বিতর্ক ॥ বাঙালীরা আদিবাসী কেন! by গৌরব জি পাথাং
গত ২৬ আগস্ট জনকণ্ঠ পত্রিকায় মোস্তাফা জব্বারের ‘বাঙালীরাই বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ অন্যরা উপজাতি’ কলামটি পড়ে মনে হলো এ লেখার পেছনে একটা স্বার্থ লুকিয়ে আছে। যে স্বার্থ আদিবাসী শব্দটিকে বাদ দেবার স্বার্থ। কোনদিন কোন বাঙালীকে নিজেকে আদিবাসী বলে পরিচয় দিতে শুনিনি।
কোনদিন কোন বাঙালীকে আদিবাসী বলে পরিচয় দিয়ে গর্ব করতে দেখিনি। তাহলে তিনি কেন বাঙালীকে আদিবাসী বলে জাহির করতে চান এবং অন্যদের উপজাতি বলতে চান। আসলে তিনি মন থেকে নিজেকে বাঙালী বলতে চান না কিন্তু স্বার্থের কারণেই লেখা। একদিন এমন হবে যে, আদিবাসী শব্দটি নিয়ে বাঙালী ও আদিবাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধবে এবং এ শব্দটিই বিলুপ্ত হবে নতুবা ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে। তিনি তাঁর লেখায় উপজাতি শব্দটি ব্যবহার করে অন্যদের অবমাননা ও অপমান করেছেন। উপজাতি মানে কি? উপজাতি বলতে জাতি থেকে ছোট এমন একটি শ্রেণীকে বোঝায়। উপজাতি বলতে এমন একটি শ্রেণীকে বোঝায় যার কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নেই। তার অর্থ এ হতে পারে, বাঙালী একটি জাতি আর অন্যরা উপজাতি। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। প্রত্যেকেই জাতি কিন্তু তুলনায় অন্য থেকে ক্ষুদ্র জাতি। আমরা জাতি-উপজাতি বললেই সবার চোখে এ রকম ভেদাভেদ দেখি। যেমন জেলা ও উপজেলার মধ্যে সম্পর্ক, অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের মধ্যে সম্পর্ক, আচার্য ও উপাচার্যের সম্পর্ক তেমনি জাতি ও উপজাতির মধ্যে সম্পর্ক ফুটে ওঠে। সেই অনুসারে উপজাতি বলতে প্রধান জাতির অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র জাতিকে নির্দেশ করে। বাংলা অভিধানও তাই বলে। কিন্তু আদিবাসীরা তো প্রধান জাতির অন্তর্ভুক্ত কোন জাতি নয়। তাহলে কেন তিনি উপজাতি বলছেন? এ লেখা কি তাহলে সরকারকে সমর্থন করে লেখা?
আদিবাসী শব্দটির ইংরেজী শব্দ হলো ওহফরমবহড়ঁং চবড়ঢ়ষব. এই ওহফরমবহড়ঁং শব্দটি এসেছে ফরাসী শব্দ ওহফরমবহধ থেকে; যার অর্থ দেশজ, স্বদেশজাত বা ভূমিজ সন্তান। বাংলায় আদিবাসী শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো আদিকালের অধিবাসী, যারা নির্দিষ্ট অঞ্চলে বহিস্থ জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বেই বসবাস করে এসেছে। বাংলাদেশে আদিবাসী শব্দটি নিয়ে অনেকের অনেক মতামত রয়েছে। আদিবাসী প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতিসংঘের সংজ্ঞাটি হলো “কোন ভূখ-ে কাদের পূর্বপুরুষ প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল সেটা মুখ্য বিষয় নয়, বরং যে সব জনগোষ্ঠী তথাকথিত সভ্যতার শিকার হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছে, যাদের এখনও নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতি ধরে রাখার প্রজেষ্টা অব্যাহত রয়েছে তারাই আদিবাসী।” আদিবাসী কোন পরিচয়হীন জনগোষ্ঠী নয় যে তাকে আইন করে সরকারের নতুন নাম দিতে হবে কিংবা নতুন পরিচয় তুলে ধরতে হবে। জানি নাÑতবে কেন আদিবাসীদের জন্য আরেকটি নাম, আরেকটি পরিচয় আইন করে দেয়া হলো। কেন আদিবাসী পরিচয় মুছে দিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিচয়ের লেভেল গায়ে লাগিয়ে দিল। তার মানে আদিবাসীদের কি নিজস্ব পরিচয় ছিল না কিংবা নাম ছিল না, যার কারণে নতুন নাম দিয়ে দিতে হলো? কিন্তু তা নয়। বরং তাদের নিজস্ব কৃষ্টি,সংস্কৃতি,ঐতিহ্য ও ইতিহাস আছে, আছে নিজস্ব পরিচয় পরিচিতি। তবে কেন নতুন নাম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী দিল?
ধরুন, একজন বাঙালী এবং নাম রহিম। কিন্তু তাকে আইন করে জুয়াং নাম দিয়ে দেয়া হল। এ নাম তার কি ভাল লাগবে? তেমনি আমরাও আদিবাসী বলে পরিচয় দিতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি অন্য কোন পরিচয় দিতে ততটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না।
গতবছর দেশের সংবিধান পরিবর্তন হলেও আদিবাসীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। দেশের সকল আদিবাসী কত আশায় বুক বেধেছিল, কত প্রতীক্ষায় ছিল। তাদের আশা ছিল গতবছর সরকার আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু সাংবিধানিক স্বীকৃতি তো হলোই না বরং আদিবাসীদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হল। গতবছরের মে মাসে জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ইকবাল আহমদ বলেই দিলেন, ‘বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই।’ তার কিছুদিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপুমণিও একই সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। অথচ যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে আদিবাসী বসবাস করে আসছে, তাদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে আসছে। আদিবাসী যে আছে তার সাক্ষ্য দিচ্ছে ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭৪ সালে ভারতীয় আইন ‘তফসিলভুক্ত জেলা আইন ১৮৭৪’ পাস করে। এ আইনে ব্রিটিশ সরকার তাদের আগমনের পূর্ববর্তী কাল থেকে নানা অঞ্চলে বসবাসরত লোকদের ওহফরমবহড়ঁং চবড়ঢ়ষব বা আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে। পাকিস্তান শাসনামলে প্রণীত ‘জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০’-এর ৯৭ ধারায় আদিবাসী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ ধারায় ‘আদিবাসী কর্তৃক জমি হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ’ সম্পর্কে বলা হয় ‘সরকার সময় সময় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা করতে পারে যে, এ ধারার বিধান কোন জেলা বা স্থানীয় এলাকার নিম্নোক্ত আদিবাসী সমাজ বা গোত্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এবং এরূপ সমাজ ও গোত্র ধারার উদ্দেশ্যে আদিবাসী বলে গণ্য হবে।’ এ ধারায় সাঁওতাল, হাজং, গারো, কোচ প্রভৃতিকে আদিবাসী বলে উল্লেখ করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাংবিধানিকভাবে আদিবাসীদের স্বীকৃতি না দিলেও আদিবাসীদের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। তাই আদিবাসীদের ‘জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ ‘সংবিধান’ ‘প্রচলিত আইন’ হিসেবে স্বীকৃত হয়।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে দেশের নেতা-নেতৃগণ আদিবাসী দিবসের বাণীতে, বক্তব্যে ও নির্বাচনের ইশতেহারে আদিবাসীদের কথা উল্লেখ করেছেন। ২০০০ সালে শেখ হাসিনা আদিবাসী ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটির কাছে বাণী প্রেরণ করেছেন। সে বাণীতে তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশে ২০ লাখ আদিবাসীসহ বিশ্বের ৩০ কোটি আদিবাসী জনগণকে এ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।” ২০০২ সালে বেগম খালেদা জিয়া আদিবাসী দিবসের বাণীতে লিখেছেন, “আমাদের জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ আদিবাসী।” ২০০১ সালে জাতীয় পার্টির নির্বাচনের ইশতেহারে ছিল “আদিবাসী জনগণের স্বার্থসংরক্ষণ করা হবে।” আর ২০১১ সালের সংস্করণে দ্বিতীয় শ্রেণীর বাংলা পুস্তকেও আদিবাসীদের উল্লেখ ছিল। সেখানে আদিবাসীদের বর্ণনা ও উদাহরণ দিতে গিয়ে গারো ও চাকমার উল্লেখ করেছে। এ ছাড়াও বলতে পারি যে, আদিবাসীদের অস্তিত্ব আছে বলেই তো আদিবাসী ফোরামের জন্ম হয়েছে এবং আদিবাসীদের উন্নয়নের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং ‘বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই’ কথাটি একেবারেই অযৌক্তিক ও ভ্রান্তিকর। বরং বাংলাদেশে আদিবাসীদের স্বীকৃতি নেই কথাটি বলাটাই সঠিক ও ন্যায্য।
আপনারা কি কখনও পড়েননি যে, অস্তিত্বের যন্ত্রণাই অস্তিত্বকে ঘোষণা করে? আমরা এই যে যুগ যুগ ধরে অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করছি, টিকে থাকার জন্য লড়াই করছি, তা কি চোখে পড়ে না? বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায় আমরা বেঁচে আছি। যেখানে সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই, অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই সেখানে তো নাগরিকের অধিকার ও মানবিক মর্যাদা কোন কিছুই থাকে না। তাই মানুষের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য সর্বপ্রথম দরকার হয় স্বীকৃতির। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদিবাসীদের প্রকৃত পরিচয় দান করবে, তার অস্তিত্ব, কৃষ্টি, সংস্কৃতি চর্চা করার সুযোগ পাবে। অন্যথায় বিলুপ্তির পথে অন্ধকারে হারিয়ে যাবার দিন ঘনিয়ে আসবে।
সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও অস্তিত্বের লড়াইয়ে আজ কত প্রাণ হলো বলিদান। কল্পনা চাকমা, আলফ্রেড সরেন, পিরেন স্নাল, গিদিতা রেমা, চলেশ রিছিল তাদের মতো কত অসহায় মানুষ অজান্তে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। জানি না আর কত রক্ত দিলে, কতটুকু পথ পেরুলে, কত জীবন বলিকৃত হলে সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিলবে?
দেখতে দেখতে ১ম আন্তর্জাতিক আদিবাসী (১৯৯৫-২০০৪) দশক পেরিয়ে গেল। বলতে গেলে এ দশকের মধ্যে রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে কথার ফুলঝুড়ি ছাড়া কিছুই পাইনি। ১ম দশক পেরিয়ে আজ ২য় দশকের (২০০৫-২০১৪) কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। কিন্তু এত বছর পেরিয়ে গেলেও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি। আমরা যেন মহাস্রোত থেকে হারিয়ে পৃথক হয়ে যাচ্ছি। আসলে ওরাই আমাদের পৃথক করে রাখছে। তাই প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, “ওদের পৃথিবী আমাদের পৃথিবী আলাদা। যোগাযোগের কোন সংবাহন বিন্দু গড়ে উঠল না। এই যে এত কিছু করা হয়নি আজও, এর ফলে কি আশা করে মূল স্রোত? উপেক্ষা করেই চলবে এবং উপেক্ষিতরা তা মেনে চলবেন নীরবে? মূল স্রোতকে ভাবতে হবে।” আজ দিন এসেছে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেবার এবং তাদের মঙ্গল করবার।
gourobcsc@gmail.com
No comments