বুয়েটে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও ছাত্রলীগ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর এবার চড়াও হয়েছেন সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। গতকাল রোববার বুয়েট ক্যাম্পাসে তাঁরা আন্দোলনকারীদের মাইক কেড়ে নেওয়া এবং প্রশাসনিক ভবনের দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন।


এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের দেখে নেওয়ার হুমকিও দেন তাঁরা।
পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানতে শিক্ষকেরা গতকাল উপাচার্যের কার্যালয়ে দিনভর অবস্থান করেন। তবে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য কার্যালয়ে ছিলেন না। উপাচার্য গতকাল নিজ কার্যালয়েই যাননি। সহ-উপাচার্য সকালে গেলেও বেশিক্ষণ কর্মস্থলে ছিলেন না। শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী এ দুজনের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন। এর পাশাপাশি বিক্ষোভ ও সমাবেশ হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আজ সোমবার বেলা ১১টা পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল দুপুর থেকে শিক্ষকেরা সেখানেই অবস্থান করছেন এবং রাত সাড়ে নয়টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই ছিলেন। বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন নেতা রাতে ক্যাম্পাসে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
বেঁধে দেওয়া সময়ে গতকাল রোববার সকাল ১০টার মধ্যে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য পদত্যাগ না করায় নতুন কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে।
সন্ধ্যায় পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। তাই সরকার না বললে পদত্যাগ করব না।’
এর আগে সকালে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য পদত্যাগ না করায় পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালনের জন্য বুয়েট ক্যাম্পাসে জড়ো হন বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। বেলা সোয়া ১১টার দিকে পুরকৌশল ভবনের সামনে থেকে তাঁরা মানববন্ধন শুরু করেন। এ সময় উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
বেলা সাড়ে ১১টায় আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে যান। এ সময় পুলিশ মিছিলটি থামিয়ে দেয়। রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম আদালতের নির্দেশনা দেখিয়ে বলেন, মিছিল করা যাবে না। তা হলে আদালত অবমাননা হবে। এ সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও পাল্টা যুক্তি দেন। পরে আবার মিছিল শুরু হয়।
জানতে চাইলে রমনা বিভাগের পুলিশের সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাধা দিচ্ছি না। হাইকোর্টের নির্দেশনার কথা জানাচ্ছি।’
এর পর মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে আবারও প্রশাসনিক ভবনের সামনে যায়। সেখানেই আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেন। এ সময় পদত্যাগের ব্যাপারে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের সিদ্ধান্ত জানতে শিক্ষকেরা তাঁদের কার্যালয়ে যান। কিন্তু তাঁদের না পেয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ে অবস্থান করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগ দেন।
আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের কার্যালয়ে থাকা বিদায়ী উপাচার্যদের টানানো ছবির পাশে বর্তমান উপাচার্যের একটি আঁকা ছবি টানিয়ে দেন। তাতে যোগদান ও মেয়াদ শেষের তারিখ লিখে রাখেন। মেয়াদ শেষের তারিখ লেখা হয় ২ সেপ্টেম্বর। ছবিতে আরও লেখা হয় ‘কালো অধ্যায়’।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই দুজনকে সরিয়ে দিয়ে বুয়েটের পরিস্থিতি দ্রুত সমাধান করতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
চড়াও ছাত্রলীগ: দুপুর ১২টার দিকে বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সামনে থেকে অবিলম্বে ক্লাস শুরুর দাবিতে ছাত্রলীগের ব্যানারে একটি মিছিল বের হয়। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি। উল্লেখ্য, শিক্ষকেরা কয়েক দিন ধরে কালো গেঞ্জি পরে কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
ছাত্রলীগের মিছিলটি প্রশাসনিক ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে অবস্থানরত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের কথা-কাটাকাটি হয়। তবে তখন শিক্ষকদের হস্তক্ষেপে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। পরে ব্যানার রেখে এসে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী মারমুখী হয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে মহড়া দিতে থাকেন। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রশাসনিক ভবনের দোতলায় উঠতে যান, যেখানে আগে থেকেই আন্দোলনকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনেকেই অবস্থান করছিলেন। এ সময় আন্দোলনকারীরা প্রবেশপথের দরজা বন্ধ করে দিলে ছাত্রলীগের কর্মীরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন। তাঁরা ইট দিয়ে দরজায় আঘাত করা ছাড়াও উপর্যুপরি লাথি মারেন। কিন্তু ভেতর থেকে শিক্ষার্থীরা দরজা আটকে রাখেন। এ সময় পুলিশও সেখানে যায়। ওপরে উঠতে না পেরে ছাত্রলীগের কর্মীরা নিচে এসে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে করে হুমকি দিতে থাকেন। তাঁরা অশ্লীল শব্দও ব্যবহার করেন। এ সময় শিক্ষকেরা তাঁদের শান্ত হতে বলেন। কিন্তু উত্তেজিত অবস্থায় তাঁরা কাউন্সিল ভবনের সামনে এক শিক্ষকের সামনে থেকে আন্দোলনকারীদের মাইক কেড়ে নেন এবং মাইক ব্যবহার করা রিকশাওয়ালাকে তাড়িয়ে দেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থীকে ঘুষি মেরেছে। উল্লেখ্য, বুয়েটে ছাত্রলীগের কমিটি নেই।
ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর চড়াও হওয়ার এ ঘটনায় ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বহিরাগত। তাঁদের কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ থেকে আসা। এই অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ হুমকি-ধমকি দিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চলে যান।
পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও বিকেলে সংবাদ ব্রিফিং করে আজ বেলা ১১টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাঁরা অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগ বহিরাগতদের নিয়ে তাঁদের ওপর চড়াও হয়েছে।
বুয়েটের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হবে। আমরা ইতিবাচক সমাধানের চেষ্টা করছি।’

No comments

Powered by Blogger.