সংবিধান-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নয়, আদিবাসী by অভয় প্রকাশ চাকমা
গত ১৫ মার্চ দেশের আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে সংবিধান সংশোধন বিষয়ক সংসদীয় কমিটির কো-চেয়ার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, যে অর্থে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় 'আদিবাসী' বোঝায়, বাংলাদেশের উপজাতিরা সে অর্থে আদিবাসী নয়।
তিনি সম্ভবত ওই দেশ দুটির আদিবাসী সংজ্ঞা সম্পর্কে অবগত। উপনিবেশপূর্ব বসবাসকারীদের আদিবাসী বলতে চেয়েছেন তিনি। তাহলে কি বাংলাদেশে কোনো ঔপনিবেশিক শাসন ছিল না?
বাংলাদেশে ওলন্দাজ, মোগল ও ব্রিটিশদের আগমনের ইতিহাস তো স্কুলের ইতিহাস বইয়ে উজ্জ্বল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলাদেশের ইতিহাস নিশ্চয়ই পড়েছেন; কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের (তার ভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী) ইতিহাস সম্পর্কে অন্ধকারে আছেন। মোগল সম্রাটের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের যুদ্ধ, পরে বশ্যতা স্বীকার ও সন্ধি, ব্রিটিশ দখলদারদের সঙ্গে চাকমাদের যুদ্ধ ও বিরোধ সর্বজনবিদিত।
ইংরেজি ইনডিজিনাস (ওহফরমবহড়ঁং) শব্দের বাংলা প্রতিরূপ দেওয়া হয়েছে আদিবাসী। আক্ষরিক ও শাব্দিক অর্থে আদিতে অর্থাৎ কোনো এলাকায় সবার আগে বসতিকারী জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বোঝায়। এখানেই অনেকের আপত্তি। তারা মনে করেন আদিবাসী দাবিদার জনগোষ্ঠীর আগেই তাদের বসবাস ছিল।
সেই অর্থেও চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা আদিবাসী। চট্টগ্রামের রাজাপুরে অধুনালুপ্ত প্রাচীন চাকমা রাজবাড়ি, এখনও চট্টগ্রাম জেলাধীন রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত চাকমা রাজবাড়ি এবং চট্টগ্রামের অনেক রাস্তাঘাট ও এলাকা চাকমা রাজার নামে রয়েছে। চাকমারা বিতাড়িত হতে হতে শেষে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি করতে বাধ্য হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম চাকমা আদিবাসীদেরই আগমন হয়েছে, এর প্রমাণ ভারত বিভাজনের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদমশুমারি প্রতিবেদনই যথেষ্ট। এ থেকে প্রমাণিত হয়, শাব্দিক অর্থেও আমরা এ অঞ্চলের আদিবাসী।
জাতিসংঘে আদিবাসীর সংজ্ঞা নেই, কারণ সংজ্ঞায়নের প্রয়োজন হয়নি। কোনো দেশেই আদিবাসীদের সংজ্ঞায়নের বিষয়ে অহেতুক বিতর্কের উদ্ভব হয়নি বাংলাদেশ ছাড়া। বাংলাদেশের বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। এ ক্ষেত্রে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে খালেদা জিয়ার মিল দেখা যায়। জাতিসংঘে অপ্রয়োজনীয় কোনো সংজ্ঞা না থাকলেও আইএলও কনভেনশন নং ১০৭-এর ১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে অন্যতম হলো তাদের জীবনাচরণ, যা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও জনসমষ্টির প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের চেয়ে তারা যে ঐতিহাসিক জনগোষ্ঠী থেকে বংশোদ্ভূত সেই জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অধিকতর পরিচালিত হওয়া। এই জীবনাচরণের ধরন দেশের প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সমসাময়িক প্রতিষ্ঠানের চেয়েও আদিবাসীদের পূর্বপুরুষদের আমলের প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়।' জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোটার হোজে আর মারটিনেজ কোবো তার এক গবেষণায় (জাতিসংঘ দলিল) উলেল্গখ করেছেন, 'আদিবাসী সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠী ও জাতি বলতে তাদের বোঝায়, যাদের ভূখণ্ডে প্রাক্-আগ্রাসন এবং প্রাক্-ঔপনিবেশিককাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে, যারা নিজেদের ওই ভূখণ্ডে বা ভূখণ্ডের কিয়দংশে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। বর্তমানে তারা সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীভুক্ত এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইনি ব্যবস্থার ভিত্তিতে জাতি হিসেবে তাদের ধারাবাহিক বিদ্যমানতার আলোকে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভূখণ্ড ও নৃতাত্তি্বক পরিচয় ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।' উলি্লখিত বক্তব্য ও গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয় যে, আমরা আদিবাসী। এত কিছুর পরও কেউ কেউ আমাদের আদিবাসী বলতে নারাজ।
দেশবরেণ্য গবেষক, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, নৃতত্ত্ববিদ, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, এমনকি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সব মন্ত্রী আমাদের আদিবাসী হিসেবে বিভিন্ন ফোরামে উল্লেখ করছেন। তাছাড়া আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সুপারিশ আমলে না নিয়ে আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদের মুখ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত। 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০' নামক আইনের ২(২) সংজ্ঞায় বলা আছে, 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অর্থ তফসিলে উলি্লখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শ্রেণীর জনগণ।' এ আইনের মাধ্যমেও আমরা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত। আইনসভার একজন সদস্য হয়ে জনাব সেনগুপ্তর আইন পরিপন্থী বক্তব্যের উদ্দেশ্য কী? সংবিধানে আমাদের 'আদিবাসী' স্বীকৃতি দিলে রাষ্ট্রের বা বাঙালি জনগণের লাভ ছাড়া তো কোনো ক্ষতি নেই। এমন নয় যে, আমাদের আদিবাসী বলা হলে বাঙালিদের ভূমি বা রাষ্ট্র ছাড়তে হবে। জাতিসংঘে আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, ঐতিহ্য, প্রথা, ভূমি, নিজস্ব ভাষা, নৃতাত্তি্বক পরিচয়, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এসবের বেশকিছু অধিকারই তো আমরা ভোগ করছি। সামান্য সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে কেন এত কার্পণ্যবোধ বোধগম্য নয়।
শাব্দিক অর্থই যদি আপত্তির কারণ হয় তাহলে ঠিক আছে, ইংরেজির ইনডিজিনাস শব্দ ব্যবহার করুন। 'ইনডিজিনাস' হিসেবে আমাদের স্বীকৃতি দিন। কিন্তু 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী'_ এ কেমন জাতি?
অভয় প্রকাশ চাকমা : কলাম লেখক
No comments