল। তিনি বলেন, 'আমি ওকে কোথায় পাব বলেন? লাশ তো চেনা যাচ্ছে না।'
নিশ্চিন্তপুরের নালপাড় জাকিরের বাসায় ভাড়া থাকেন তাজরীন গার্মেন্টের পাঁচ কর্মী। শামছুন্নাহার নামে একজন লাফিয়ে বাঁচলেও বাকি চার কর্মীর খোঁজ নেই। তাঁরা হলেন চারতলার অপারেটর রোকসানা, পাঁচতলার কোয়ালিটিম্যান লাভলী, অপারেটর লাইলী ও পপি। লাভলী, লাইলি ও পপি তিন বোন। লাভলীর স্বামী মোস্তফাও পাঁচতলার ফিনিশিং বিভাগের হেলপার। অগ্নিকাণ্ডের সময় তিনি বাঁশ বেয়ে নেমে পড়েন। তবে স্ত্রী ও শ্যালিকাদের আর বাঁচাতে পারেননি। এখনো স্বজনের অপেক্ষায় মোস্তফা। কান্নার রোল চলছে ওই বাড়িতে। পোড়া লাশের মাঝে যেন স্বজনের সন্ধান না পেয়ে জীবিত ফেরত পান, সেই প্রার্থনা করছেন তাঁরা।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তুবা গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি করলেও মধ্যরাতে ফের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তখন পর্যন্ত লাশের সংখ্যা ছিল ৯। এ ৯ জনের সবাই আগুন থেকে বাঁচতে ৯ তলা কারখানা থেকে লাফিয়ে পড়ে এবং ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। রবিবার সকালে সবাইকে শোকে স্তব্ধ করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানাতে থাকেন আরো লাশ উদ্ধারের সংবাদ। দুপুরে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার মুহূর্তে ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আবদুল মতিন জানান, কারখানার ভেতরে বিভিন্ন তলায় তাঁরা ভোরে ১০০টি লাশ পেয়েছেন।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় এর আগে বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও এত বেশি প্রাণহানি আর কখনো ঘটেনি। আর ভয়াবহ আগুনের ট্র্যাজেডিতে এ মৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করছে যে স্থানটি, সেখানেই রয়েছে দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পোশাক কারখানা। লাখ লাখ পোশাক শ্রমিকের বসবাস আশুলিয়া, নিশ্চিন্তপুর, নরসিংহপুর, জিরাবো, বেরন, ঘোষবাগ, বাইপাইল ও পলাশবাড়ী এলাকায়। তাই রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণার আগেই নিশ্চিন্তপুরে ঘরে ঘরে শোকের ছায়া। স্বজন না হারিয়েও বিলাপ করছে অনেক মানুষ। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটছে ট্র্যাজেডির স্থানটি দেখতে।
রবিবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় লাখো মানুষের ভিড়। লাশ আর গার্মেন্টের কাপড় পোড়ার গন্ধ একাকার হয়ে নাকে লাগছে। নিশ্চিন্তপুর রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো করা হচ্ছে লাশগুলো। বেশির ভাগই পুড়ে কয়লা। শনাক্ত করতে ছুটে আসা স্বজনরা প্রায়ই ব্যর্থ হচ্ছে কাছের মানুষের দেহটি চিনতে। আশুরার দিনে লাশ উদ্ধার আর শনাক্ত করার ঘটনায় শোকের মাতম উঠেছে দফায় দফায়।
যেভাবে তৈরি হলো মৃত্যুফাঁদ
অনুসন্ধান ও আহত গার্মেন্টকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগুনের ঘটনার পর নানাভাবে বন্দি হয়ে পড়েন কর্মীরা। কারখানার কর্মকর্তাদের আচরণ আর আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন বেশির ভাগ কর্মী। গার্মেন্ট নিরাপত্তার নানা আয়োজনও কর্মীদের আগুন থেকে উদ্ধার পাওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি তলায় নিরাপত্তার জন্য লাগানো তালাগুলো আগুন লাগার পরও খুলে দেওয়া হয়নি। কিছু কর্মী বের হয়ে যেতে চাইলে তাঁদের উল্টো বের হতে বাধা দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একপর্যায় তালা খুলে দেওয়া হলেও ধোঁয়া আর আগুনের তাপে বের হতে পারেননি কর্মীরা। কর্তৃপক্ষের এমন আচরণের কারণেই তিনতলা, চারতলা, পাঁচতলা ও ছয়তলার শ্রমিকরা আটকে পড়ে নিহত হয়েছেন। বেশি শ্রমিক ছিলেন তিনতলা ও চারতলায়। ফায়ার সার্ভিসের হিসাব মতে, তিনতলা থেকেই ৬৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
আহতরা জানান, অগ্নিকাণ্ডের সংকেত যখন বাজে, তখন কারখানার ব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক তিনতলায় ছিলেন। তিনিই প্রথমে সবাইকে নামতে বাধা দেন। আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনতলার কোয়ালিটিম্যান শান্তনা (২২) জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে বেজে ওঠা ফায়ার অ্যালার্মটি অল্প সময় ধরে ছিল। তাঁরা বের হতে চাইলে কারখানার লোকজন তাঁদের বাধা দেয়। কারখানার দক্ষিণ দিকে পুরুষের সিঁড়ি ও উত্তর দিকে নারীদের জন্য দুটি সিঁড়ি আছে। তবে ধোঁয়ার কারণে ওই দুই সিঁড়ির কাছেও তাঁরা যেতে পারেননি। যখন গেটের তালা খুলে দেওয়া হয়, তখন বড় সিঁড়িও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল। তিনি জানান, তাঁর ফ্লোরে কোয়ালিটি বিভাগে কাজ করা ২২ নারীর মধ্যে মাত্র দুজন বেঁচে আছেন।
পঞ্চম তলা থেকে নিচে লাফিয়ে পরে বেঁচে যাওয়া আরেক কর্মী শামছুন্নাহার জানান, প্রথমে তাঁরা বের হতে চাইলেও সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরে তালা খুলে দিলেও তাঁরা বের হতে পারেননি, এমনকি ছাদের দিকেও যেতে পারেননি। তৃতীয় তলার সুইপিং অপারেটর মোরশেদাও (২৫) লাফিয়ে পরে জীবন রক্ষা করেছেন। তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান পাশের শারমিন গার্মেন্টের লোডার। মোরশেদা জানান, সহকর্মী আঞ্জুয়ারা ও আমেনার সঙ্গে বাঁচার লড়াই করেছেন তিনি, কিন্তু এখন তাঁদের আর খোঁজ নেই।
অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছেন তৃতীয় তলার সুপারভাইজার মমিরুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, অ্যালার্মটি বাজে পাঁচ থেকে ছয় সেকেন্ডের জন্য। সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিস এ কাজটি করে থাকেন। কিন্তু ওই সময় ওপর থেকে কাউকে না নামতেও বলে দেন কর্মকর্তারা। পাঁচ-ছয় মিনিট পর ওপরে ধোঁয়া যায়। ততক্ষণে নিচে আগুন ধরে গেছে। তৃতীয় তলার ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান দ্বিতীয় তলার কাটিং ম্যানেজার রিয়াজ, চতুর্থ তলার ইনচার্জ রঞ্জু, ফিনিশিং ইনচার্জ নূর মোহাম্মদসহ অনেক কর্মকর্তাই তখন উপস্থিত ছিলেন। এ কর্মকর্তারাই কর্মীদের বের হতে বাধা দেন বলে জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা। ভবনে ঘটনার সময় নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের ১০ কর্মী কাজ করছিলেন।
পঞ্চম তলার আহত সুইং সুপারভাইজার মিরাজুল ইমলাম জানান, আগুনের তীব্রতা বাড়ার পর তাঁরা নামার অনুমতি পান। ওই সময় ছাদে যাওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না। সিঁড়িতে ধোঁয়ার কারণে কোনো দিকে যেতে পারছিলেন না তাঁরা। পরে সিনিয়র অপারেটর মারুফ ও মিরাজুল দড়ি ধরে লাফিয়ে পড়েন। মারুফ মারা গেছেন।
কর্মী আলেনুর বেগম জানান, অগ্নিকাণ্ডের সময় পাঁচতলায় কাজ করছিলেন তিনি। সন্ধ্যায় আগুন লাগার সময় অ্যালার্ম বাজলেও তখন অ্যালার্মকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি। তাঁর অভিযোগ, অ্যালার্মকে গুরুত্ব দেওয়া হলে এমন ঘটনা ঘটত না। আলেনুর জানান, নিরাপত্তারক্ষীরা বলেন, 'এটা কিছু না, এটা মহড়া। তোমরা কাজে ফিরে যাও। সাত দিনের মধ্যে মাল ডেলিভারি দিতে হবে।' এ কথা শুনে কাজে মনোনিবেশ করেন তিনি। পরে অন্ধকার হয়ে গেলে তিনি নামার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। একসময় তিনি দেখেন, তাঁর সহকর্মীরা জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে নামছেন। উপায়ান্তর না দেখে তিনিও পাঁচতলা থেকে লাফ দেন। পড়েন পার্শ্ববর্তী ভবনের দোতলায়। হাত-পায়ে ও কোমরে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন তিনি।
সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শাহনাজ পারভীন পাঁচতলায় অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তিনি জানান, কাজ করার সময় আগুনের 'হুইসেল' বাজে। ওই সময় বের হওয়ার চেষ্টা করলে নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁদের বলেন, 'ওপরে ওঠো, কিছু হয়নি।' কয়েকজন ছেলে সহকর্মী পাঁচতলার একটি জানালা ভাঙেন। ওই জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েন শাহনাজসহ কয়েকজন। শাহনাজের দুটি পা ও বাঁ হাত ভেঙে গেছে। তাঁর স্বামী উকিল রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি বলেন, গতকাল সকাল পর্যন্ত কেউ তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি।
আহত নিলুফা (৩৫) জানান, তিনি পঞ্চম তলায় অপারেটর হিসেবে কাজ করছিলেন। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে তিনি সবার সঙ্গে নিচে নামতে থাকেন। চারতলায় এলে দুই নিরাপত্তাকর্মী তাঁদের বলেন, 'এমনিতেই সাইরেন বাজানো হয়েছে। তোমরা ওপরে চলে যাও।' পরে কালো ধোঁয়ায় আর কিছু দেখতে পাননি তাঁরা। একপর্যায়ে চারতলার জানালা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়েন নিলুফা। নিলুফা ও শাহনাজের বর্ণনায় জানা গেছে, পাঁচতলায় কমপক্ষে দেড় শ শ্রমিক কাজ করছিলেন।
কারখানার ষষ্ঠ তলায় কাজ করেন ইউনুস এবং তৃতীয় তলায় কাজ করেন তাঁর স্ত্রী সাবিনা। অগ্নিকাণ্ডের সময় পঞ্চম তলায় এসে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়েন ইউনুস। আহত ইউনুস স্থানীয় নারী ও শিশু হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখন নিশ্চিন্তপুরের ভাড়া বাসায় আছেন। তাঁর স্ত্রী সাবিনাও বেঁচে গেছেন। তবে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন। কালের কণ্ঠকে তাঁরা বলেন, 'আমরা গরিব মানুষ, আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা কে করবে?'
এখনো স্বজনের খোঁজ
নিশ্চিন্তপুরের মেহেরের বাড়ির ভাড়াটিয়া বাবুল ও তাঁর স্ত্রী মরিয়ম চাকরি করেন তাজরীন ফ্যাশনসে। শনিবার অগ্নিকাণ্ডের সময় চারতলা থেকে বাঁশ বেয়ে নেমে বেঁচে গেছেন বাবুল। আর পাঁচতলায় কাজ করছিলেন মরিয়ম। ঘটনার পর থেকে স্ত্রীকে খুঁজে ফিরছেন বাবুল। তিনি বলেন, 'আমি ওকে কোথায় পাব বলেন? লাশ তো চেনা যাচ্ছে না।'
নিশ্চিন্তপুরের নালপাড় জাকিরের বাসায় ভাড়া থাকেন তাজরীন গার্মেন্টের পাঁচ কর্মী। শামছুন্নাহার নামে একজন লাফিয়ে বাঁচলেও বাকি চার কর্মীর খোঁজ নেই। তাঁরা হলেন চারতলার অপারেটর রোকসানা, পাঁচতলার কোয়ালিটিম্যান লাভলী, অপারেটর লাইলী ও পপি। লাভলী, লাইলি ও পপি তিন বোন। লাভলীর স্বামী মোস্তফাও পাঁচতলার ফিনিশিং বিভাগের হেলপার। অগ্নিকাণ্ডের সময় তিনি বাঁশ বেয়ে নেমে পড়েন। তবে স্ত্রী ও শ্যালিকাদের আর বাঁচাতে পারেননি। এখনো স্বজনের অপেক্ষায় মোস্তফা। কান্নার রোল চলছে ওই বাড়িতে। পোড়া লাশের মাঝে যেন স্বজনের সন্ধান না পেয়ে জীবিত ফেরত পান, সেই প্রার্থনা করছেন তাঁরা।
No comments