নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস ও নদী খনন by ধরিত্রী সরকার সবুজ
বাংলাদেশের নদীগুলো খুব দ্রুত নাব্যতা হারাচ্ছে। একসময় যেসব নদী বেশ খরস্রোতা ছিল, সেগুলোও এখন মরা নদীতে পরিণত হতে চলেছে। বলা চলে, নদীগুলো তাদের চরিত্রই হারিয়ে ফেলছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সেই নদীগুলোর অবস্থা এখন বড়ই করুণ। পুরনো ব্রহ্মপুত্র আজ মৃতপ্রায় স্রোতস্বিনী।
পদ্মা ও যমুনার বুকেও যখন-তখন জেগে উঠছে চর। সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই, নবগঙ্গা, ভৈরব, করতোয়া, চিত্রাসহ দেশের অসংখ্য নদ-নদী আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে এগুলোর অধিকাংশ নৌ চলাচলের উপযোগী থাকলেও, শীতের শুরুতেই এগুলো নাব্যতা হারায়। গ্রীষ্মকালে অনেক নদী স্থানে স্থানে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়। পানিবিহীন নদীর বুক চিরে হাঁটার পথ তৈরি হওয়ার দৃশ্যও তখন দেখা যায়।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মোট নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার, ১৯৮৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় আট হাজার ৪৩৫ কিলোমিটারে। ১৯৯২ সালে কমে নৌপথের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৮৯৬ কিলোমিটারে এবং বর্তমানে নদীর পানিপ্রবাহ কমে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র তিন হাজার ৮০০ কিলোমিটারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নদীগুলোয় ৩০ শতাংশ পানিপ্রবাহ কমে যাবে এবং সে ক্ষেত্রে আরো ১০০টি নদী নাব্যতা হারাবে।
নদীগুলোর এভাবে নাব্যতা হারানোর মূল কারণই হলো নদীবক্ষে পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। আমাদের নদীগুলোয় সাধারণত অক্টোবর মাস থেকেই পানিপ্রবাহের গতি কমতে থাকে। ফলে নদীর পলি বহনের ক্ষমতাও হ্রাস পায়। প্রবাহের গতি ও পানির ঘূর্ণন কমে যাওয়ায় পলিমাটি আস্তে আস্তে নদীর তলদেশে জমতে থাকে। বেশ কয়েক বছর এভাবে একই স্থানে পলি জমার পর ওই স্থানে চর জেগে ওঠে এবং নদীর নাব্যতা হ্রাস করে।
আমাদের এ নদীগুলোয় পলিমাটি জমে ভরাট হওয়ার প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানুষের সৃষ্ট কারণও কম দায়ী নয়। নদীর উজানে বনভূমি উজাড় করা হলে পলিপ্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত পলি নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। মানুষ নদীর পানিতে শিল্পবর্জ্যের নিঃসরণ ঘটাচ্ছে। এসব শিল্পবর্জ্যের রাসায়নিক অংশ নদীর পানি দূষণের পাশাপাশি বর্জ্যের অদ্রবণীয় অংশ শুষ্ক মৌসুমে নদীর তলদেশে জমে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমে আছে কয়েক ফুট পলিথিনের স্তর, যা অপসারণ এখন সত্যিই কঠিন। অতিলোভী ও সম্পূর্ণ বিবেকবর্জিত কিছু মানুষ অনেক নদ-নদীর তীর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করার কারণেও অনেক নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া উজানে বাঁধ নির্মাণ, পাহাড় কাটা, পাহাড়ি জমিতে কৃষিকাজ, অপরিকল্পিত পাড় বাঁধাই ও যত্রতত্র বালু উত্তোলনের কারণেও নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে।
নদীতে পানি না থাকলে মাছ থাকবে না। নৌপথ বন্ধ হয়ে যাবে। জেলেরা বেকার হয়ে পড়বে। হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। কৃষিকাজ হবে না। গবাদিপশুর খাদ্য থাকবে না। অদ্ভুত এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সে কারণেই বর্তমানের বাস্তবতায় নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি এবং এ সমস্যার সমাধান করা যায় নদী খননের মাধ্যমে। দুভাবে এই নদী খননকাজ করা যায়। প্রথমত, মানুষের কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত, ড্রেজিং বা বানডালিংয়ের মাধ্যমে। অপেক্ষাকৃত ছোট নদীগুলোয় শুষ্ক মৌসুমে জনশক্তি নিয়োগ করে খননকাজের সাহায্যে নদীর তলদেশের পলিমাটি অপসারণ করা যায়। তবে অপেক্ষাকৃত বড় নদীগুলোর পলিমাটি অপসারণের জন্য ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে। ড্রেজিংয়ের সাহায্যে নদীর নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট ডিজাইনে গভীরতা বা নাব্যতা বৃদ্ধি করা যায়। ড্রেজিংয়ের ফলে নদীর তলদেশের পলিমাটিতে বিরাজমান খাদ্যপ্রাণ পুনর্বিভাজিত হয় এবং জলজ প্রাণীর জীবনধারণের জন্য সুবিধাজনক হয়। তবে ড্রেজিং হতে হবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সুষ্ঠুভাবে। ইতিমধ্যে আমাদের দেশে অনেক ড্রেজিং পরিকল্পনাবিহীনভাবে হওয়ায় তা কোনো কাজেই আসেনি। আবার অনেক সময়ই বিভিন্ন নদীতে ড্রেজিং করার পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না।
বানডালিং ড্রেজিংয়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সস্তা এবং বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় বিধায় এটি পরিবেশবান্ধবও। উজানের পানিপ্রবাহকে গাইড করে সমস্যাপূর্ণ অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রয়োজনীয় গতিবেগে প্রবাহিত করাই বানডালের মূল কাজ। বানডাল বসানোর জন্য প্রথমেই হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের সাহায্যে নৌপথের সম্ভাব্য সমস্যাপূর্ণ অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করতে হয়। অতঃপর নদীর গতিপথে বানডাল বসিয়ে নাব্যতা হারানো স্থানের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত করে নাব্যতা বৃদ্ধি করা যায়।
লেখক : প্রকৌশলী, বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক কলামিস্ট
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মোট নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার, ১৯৮৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় আট হাজার ৪৩৫ কিলোমিটারে। ১৯৯২ সালে কমে নৌপথের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৮৯৬ কিলোমিটারে এবং বর্তমানে নদীর পানিপ্রবাহ কমে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র তিন হাজার ৮০০ কিলোমিটারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নদীগুলোয় ৩০ শতাংশ পানিপ্রবাহ কমে যাবে এবং সে ক্ষেত্রে আরো ১০০টি নদী নাব্যতা হারাবে।
নদীগুলোর এভাবে নাব্যতা হারানোর মূল কারণই হলো নদীবক্ষে পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। আমাদের নদীগুলোয় সাধারণত অক্টোবর মাস থেকেই পানিপ্রবাহের গতি কমতে থাকে। ফলে নদীর পলি বহনের ক্ষমতাও হ্রাস পায়। প্রবাহের গতি ও পানির ঘূর্ণন কমে যাওয়ায় পলিমাটি আস্তে আস্তে নদীর তলদেশে জমতে থাকে। বেশ কয়েক বছর এভাবে একই স্থানে পলি জমার পর ওই স্থানে চর জেগে ওঠে এবং নদীর নাব্যতা হ্রাস করে।
আমাদের এ নদীগুলোয় পলিমাটি জমে ভরাট হওয়ার প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানুষের সৃষ্ট কারণও কম দায়ী নয়। নদীর উজানে বনভূমি উজাড় করা হলে পলিপ্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত পলি নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদী ভরাট-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। মানুষ নদীর পানিতে শিল্পবর্জ্যের নিঃসরণ ঘটাচ্ছে। এসব শিল্পবর্জ্যের রাসায়নিক অংশ নদীর পানি দূষণের পাশাপাশি বর্জ্যের অদ্রবণীয় অংশ শুষ্ক মৌসুমে নদীর তলদেশে জমে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশে জমে আছে কয়েক ফুট পলিথিনের স্তর, যা অপসারণ এখন সত্যিই কঠিন। অতিলোভী ও সম্পূর্ণ বিবেকবর্জিত কিছু মানুষ অনেক নদ-নদীর তীর দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করার কারণেও অনেক নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া উজানে বাঁধ নির্মাণ, পাহাড় কাটা, পাহাড়ি জমিতে কৃষিকাজ, অপরিকল্পিত পাড় বাঁধাই ও যত্রতত্র বালু উত্তোলনের কারণেও নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে।
নদীতে পানি না থাকলে মাছ থাকবে না। নৌপথ বন্ধ হয়ে যাবে। জেলেরা বেকার হয়ে পড়বে। হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। কৃষিকাজ হবে না। গবাদিপশুর খাদ্য থাকবে না। অদ্ভুত এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সে কারণেই বর্তমানের বাস্তবতায় নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি এবং এ সমস্যার সমাধান করা যায় নদী খননের মাধ্যমে। দুভাবে এই নদী খননকাজ করা যায়। প্রথমত, মানুষের কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত, ড্রেজিং বা বানডালিংয়ের মাধ্যমে। অপেক্ষাকৃত ছোট নদীগুলোয় শুষ্ক মৌসুমে জনশক্তি নিয়োগ করে খননকাজের সাহায্যে নদীর তলদেশের পলিমাটি অপসারণ করা যায়। তবে অপেক্ষাকৃত বড় নদীগুলোর পলিমাটি অপসারণের জন্য ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে। ড্রেজিংয়ের সাহায্যে নদীর নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট ডিজাইনে গভীরতা বা নাব্যতা বৃদ্ধি করা যায়। ড্রেজিংয়ের ফলে নদীর তলদেশের পলিমাটিতে বিরাজমান খাদ্যপ্রাণ পুনর্বিভাজিত হয় এবং জলজ প্রাণীর জীবনধারণের জন্য সুবিধাজনক হয়। তবে ড্রেজিং হতে হবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও সুষ্ঠুভাবে। ইতিমধ্যে আমাদের দেশে অনেক ড্রেজিং পরিকল্পনাবিহীনভাবে হওয়ায় তা কোনো কাজেই আসেনি। আবার অনেক সময়ই বিভিন্ন নদীতে ড্রেজিং করার পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না।
বানডালিং ড্রেজিংয়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সস্তা এবং বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় বিধায় এটি পরিবেশবান্ধবও। উজানের পানিপ্রবাহকে গাইড করে সমস্যাপূর্ণ অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রয়োজনীয় গতিবেগে প্রবাহিত করাই বানডালের মূল কাজ। বানডাল বসানোর জন্য প্রথমেই হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের সাহায্যে নৌপথের সম্ভাব্য সমস্যাপূর্ণ অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করতে হয়। অতঃপর নদীর গতিপথে বানডাল বসিয়ে নাব্যতা হারানো স্থানের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত করে নাব্যতা বৃদ্ধি করা যায়।
লেখক : প্রকৌশলী, বিজ্ঞান ও পরিবেশবিষয়ক কলামিস্ট
No comments