মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ ২২ অভিযোগ
একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এতে তাঁর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট,
ধর্মান্তরিত ও দেশান্তর করাসহ ১০টি ঘটনায় ২২টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এ আসামি বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান গতকাল রবিবার অভিযোগ জমা দেন। বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ৪৪৮ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়।
অভিযোগ দাখিলের পর প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে অন্যতম হলো- ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকায় জগৎবন্ধু আশ্রমে তাঁর সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটজন সাধককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ফরিদপুর পুলিশ লাইনে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়।
অভিযোগে বলা হয়, ফরিদপুর শহরে একটি হিন্দু বাড়ি (মারোয়ারি বাড়ি) দখল করে সেখানে নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করেন আজাদ। ফরিদপুরে তাঁর শ্বশুর চাঁন আলী রাজাকারের হাত ধরে রাজাকার বাহিনীর অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন বাচ্চু রাজাকার। প্রথমদিকে সালথা থানা এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরে ফরিদপুর শহরসহ বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ করেন। তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত হন। এ সুবাদে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গে তাঁর জানাশোনা ছিল। তাঁকে ফরিদপুর স্টেডিয়াম ও সার্কিট হাউসের নির্যাতনকেন্দ্রে মুজাহিদের সঙ্গে দেখা গেছে।
জানা গেছে, বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ফরিদপুর শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথম প্রবেশ করে। সে দিনই ফরিদপুর শহরের জগৎবন্ধু আশ্রমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে হামলা চালান বাচ্চু রাজাকার। সেখানে আট ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া ১৭ মে ফরিদপুরের হাশামদিয়া গ্রাম ও নন্দিয়া বাজারে হামলা চালান বাচ্চু রাজাকার। সেখানে ব্যাপক গণহত্যা চালানোর পর বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তদন্ত সংস্থা তথ্য পেয়েছে, এসব কাজে নেতৃত্ব দেন মাওলানা আজাদ।
এ ছাড়া বোয়ালমারী থানার নদীরদিয়া গ্রামে দুই বোনসহ বেশ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণের সঙ্গে মাওলানা আজাদ জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। নির্যাতিত হওয়ার পর ওই দুই নারী দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান।
অভিযোগে বলা হয়, ফরিদপুর শহরে এক হাজার ২০০ বধ্যভূমিতে হাজার হাজার মানুষ জড়ো করে হত্যার পর সেখানেই মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। এসব মানুষকে হত্যার নির্দেশদাতা মাওলানা আজাদ এবং তিনি নিজেও সরাসরি হত্যাকারী। তিনি নিজে গুলি করে অসংখ্য নিরীহ ও স্বাধীনতাকামী মানুষ হত্যা করেন। ফরিদপুর স্টেডিয়াম ছিল তাঁদের মূল নির্যাতনকেন্দ্র। তাঁরা অসংখ্য মানুষের লাশ ফরিদপুর স্টেডিয়ামে মাটিচাপা দিয়েছেন, নদীতে ফেলে দিয়েছেন, শহরের বিভিন্ন স্থানে মাটিচাপা দিয়েছেন। ফরিদপুরে দুটি গণহত্যার সঙ্গে আবুল কালাম আজাদ সরাসরি জড়িত।
বাচ্চু রাজাকারের বিষয়ে তদন্ত সম্পন্ন শেষে তদন্ত সংস্থা গত ২৬ জুলাই প্রসিকিউশনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রসিকিউশন এ তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ফরমাল চার্জ তৈরি করে গতকাল তা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে দাখিল করে।
তদন্ত সংস্থার আবেদনে ট্রাইব্যুনাল-২ মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে গত ৩ এপ্রিল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তদন্ত সংস্থার দাবি, বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে নেপাল হয়ে পাকিস্তানে যান। সেখানে তিনি অবস্থান করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুর সদর, নগরকান্দা, বোয়ালমারী ও সালথা থানা এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গেও ফরিদপুরে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ অপরাধ কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন।
No comments